এক.
লেখা ও পড়া পরস্পর ঘনিষ্ট শব্দ। যারা লেখেন তারা হঠাৎ করে লিখতে শুরু করেননি, লেখা শুরুর আগে তাদের পড়ার অভিজ্ঞতা রয়েছে। প্রথমে তারা প্রচুর পড়েছেন, পড়তে পড়তে একসময় তাদের লেখার আগ্রহ জন্মেছে ও লিখতে শুরু করেছেন। তারপর লিখতে লিখতে লেখকে পরিণত হয়েছেন।
অনেক সফল লেখকের জীবনেই এমনটা ঘটেছে। জনপ্রিয় লেখক হুমায়ূন আহমেদের লেখালেখি শুরু হয়েছিল স্কুল ম্যাগাজিনে লেখা প্রকাশের মাধ্যমে। তিনি তার একটি লেখায় উল্লেখ করেছেন, ‘পড়তে পড়তে হঠাৎ করে মনে হলো যে লিখি।’
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় চাকরি সূত্রে ১৪ বছর কাটিয়েছেন বার্মার রেঙ্গুনে। তিনি তখন প্রচুর পড়াশোনা করতেন। অবসরের বেশিরভাগ সময় কাটতো তার বানার্ট ফ্রি লাইব্রেরিতে। একবন্ধুকে তিনি চিঠিতে লিখেছিলেন—‘আমি প্রতিদিন দুই ঘণ্টার বেশি কিছুতেই লিখি না। বাকি সময়ের বেশিরভাগটুকুই পড়াশোনা। বেশি লিখতে গেলে পড়াশোনা বন্ধ করতে হয়—সেটা আমার মৃত্যু না হলে পারবো না।’ তাই বলে বিষয়টি এমনও নয় যে, পড়তে পড়তে যে কেউ চাইলেই লেখক হতে পারবেন। লেখকের মাঝে সৃষ্টিশীলতার যে বৈশিষ্ট্য থাকে, তা সবার থাকে না। একারণেই সব লেখক পাঠক হলেও সব পাঠক কিন্তু লেখক নয়।
অবাক ব্যাপার, বাংলা অ্যাকাডেমির বইমেলায় যেখানে উপচেপড়া ভিড় হয়, সেখানে ধানমন্ডির এই মেলায় কোনো ক্রেতা ছিল না। ফলে প্রকাশকদের লোকসান গুনতে হয়েছিল।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তখনো লেখালেখিতে হাত দেননি। পড়াশুনা শেষে বেশ কয়েক বছর বেকার ছিলেন। এই সময়টাতে তিনি প্রচুর পড়েছেন। কলকাতার ব্রহ্ম সমাজ মন্দিরের লাইব্রেরিতে তিনি প্রথম পাঠ করেন ভাই গিরিশচন্দ্র সেন অনূদিত কোরআন শরিফ। সঙ্গে ইসলাম ধর্মের ওপরে বিভিন্ন বই। সুনীল বলেন, ‘ব্রহ্ম সমাজের গ্রন্থাগারে আমি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের আত্মজীবনী পড়ি, তখন বইটি দুর্লভ ছিল। রামমোহন রায়ের জীবনী, রাজনারায়ণ বসু ও শিবনাথ শাস্ত্রীর আত্মজীবনী, কেশবচন্দ্র সেনের রচনাবলী পড়তে পড়তে আমি যেন ফিরে যাই উনিশ শতকের গৌরবময় দিনগুলোতে। ওইসব মানুষদের দেখতে পাই স্বচক্ষে, একা একা রোমাঞ্চিত হই, সেই নির্জন লাইব্রেরি ঘরে শুনতে পাই ব্রহ্ম সমাজের তরুণ সম্পাদক রবীন্দ্রনাথের কণ্ঠস্বর।’ এই পড়াশোনা সুনীলের পরবর্তী জীবনে সফল লেখক হতে অনেক কাজে এসেছে।
