আমি একজন অনুরাগী পাঠক। লেখালেখিতে আগ্রহী হওয়ার একটা কারণ ছিল ভুল ধারণা থেকে। লেখালেখিকে প্রথমে সহজ ভেবেছিলাম। কিন্তু শুরু করার পর দেখলাম ঘটনা পুরো উল্টো। লেখালেখি কঠিনেরও কঠিন। কিন্তু ভালোবাসা যেহেতু হয়ে গেছে, তাই ফেরার উপায় নেই। তাই কঠিনেরেই ভালোবাসিলাম।
আমার যখন অক্ষরজ্ঞান হয়নি, তখন প্রথম গল্পের স্পর্শ পেয়েছি বাবার কাছে। বাবার ব্যবসায়ের কারণে প্রচুর বই-পত্র আর নানা কাগজের বিশাল সংগ্রহ ছিল আমাদের। বাবা একদিন রঙচঙে একটা বই থেকে পড়ে শোনাচ্ছে, সেখানে একটা লাইন আকাশ ভেঙে পড়েছে রে আকাশ ভেঙে পড়েছে; বাবা পড়ছে, আর বিশাল একটা কিছু আমাকে গিলে নিচ্ছে, মাথা, মুখ, নাক, কান আর চোখ ঢাকা পড়ছে, দমবন্ধ হয়ে আসছে। এইরকম অনুভূতি হচ্ছে আমার; কিন্তু বিশাল ব্যাপারটা যে কী আর এর বিরাটত্ব ঠিক কতখানি, সেটা বুঝতে পারছি না। খাবি খাচ্ছি, তারপর তারস্বরে কেঁদে উঠছি একসময়। অথচ বাবাকে বারবার বলছি ওই লাইনটাই পড়তে, ডুবে যাওয়ার অনুভূতি আবার পেতে চাইছি; বাবা যখন বাড়ি নেই, বই হাতে আমি মেঝো আপার কাছে যাচ্ছি, বড় ভাবির কাছে যাচ্ছি। তারপর পাশের বাড়ির বাউচের কাছে, চাচির কাছে বলছি, ওই লাইনটা পড়ো, ‘আকাশ ভেঙে পড়েছে রে, আকাশ ভেঙে পড়েছে।’ কাঁদতে কাঁদতে হেঁচকি উঠছে আমার।
সবে পড়তে শিখেছি, স্কুল শুরু হয়নি, বাবা গল্পগুচ্ছ থেকে ‘ছুটি’ গল্পটা পড়ছেন, ‘‘এই নিয়ে বোধ হয় পঞ্চমবার ফটিক খালাসিদের মতো সুর করিয়া করিয়া বলিতে লাগিল, ‘এক বাও মেলে না। দো বাও মেলে, এ-এ না’। আমি আবার সেই খাবিখাওয়া কান্না শুরু করে দিয়েছি| কারণ, এরপর ফটিকের মা আসবে, আর বলবে ‘ফটিক! সোনা! মানিক আমার!’ আর তখনই ফটিক আস্তে আস্তে পাশ ফিরিয়ে কাহাকেও লক্ষ্য না করিয়া মৃদু স্বরে কহিল, ‘মা, এখন আমার ছুটি হয়েছে মা, এখন আমি বাড়ি যাচ্ছি।’’
মা ছোট ভাইকে জড়িয়ে ধরে সে কী বিলাপ! বাবাকে ঘিরে আমার, আমাদের অজস্র স্মৃতি আছে। কিন্তু বাবা যখন মারা গেলেন, তখন আমার এই ছোট ভাইটা মাত্র বাবা ডাকা শিখেছিল!
