লেখক হওয়ার বাসনা ছিল ছোটবেলা থেকেই। এর কারণও সুস্পষ্ট। কিন্তু কিভাবে লেখক হতে হয়, লেখক হতে হলে কী কী প্রয়োজন, ওসব একদমই জানতাম না। জন্মের পর থেকেই শুনে আসছি, এই গ্রামে ঔপন্যাসিক আকবর হোসেনের জন্ম। বিখ্যাত লেখক। ঔপন্যাসিক ও লেখক; এই শব্দদুটির মানেও বুঝি না তখন। কিন্তু শব্দ দুটির প্রতি কেমন এক মোহ জন্মায়। একটু একটু বড় হতে থাকি, আর জানতে থাকি এই গ্রামে বাঘা যতীনের বাড়ি। তিনি বিপ্লবী ছিলেন। কিন্তু কবিতা লিখতেন। এই গ্রাম থেকে ‘সত্যাগ্রহ’ নামে পত্রিকা বের করতেন। তার বিখ্যাত মামারা লিখতেন পত্রিকাটিতে। বাঘা যতীন নিজেও লিখতেন। তার মা শরৎশশীও কবি ছিলেন। বোন বিনোদবালা কবিতা লিখতেন, প্রবন্ধ লিখতেন। তার ছোট মামা ললিতকুমার চট্টপাধ্যায় সুসাহিত্যিক। এসব ছোটবেলা থেকেই শুনতে থাকি, জানতে থাকি।
আমাদের গ্রামঘেঁষে গড়াই নদী চলে গেছে দূরের পথে। শুনি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার নিজস্ব নৌকায় এই নদী দিয়ে কতদিন গেছেন। একবার ঝড়ের কবলে পড়ে তার নৌকা আমাদের কয়া বাজারের ঘাটে নোঙর ফেলেছিল। তিনি আকবর হোসেনের পিতা হাজী আব্দুল আলী বিশ্বাসের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন। বালক আকবর হোসেন তাকে কবিতা শুনিয়েছিলেন। এসব আমাকে আকৃষ্ট করে। আমি গড়াই নদীর স্রোতে গভীর চোখ রেখে ভেবেছি, লেখক হতে চাই। কিন্তু কিভাবে পথ জানা নেই। নদীর স্রোতের মতোই আমার ভাবনা ভেসে যেতে থাকে। আরও একটু বড় হয়ে জানি, লালন সাঁই, মীর মশাররফ হোসেন, কাঙাল হরিনাথ মজুমদার, গগন হরকরা, কবি আজিজুর রহমানও আমাদের এলাকার মানুষ। মানুষের মুখে মুখে তাদের কথা, তাদের নিয়ে কত রকমের আলোচনা। আমার ভেতর সেসব নীরবে একটি পথ তৈরি করে ফেলে। আমাকে সে পথেই যেতে হবে, যে পথ লেখকের, যে পথ জীবনবোধের পথ।
লেখক হলে ভবিষ্যৎ কী? ভাত-পানি জুটবে কি না, সেসব মাথায় কাজ করে না। তবে, এটুকু তখুনি বোঝিনি, এ পথ সাধনার; এ পথ কঠিনের; এ পথ বহমান নদীর মতো; এ পথ পুষ্প বিছানো নয়, কণ্টাকাকীর্ণ।
আমি তখন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ি। তৃতীয় শ্রেণিতে। একদিন স্যাররা বললেন, ‘তোমরা কখনো লেখক দেখেছ? ওই দেখো রাস্তার ওপর আকবর হোসেন দাঁড়িয়ে আছেন। উনি একজন বড় লেখক। উনি অনেক বই লিখেছেন। ঢাকায় থাকেন।’
আমরা ছোট ছোট বাচ্চারা স্কুলের বারান্দায় এসে দাঁড়াই। স্কুল আর রাস্তার মাঝে একটা খেলার মাঠ। মাঠের ওপাশেই দাঁড়িয়ে আছেন আকবর হোসেন। কী ভেবে আমি এক দৌড়ে খেলার মাঠ পেরিয়ে আকবর হোসেনের সামনে এসে দাঁড়াই। আরও কয়েকজন তার দুপাশে দাঁড়ানো। আমি তাকে বললাম, ‘আপনি নাকি লেখক, বই লেখেন! আমাদের এই মাদার গাছ (শিমুল গাছ) নিয়ে কিছু লেখেন তো।’ খেলার মাঠের পাশেই পুরনো একটা শিমুল গাছ ছিল। আমরা সেটাকে মাদার গাছ বলতাম। তিনি হাসি দিয়ে বললেন, ‘বড় হয়ে তুমি নিজেই লেখো।’ বেশ লম্বা, খালি পা, মাথায় ব্যাকব্রাশ চুল, চোখে পুরো কালো চশমা। ছবিটা আমার মনের মধ্যে চিরকালের হয়ে গেঁথে গেলো। তিনি কী লিখেছেন, কী বই লিখেছেন; উপন্যাস গল্প কবিতা কী জিনিস; ওসব তখন আমি কিছুই জানি না। কিন্তু ‘লেখক’ শব্দটি আমার মাথার ভেতর স্রোতের মতো ঢেউখেলা হয়ে দূরের পথে ভেসে যেতে থাকে।
আমার আব্বার সঙ্গে আকবর হোসেনের ভালো সম্পর্ক ছিল। তার কাছ থেকে আকবর হোসেনের বিভিন্ন গল্প শুনে আগ্রহটা আরও বেশি করে তৈরি হতে থাকে। কিন্তু সেটি আমার কিশোর মনেই বন্দি হয়ে থাকে। ক্লাস ফাইভের বৃত্তি পরীক্ষা দিয়ে কুমারখালী থেকে বাড়িতে এসেছি। প্রায় এক সপ্তাহ পরীক্ষার জন্য কুমারখালীতে এক আত্মীয় বাড়িতে ছিলাম। বাড়িতে ফিরে নিজেকে বেশ দামি দামি মনে হচ্ছে। দামি দামি ভাবটা কিছুক্ষণের ভেতরেই শেষ হয়ে গেলো, যখন আব্বা মোটা গলায় বললেন, ‘খালোই নিয়ে বাজারে চল।’ সেদিনই মাত্র বাড়িতে ফিরেছি, এসেই বিকেলে বাজার টানার দায়িত্ব পড়লো আমার ওপর। কী আর করা! বাবা তো তখন সম্রাট! বাজার থেকে খালোই ভর্তি বাজার নিয়ে একটুখানি পথ আসতেই আমি থমকে দাঁড়াই। একজন ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে গ্রামের মান্যব্যক্তিত্ব দুর্গা ঠাকুরকে বলছেন, ‘আপনি গ্রামে কেন থাকেন? আপনি অনেক জ্ঞানী মানুষ। ভালো ইংরেজি জানেন। ঢাকায় আপনার মতো মানুষের অনেক দাম। আপনি ঢাকায় চলে আসেন। আপনার একটা ভালো ব্যবস্থা হয়ে যাবে।’ আমি ভদ্রলোকটিকে দেখি। তার দিকে গভীরভাবে তাকাই। এ তো সেই মানুষটি; দুই বছর আগে আমি তাকে দেখেছি; এই মানুষটিই তো আকবর হোসেন। বই লেখেন।
আমি ধীর পায়ে ধীরে ধীরে চলে আসি, মানুষটাকে কেমন যেন আলাদা মনে হয়, বারবার কেন যেন তাকে দেখতে ইচ্ছে করে। খানিকটা এসে পেছন ফিরে তাকাই। তাকে আমার কিছুই বলা হয় না। দুর্গা ঠাকুরকে বলা তার কথাগুলো আমার কানে ভাসতে থাকে। কত মানুষের কথাই তো প্রতিদিন শুনি, এভাবে তো আমাকে টানে না, আমার ভেতর তো এভাবে কারও কথা গভীরভাবে রেখাপাত করে না। তাহলে লেখক কি আলাদা কোন সত্তা? আলাদা ধরনের কোনো মানুষ? এ জন্যই কি মানুষ লেখকদের এত সম্মান করে? মানুষ আর লেখক কি আলাদা কিছু? কত কত প্রশ্ন আমার ভেতর খেলা করে। আবার, আমার পিতামহ আবদুল গণি শেখ মুখে মুখে ছড়া তৈরি করতে পারতেন; আমাকে শোনাতেন; আমি অভিভূত হয়ে শুনতাম। লেখকদের প্রতি তার বিশেষ দুর্বলতা ছিল। নিজের গ্রামের ছেলে আকবর হোসেন লেখক হয়েছেন বলে তিনি খুব গর্ব করতেন। এটা আমাকে খুব আন্দোলিত করতো এবং ভাবাতো। এসব কারণে লেখক হওয়ার একটা স্বপ্ন তৈরি হয় নিজের ভেতর।
ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হওয়ার জন্য পঞ্চম শ্রেণি পাসের সনদ লাগে। আমার মনে হলো, বাবা-মায়ের দেওয়া যে নাম, এ নামটা লেখক হওয়ার জন্য যুতসই নয়। নামটা পাল্টাতে হবে। বড় ভাইয়ের নামের সাথে মিল করে আমার নানি নাম রেখেছিলেন ‘রুতুব উদ্দিন শেখ’। আমি হেড স্যারকে অনুরোধ করে আমার নামের খানিকটা পরিবর্তন করে ফেলি। ‘রুতুব’-র জায়গায় ‘রকিব’ করি। বাড়িতে এটা কয়েক বছর গোপনই থেকে যায়। হাইস্কুলে ভর্তি হওয়ার পরে স্কুলের লাইব্রেরিতে যত বই ছিল, একে একে সব পড়তে থাকি। মনে আছে, স্কুলের বেতন না দিয়ে কাজী নজরুল ইসলামের ‘দোলনচাঁপা’ কিনেছিলাম। তখন আমার শিক্ষক ছিলেন শ্যামলেন্দু বিশ্বাস। জীববিজ্ঞান পড়াতেন। কুষ্টিয়া থাকতেন। কুষ্টিয়া থেকে প্রতিদিন আসতেন। স্যারকে টাকা দিয়ে অনুরোধ করেছিলাম, বইটি কিনে দেওয়ার জন্য। স্যার অনুরোধ রেখেছিলেন। তিনি খানিকটা অবাকও হয়েছিলেন কবিতার প্রতি আমার আগ্রহ দেখে। অনেকদিন সেই বইয়ের ভেতর আমি বুঁদ হয়েছিলাম। একটু একটু করে কবিতা লিখতে থাকি। স্কুলের একুশের অনুষ্ঠান উপলক্ষে একটি কবিতা লিখলাম। কিন্তু সংকোচে কাউকে বলতে পারি না, দেখাতে পারি না। আমার চাচা আবুসালেহ (চয়েন), আমরা সমবয়সী। আমার এক ক্লাসে নিচে পড়তেন। তাকে বললাম। তিনি তো বহুত খুশি হয়ে বললেন, দেখি কী লিখেছিস। আবু সালেহ চাচা একরকম জোর করেই কবিতাটা নিয়ে পড়লেন। বললেন, ‘আরে এটা আমি অনুষ্ঠানে পড়বো।’ করলেনও তাই। অনুষ্ঠানে কবিতাটা পড়ার পরে সবাই আমাকে বেশ গুরুত্ব দিতে থাকে। স্যাররাও ভালো বললেন। বাড়িতেও কিভাবে এই খবর চলে গেলো। আমি যখন বাড়িতে গেলাম, আমার আব্বা খুশি হয়ে বললেন, ‘কী বলে লিখেছিস! সবাই তো ভালো কচ্ছে।’ মায়ের চোখেও খুশির আলো। আবু সালেহ চাচাও মুখ বড় করে প্রশংসা করতে লাগলেন। মনে মনে ভাবি, ‘লেখক আমাকে হতেই হবে।’ কিন্তু আমার নিজের নামটা নিয়ে আমার ভেতর খুঁতখুঁতে ভাবটা খুব জ্বালাচ্ছিল।
কুষ্টিয়া শহর তখন আজকের মতো এত কাছের নয়। যোগাযোগ ব্যবস্থা সে রকম নয়, অত রাতে মাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার কোনো উপায় নেই। বুলবুল (রুস্তম আল বুলবুল) ঘুম ঘুম চোখে উঠে এসে আমার পাশে বসে। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। আমাদের মুখে কোনো কথা নেই। পাথর ভারী হয়ে বসে আছি।
এদিকে খেলোয়াড় হতেও ইচ্ছে করে। লেখাধূলায় তখন আমাকে দুচার দশগ্রামের লোক চেনে। এসএসসি পরীক্ষার আগে ফরম পূরণের সময় সুযোগটা এলো। একা তো নাম পরিবর্তন করা যাবে না। স্যাররা রাজি হবে না। সেকারণে কয়েকজন বন্ধুকে বুঝাই, আমাদের নামগুলো সুন্দর না। নাম একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বন্ধুরা রাজি হয়ে গেলো। কথা যা কাজও তাই। ফরমে ‘রকিব উদ্দিন শেখ’ বাদ দিয়ে ‘রকিবুল হাসান’ লিখি। মৌলভী ইউনুস আলী স্যার ক্ষীপ্ত হয়ে বললেন, এটা কি করলি? রকিবুল ইসলাম করলি না কেন? আমি কোন উত্তর না দিয়ে চুপ থাকি। কারণ আমি যা করতে চেয়েছি, সেটা করতে পেরেছি। দিনে দিনে আমি রকিবুল হাসান হয়ে উঠি। আমার মা এটা একদিন শুনে বললেন, ‘তুই রকিব হলি কবে?’ আমি মায়ের কথায় উত্তর না দিয়ে হাসতে থাকি। ভাবি, আমি তো লেখক হবো, আমার তো একটা ভালো নাম দরকার। তোমাদের দেয়া নামটাতে আমার চলবে না। একথা মাকে বলা হয় না। নিজের মনের ভেতরই থাকে।
আমাদের পরিবারে আচমকা ভয়ঙ্কর এক ঝড় এলো। সেই ঝড়ের কোনো পূর্বাভাস ছিল না। সন্ধ্যায় মায়ের সঙ্গে গল্প করে বাজারে যাই আড্ডা দিতে। সেসময় আমার এসএসসি পরীক্ষা হয়ে গেছে। রেজাল্ট হওয়ার সময় প্রায় ঘনিয়ে এসেছে। কয়েকদিন পরেই রেজাল্ট বেরুবে। আমার মায়ের খুব ইচ্ছে, আমি যেন এসএসসিটা পাস করি; ফার্স্ট ডিভিশন সেকেন্ড ডিভিশন থার্ড ডিভিশন যাই হোক। তার চাওয়া, আমি যেন পরীক্ষায় পাস করি। আমি যতই বলি, মা আমি তো ফার্স্ট ডিভিশন পাবো, লেটার মার্ক পাবো। আমার ওসব কথায় মায়ের কোনো গুরুত্ব থাকে না। তার এককথা, ‘বাপ, আমি তোর পাসটা দেখতে চাই।’ আমি কথা বাড়াই না। রেজাল্টের অপেক্ষায় থাকি। মা-ও অপেক্ষায় থাকেন। কবে রেজাল্ট হবে! ৯ মে ১৯৮৪ সাল। ৮ মে’র দিবাগত রাত। সারাদিন শিলাইদহে রবিঠাকুরের জন্মজয়ন্তিতে আনন্দ উৎসব করে সন্ধ্যা ছুঁই ছুঁই বাসায় ফিরি। মায়ের হাতে দ্রুত খেয়ে কয়া বাজারে ছুটি; গড়াই নদীর তীরে; পানসি নৌকার ছৈয়ে বসে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতে। আর জরুরি একটা কাজা আছে। এসএসসি পরীক্ষার পরে শখ করে প্রাইভেট পড়াতাম। সেই টাকায় মায়ের জন্য পেডিকোট ব্লাউজ তৈরি করতে দিয়েছি। আমি নিজে মায়ের জন্য লাল রঙের কাপড় পছন্দ করে দিয়েছি। নীরা দর্জি কাকা আজ সেগুলো দিতে চেয়েছেন। মা এসবের কিছুই জানেন না। আমি আজ রাতে মাকে চমকে দেবো। আমার ভেতর আনন্দগুলো গড়াই নদীর ঢেউয়ের মতো ডুবসাঁতার খেলতে থাকে।
আমি রাত নটা/দশটার দিকে মায়ের জন্য শাড়ি কিনে, নীলা দর্জি কাকার কাছ থেকে পেটিকোট ব্লাউজ নিয়ে বগলে চেপে ধরে সার্থক রাজপুত্রের মতো গর্বে বাড়িতে ফিরতে থাকি। কিন্তু হায়রে জীবন! হায়রে নিয়তি! বাড়ি ফিরে মাকে আমার দেখা হয় না। মাকে চমকে দেওয়া হয় না। মায়ের হাতে তুলে দেওয়া হয় না আমার স্বপ্নের শাড়ি পেটিকোট ব্লাউজ। মা ঘরের ভেতর মৃত্যু যন্ত্রণায় ছটফট করছেন। ডা. রব্বেল মামা মায়ের চিকিৎসা করছেন। ছোট ভাই-বোন ঘুমোচ্ছে। কেউ কেউ জেগে আছে; তারা কিছুই বুঝতে পারছে না; কী ঘটতে যাচ্ছে আমাদের জীবনে! কী ভয়ঙ্কর ঝড় আমাদের সব স্বপ্নকে হত্যা করার জন্য উদ্যত বিষধর ফণা তুলেছে। তখন রাত গভীর। কুষ্টিয়া শহর তখন আজকের মতো এত কাছের নয়। যোগাযোগ ব্যবস্থা সে রকম নয়, অত রাতে মাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার কোনো উপায় নেই। বুলবুল (রুস্তম আল বুলবুল) ঘুম ঘুম চোখে উঠে এসে আমার পাশে বসে। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। আমাদের মুখে কোনো কথা নেই। পাথর ভারী হয়ে বসে আছি।
