শৈশবে শখের বশে অনেকের মতো আমিও ছড়া, কবিতা লিখেছি। ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ার সময় স্কুলের দেয়াল পত্রিকায় হাতেলেখা অক্ষরে প্রথমবার নিজের কবিতা দেখার সৌভাগ্য হয়। অদ্ভুত আনন্দ অনুভূতি হয়েছিল তখন। প্রথম বা দ্বিতীয় শ্রেণীতে পড়ার সময় বড় মামা মাহবুবুল আলম কলকাতা থেকে আনা কাজী নজরুল ইসলামের কবিতাসংবলিত একটি সচিত্র বই উপহার দিয়েছিলেন। অসামান্য সুন্দর একটি বই। পড়তে পড়তে সব কবিতা মুখস্থ করে ফেলেছিলাম। সঙ্গে আরও দিয়েছিলেন ঠাকুরমার ঝুলি। কী সুন্দর ছিল সেই রাক্ষস-খোক্কসের গল্পগুলো!
আমাদের স্কুল ছিল সরকারি গার্লস স্কুল। এখন এমনটা হয় কি না, জানি না, তবে তখন বছরের একটা সময় সরকারি স্কুলে ট্রেনিং-টিচারেরা আসতেন। কয়েকমাস তারাই আমাদের ক্লাস নিতেন। তাদের পারফরমেন্স যাচাই করে মূল্যায়ন করা হতো। ফলে স্বাভাবিকভাবেই নিয়মিত শিক্ষকদের চেয়ে তারা অনেক বেশি নমনীয় ও আনন্দোচ্ছল হয়ে পড়াতেন। আমরাও কিছুদিন রাগী শিক্ষকদের হাত থেকে পরিত্রাণ পেতাম। সপ্তম শ্রেণীতে পড়ার বেশ কয়েকজন ট্রেনিং টিচার এসেছিলেন। তারমধ্যে বাংলা বিষয়ের ট্রেনিং টিচারের পড়ানোর পদ্ধতি ছিল খুব চমৎকার। আমরা সবাই তার ভক্ত হয়ে গেলাম। ক্লাসে এসে তিনি আমাদের কবিতা বা গদ্যের কিছু অংশ পড়তে দিতেন। প্রথমদিন আমাকে কবিতা পড়তে দিলেন। পড়েছিলাম কবি আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ’র ‘কোনো এক মাকে’। ‘কুমড়ো ফুলে ফুলে নুয়ে পড়েছে লতাটা…’। স্পষ্ট মনে আছে, আপা সেদিন ভূয়সী প্রশংসা করেছিলেন। এরপর থেকে রোজ ক্লাসে এসেই বিভিন্ন জনকে দিয়ে পড়ালেও আমি ছিলাম তার কমন ছাত্রী, যার মুখ থেকে তিনি গদ্য বা পদ্য শুনতে পছন্দ করতেন। চলে যাওয়ার কয়েকদিন আগে ক্লাসে বললেন, ‘তোমাদের কেমন লাগে ফরিদার আবৃত্তি? আমার কিন্তু ওর কণ্ঠে কবিতা শুনতে খুব ভালো লাগে’।
বলাবাহুল্য, ওই বয়সে এ ধরনের প্রশংসা আমাকে ভীষণভাবে নাড়া দিয়েছিল, উজ্জীবিত করেছিল। এমনিতেই কবিতা পড়তে আমার সবসময়ই ভালো লাগতো। কিন্তু সেদিনের পর থেকে আমি শব্দ করে কবিতা পড়তে ভালোবাসতাম। যেখানে যা পেতাম, লেখাটিকে আত্মস্থ করে শুদ্ধ উচ্চারণে পড়বার চেষ্টা করতাম। মনে পড়ে বাংলা আপা চলে যাওয়ার পর কেঁদেছিলাম। মন খারাপ করে ডায়েরি লিখেছিলাম। এরপর থেকেই যেন গল্প, কবিতার প্রতি ভীষণভাবে দুর্বল হয়ে পড়ি।
ক্লাস ফাইভ থেকে আমরা যে বিল্ডিংটাতে থাকতাম, সেটা ছিল কিছুটা কলোনি ধাঁচের । প্রতিবেশী হিসেবে পেয়েছিলাম অসাধারণ ভালো একজন মানুষ—অশোক চাকমাকে। তখন তিনি ছিলেন এইচএসসি পরিক্ষার্থী। ছাত্র ইউনিয়ন করতেন। রাশিয়ার উপকথা, রূপকথাসহ অসামান্য সব বই পড়ার সুযোগ পেয়েছিলাম অশোক ভাইয়ের কারণে। কিছুদিন পরপরই নতুন নতুন বই এনে দিতেন। পড়া হলে ফেরত দিতাম। নবম শ্রেণীতে ওঠার পর ম্যাক্সিম গোর্কির ‘মা’ দিয়েছিলেন পড়তে। কিন্তু ওই সময় কেন যেন কয়েক পৃষ্ঠা পড়ে আর পড়া হয়নি। তার কাছ থেকেই পেয়েছিলাম আমার অন্যতম প্রিয় বই মৈত্রেয়ী দেবীর ‘ন হন্যতে’। এসএসসির পর পড়া এই বইটি পড়ে মুহূর্তেই যেন বড় হয়ে উঠেছিলাম! পড়ালেখা সংক্রান্ত রুচি গঠনে অশোক ভাইয়ের ভূমিকা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি সবসময়।
কস্মিনকালেও ভাবিনি কোনো পত্রিকায় আমার লেখা ছাপা হতে পারে বা নিজের লেখা বই ছাপা হবে কোনোদিন! সেই যে প্রেমে পড়েছি লেখালেখির, আজও নিমজ্জিত আছি। যতদিন ভালো লাগে, যতদিন আনন্দ পাবো লিখে যাবো। ভবিষ্যৎ জানি না, ভাবিও না!
