অনুবাদ: ফারহানা রহমান
(পর্ব-৩০)
স্ট্যাম্পের এই নিদারুণ শূন্যতার মধ্যেই আমি শেষপর্যন্ত নিজেকে একেবারে সমর্পণ করে দিলাম। সচেতনভাবে না হলেও মনে মনে বহুদিন থেকে আমি এমন নির্জনতাই খুঁজে বেড়াচ্ছিলাম। সেইন্ট লুইসের ভয়াবহ আওয়াজ ও ভীষণ ব্যস্ততা এবং হাজার হাজার ট্রাক আর বাসের শব্দ, বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়স্বজন নিয়ে বিশাল পারিবারিক আড্ডাবাজি, এসব কিছুর পর আমি একটু শান্ত আর নির্জন পরিবেশের জন্য আসলে মনে মনে পাগল হয়ে উঠেছিলাম। হলে স্ট্যাম্পের নির্জন রাস্তাগুলো এবং ঝরাপাতায় ভরে থাকা সুনসান বাংলোগুলোকে আমি মনপ্রাণ সঁপে দিয়ে একেবারে আন্তরিকভাবে গ্রহণ করলাম।
স্ট্যাম্পসের বাসিন্দাদের নিরুৎসাহ আর উপেক্ষাই আমার মনকে গভীরভাবে শান্ত করলো। তাদের আচরণের মধ্যে এমন একটা সন্তুষ্টির ভাব ফুটে উঠেছিল, যে মনে হচ্ছিল কোনোকিছুতেই আসলে ওঁদের আর কিছুই এসে যায় না। অথচ তাদের জীবনে আসলে তেমন উল্লেখযোগ্য বা বিশেষ কিছুই ছিল না। আর তাছাড়া আরও অনেককিছু হতেও তখনো বাকি ছিল। এই যে জীবনের এত এত না পাওয়া আর বৈষম্যের মধ্যেও খুব ছোটখাটো বিষয় নিয়ে খুশি থাকার যে প্রবণতা ওঁদের ভেতরে দেখেছিলাম, সেটাই মূলত আমাকে আমার নিজেকে এবং আমার এই জীবনকে চিনতে সাহায্য করেছিল। সত্যি বলতে কি, আসলে স্ট্যাম্পসের মানুষদের এই মানসিকতাই আসলে পরবর্তী সময়ে আমার জীবনবোধের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিল। এবার আমার জীবনে এতকিছু ঘটে যাওয়ার পর যখন আমি আবারও স্ট্যাম্পসে ঢুকলাম, আমার মনে হলো আমি যেন পৃথিবীর ম্যাপের শেষ প্রান্তে চলে এসেছি। আর এখান থেকে আমি একেবারে নির্ভয়ে ও প্রশান্তমনে এই দুর্বিষহ পৃথিবী থেকে একেবারে স্ট্যাম্পসের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারবো। এখানকার জীবনে নেই কোনো ঘটনার ঘনঘটা। নেই কোনো মানুষের সঙ্গে মানুষের তীব্র প্রতিযোগিতার বিষণ্ণতা। এটি একটি প্রশান্ত জনপদ।
আর এই নতুন জীবনের বৃত্তের মধ্যেই আমি নিজেকে একেবারে ঘুটিয়ে নিলাম। এখানে যেন অনির্দিষ্ট কালের জন্য আমার আর বেইলির জীবনে প্রশান্তি নেমে এলো। কেউ আমাদের কাছে কিছু দাবি করে না। কারও মনে ইচ্ছে পূরণের জন্য আমাদের কষ্ট করতে হয় না। আসল কথা হচ্ছে, যত যাই হোক না কেন আমরা হচ্ছি মিসের হ্যান্ডারসনের ক্যালফরনিয়ার নাতিনাতনি। কল্পকাহিনিতে ভরপুর উত্তরের শহর সেইন্ট লুইসে গিয়ে যারা একটি দারুণ ঐশ্বর্যময় আর চাকচিক্যপূর্ণ ছুটি কাটিয়ে আবারও স্ট্যাম্পসে ফিরে এসেছে। এই তো মাত্র একবছর আগেই আমার বাবা একটি বিশাল ও চকচকে দামি একটি গাড়ি চালিয়ে এখানে এসেছিলেন। রাজারানিদের মতো করে শহুরে