সম্পূর্ণ অপরিচিত এক বালকের জন্য হাহাকার করে আমি কাঁদছি, নিজেই অবাক হতাম| এ আমার বকুনি খেয়ে কান্না নয়, আছাড় খেয়ে কপাল কেটে কান্না নয়, ইঞ্জেকশন নেওয়ার কান্নাও নয়, কেন কাঁদছি, কার জন্য কাঁদছি, কিছুই স্পষ্টই নয়। বস্তুত মরে যাওয়া ব্যাপারটাই তখন আমার কাছে অস্পষ্ট। শব্দের পরে শব্দ সাজানো একটা বাক্য আমাকে কাঁদাচ্ছে আর সেই আশ্চর্য কান্না বারবার কাঁদতে চাইছি আমি, আবছা মনে হতো, এই অবোধ্য আশ্চর্য দাঁড়িয়ে থাকছে একটি কি দুটি লাইনের ওপর অনেক ক্ষেত্রে তা আবার একটা কাহিনির ওপর।
বুঝতে পারছিলাম, বাবার মুখে গল্প শোনার আগের আমি আর পরের আমি আলাদা, যেন পি সি সরকারের ম্যাজিক বাক্সে ঢুকল একটা ছেলে, হয় হারিয়ে গেলো; নয়তো বেরিয়ে এলো বাঘ হয়ে। বাবার হঠাৎ মৃত্যু আমার শৈশবটাকে পুরো এলোমেলো করে দিয়েছিল। বাবা নেই, আমার আর নিয়ম করে গল্প শোনানোরও কেউ নেই। অথচ আমি গল্প শুনতে চাইছি ভীষণভাবে। না, গল্প যখন শুনতে যখন পারছি না, তখন সবাইকে আমার বাবার গল্প শোনানো শুরু করলাম। বাবাকে ঘিরে সেই সব গল্প সবাই খুব মনোযোগ দিয়ে শোনে। আমি উৎস পাই গল্প বলার।
হাতে থাকা পেন্সিলকে সম্বল করে বাবার সঙ্গে পার করে আসা প্রতি মুহূর্তে বিবর্ণ হতে থাকা স্মৃতির টুকরো ছবিগুলোই লিখতে শুরু করলাম। কখনো তা হয়ে উঠলো স্মৃতিগদ্য কখনো গল্প, আবার কখনো কবিতার অক্ষরেও ফুটে তুলতাম বাবার মুখ। এভাবেই বাবার স্মৃতি ধরে রাখতে গিয়েই লেখার আগুনে হাত পোড়ানোর সূত্রপাত।
আমার সেই লেখা প্রথমে পড়ে শোনাতাম বড় ভাবি আর আপাদের, তারপর আমার বন্ধুদের। আপারা আমার লেখা শুনে কখনোই সন্দেহ করেনি কেননা আমি যা কিছু লিখেছি তা তো ওরাও জানে। তবে মাঝে মাঝে ওরা খুব অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকতো। বলতো, ‘কী করে এত কিছু মনে রেখেছিস আর এত সুন্দর করে গুছিয়ে লিখেছিস!’ কিন্তু বন্ধুদের মধ্যে কেউ কেউ কিছুতেই বিশ্বাস করতো না এসব আমি লিখেছি। আমার সেই লেখালেখি একদম জ্যান্ত এবং বিশ্বাসযোগ্য হয়ে এলো অনেক পরে। যখন ওরা ম্যাগাজিনে বা পত্রিকায় ছাপার অক্ষরে আমার নামসহ সেই লেখাগুলো পড়লো।
জীবনটাজুড়ে বিশেষ কিছু পড়া হয়নি। বিস্তারে ও গভীরতায় যা পড়েছিলাম তার কিছুটা ভাবতাম, বুঝেছি। অতিক্রান্ত জীবনের অভিজ্ঞতায় আর অবরে সবরে ছেঁড়া ছেঁড়া নতুন পাঠের ঢেউয়ে বুঝেছি আগের সেই বোঝাগুলোর বেশির ভাগটাই বোঝা, ফেলে দেওয়ার। গল্প যে মনে রাখার মতো লাইন আর শব্দের বাইরে আরও কিছু দিতে সক্ষম সেইটা বুঝলাম।