মধ্যবিত্ত পরিবার হলেও বাসায় প্রচুর পত্রিকা রাখা হতো। দৈনিক পত্রিকা সংবাদ ছাড়াও রাখা হতো বিচিত্রা, বেগম, গণস্বাস্থ্য, যায়যায়দিন, বিচিন্তা, উন্মাদ, আনন্দবিচিত্রা ইত্যাদি। আব্বা একবার ঢাকা বইমেলা থেকে নিয়ে এলেন শিশুসাহিত্যিক আমীরুল ইসলাম ও এখলাসউদ্দিন আহমেদের সম্পাদনায় ‘কিশোর অনিন্দ্য’ বইটি। সুন্দর প্রচ্ছদ আর বাঁধাইয়ে চমৎকার একটি বই! লুৎফর রহমান রিটনের ছড়াসহ অনেক মজার মজার ছড়া, কবিতা, গল্প ছিল বইটিতে। কতবার যে বইটি পড়েছি হিসাব নেই।
আমার জীবনের প্রথম গল্প, উপন্যাস পড়া হয় সাংবাদিক শাহাদত চৌধুরীর সম্পাদনায় ‘বিচিত্রা’র ঈদসংখ্যায়। যতদূর মনে পড়ে তখনকার বিচিত্রা ঈদসংখ্যা অত্যন্ত সমৃদ্ধ ছিল। প্রায় সব গণ্যমান্য লেখকের লেখাই থাকতো তাতে। বাসায় সবসময় শিল্প-সংস্কৃতির অনুকূল একটা পরিবেশ ছিল বলা চলে। ছুটির দিনে মুভি দেখা হতো। তবে পড়ার সময় অথবা পড়ালেখা রেখে গল্পের বই পড়লে আম্মা খুব বকতেন। প্রচুর বই পড়া হতো। কিনে পড়ার চাইতে বন্ধুদের সঙ্গে বিনিময়ের মাধ্যমেই বেশি পড়া হতো। একসময় রোমেনা আফাজের দস্যু বনহুরের নেশা পেয়ে বসল। সেবাপ্রকাশনীর পেপারব্যাক বই, তিনগোয়েন্দা সিরিজ পড়া হতো বেশি। এভাবেই একদিন হাতে চলে এলো হুমায়ুন আহমেদের নন্দিত নরকে বইটি। বইটি পড়ে মুগ্ধতায় আচ্ছন্ন ছিলাম বহুদিন।
এরপর বিভিন্ন সময়ে পড়ার পাশাপাশি অনিয়মিতভাবে লেখালেখি করেছি। অনেকটা ডায়েরি লেখার মতো। নবম শ্রেণী থেকে শুরু করে উচ্চমাধ্যমিক উত্তীর্ণ হওয়া পর্যন্ত সময়ে বাবা-মা, চার ভাইবোনসহ আমাদের পরিবার চরম অর্থনৈতিক দুর্দশার সম্মুখীন হয়। এই কঠিন সময়ের মধ্যে ভালো ফল নিয়ে এইচএসসি পাস করি। পরবর্তী সময়ে মেডিক্যালে চান্স পাওয়ার পরপরই বিয়ে হয়ে যায়। এমবিবিএস আর বিবাহিত জীবন শুরু হয় প্রায় একইসময়ে। এমবিবিএস প্রথম বর্ষেই জন্ম হয় প্রথম সন্তানের। জীবনে কোনোকিছুই পরিকল্পনা করে গুছিয়ে করা হয়নি। অগোছালো জীবন ভুগিয়েছেও অনেক। ওই সময়কার বহুকিছুই আমি ঠিকঠাক মনে করতে পারি না। মস্তিষ্ক সম্ভবত কষ্টকর স্মৃতি মুছে ফেলতে চায় এবং মুছে ফেলে। পুরো এমবিবিএস পড়ার সময় কেটেছে প্রচণ্ড দুঃখ-কষ্ট আর অনিশ্চয়তার মধ্যে। তবে স্বামী অত্যন্ত ভালোমানুষ ও সহযোগী মানসিকতার হওয়ার এতটুকু পথ পাড়ি দিতে পেরেছি। তখন প্রায় প্রতিদিন কাঁদতাম আর ডায়েরি লিখতাম। দুর্দশা আর হতাশার কথা ছাড়া কিছুই ছিল না তাতে। অসংখ্যবার সাইক্রিয়াটিস্টের শরণাপন্ন হয়েছি। বাঁচতে চেয়েছি। পড়তে চেয়েছি। লিখতে চেয়েছি। ওই সময়ের কোনো লেখা আমার সংগ্রহে নেই। নষ্ট হয়েছে বা হারিয়ে গেছে বেশিরভাগ।
ইন্টার্ন করার সময় প্রথম আলো পত্রিকায় প্রতি মঙ্গলবার নকশা পাতায় স্বাস্থ্যবিষয়ক লেখা লিখতে শুরু করি। চট্টগ্রামের দৈনিক পত্রিকাগুলোতেও লিখতাম। ওই সময় প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম বিসিএস পরীক্ষার। প্রথমবারেই চান্স পেয়ে গেলাম। জয়েন করলাম সরকারি চাকুরিতে । এর তিন মাসের মাথায় দ্বিতীয় সন্তানের জন্মের সময় প্রসব-সংক্রান্ত জটিলতায় ভুগে অল্পের জন্য বেঁচে গেলাম। উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা আমার বরাবরই বহাল ছিল। পরবর্তী সময়ে গাইনি ও অবসটেট্রিক্সে পোস্টগ্র্যাজুয়েশন কোর্সে ভর্তি হলাম। অতীতের দুঃখ-কষ্ট ভুলে আরেকবার বাঁচতে চাইলাম। পাশাপাশি লিখতে শুরু করলাম। লেখালেখি আমাকে নিরঙ্কুশ আনন্দ দিতো, প্রেরণা জোগাতো। এর মধ্য দিয়ে ফিরে পেতে চাইতাম হারিয়ে ফেলা কৈশোর আর উঠতি যৌবনের সুন্দর সময়গুলো।
২০১০ সাল থেকে আবার শুরু করলাম বইকেনা, বইপড়া এবং লেখালেখি। তখন থেকে লেখালেখি হয়ে গেলো আমার আনন্দের অন্যতম উৎস—আকাঙ্ক্ষিত প্রেমিকপ্রবর। সমর্পিত হতে থাকলাম লেখার প্রেমে। লেখাকে সঙ্গে নিয়ে নিজের ভুবন গড়ে তুললাম। লেখার সঙ্গে একা হতে ভালো লাগতো। লেখালেখি আমাকে সেই জগতের সন্ধান দিল, যাতে নেই কোনো জাগতিক দুঃখকষ্ট, অভাব-অনটন বা হতাশা। আমার লেখালেখির নির্দিষ্ট কোনো গণ্ডি ছিল না। যখন যা মনে হতো লিখে রাখতাম। তবে কবিতাই লেখা হতো বেশি। সেই লেখা শুধু আমিই পড়তাম। কাউকে দেখাতাম বা শোনাতাম না। আমি আনন্দ-সন্ধানকারী। আলোক-সন্ধানকারী। আলো আর আনন্দের সন্ধানেই লিখছি। কস্মিনকালেও ভাবিনি কোনো পত্রিকায় আমার লেখা ছাপা হতে পারে বা নিজের লেখা বই ছাপা হবে কোনোদিন! সেই যে প্রেমে পড়েছি লেখালেখির, আজও নিমজ্জিত আছি। যতদিন ভালো লাগে, যতদিন আনন্দ পাবো লিখে যাবো। ভবিষ্যৎ জানি না, ভাবিও না!