ইংরেজি উচ্চারণে কথা বলে পুরো স্ট্যাম্পসের জনগণকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন। এখানকার প্রত্যেকেই যে আমাদের ভীষণ সমীহের চোখে দেখছিল, তার পেছনে এমন অনেক কারণ কাজ করছিল। ফলে আমাদের শুধু কয়েকমাসের জন্য মুখ বন্ধ করে নীরব থেকে স্ট্যাম্পসের সাধারণ মানুষের ভেতরের এসব উত্তেজনাকে স্থিমিত করার জন্য সময় দিতে হয়েছিল।
আর এভাবেই স্ট্যাম্পসে ফিরে এসে আমাদের দিনগুলো একেবারে অন্যরকম এক অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে কেটে যেতে লাগলো।
সাধারণ জনগণের চোখে তখন আমরা খুব অভিজাত পর্যটকে পরিণত হয়েছিলাম। আর সেকারণেই স্ট্যাম্পসের কৃষক, কর্মচারী, রাঁধুনি, কাঠমিস্ত্রি থেকে শুরু করে মৌসুমি শ্রমিকরা এবং তাদের ছেলেমেয়েরা এমনকি এই শহরের সমস্ত শিশুরাও আমাদের পরিব্রাজক মনে করতো। তারা প্রত্যেকদিন দাদির স্টোরটিকে তীর্থস্থান মনে করে সেটিকে দেখতে আসতো। আমাদের তীর্থযাত্রীদের মতো করে সম্মান জানাতো। যেমন করে কার্ডবোর্ড কেটে মানুষের দেহের মাপে কার্ডবোর্ডের মানুষ বানিয়ে দোকানে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়, ওঁরাও দোকানের ভেতর ঠিক সেভাবেই ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকতো। আর জানতে চাইতো, ওহ! আচ্ছা বোলো তো উত্তরদিকটা আসলে ঠিক ক্যামন?
-ওখানে কি খুব বড় বড় বিল্ডিং আছে নাকি? হুম? তোমরা কি ওগুলো দেখেছ নাকি?
-কখনো কি কোনো চলন্ত সিঁড়িতে বা লিফটে উঠেছ?
-খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলে তাই না?
-আচ্ছা, সাদা মানুষগুলো ঠিক যেভাবে কথাবার্তা বলে ওঁরা কি ওরকমই? নাকি সামনাসামনি এলে অন্যরকম? তোমাদের কাছে ওঁদের দেখে ঠিক ক্যামন মনে হয়েছিল?
এসব আমজনতার এত এতসব প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার দায়িত্ব বেইলি তার নিজের ঘাড়েই টেনে নিয়েছিল। আমি জানি যে, এসব সাধারণ মানুষকে আনন্দ দেওয়ার জন্য বেইলি তার কল্পনার জগতকে অসম্ভব রকমভাবে বিস্তৃত করে সেখান থেকে একের পর এক তাদের প্রশ্নের উত্তর দিয়ে যাবে। মনে হলো এবার স্ট্যাম্পসে এসে আমি আর বেইলি দুজনেই আসলে একেবারে এক আজব পরিবেশ-পরিস্থিতির সম্মুখীন হলাম, যা আমাদের কাছে একদম নতুন এক অভিজ্ঞতা মনে হলো।
স্বভাবতই বেইলি সমস্ত প্রশ্নের উত্তর যতদূর সম্ভব সংক্ষেপেই দিচ্ছিল, হুম উত্তরে বহুকিছু আছে। আসলেই অনেক কিছু। ওখানকার বিল্ডিংগুলো এতই বড় যে, সেগুলো আসলে আকাশ ছুঁয়ে থাকে। আর শীতকালে তো ওগুলোর ওপরের দিকের ফ্ল্যাটগুলোকে বা ফ্লোরগুলোকে একেবারে দেখাই যায় না। ওগুলো তখন বরফের নিচেই থাকে।
-সত্যি কথা বলতে কি। আসলেই কি তোমরা সত্যিটাই শুনতে চাও?