আসলে, এই সময় অবধি উপন্যাস, বড় গল্প, ছোটগল্প, কবিতা কোনো কিছুই আলাদা করিনি, শুধু লাইন কুড়িয়েছি, ঝিনুক খোঁজার মতো শব্দ খুঁটে খুঁটে তুলে নিয়েছি; এরপর কলেজ যেতে যেতে যেটা ঘটলো, ড. বেলাল স্যারকে পেয়ে গেলাম। দক্ষিণ এশিয়ার একজন প্রখ্যাত ফোকলোরদিব তিনি। বাংলা ক্লাসে এসে বেলাল স্যার আমার মনে দরজা খুলে দিলেন পুরো দমে। আমিও খোলা দরজা দিয়ে বেরিয়ে অজস্র ছোটো গল্প দেখতে শুরু করলাম চারপাশে। অনবরত লিখতে থাকলাম সেসব দেখা গল্পগুলো।
কিন্তু লেখালেখিতে হঠাৎ করেই বড় রকমের একটা পরিবর্তন চলে এলো। আমি যখন প্রচুর লিখছি কিন্তু সেই সব লেখাতে আর আমার বাবা থাকে না। আমি বাবাকে নিয়ে কিছু লিখতে সাহস পাই না, ভয় হয় ভীষণ ভয় হয়! একদিন এক ক্লান্ত বিকেলে, ঈষৎ মন খারাপ নিয়ে জানালার বাইরের উদাসী আকাশের দিকে তাকিয়ে আছি। হঠাৎ পাশের ঘর থেকে কান্নার শব্দ ভেসে আসে। গিয়ে দেখি পড়ার টেবিলে আমার একটি খাতা বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে আমার ছোট ভাইটি ‘আব্বা…আব্বা গো আমি কেন তোমার সুন্দর মুখটা মনে করতে পারি না গো আব্বা’ বলে হাউমাউ করে কাঁদছে। সেদিন সে দৃশ্য দেখে বাড়ির প্রত্যেকেই অনেক কান্নাকাটি করেছে। মা ছোট ভাইকে জড়িয়ে ধরে সে কী বিলাপ! বাবাকে ঘিরে আমার, আমাদের অজস্র স্মৃতি আছে। কিন্তু বাবা যখন মারা গেলেন, তখন আমার এই ছোট ভাইটা মাত্র বাবা ডাকা শিখেছিল!
এই কারণে লেখালেখি নিয়ে আমাকে কেউ যখন জিজ্ঞেস করে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী? আমার উত্তর থাকে পরিকল্পনা একটাই। লিখে যেতে চাই। লিখে যেতে চাই। লিখে যেতে চাই।
ছোট ভাইটির জন্যই আমার বাবাহীন লেখালেখি চলতে থাকে। চলার পথে প্রেমের সঙ্গে, সম্পর্কের সঙ্গে পায়ে পায়ে এসে যায় হরেক রকমের সুখ, এসে যায় দুঃখমিশ্রিত হাজারো কথা, যা আমি লিখি আর শিরোনাম দেই কখনো গল্প, উপন্যাস, কিংবা মুক্তগদ্য অথবা গদ্যকবিতার নামে। তবে হ্যাঁ, এটা বলতেই হয়, লেখালেখি খুবই কষ্টকর একটা ব্যাপার। কখনো কখনো মাস কেটে যায়, একটা লাইনও লিখতে পারি না। আবার কখনো কখনো একটানা তিন দিন তিন রাত ধরে লেখার পর একসময় বুঝতে পারি, যা কিছু লিখছি তা কিছু হয়নি। এসব কিছুর পরও লেখালেখির মধ্যে একটা অপার আনন্দ আছে। জীবনযাপনের সমস্যাদির সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যায়, লেখালেখির মধ্যে অর্থবহ কিছু খুঁজে পাওয়া খুবই সহজ। আমার