দশ
মাসখানেকের মধ্যেই বাঘা যতীন বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন উপাচার্য হিসেবে প্রফেসর ড. সাদিক আহসান যোগ দিলেন। সবার মনে একটাই আশঙ্কা নতুন ভিসি কেমন হবেন! আগের ভিসির মতোই হবেন কি না! সবার ভেতরেই একটা ভয়, একটা দুশ্চিন্তা কাজ করছে। সবচেয়ে বেশি ভয় কাজ করছে ড. ফারজানার ভেতর, আব্দুল করিমের সঙ্গে তার একটা দূরত্ব যে তৈরি হয়ে যাচ্ছে; ড. এলিনা রহমান যে এটা করাচ্ছেন, তা তিনি ভালোভাবেই বুঝতে পারছেন। আব্দুল করিমের রুমে এখন তিনি বসারই সুযোগ পান না। ড. এলিনা রহমান সারাক্ষণ থাকেন। আগের মতো তার কাছে যে গুরুত্বও নেই; তাও অনুধাবন করেন। এত দ্রুত একজন মানুষ যে পরিবর্তন হয়ে যেতে পারে, আব্দুল করিমের সঙ্গে সম্পর্কটা না হলে বোধ হয় তিনি বুঝতে পারতেন না। যে কারণে নতুন উপাচার্যকে নিয়ে তার চিন্তা ও ভয় সবচেয়ে বেশি। ভিসির বয়স যে খুব বেশি, তাও নয়। বায়ান্ন-তিপ্পান্ন বছর কিংবা এর একটু কমবেশি। নায়কসুলভ চেহারা। কথাবার্তায় ব্যক্তিত্বসম্পন্ন। তিনি যে ড. শাহেদ জাহানের মতো হবেন না, তা কিছুটা হলেও অনুমান করেন ড. ফারজানা। ফলে তার রক্তচাপ ক্রমেই বাড়তে থাকে। আব্দুল করিমের সঙ্গে সম্পর্কটা গভীর থাকলে সমস্যা হতো না, কিন্তু ভাটার জলের মতো সম্পর্কটা দ্রুত দূরে সরে যাচ্ছে।
ড. সাদিক আহসানের রুমে এর আগে এক দুবার তিনি সৌজন্যবশত গিয়েছেন। আজ বিভাগের বেশকিছু পরিকল্পনা তৈরি করে নিয়ে গেলেন; একটু বেশি সময় ধরে যেন কথা বলা যায়; মানুষটাকে যেন বোঝা যায়! ড. ফারজানা বললেন, স্যার, আমাদের বাংলা বিভাগে তো কিছু সমস্যা আছে। ছাত্র সংখ্যাও কম। ভালো শিক্ষক নেই। কিভাবে কী করবো; বুঝতে পারছি না!
হ্যাঁ। বাংলা বিভাগ নিয়ে বোর্ডের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। বলেই ইন্টারকমে ফোন করে আব্দুল করিমকে ডাকলেন।
ড. ফারজানা ভাবলেন, এই স্যার আগের ভিসি স্যারের মতো নন। একদমই আলাদা। সিসি স্যার এলে তো আমার আরও সমস্যা!
