পর্ব-৮
দার্জিলিং: অদম্য ক্ষমতার অধিকারী, বজ্রপাতের শহর
দার্জিলিং শব্দটি এসেছে সংস্কৃত থেকে। যার অর্থ দুর্জয় লিঙ্গ। হিমালয় সংলগ্ন এই দার্জিলিংকে তুলনা করা হয়েছে অদম্য ক্ষমতার অধিকারী শিবের সঙ্গে। যে হিমালয় শাসন করে। এটি একটি মনোরম শৈল শহর। চায়ের জন্য বিখ্যাত। দার্জিলিংয়ে দ্বিতীয় রাতেই দেখলাম এর আসল চেহারা। শুরু হয়ে গেলো তুমুল বৃষ্টি। বারান্দায় গিয়ে দেখলাম অঝোর ধারা। দার্জিলিং শব্দের আরেক অর্থ নাকি বজ্রপাতের শহর। রুমের ভেতরে এসে বৃষ্টি উপভোগ করছিলাম। আমাদের রুমের পূর্ব দিক পুরোটা কাঁচের দেয়াল। পর্দা সরালেই বাইরেটা দেখা যাচ্ছিল। তার মধ্যে বগ্রপাতের গুরুগুরু শব্দও কানে আসছিল। তবে সেটা বাংলাদেশের মতো ভয়ঙ্কর শব্দের নয়। খুব একটা হন্তারক বলেও মনে হলো না।
গত কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশে বজ্রপাতে অসংখ্য মানুষ মারা যাচ্ছে। ঢাকা থেকে দার্জিলিং আসার পথে বাসে একটা লেখা পড়ছিলাম। কেউ একজন ফেসবুকে শেয়ার দিয়েছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোলের এক অধ্যাপক বিষয়টা ব্যাখ্যা করছিলেন। তিনি জানান, উত্তরে হিমালয় পর্বত থাকার কারণে সেখান থেকে ঠাণ্ডা বাতাস ছোটে দক্ষিণে। আবার দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর ও ভারত মহাসগার থাকায় এখানকার গরম বাতাস ছোটে উত্তরে। এই দুই প্রবল বায়ুর সংঘর্ষে বাংলাদেশের ভূখণ্ডে ব্যাপক বজ্রপাতের ঘটনা ঘটছে। ভৌগলিক অবস্থানের কারণেই এমনটা ঘটছে। পৃথিবীর আর কোথাও এত বেশি প্রাণসংহারী বজ্রপাতের নজির নেই।
তাহলে তো দার্জিলিংয়ে বজ্রপাত আরও বেশি হওয়ার কথা। কিন্তু হচ্ছে না। কারণ আছে এখানেও। দক্ষিণের গরম বাতাস দার্জিলিং পর্যন্ত যেতে যেতে দুর্বল ও ঠাণ্ডা হয়ে যায়। ফলে সংঘর্ষের ঘটনা কম। হলেও সেটা অতি দুর্বলের যুদ্ধ। কারণ গরম বাতাস এই পর্যন্ত এসে যেমন ঠাণ্ডা হয়ে যায়, তখন বাতাস আর জল ধরে রাখতে পারে না। বৃষ্টি হয়ে ঝরে।
আলো নিভিয়ে বৃষ্টি দেখছিলাম। ভাসছিলাম কল্পনায়! তখন যদি কেউ আসতো ঘরে! মনে পড়লো অখিল বন্ধু ঘোষের গাওয়া সেই নজরুল সঙ্গীত, ‘ঝর ঝর ঝরে শাওন ধারা/ ভবনে এলে মোর কে পথহারা‘। গৃহে আলো নেই। নয়নে জল। আঁধারে দেখা যাচ্ছে না অতিথির মুখ। কল্পনাতে কত সুখ!