কথা হলো, মানুষ কেন পড়ে? এই নিয়ে নানান মত আছে। তবে সবচেয়ে পুরনো এবং বহুল ব্যবহৃত ধারণাটি হলো—মানুষ জ্ঞান অর্জনের জন্য পড়ে। আরও সোজা কথায় জানার জন্য পড়া। কোনো একটি সিনেমা যখন কেউ বারবার দেখেন বা কোনো বই যখন বারবার পড়েন, সেটি নিশ্চয়ই জ্ঞান অর্জনের জন্য নয়, বরং ভালোলাগার বিষয়টি এখানে সক্রিয় থাকে। কেউ নোট বই, গাইড বা পাঠ্য বই পড়েন, কেউবা পত্রিকা-ম্যাগাজিন পড়েন। আবার কেউ গল্প-উপন্যাস পড়েন—সবই তো পড়া। তবে একেক জন একেক উদ্দেশ্য নিয়ে পড়েন। পড়ার জন্য প্রয়োজন হয় বইয়ের। কেবল ধার করে বা লাইব্রেরির আশ্রয় নিয়ে সব বইয়ের চাহিদা মেটানো পড়া সম্ভব হয় না। এজন্যই বই কিনতে হয়।
প্রচলিত আছে যে, ধনীরা মানে বেশি টাকাঅলারা নাকি বই কমই কেনেন, কিনলেও পড়ার জন্য নয়—শোকেসে সাজিয়ে রাখার জন্য। বরং সীমিত আয়ের মানুষেরা নাকি বেশি বই কেনেন ও তারাই বেশি বই পড়েন।
১৯৮৯ সালে ধানমন্ডির কলাবাগান মাঠে সপ্তাহব্যাপী বই মেলার অয়োজন করেছিল পুস্তক প্রকাশক সমিতি। মনে পড়ে, ওই মেলায় আমিও দুই দিন গিয়েছিলাম। অবাক ব্যাপার, বাংলা অ্যাকাডেমির বইমেলায় যেখানে উপচেপড়া ভিড় হয়, সেখানে ধানমন্ডির এই মেলায় কোনো ক্রেতা ছিল না। ফলে প্রকাশকদের লোকসান গুনতে হয়েছিল। কেন এমন হলো, সে সম্পর্কে আহমদ ছফা তার ‘বাংলাদেশের উচ্চবিত্ত শ্রেণি এবং সমাজ বিপ্লব প্রসঙ্গ’ (পুস্তক: রাজনীতির লেখা) নিবন্ধে লিখেছেন,‘প্রকাশকরা আমাকে জানালেন, বই বিক্রির পরিমাণ কোনোদিনই পাঁচশো টাকার ওপরে যায়নি। ধানমন্ডি ঢাকা শহরে দুই-তিনটি ধনী এলাকার একটি। লেখাপড়ায় জ্ঞানে-বুদ্ধিতে অর্থসামর্থ্যে একমাত্র গুলশান-বনানী এলাকার বাসিন্দারাই ধানমন্ডির পাল্লা দিতে পারেন। এই রকম একটি ধনী এলাকায় সাত-আট দিন বইমেলা চলার পরও বিক্রির যা পরিমাণ দাঁড়ালো, সচরাচর একটি থানার বই মেলাতেও তার চাইতে বেশি টাকার বই বিক্রি হয়ে থাকে। পেছনের কারণ কী? প্রকাশকরা এক বাক্যে জানালেন, ধানমন্ডির লোকেরা বই পড়ে না, পড়লেও বাংলা বই পড়েন না। বাংলাদেশে বসবাস করে অথচ বাংলা ভাষার বইপত্র পাঠ করে না, এ কেমন কথা! বিষয়টি আমাকে ভাবিয়ে তোলে। বাংলা ভাষার বইপত্র পড়ে না মানে তো বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গে সম্পর্ক অস্বীকার করা।’
সান্ত্বনা এটি, রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন—‘আগে বাংলা ভাষায় পড়তে হবে। বাংলা পড়তে হবে। বাংলায় লিখতে হবে। পরে অন্যকিছু।’
যারা নিয়মিত বই কেনেন, তাদের জন্য বই একটি বোঝাও বটে, বিশেষ এই নগরীতে যারা ভাড়াটে শ্রেণীর, ভাসমান জীবনযাপন করেন। আজ এ বাসা তো কাল আরেক বাসা। আসবাবপত্রের মতো বই টানাহেঁচড়াও কম ঝামেলার নয়। বছর পনেরো-ষোলো আগের ঘটনা। এক বাসা ছেড়ে আরেক বাসায় উঠবো। আসবাবপত্র তেমন নেই। রিকশাভ্যানে করে ৭-৮টি কার্টন নিয়ে নতুন বাসার গেটে হাজির। এমন সময় বাড়িঅলা জানতে চান, এতগুলো কার্টনে করে কী এনেছেন?