ড. সাদিক আহসান বললেন, আমি বাংলা বিভাগে গিয়েছিলাম। আপনাকে না জানিয়েই। রেজিস্ট্রার সাহেবকে নিয়ে। আপনি তখন ছিলেন না। পরে নিশ্চয় তা জেনেছেন। বাংলা বিভাগ অন্য বিভাগগুলো থেকে সবকিছুতেই আলাদা। মাইকেল মধুসূদন দত্ত, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, মীর মশাররফ হোসেন, শরৎচন্দ্র, জীবনানন্দ দাশ, জসীম উদ্দীন, সুকান্ত ভট্টাচার্য, শামসুর রাহমান, আল মাহমুদসহ অনেক বিখ্যাত কবি সাহিত্যিক বাংলা সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ। বিভাগে কোথাও তাদের কারও ছবি টানানো নেই। বাংলা ভাষার উৎপত্তি বিষয়ক কোনো নকশা কোথাও দেখলাম না। বিভাগের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য এসবও নেই। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কখন কোন শিক্ষকের কাউন্সিলিং টাইম, সেসবের কোনো রুটিন কোনো শিক্ষকের দরোজাতেই নেই। একজনমাত্র শিক্ষক বিভাগে ছিলেন। আপনার প্রোগ্রাম অফিসার রুম তালাবদ্ধ করে কোথায় গেছেন, কেউ জানেন না। আমি ফার্মেসি বিভাগে মিটিংয়ে গিয়েছিলাম। তো ভাবলাম, মিটিং শুরুর আগেই বাংলা বিভাগটা দেখে যাই। এই হলো আপনার বিভাগের বাস্তবতা। তো বলুন ড. ফারজানা…
ড. ফারজানা বিব্রত অনুভব করলেন। যে সমস্যাগুলো ও পরিকল্পনা লিখে এনেছিলেন, সেগুলো কোনভাবে বললেন। খুব মনোযোগ দিয়ে কথাগুলো শুনছিলেন; এমন সময় রুমে কলা অনুষদের ডিন ড. আব্দুল হামিদ ঢুকলেন। ড. সাদিক আহসান বললেন, আপনি আসাতে খুব ভালো হলো। আমি আপনার কথা ভাবছিলাম। ডিন সাহেব, বাংলা বিভাগের তো অনেক সমস্যা। এ বিষয়ে কথা বলার আগে আপনাকে একটা বিষয় বলে রাখি, তা হলো, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম যেহেতু বাঘা যতীন বিশ্ববিদ্যালয়, সেহেতু নিশ্চয় তার দেশপ্রেম ও বিপ্লবী কর্মকাণ্ড বিবেচনা করেই, তার প্রতি সম্মানপ্রদর্শন পূর্বক নামকরণ করা হয়েছে। বর্তমান প্রজন্ম মহান এই বিপ্লবীকে জানে না। সেকারণে ট্রাস্টি বোর্ডের সঙ্গে আলোচনা করে বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল গেটের পাশে মহান এই বিপ্লবীর একটা ভাস্কর্য স্থাপন করার ব্যবস্থা করতে হবে। তার জন্ম-মৃত্যুবার্ষিকীতে প্রতি বছর আলোচনা সভাসহ বিভিন্ন কর্মকাণ্ড গ্রহণ করার ব্যবস্থা করতে হবে, যেন বর্তমান প্রজন্ম জানতে পারে, বাঘা যতীন কে ছিলেন, কত বড় বিপ্লবী ছিলেন। আপনি অবাক হবেন, আমাদের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও বাঘা যতীনের বিপ্লবী কর্মকাণ্ডকে আলোর সঙ্গে তুলনা করেছেন।
ড. আব্দুল হামিদও খুব খুশি হয়ে বললেন, স্যার আমার নিজেরও বাঘা যতীন বিষয়ে আগ্রহ আছে। আর আমাদের চেয়ারম্যান স্যার তো বিপ্লবীদের বিশেষভাবে সম্মান করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম দেখেই তো তা অনুধাবন করা যায়। চেয়ারম্যান স্যারের সঙ্গে আমি শিগগিরই এ বিষয়ে আলোচনা করে এসব বাস্তবায়নের চেষ্টা করবো। স্যার ব্যবসা-বাণিজ্যের লোক হলেও ব্যাপক পড়াশোনা করেন তিনি। দেশের প্রতি তার যে প্রেম, তা চিন্তাও করা যায় না। কথা বলতে বলতেই ড. ফারজানাকে হুট করে বললেন, আপনি বাঘা যতীন সম্পর্কে জানেন? তিনি কে ছিলেন?
না, স্যার। মুখ নিচু করে উত্তর দিলেন ড. ফারজানা।
ড. সাদিক আহসান বললেন, নেতাজি সুভাষচন্ত্র বসু, বাঘা যতীন, রাসবিহারী বসু, ক্ষুদিরাম, প্রফুল্ল চাকী; এসব বিপ্লবীর সম্পর্কে জানা প্রয়োজন। বাংলার শিক্ষকদের যেমন সাহিত্য-সংস্কৃতি পড়তে হয়, তেমনি ইতিহাস দর্শন এসব পড়াও কিন্তু অপরিহার্য। যা হোক, আমি চেয়ারম্যান স্যারের সঙ্গে বাংলা নিয়ে কথা বলেছি, তিনি তো বাংলা বিভাগের প্রতি খুব একটা খুশি নন বলে মনে হলো।
ড. আব্দুল হামিদ বললেন, স্যার, বাংলাতে কিছু সমস্যা তো আছেই। ছাত্ররা ভর্তি হতে চায় ন। কোনো কোনো সেমিস্টারে নিলও গেছে। আমার অর্থনীতি বিভাগেও কিছু সমস্যা আছে। ইংরেজি বিভাগেও ছাত্রভর্তি কমে যাচ্ছে। বিজনেসও আগের মতো নেই। সবকিছু মিলেই একটা নাজুক অবস্থা বিরাজ করছে। এটাও সত্য।
এ সময় সিসি আব্দুল করিম ঢুকলেন। ড. সাদিক আহসান বললেন, সিসি সাহেব, আপনি তো অনেকদিন এখানে আছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কিছু বিভাগের তো নাজুক অবস্থা। আপনি এসব বিষয়ে বোর্ডকে কখনো জানিয়েছেন?