ভোর সাড়ে তিটনায় ঘুম ভাঙলো। অ্যালার্ম দেওয়া ছিল। যাওয়ার কথা টাইগার পয়েন্টে। উদ্দেশ্য কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা। এত সকালে কেন? কারণ স্পটে পৌঁছতে হবে সূর্য ওঠার আগে। তাছাড়া ৫ মিনিট দেরি হলে ২০০ গাড়ির পেছনে পড়তে হবে।
দার্জিলিং এর সবচেয়ে পুরনো পাইন বন এটি। একে বলা চলে ব্ল্যাক ফরেস্ট। এরকম গহীন বনে সাধারণত কেউ প্রবেশ করে না। দেহাতি পরিত্যক্ত স্টেশনের মতো শ্যাওলাধরা একটি কাঠের বেঞ্চ ছিল। সেখানেই আমাদের চিত্রবিহার!
বৃষ্টি হচ্ছিলো তখনো। তবে সারা রাত ঝরে ধারা এসেছে ধরে। বৃষ্টির কারণে তাপমাত্রা অনেকটাই নেমে এসেছিল। গরম কাপড় সঙ্গে নিলাম। হোটেলের নিচে সবাই উপস্থিত। কিন্তু আমাদের গাড়ি তখনো আসেনি। গাইড পার্থ বললেন, চলেন কিছুটা এগিয়ে যাই। হাঁটতে হাঁটতে অনেকটা পথ নিচে নেমে গেলাম। গাড়ি এলো ভোর সাড়ে চারটায়। আঁকা-বাঁকা গলি ঘুপচি দিয়ে গাড়ি ছুটছিল। রাস্তায় টাইগার হিল পয়েন্টমুখী অনেক গাড়ি। বুঝলাম, কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখার সূচিটা স্থানীয়রা পর্যটকদের ভালোই খাইয়েছেন। এখানে এসে কেউ এটা মিস করতে চায় না। তাই বৃষ্টি মাথায় নিয়েই সবাই ছুটছিল। সবার আশা, পৌঁছতে পৌঁছতে যদি বৃষ্টি থামে। যদি দেখা মেলে কাঞ্চনের। অনেকেই নাকি ১৫ দিন অপেক্ষা করেও দেখতে পাননি কাঞ্চনজঙ্ঘা। ভাগ্য ভালো থাকলে ওটা দেখার জন্য এতদূর যেতে হয় না। শীতকালে বাংলাদেশের পঞ্চগড়, দিনাজপুর, লালমনিটরহাট থেকেও দেখা যায়। আবার মেঘ-বৃষ্টির কারণে নাকের ডগায় বসেও চূড়ামনির দেখা মেলে না।
আমরা যখন পৌঁছলাম ততক্ষণে ভোরের আলো ফুটেছে। চারদিকটা পরিষ্কার। সামনে এগোনো যাচ্ছিল না। শত শত গাড়ি রাস্তার ওপর। দুই সারিতে এলোমেলো করে রাখা। জিপ থেকে নেমে দ্রুত হাঁটা শুরু করলাম। রাস্তা আর পাহাড় বেয়ে কিছুক্ষণ উঠতেই শরীরের ঠাণ্ডা ভাব চলে গেলো। অনেক মানুষ উঁচু জায়গায় দাঁড়িয়ে তাকিয়ে ছিল পূর্ব দিকে। সূর্যের দেখা নেই। যেদিকটায় তীর্থের কাকের মতো সবাই তাকিয়ে, সেদিকে মেঘ আর মেঘের ছাঁট। কিছুটা দক্ষিণে সরে গেলাম আমরা। আমাদের দেখাদেখি অনেকেই সেদিকে চলে এলো। আমরা আরও দক্ষিণে গিয়ে টাইগার হিল পয়েন্টের কাছাকাছি নিরিবিলি গিয়ে দাঁড়ালাম। ব্যাপারটা এমন হয়ে দাঁড়ালো যে, আমরা সরল পাবলিক মনে করে ওখানে না জানি আছে, যেতে হবে ওখানেই, চলে আসছিল অনেক লোক। তাই দেখার কিছু নেই ভাব করে নিরিবিলি পেলাম।