-হয়তো তোমাদের বিশ্বাস করতে কষ্ট হবে কিন্তু এটাই সত্যি যে ওঁদের একেকটা তরমুজের সাইজ হচ্ছে দুইটি বিশাল সাইজের গরুর মাথার সমান। আর কী বলবো? ওগুলো হচ্ছে চিনির সিরাপের চেয়েও বেশি মিষ্টি। আর তুমি যদি কোনোভাবে কাটার আগেই সেই তরমুজগুলোর বীচিগুলোকে গুনে ফেলতে পারো তাহলেই কাম সারা। একেবারে পাঁচ হাজার কোটি টাকা আর ভীষণ দামি একটি নতুন গাড়িও সঙ্গে পেয়ে যাবে।
বেইলি যখন এসব গালগপ্প করতো, তখন ওর চেহারার দিকে তাকিয়েই আমি স্পষ্টতই ওর মনের অভিপ্রায় বুঝতে পারতাম। আর ওর দিকে বিমুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকা শ্রোতাদের চেহারা দেখেও বুঝতে পারতাম যে, বেইলির গল্প শুনে আসলেই ওদের মনের মধ্যে ঠিক কী চলছে।
বেইলির এসব ক্লাণ্ডকারখানা বুঝতে পেরেই মোমা ওকে বারবার সাবধান করতে লাগলো, শোনো জুনিয়র, তুমি কিন্তু প্লিজ নিজেকে একটু কন্ট্রোল করো। দয়া করে ওঁদের সাথে আরেকটু চিন্তাভাবনা করে কথা বোলো, একটু সাবধানে কথা বোলো। এত চাপাবাজি করতে গিয়ে কিন্তু দয়া করে পচা শামুকে পা কেটো না। আর লক্ষ্মী বাচ্চাটা কখনোই কোনো মিথ্যা কথা বলে না, বুঝলা?
-শোনো এখানে সব লোকজন নতুন জামাকাপড় পরে ঘুরে বেড়ায় কিন্তু মনে রেখো ওঁদের সবার পেটেই কিন্তু গু আছে। আর তুমি যদি সেই নোংরা গু’য়ে পা পিছলে পড়ো, তাহলে কিন্তু গুয়ের ট্যাংকিতে হুমড়ি খেয়ে পড়বে। আর একেবারে মিসিসিপি নদীতে গিয়ে ডুবে মরবে। কারও কারও আবার বরফের বক্সও আছে। যাদের প্রকৃত নাম হচ্ছে ঠাণ্ডা জায়গা বা ফ্রিজ। ওখানকার বরফ এতই বেশি আর গভীর যে তুমি তোমার ঘরের দরজা পার হওয়া মাত্রই হয়তো ওখানকার বরফের স্তূপের মধ্যে তোমার সলীল সমাধি হয়ে যাবে। আর তোমার প্রিয়জনরা অর্থাৎ আমরা হয়তো এ জীবনে আর কখনোই তোমার দেখা পাবো না। আর ওই বরফ দিয়েই হয়তো আমরা না জেনেই আইসক্রিম বানিয়ে খেয়ে ফেলবো। ফলে বুঝতেই পারছ যে, আমি আসলে কী বলতে চাইছি? দয়া করে ওঁদের সাথে বুঝেশুনে কথাবার্তা বোলো। বেইলিকে বলা মোমার এই কথাগুলোকে আমি সম্পূর্ণভাবে সাপোর্ট করেছিলাম। শীতকালে সত্যি সত্যি আমরা একটা বড় গামলা করে বরফ সংগ্রহ করে ওটার ওপরে দুধ ঢেলে দিতাম আর তার ওপরে চিনি ছিটিয়ে দিয়ে ওটাকে আইসক্রিম বলতাম। আইসক্রিমের মতো করেই চুষে চুষে খেতাম। বেইলি যে নানারকমভাবে ভাইল মেরে কাস্টমারদের পটাতো, আর তাতে করে দোকানের বেচাবিক্রি অনেক বেশি বেড়ে যেতো বলে মোমার মুখটি খুশিতে জ্বলজ্বল করে জ্বলত।
আংকেল উইলি বেইলির কীত্তিকলাপে রীতিমতো গর্বিতবোধ করতো। স্টোরে বেচার জন্য আমরা নানা কার্ডের ওপর রঙ দিয়ে অনেক ধরণের ছবি ও শহরের প্রার্থনাকেন্দ্রগুলোর ছবি এঁকে করে দিতাম। ক্যানভাসের ওপর রঙ দিয়ে আঁকা ছবিগুলোই ওঁদের কাছে প্রমাণ করে দিতো যে আমরা সেইন্ট লুইস শহরের অনেক অনেক বিস্ময়কর জায়গাগুলোতে একা একাই ঘুরে বেড়িয়েছি। আর এতসব ভ্রমণ শেষে আবারও এই স্ট্যাম্পস শহরেই ফিরে এসেছি। এইসব ব্যাপারগুলোই ওঁদের কাছে আশ্চর্যজনক মনে হোতো। তদুপরি আমাদের এই ভ্রমণের সফলতা ওঁদের আমাদের প্রতি আরও ভয়াবহভাবে ঈর্ষান্বিত করে তুলতো।
আর এভাবেই স্ট্যাম্পসে ফিরে এসে আমাদের দিনগুলো একেবারে অন্যরকম এক অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে কেটে যেতে লাগলো।
চলবে…