নতুন ভিসি একদম অন্যরকম একজন মানুষ; কাজ ছাড়া কিছু বোঝেন না। তৈলমর্দন করে শার্টের বোতাম খুলে খালি গায়ে বাতাস লাগিয়ে চলার সময় শেষ হয়ে গেছে।
কখনো কখনো জানিয়েছি। সব নেগেটিভ রিপোর্ট তো স্যার বোর্ডকে দেওয়া যায় না। নেগেটিভ রিপোর্ট দেখলে তারা তো ক্ষেপে যান।
ক্ষেপে যাওয়া তো স্বাভাবিক। আমাদের কাজটা কী? আচ্ছা ড. ফারজানা, আপনিও তো এখানে অনেকদিন আছেন। বিভাগের উন্নতির জন্য কী কী করেছেন, বলেন তো।
ড. ফারজানা একবার আব্দুল করিমের দিকে তাকালেন। তিনি যে সে তাকানোতে কোনো গুরুত্ব দিলেন না, তা ভালোভাবেই অনুধাবন করলেন।
আচ্ছা, মধুসূদন-রবীন্দ্রনাথ-নজরুল-জীবনানন্দ দাশ-জসীম উদ্দ্দীসহ আমাদের যেসব প্রধান কবি সাহিত্যিক আছেন, তাদের নিয়ে আপনি এ পর্যন্ত কয়টা সেমিনার করেছেন? নতুন প্রজন্মের যারা লেখালেখি করছেন, তাদের নিয়েও কোনো কাজ করেছেন কি না!
ড. ফারজানা মাথা নিচু করে থাকলেন।
ড. সাদিক আহসান বললেন, আমাদের যে সব জাতীয় দিবস আছে, সেসব দিবসে কি কোন অনুষ্ঠান করেন?
ড. আব্দুল হামিদ বললেন, স্যার, সব দিবসে করা হয় না। কিছু দিবসে করা হয়। তবে কেন্দ্রীয়ভাবে হয়। বাংলা বিভাগ নিজের থেকে কোনো অনুষ্ঠান করেছে বলে আমার জানা নেই।
এখন থেকে সব জাতীয় দিবসে বিশেষ করে বিজয় দিবস, স্বাধীনতা দিবস, ভাষা দিবস, বঙ্গবন্ধুর জন্মদিবস, নববর্ষ; এ ধরনের গুরুত্বপূর্ণ দিবসগুলোতে ব্যাপক আয়োজন করে অনুষ্ঠান করবেন। বাইরে থেকে জাতীয় পর্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের প্রধান অতিথি করবেন। কথা বলতে বলতে প্রোভিসি নাজমুল সৈকতকেও ডাকলেন তিনি। প্রোভিসিকে বললেন, আচ্ছা আমাদের এখানে জাতীয় পর্যায়ের অনুষ্ঠানগুলো কেন হয় না? আন্তর্জাতিক সেমিনার এই বছরে কয়টা করেছেন?