দক্ষিণে দেখতে পাচ্ছিলাম টাইগার হিল পয়েন্টের ওয়াচ টাউয়ার। ওখানে আমরা গেলাম না কেন? গাইড পার্থ জানালেন, টাইগার পয়েন্টে নির্মাণ কাজ চলছে। মাস ছয়েক পর খুলে দেয়া হবে পর্যটকদের জন্য। এখন আপাতত বন্ধ। তাহলে আমরা যেখানে এর নাম কি? এটা ডাক বাংলো পয়েন্টে। ডাক বাংলো কোথায়? অনেকটা উত্তরের শেষ মাথায়।
অসংখ্য মহিলা ডাক বাংলো পয়েন্টে কফি বিক্রি করছিলেন। ১০ টাকা রুপি। অনেকেই কফি পান করছিলেন। আমরা নিরিবিলি সরে যাওয়ার পর ওদিকটায় আর তাদের বিরক্তিকর উপস্থিতি ছিলো না। ফিরোজ আলম সেলফি স্টিকের মাথায় মোবাইল সেট করে কুয়াশা আর শিশিরের ছবি তুলছিলেন। আমি গিয়ে পাহাড়ের কিনারায় দাঁড়ালাম। একটু আগেও যে যায়গাটা পরিষ্কার ছিল, সেখানেও মেঘ গিয়ে ঢেকে দিচ্ছিল। দুই পাহাড়ের খাদ বেয়ে মেঘ চলছিল ধেয়ে, বানের জলের মতো। একটার পর একটা বনাঞ্চল ঢেকে দিচ্ছিল সাদাকালো মেঘ। জাহিদ স্যার পাশে দাঁড়িয়ে বললেন, আবহাওয়া রমনীর মনের মতো! এই ফরসা এই কালো।
সূর্য বার দুয়েক উঁকি দিয়েও আবার মেঘের গহ্বরে চলে গেলো। মেঘের সঙ্গে কুলিয়ে উঠতে পারছিলো না। কী আর করা। মালভূমির মতো একটা জায়গা ছিল। নুরুল বলছিলেন, ফুটবল বা ক্রিকেট থাকলে এখানে খেলা যেতো। আমরা সেরকম কিছু নিয়ে যাইনি। কারণ ভ্রমণে গেলে খেলার সময় হয়ে ওঠে না। একবার নিঝুম দীপে গিয়েছিলাম। বছর দুয়েক আগে। সঙ্গে ছিল ক্রিকেট সরঞ্জামের বিশাল ব্যাগ। ফুটবল। কিন্তু ঘণ্টাখানেক ক্রিকেট আর সমুদ্রের কাদাপানিতে ফুটবল নিয়ে কিছুক্ষণ দাপাদাপি ছাড়া ভালো কোনো অভিজ্ঞতা হয়নি। সেই ভয়ে এবার এসবের কথা কেউ কয়নি।
হাঁটতে হাঁটতে পশ্চিম উত্তর দিকে চলে গেলাম। সেখানে বিশাল পাইন বন। ওই সফরে পাইন গাছের প্রেমে পড়ে গিয়েছিলাম আমি। এত ঘন, সুশ্রী পাইন বন আর দেখিনি। বিশাল বিশাল বৃক্ষের আড়ালে হারিয়ে যেতে ইচ্ছে করছিল। একটা জায়গায় কাঠের বেঞ্চির মতো করা ছিল। তাতে শ্যাওলা জমে ছিল বলে ক্লান্ত থাকতেও কেউ বসছিল না। পরে অবশ্য গ্রুপ ছবির জন্য বসেছিলাম টিম ওয়ালটনের সবাই। ক্যামেরা ছিল পার্থ বাসনেতের হাতে।
দার্জিলিং এর সবচেয়ে পুরনো পাইন বন এটি। একে বলা চলে ব্ল্যাক ফরেস্ট। এরকম গহীন বনে সাধারণত কেউ প্রবেশ করে না। দেহাতি পরিত্যক্ত স্টেশনের মতো শ্যাওলাধরা একটি কাঠের বেঞ্চ ছিল। সেখানেই আমাদের চিত্রবিহার!
ফেরার সময় জনস্রোত শুরু হয়ে গেলো। সবাই একসঙ্গে ফিরছিল। হাঁটার জায়গাও নেই। রীতিমত জন্যট। এলোমেলো করে রাখার গাড়ির জন্য হাঁটাও যাচ্ছিল না। আবার গাড়িও বের হতে পারছিল না।
চলবে…
দার্জিলিঙে বৃষ্টি, কালিম্পঙে রোদ-৭॥ উদয় হাকিম