প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘যাদুর নীল বেলুন’, দ্বিতীয়টা প্রবন্ধের ‘অতঃপর প্রহসন’ এবং তৃতীয়টা উপন্যাস ‘গল্পের মোড়কে মানুষ’। আমার এই লেখাগুলো সময়ের অনুরোধে ভিন্ন সময়ে রচিত বিচ্ছিন্ন ভাবনার বিবরণ। জীবনের পরতে পরতে নিঃশব্দের প্রহসনকে মেনে নিয়ে পোড় খাওয়া অভিজ্ঞতায় যা দেখেছি, নানা ঘটন আর অঘটনের আঘাতে আঘাতে মগজের চাপে বশীভূত হয়ে যা লিখেছি, সংবেদনশীল পাঠকের জন্য নিতান্ত কম অস্বাদযোগ্য হবে না। এটা এখন বলাই যায়।
লেখক হিসেবে আমি বিশ্বাস করি সমাজ ও জীবন পরিবর্তনশীল এবং সমাজের সঙ্গে সম্পর্কিত সাহিত্যও পরিবর্তনশীল। অতএব আমি আমার মতোই স্বতন্ত্র একটা ছকে এগিয়ে গেছি পরিবর্তনশীল সেই পল্লীপ্রকৃতির নিসর্গ স্তব্ধতা ও স্থবিরতার দিকেই। মানুষের কাছাকাছি যাওয়া এবং সেই মানুষটাকে ঠিকঠাক ছেঁকে তুলে আনার কাজটা শিখেছি আমার প্রয়াত প্রিয় বাবার কাছেই। আমার যেখানে জন্ম সেখানে নিম্নবিত্ত থেকে উচ্চবিত্ত, সংখ্যাগরিষ্ট থেকে সংখ্যালঘু সবারই বসাবস ছিল। আমি সেসব মানুষদের অন্তর্দ্বন্দ্ব, তাদের বেদনা, নানা বিষয়ে তাদের ক্ষোভ সব দেখেছি। দেখেছি বলেই হয় তো তা পাঠকের দরবারে সাহিত্যের মাধ্যমে উপস্থাপনের দায়িত্ব অনুভব করেছি। এই লেখালেখির জন্যই আমি পেয়েছি ‘ফ্রেন্ডস পদক-২০১৯’। যদিও শিল্প-সাহিত্যের দিকে রঙ ঢালতে ঢালতে এখন আমার নিজের দিকে রঙের বড় আকাল চলছে। তবু দিন শেষে যখন পড়ার টেবিলে যায় তখন মনে হয় জীবন সুন্দর।
শৈশবে বাবার হঠাৎ মৃত্যু, ড. বেলাল স্যারের উৎসাহ এরকম আরও অনেকেই আমাকে লেখালেখি করতে উৎসাহী করছেন। তবে, আমার ধারণা একজনের লেখক হওয়ার পেছনে তার নিজের অবদানটাই সবচেয়ে বেশি থাকে। কারণ কোনো মা-বাবাই প্রথম দিকে চান না সন্তান লেখালেখি করুক। এইম ইন লাইফ রচনায় লেখক হওয়ার বিষয়টি কখনো শেখানো হয় না। কারণ আমাদের দেশে শুধু লেখালেখি করে সম্মানজনক ও স্বাস্থ্যকর জীবন যাপন এখনো সম্ভব নয়। এটি একটি অনিশ্চিত যাত্রা। সুতরাং আমার তো মনে হয় লেখক হওয়ার ঝুঁকি প্রথমে নিজেকেই নিতে হয়। আমিও তাই নিয়েছি। তবে এ পর্যন্ত আসার পেছনে বহু মানুষের সহযোগিতা, উৎসাহ, প্রেরণা আর ভালোবাসা ছিল। যা এখনো আছে। আশাকরি ভবিষ্যতেও অব্যাহত থাকবে। এই কারণে লেখালেখি নিয়ে আমাকে কেউ যখন জিজ্ঞেস করে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী? আমার উত্তর থাকে পরিকল্পনা একটাই। লিখে যেতে চাই। লিখে যেতে চাই। লিখে যেতে চাই।