স্যার, ডাটা দেখে বলতে হবে। কিছু সেমিনার হয়েছে। তবে যেভাবে হওয়া দরকার, তা হয়তো হয়নি। এটা সত্য।
ড. সাদিক আহসান, বললেন, কয়টা আন্তর্জাতিক সেমিনার হয়েছে; সেটাও ডাটা দেখে বলতে হবে! এখন থেকে একটা পরিকল্পনা তৈরি করেন, সেমিস্টারভিত্তিক। আন্তর্জাতিক ও স্থানীয়ভাবে বিভিন্ন সেমিনার সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিকল্পনাভিত্তিক নিয়মিত করতে হবে। প্রত্যেক ডিপার্টমেন্টের চেয়ারম্যানের কাছ থেকে তাদের নিজস্ব পরিকল্পনা নেন। তারপর তাদের সাথে মিটিং করেন। তিনটা সেমিস্টারের পরিকল্পনা এক সাথে করে এক বছরের পরিকল্পনা আমাকে পনের দিনের মধ্যে দিবেন। প্রোভিসি সাহেব আপনি মিটিংয়ে তা উপস্থাপন করবেন। আর একটা বিষয় প্রত্যেক বিভাগের চেয়ারম্যান ও ফ্যাকাল্টি অফিস সময়ে নিজের বিভাগেই থাকবেন। বিনা কারণে বিভাগের বাইরে যেয়ে যেন সময় নষ্ট না করেন। বিভাগে পড়ালেখা করবেন। গবেষণার কাজ করবেন। স্টুডেন্টদের সাথে নিয়মিত কাউন্সিলিং করবেন। বিভাগে শিক্ষকরা নিজেরা মিটিং করবেন। আলাপ-আলোচনা করবেন। নতুন নতুন পরিকল্পনা তৈরি করবেন। সেগুলো নিয়মিত রেজিস্ট্রার অফিসে পাঠাতে হবে। পনের দিন পর পর এসব বিষয় নিয়ে ভিসি মিটিং হবে। সেই মিটিংয়ে প্রোভিসি, ডিন মহোদয়গণ, রেজিস্ট্রার, সিসি, সব বিভাগের চেয়ারম্যান এবং ডেপুটি রেজিস্টার পর্যায়ের সবাই থাকবেন। আজকেই এই নোটিশ জারি করে দেন। এটা নিয়মিত মিটিং হিসেবে চলবে।
ড. আব্দুল হামিদ বললেন, এটা খুব ভালো সিদ্ধান্ত স্যার।
প্রোভিসি ড. নাজমুল সৈকত বললেন, স্যার, পরিকল্পনা তো অনেক নেওয়া যাবে। কিন্তু বাস্তবায়ন করতে গেলে তো ফান্ডের প্রয়োজন হয়। ফান্ড দেবে কে? বোর্ড তো একটা টাকাও দিতে রাজি হয় না।
কে বলছে আপনাকে বোর্ড টাকা দিতে রাজি হয় না? বোর্ডকে কখনো বুঝিয়েছেন আপনারা কী পরিকল্পনা করেছেন? এটা কিভাবে কার্যকর করবেন? কত টাকা প্রয়োজন? পরিকল্পনাগুলো কার্যকর হলে বিশ্ববিদ্যালয় কতটা লাভবান হবে? এসব না বোঝালে বোর্ড টাকা দেবে কেন? ফান্ড নিয়ে আপনাদের ভাবতে হবে না। এটা বোর্ডের সাথে আমি বুঝবো। কিন্তু তার আগে আমি পরিকল্পনা চাই; এসব পরিকল্পনা কার্যকর করলে আমাদের কী কী ডেভেলপ হবে; একেবারে ছকসহ উল্লেখ করবেন। সাথে কী পরিমাণ ফান্ড প্রয়োজন হতে পারে; তাও দেখাবেন। আমি আপনাদের সবাইকে নিয়ে এই বিশ্ববিদ্যালয়কে দেশের সেরা চার পাঁচটা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে একটা বানাতে চাই, তার জন্য আমাদের নির্দিষ্ট লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য থাকতে হবে। তা না হলে আমরা এটা অর্জন করতে পারবো না।
আপনার সুযোগ্য নেতৃত্বে আমরা আমাদের স্বপ্নকে বাস্তব রূপ দিতে পারবে আশা করিা। প্রোভিসি নাজমুল সৈকত বললেন। কথাটা তার মুখের, অন্তরের নয়।
আমাদের এখানে কোন রিসার্চ হয়?
বিজনেস বিভাগে কিছ কিছু কিছু রিসার্চ হয়। ফার্মেসি ডিপার্টমেন্টও কিছু করে।
অন্য বিভাগগুলো করে না কেন?