সারাবাড়ি থমথমে। তবু আশা, ডাক্তার মামা চেষ্টা করছেন; মা নিশ্চয় ভালো হয়ে উঠবেন। কিন্তু মামা কোনো কথা না বলে চুপ করে বের হয়ে গেলেন। আব্বা বললেন, ‘কী রে রব্বেল তোর বু’র কী অবস্থা?’ মামা কোনো উত্তর না দিয়ে মাথা নিচু করে চলে গেলেন।
একটু পরেই মায়ের ঘর থেকে চিৎকার করে কান্না এলো, আমাদের মা নেই। ছোট ছোট ভাই-বোন ঘুমের ভেতর থেকেই যেন এই আর্তনাদ শুনতে পেলো। সবাই মা মা বলে চিৎকার করে কেঁদে ওঠে। বুলবুল দুহাত বাড়িয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরে আর্তনাদ করে কেঁদে উঠে বললো, মেজো ভাই, আমার মা কই? গোটা বাড়ি আর্তনাদে আর্তনাদে কান্নায় ভেঙে পড়ে। মুহূর্তে গভীর বেদনায় গোটা গ্রাম আমাদের বাড়িতে আছড়ে পড়ে। ছোট বোন রিক্তা আর সবার ছোট মিলন (মিলন হাসান); ওদের তখনো বোঝার শক্তি হয়নি; মৃত্যু কী! আমরা সব ভাইবোন প্রাণহীন নিথর শরীরের মাকে জড়িয়ে ধরে নদীর পাড় ভাঙার মতো তার শরীরে ভেঙে পড়ি। এই বেদনা থেকে আমি কোনোদিন বেরুতে পারিনি। মাকে বড় অসময়ে হারানোর অবর্ণনীয় শত সমুদ্র গভীর বেদনায় আমি কবিতা বানাতে থাকি; চোখের জলে বুকের ব্যথায়; নিদ্রাহীন বহু রাত। কবিতাকেই বেছে নেই নিজের কষ্ট নিজের দুঃখ নিজের আর্তনাদ নিজের বেদনা প্রকাশের আশ্রয় হিসেবে। সেটা কবিতা হচ্ছে কি না, কবিতা হয় কি না; সেসব ভাবিনি; ভুল ছন্দ কিংবা ভুল মাত্রা সেসবের থেকে বড় হয়ে ওঠে কবিতার ভেতর আমি আপন বেদনাকে প্রকাশ করতে পারি; কবিতার ভেতর নিজেকে হারাতে পারি। লেখক যতটুকু হতে চাই, নিজেকে বাঁচানোর জন্য তার চেয়ে বেশি প্রয়োজন অনুভব করি লেখালেখির। কারণ লেখালেখির ভেতর আমি আমাকে হারিয়ে ফেলতে পারি; নিমগ্ন হতে পারি। আমাকে হারিয়ে আমি আমাকে বাঁচাতে পারি; আমি বাঁচলেই আমার ভাইবোন বাঁচবে। পরিবারের চরম এক ভাঙনের মুখে দাঁড়িয়ে বুঝতে পারি, আমার ভাইবোনকে বাঁচানোর জন্য; সাহিত্যশিল্পকে আঁকড়ে ধরে শুদ্ধ মানুষ হওয়া ছাড়া আমার আর কোনো বিকল্প ছিল না।
বিরতি টানলেই যে নদীর মতো এ পথ চলারও একরকম মৃত্যু ঘটে; সেটুকু অনুভব করতে পারি। ফলে লিখছি; লিখে যাচ্ছি; কোথায় যাচ্ছি; কত দূর যাচ্ছি; কত দূর যেতে হবে; কত দূর যেতে পারবো: এসব একেবারেই অজানা। একটা ব্রত নিয়ে আছি; এটুকুই।