: বললাম বই।
: আপনি বুঝি বইয়ের ব্যবসা করেন?
: না, পড়ি।
: ও। এখনো চালিয়ে যাচ্ছেন। আপনার দেখি অনেক ধৈর্য, এ বয়সেও। কোন কলেজে?
বাড়িঅলা গড়গড় করে বলেই যাচ্ছেন। তার ধারণা—আমি এখনো স্টুডেন্ট। কথা না বাড়িয়ে পাশ কাটিয়ে গেলাম। বই নিয়ে এরকম অভিজ্ঞতা কমবেশি অনেকেরই আছে। শুধু কি তাই! ভাড়া বাড়িতে বই রাখার জায়গারও সংকট থাকে। বই রাখা নিয়ে একবার বিপদে পড়েছিলেন আলাউদ্দিন আল আজাদ। সেকথা তার এক লেখায় তিনি উল্লেখ করেছেন—‘মস্কো দূতাবাস থেকে বদলি হয়ে দেশে আসার সময় আসবাবপত্র, সাংসারিক দ্রব্যাদির সঙ্গে ওয়াগন আকৃতির একটা লিফট ভ্যানে করে কয়েক কার্টন দুষ্প্রাপ্য ও দামি দামি বইও এনেছিলাম। জায়গার অভাবে লালমাটিয়া কলেজের কাছে এক আত্মীয়ার নিচতলার করিডোরে রাখি। কার্টনগুলো বড় বড়, দেখতে ভালো। সাজানো ছিল। টিপ টিপ বৃষ্টির মধ্যে অমাবস্যার গভীর রাতে একদল চোর এসে ঢোকে, কালো মুখোশ পরা। নাইটগার্ড নিরাপদ দূরত্ব থেকে ভেতর দোরের ছিদ্রপথে সবকাণ্ড দেখছিল। ষণ্ডা মতো যেটা একটা একটা করে কার্টন খোলে। দেখা শেষ করে ঝট করে দাঁড়ালো এবং চরম বিরক্তি ও রাগতস্বরে সঙ্গীদের বললো, দুশশালা, বোধহয় পরফেসার। কিছছুই নাই, খালি বই! কার্টনগুলোকে লাত্থি মেরে মেরে ওরা বেরিয়ে গেলো।’
আমার বন্ধু কবি কমল মোমিন পঁচিশ বছর ক্যান্সারের সঙ্গে লড়াই করে সম্প্রতি মারা গেছেন। গত আড়াই দশকে চিকিৎসার জন্য তাকে বারবার কলকাতা যেতে হয়েছে। চিকিৎসা শেষে ফেরার পথে প্রচুর বই নিয়ে আসতেন। শেষের দিকে জীবনী পড়ার প্রতি ঝোঁক বেড়ে গিয়েছিল। লেখালেখির চেয়ে পড়ার পেছনেই বেশি সময় ব্যয় করতেন। বিখ্যাত ব্যক্তিদের বই পড়া নিয়ে কমল মোমিন বেশকিছু নিবন্ধও লিখেছেন, তার বইয়ে সেগুলো স্থান পেয়েছে। এই লেখায় কমলের বই থেকেও কয়েকটি উদ্ধৃতি ধার করেছি। বই পড়া নিয়ে আমার এই কবি বন্ধু লিখেছেন, ‘আমার খুব লিখতে ইচ্ছে করে। আমার খুব পড়তে ইচ্ছে করে। পড়তে গিয়ে লেখার উৎসাহ কমে যায়। কলম ধরতে সাহস হয় না। মনে হয় আমার চেয়ে অন্যরা ভালো লেখেন। অনেক ভালো ভালো বিষয় তারা লিখে ফেলেছেন। পড়তে গিয়ে বিন্দুর মধ্যে আটকে থাকি। এত অজস্র বই, তার কয়টি পড়তে পেরেছি? বাংলা ভাষা ছাড়া যে আর কিছুই জানি না। সান্ত্বনা এটি, রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন—‘আগে বাংলা ভাষায় পড়তে হবে। বাংলা পড়তে হবে। বাংলায় লিখতে হবে। পরে অন্যকিছু।’
(চলবে)