কেউই কোনো উত্তর দিলেন না। একটু চুপ হয়েই থাকলেন।
ড. সাদিক আহসান বললেন, প্রত্যেক ডিপার্টমেন্টকে রিসার্চ করতে হবে। রিসার্চ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেভেলপমেন্ট হবে কিভাবে! একটা রিসার্চ সেন্টার চালু করার জন্য সুন্দর একটা প্রস্তাবনা বানান। বোর্ডে আমি সাবমিট করবো। রিসার্চ সেন্টারের অধীনে এসব কর্মকাণ্ড পরিচালিত হবে। আচ্ছা, আমাদের এখান থেকে পিআর রিভিউ জার্নাল কয়টা বের হয়?
প্রোভিসি নাজমুল সৈকত মনে মনে বিরক্তই হচ্ছিলেন। ভাবছিলেন, ব্যাটা, একমাস না যেতেই তাফালিং শুরু করে দিয়েছে! এমন মাইর দেবো, ড. শাহেদ জাহানের মতো কোর্টের বাইরে গিয়ে পড়বে! মনের ক্ষোভ মনেই চেপে স্বাভাবিকভাবে বললেন, স্যার, সত্যি কথা বলতে কি, এখানে এর আগে এভাবে পরিকল্পনামাফিক কোনো কাজ হয়ে ওঠেনি। আশা করছি, এখন থেকে আমরা করতে পারবো।
ড. ফারজানা, আপনি তো জার্নাল করতে পারেন। আপনি তো লেখালেখি করেন। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে আপনার যোগাযোগও ভালো। আপনি ছয় মাসের মধ্যে একটা পিআর রিভিউ জার্নাল করে আমাকে দেখাবেন। এটার জন্য আইএসএসএন নম্বর নিতে হয়। এসব জানেন তো!
ড. ফারজানা মাথার ভেতর কি ঢুকলো না ঢুকলো, বুঝলো কি না-বুঝলো না, বললেন, জি স্যার।
আব্দুল করিম বললেন, বাংলা বিভাগে অনেক কাজ করতে হবে স্যার। এটা সবচেয়ে বেশি লোকসানের ডিপার্টমেন্ট। এতদিন জোড়াতালি দিয়ে ডিপার্টমেন্ট চলে আসছে। এভাবে চালানো যাবে না। বোর্ড তো বাংলা বিভাগকে কোনো গুরুত্বই দিতে চায় না। জার্নাল করলে এর জন্য তো বাজেট লাগবে। চেয়ারম্যান স্যারকে বললেই তো রেগেমেগে আগুন হয়ে যাবেন।
আমি আপনার কাছে তো এ বিষয়ে শুনতে চাইনি। বলেছি বাংলা বিভাগ থেকে জার্নাল করার কথা। এটা করা প্রয়োজন। নিয়মিতভাবে জার্নাল বের করতে হবে। এটা নিয়ে আপনাকে ভাবতে হবে না। আমি নিজে দেখবো। বাংলা বিভাগ আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের অলঙ্কার, এটা গর্ব। এটা আপনাকে বুঝতে হবে। সব ডিপার্টমেন্টকে দিয়ে ব্যবসা হয় না। সংসারে মা যেমন গুরুত্বপূর্ণ, একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য বাংলা বিভাগও ঠিক তেমন। ড. ফারজানা, আপনি জার্নালের প্রথম সংখ্যাটা করবেন ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে। প্রবন্ধগুলো এ বিষয়ের ওপরে লেখা হবে। প্রত্যেকটা সংখ্যা নির্দিষ্ট বিষয় নির্ধারণ করে করবেন।
ড. ফারজানার সামনে ভিসির কাছে আব্দুল করিম এরকম পরিস্থিতির শিকার হবেন, চিন্তাও করেননি। মনে মনে বিব্রতবোধ করলেন। তারপরও স্বাভাবিককণ্ঠে তিনি বললেন, এটা হলে তো ভালো স্যার। আমি একটা প্রস্তাব দিই স্যার, বাংলা বিভাগে তো শিক্ষক কম। ড. ফারজানাসহ মোট তিনজন। ড. এলিনা রহমান নামে একজন আছেন; ইংরেজি বিভাগে বাংলা জিইডি কোর্স পড়ান। অনেক ট্যালেন্ট স্যার। ড. ফারজানা তাকে সাথে নিয়ে একটা কমিটি করে কাজটা করলে ডিপার্টমেন্টের জার্নালসহ অন্যান্য কর্মকাণ্ডও ভালো হবে।