পাবনা সরকারি শহীদ বুলবুল কলেজে ইন্টারমিডিয়েট অধ্যয়নের সময় প্রখ্যাত কবি ওমর আলীকে আমার শিক্ষক হিসেবে পাই। তার স্নেহধন্য হয়ে উঠি। লেখক হওয়ার বাসনা তার আলোয় আরও পরিষ্কার হয়ে ওঠে। এরপর শিক্ষক হিসেবে পাই প্রখ্যাত গবেষক আবুল আহসান চৌধুরী ও খ্যাতিমান কবি অনীক মাহমুদকে। কবি ও ছড়াকার নাসের মাহমুদ, কবি-গল্পকার আখতারুজ্জামান চিরু ও কুষ্টিয়ার কবি খৈয়াম বাসারের প্রেরণা ও অবদান শ্রদ্ধাচিত্তে স্মরণ করি। কুষ্টিয়াতে সাহিত্যচর্চায় এঁরা আমার অভিভাবক ছিলেন। ঢাকায় এসে প্রগতিশীল রাজনীতির এক সময়ের মেধাবী ছাত্রনেতা ও শিল্পোদ্যোক্তা এএসএম কামাল উদ্দিনকে ব্যক্তি জীবনেরই শুধু নয়, লেখালেখি জীবনেরও অভিভাবক হিসেবে পাই। আমার চিন্তা-চেতনায় তিনি দারুণভাবে প্রভাব বিস্তার করে লেখালেখিকে আরও অর্থবহ করে তুলতে অসামান্য ভূমিকা রেখেছেন, যেটা এখন প্রবহমান নদীর মতো আমার জীবনে বহমান। জীবন চলার পথে খ্যাতিমান অনেক কবি-সাহিত্যিকের বিশেষ স্নেহভাজন হওয়ার পরম ভাগ্য আমার হয়েছে। তাদের পরম সান্নিধ্য আমাকে লেখক হয়ে উঠতে বিশেষ ভূমিকা রেখেছে।
আমাদের এলাকায় বিখ্যাত বিভিন্ন কবি-সাহিত্যিকের জন্ম ও তাদের বিভিন্ন রকমের সংযুক্ততা এবং আমার ব্যক্তিগত বেদনাবোধ আমাকে লেখক হয়ে উঠতে প্রভাবিত করেছে যেমন সত্য, তেমনি এলাকার বিখ্যাত অনেক ব্যক্তি অমূল্যায়িত ছিলেন, অবহেলিত ছিলেন। যেমন বিপ্লবী বীর বাঘা যতীন, ঔপন্যাসিক আকবর হোসেন, ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে চ্যাটার্জি পরিবারের অবদান, গীতিকার মাসুদ করিম, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, শহীদ আলিমুদ্দিন মোল্লার পরিবার; এদের নিয়ে সেভাবে কোনো কাজ আমাদের এখানে হয়নি। আমি চেতনা ও দায়িত্ববোধ থেকে তাদের নিয়ে কাজ করেছি। লেখক না হলে এ বোধ হয়তো আমার ভেতর কাজ করতো না। তারাই পরোক্ষভাবে হয়তো আমাকে লেখক হয়ে উঠতে প্রবলভাবে ভূমিকা রেখেছেন।
শেষে যে কথাটি বলতেই হবে, অনার্স পড়ার সময় মিলি (খুর্শিদা বারী মিলি)-র সঙ্গে আমার পরিচয় ঘটে। এরপর সময়ের সিঁড়ি ধরে আমাদের বন্ধুত্ব-সম্পর্ক গড়ে ওঠে। তিনি আমাকে যেভাবে প্রেরণা দিয়েছেন, যেভাবে আমার লেখালেখিকে গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করে উৎসাহ দিয়েছেন, পাশে থেকেছেন, জীবনে জড়িয়েছেন, আমাকে এতেটা লালন না করলে, হয়তো প্রবল ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও লেখালেখির সুদীর্ঘ কণ্টকাকীর্ণ এই পথে এভাবে বিরতিহীন হাঁটা সম্ভব হতো না। এটা আমার জীবনে অভাবনীয় একটি প্রাপ্তি।
লেখক হতে পেরেছি কি না, জানি না। তবে এ পথ যে কঠিনের চেয়েও কঠিন, বহমান নদীর মতো অবিরত চলতে হয়; বিরতি টানলেই যে নদীর মতো এ পথ চলারও একরকম মৃত্যু ঘটে; সেটুকু অনুভব করতে পারি। ফলে লিখছি; লিখে যাচ্ছি; কোথায় যাচ্ছি; কত দূর যাচ্ছি; কত দূর যেতে হবে; কত দূর যেতে পারবো: এসব একেবারেই অজানা। একটা ব্রত নিয়ে আছি; এটুকুই।