ড. নাজমুল সৈকত সিসিকে খুশি করার জন্য সাথে সাথে বললেন, সিসি সাহেব খুবই ভালো একটা প্রস্তাব দিয়েছেন। ড. এলিনাকে কাজে লাগাতে পারলে ডিপার্টমেন্টটা কিছুটা হলেও উন্নতি করতে পারবে।
ড. আব্দুল হামিদ বললেন, ড. এলিনা তো খণ্ডকালীন শিক্ষক। তাকে ডিপার্টমেন্টের কোনো কমিটিতে রাখা ঠিক হবে না। আমরা তো অতীতে কোনো খণ্ডকালীন শিক্ষককে বিভাগের কমিটিতে রেখেছি বলে মনে পড়ে না। ড. এলিনা যদি ট্যালেন্ট হন, তাকে স্থায়ীভাবে নিয়ে নেন।
খণ্ডকালীন শিক্ষককে কমিটিতে রাখা ঠিক হবে না। প্রয়োজনে তার পরামর্শ নেন, সহযোগিতা নেন। তারপরও আমার কথা হলো, কাজটা হতে হবে। যদি মনে করেন, সেরকম নিবেদিত খণ্ডকালীন শিক্ষক থাকে, তাকে কাজে লাগাবেন।
স্যার, খণ্ডকালীন শিক্ষকের ব্যাপারে অনেক সমস্যা। এ ক্ষেত্রে আত্মীয়করণ বেশি হয়। যে কারণে মেধাবী শিক্ষক এখানে ক্লাস পান না। বাংলাতে যেসব খণ্ডকালীন শিক্ষক আসেন, দুচার জনকে আমি জানি; ড. মিদা নামে একজন আছেন, কিন্ডারগার্টেনেও পড়াতে পারবেন বলে আমার মনে হয় না। কিন্তু তিনি আত্মীয়সুত্রে আছেন। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের যারা এখানে পড়ান, তারা তো এটা নিয়ে ভাবেন না, আসেন; একদিনে দুটোর জায়গায় চারটা ক্লাস নিয়ে চলে যান। এসব তো পড়ানো নয়, ক্ষ্যাপ মারা আর কি! ভদ্রভাবে লুটপাট করা! এসব সমস্যা তো অস্বীকার করার উপায় নেই।
ড. ফারজানা, আপনি এগুলো দেখেন না? আপনি ডিপার্টমেন্টে থাকেন না? আমাদের লক্ষ্য একটাই, বাঘা যতীন বিশ্ববিদ্যালয়কে অনেক ওপরে নিয়ে যাওয়া। তা কিন্তু বাংলাকে বাদ দিয়ে নয়। আমাদের সবাইকে এক হয়ে কাজ করতে হবে। তাহলে অবশ্যই আমরা সফল হবো; আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় সম্মানজনক একটা উন্নত অবস্থানে পৌঁছুতে পারবে।
ড. ফারজানা ভাবেন, সিসি স্যার কিভাবে ড. এলিনার জন্য নির্লজ্জভাবে কথা বলতে পারছেন! এত দ্রুত তিনি কিভাবে নিজের খোলস পরিবর্তন করে ফেললেন! আবার ভাবেন, এ ভিসি স্যার আগের ড. শাহেদ জাহান নন। কাজ পুরোটাই বুঝে নেবেন। সিসি স্যারেরও অত বাহাদুরি থাকবে না। কোনো পূজাতেই কোনো কাজ এখন হবে না। পূজা দিতে গেলেই ছোবলে নীল হয়ে যেতে হবে। নতুন ভিসি একদম অন্যরকম একজন মানুষ; কাজ ছাড়া কিছু বোঝেন না। তৈলমর্দন করে শার্টের বোতাম খুলে খালি গায়ে বাতাস লাগিয়ে চলার সময় শেষ হয়ে গেছে।
আমার লক্ষে আমাকে পৌঁছাতেই হবে। একটা আদর্শ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে এটাকে দাঁড় না করানো পর্যন্ত শান্তিতে আমার ঘুম হবে না। একবছর, দুবছর তিন বছর তার বেশি আর কত!
ড. সাদিক আহসান বললেন, আপনাদের সবার জন্য একটা কথা বলি, আপনারা এখানে যারা আছেন; সবাই আমার আগে থেকেই আছেন; আপনারা আগে এই প্রতিষ্ঠানকে কিভাবে দেখেছেন, আমি জানি না। এখন থেকে এটাকে চাকরি ভাববেন না। এটাকে নিজের প্রতিষ্ঠান ভাববেন। মনে করবেন এটা আপনার নিজের মেহনত করে তৈরি করা প্রতিষ্ঠান। আমরা সবাই যদি তা মনে করি, সেভাবে প্রতিষ্ঠানকে গ্রহণ করি, তাহলে এই বিশ্ববিদ্যালয় দেশের সেরা দুচারটে বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে একটা হতে খুব বেশি সময় নেবে না। এতে আপনাদের সম্মান বাড়বে, অর্থনৈতিক সুবিধা বাড়বে। সামাজিক মর্যাদা বাড়বে। আমি সবসময় বিশ্বাস করি, আপনি যে প্রতিষ্ঠানেই থাকুন, সেই প্রতিষ্ঠান যদি আপনাকে স্যালুট না করে, আপনি কোথাও স্যালুট পাবেন না। কেউ আপনাকে সম্মান করবে না।
আপনারা কি আমার এ কথা মানেন?
সবাই মাথা নেড়ে সম্মতি জানালেন।
ড. সাদিক আহসান বললেন, আচ্ছা, প্রোভিসি সাহেব, আপনাকে এখন যদি নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয় প্রোভিসি হিসেবে প্রস্তাব দেয়, তাদের সুযোগ-সুবিধা আমাদের থেকে অনেক বেশি, প্রাতিষ্ঠানিক ও সামাজিক সম্মানও অনেক বেশি; আপনি এই প্রস্তাব পেয়ে কি এখানে থাকবেন? কোনো সংকোচ না করে বলুন তো!
ড. নাজমুল সৈকত বললেন, স্যার, নর্থসাউথ থেকে প্রস্তাব পেলে এখানে থাকার তো প্রশ্নই ওঠে না।
কিন্তু আমি আপনাকে বলতে চাই; আপনি নিজে এটাকে নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয় মানের একটা বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি করেন। তারা যদি পারেন, আমি আপনি-আমরা সবাই মিলে কেন পারবো না? আমাদের ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান ভালো মানুষ। সদস্যরা ভালো মানুষ। তারা তো আমাদের সবসময় বলছেন, আপনারা এটাকে আরও ডেভেলপ করে আপনাদের সুযোগ সুবিধা বাড়িয়ে নেন। নিজেদের সম্মান নিজেরা তৈরি করে নেন। শুধু বলেন, আমাদের কী করতে হবে; আমরা করে দিচ্ছি। তাহলে আমরা পারবো না কেন? আমরা যদি সবাই আন্তরিকভাবে চাই, অবশ্যই এটা আমরা পারি। চাই ঐক্য, চাই দৃঢ়তা। দেখবেন দু বছরের মধ্যে বাঘা যতীন বিশ্ববিদ্যালয় কত উঁচুতে পৌছে গেছে; তখন আপনার নিজেরও ভালো লাগবে।
সত্যি স্যার। ড. আব্দুল হামিদ বললেন। প্রোভিসিও তাতে সায় দিলেন।
ড. সৈকত আহসান আবার বললেন, সিসি সাহেব আপনাকে একটা কথা বলি, আপনি বোর্ডের কাছে প্রকৃত সত্য রিপোর্টটা উপস্থাপন করবেন। মনগড়া কোনো রিপোর্ট দেবেন না। আমাদের পরিকল্পনা ও কার্যক্রমগুলো জানাবেন। কারও প্রতি আপনার বিদ্বেষভাবও যদি থাকে, তবু সত্য রিপোর্টটাই দেবেন। বিশ্ববিদ্যালয়কে এগিয়ে নেওয়ার জন্য আপনার আন্তরিকতা অনেক বেশি দরকার। কারণ, আপনি প্রতিদিন বোর্ডের সাথে কথা বলছেন, আপনি একটা মিথ্যাকে যদি দশদিন বলেন, তা কিন্তু সত্য হয়ে যাবে। এ ধরনের কাজ করবেন না।
স্যার, আমি কিন্তু এ ধরনের কাজ কখনো করি না।
আমি জানি আপনি করেন না। আমার অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, বোর্ড এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঝখানে যেসব বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিনিধি থাকেন, সেখানে তিনি নিজেকে অনেক ক্ষমতাবান মনে করেন। এতে অনেক সত্য মিথ্যে হয়ে যায়, অনেক মিথ্যে সত্য হয়ে যায়। আমি আপনাদের সবাইকে বলছি, আমি কিন্তু সবার ভেতর স্বচ্ছতা আদর্শ ও নীতিবোধ দেখতে চাই। আমার লক্ষ্য একটাই; বাঘা যতীন বিশ্ববিদ্যালয় দেশের নামকরা একটা বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে সুখ্যাতি অর্জন করবে।
ওকে স্যার। আমরা অবশ্যই তা করতে পারবো।
মনে রাখবেন, আপনার প্রতিষ্ঠান যদি আপনাকে সম্মান না করে, পৃথিবীর কোথাও আপনাকে কেউ সম্মান করবে না।
একদম ঠিক স্যার।
ঠিক আছে। আপনারা এখন গিয়ে নিজেরা বসেন, আলোচনা করেন, পরিকল্পনা বের করেন। কার্যক্রম গ্রহণ করেন। পরবর্তী মিটিংয়ে সেসব নিয়ে কথা হবে।
ড. সাদিক আহসানের রুম থেকে বের হয়েই প্রোভিসি নাজমুল সৈকত গাল ফুলিয়ে বললেন, প্রথম প্রথম সবাই দেখায়; দুদিন যাক ভেড়া বানিয়ে রাখবো!
ড. আব্দুল হামিদ বললেন, প্রোভিসি সাহেব, এই ভিসি কিন্তু আলাদা। তার কর্মস্পৃহা নীতি আদর্শ প্রখর। আমার কিন্তু ভালো লেগেছে। আমরা সবাই ভিসিকে সহযোগিতা করলে বিশ্ববিদ্যালয়টা অনেক ভালো করবে। ড. ফারজানা, আপনার কী মনে হয়?
একদম আলাদা ধরনের মানুষ। নীতিবান ও দায়িত্বশীল মানুষ বলতে যা বোঝায়, তিনি ঠিক তাই। কিন্তু স্যার, আমি তো বিপদে পড়ে যাচ্ছি। ডিপার্টমেন্ট নিয়ে কী পরিকল্পনা করবো, কিভাবে সেমিনার করবো; কিভাবে জার্নাল করবো; আমি তো পারবো বলে মনে হয় না!
আস্তে বলেন। এসব সিসি শুনলে বোর্ডকে বলে দেবে আপনি এসব জানেন না। ড. এলিনার জন্য তদবির চালাবে। সাবধানে চলবেন। কাজ শিখে ফেলবেন। আমি আপনাকে যতটা পারি, সাহায্য করবো। হতাশ হবেন না। নতুন ভিসি রিয়েলি ভালো মানুষ। দেখবেন, তার সাথে কাজ করে ভালো লাগবে।
প্রোভিসি কোনো মন্তব্য করলেন না। কিছু একটা ভাবছেন।
ড. সাদিক আহসান ভাবতে থাকেন, কঠোর পরিশ্রম করতে হবে। সবাইকে ভালোবেসে একসঙ্গে নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়টাকে উন্নত করতে হলে কোয়ালিটি যেকোনভাবেই হোক সুনিশ্চিত করতে হবে। কোয়ালিটি যদি আমরা নিশ্চিত করতে পারি, তাহলে আমাদের কাজ অনেক সহজ হয়ে যাবে। শিক্ষার্থীও বাড়বে। রেভিনিউ বাড়বে। শিক্ষক অফিসারদের সুযোগ-সুবিধা বাড়ানো যাবে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে এটাকে একটা মডেল হিসেবে দাঁড় করাতে চাই। এতে যত শ্রম দিতে হয়, দেবো। শুধু শুধু চাকরি করে দিন পার করা লোক আমি নই। আমার প্রতিটি মিনিটই এখানে গুরুত্বপূর্ণ। আমার লক্ষে আমাকে পৌঁছাতেই হবে। একটা আদর্শ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে এটাকে দাঁড় না করানো পর্যন্ত শান্তিতে আমার ঘুম হবে না। একবছর, দুবছর তিন বছর তার বেশি আর কত!
চলবে…
ঈশ্বর ও শয়তান-৯॥ রকিবুল হাসান