মুগ্ধযাত্রা
– এই মেয়ে? লিখছ না কেন? কী দেখছ বাইরে?
মেয়েটিকে এই ধমক বিন্দুমাত্র বিচলিত করলো বলে মনে হলো না। দৃষ্টির মুগ্ধতা তার কণ্ঠেও ছড়িয়ে গেলো।
– বক দেখছি স্যার। দেখুন কী সুন্দর সাদা সাদা বক!
পরিদর্শক অবাক।
– তুমি জানো তুমি কী পরীক্ষা দিচ্ছ?
– কেন জানবো না স্যার? বৃত্তি পরীক্ষা দিচ্ছি।
– গুড। তাহলে? পরীক্ষার হলে না লিখে তুমি বক দেখছ?
– আমার তো লেখা শেষ।
– দেখি তো কী লিখেছ।
মেয়েটি অনিচ্ছা সত্ত্বেও খাতাটা এগিয়ে দিলো। পরিদর্শক খাতাটি দেখতে গিয়ে পেছনের পৃষ্ঠায় একটি লেখা আবিষ্কার করে হা হয়ে গেলেন।
– তুমি অঙ্ক খাতায় ছড়া লিখেছ কেন?
-স্যার ,বক দেখে মনে এলো। তাই লিখে রাখলাম।
-মানে কি! এটা তুমি লিখেছ! তোমার ছড়া!
– জি স্যার। পরে তো ভুলে যাবো। তাই লিখে রাখলাম।
– কিন্তু এ খাতা তো তোমাকে জমা দিয়ে দিতে হবে। তখন?
-ওহ ! তাই তো! তা তো ভাবিনি স্যার।
পরিদর্শক খাতাসহ মেয়েটিকে নিয়ে এলেন হেড মাস্টারের কক্ষে। হেড মাস্টার মেয়েটিকে আগে থেকেই চিনতেন। পরিদর্শক মেয়েটিসহ কক্ষে ঢুকতেই তিনি খুব অবাক হলেন। কারণ মেয়েটিকে তিনি অপরিমেয় স্নেহ আর ভালোবাসা দিয়েছেন এতদিন। এলাকার সবাই মেয়েটিকে চেনে এক ভদ্র, মেধাবী আর ভাবুক মেয়ে হিসেবে। শুধু তাই নয়, এলাকার প্রতিটি মানুষের কাছে মেয়েটি অনেক আদরের। সেই মেয়েটি কী এমন অপরাধ করতে পারে, যে কারণে পরীক্ষা কেন্দ্র থেকে খাতাসমেত তাকে এখানে আনা হলো?
মায়া সময়
সময়টা একাশি বা বিরাশি সনের দিকে বাবা অফিস থেকে বাসায় ঢুকে গম্ভীর মুখে বসে আছেন। ছোট্ট থানা শহর মঠবাড়িয়ায় বাবার পোস্টিং। পরিবার থেকে দূরে না থাকা বাবা আমার বেশ চিন্তায় পড়লেন আমাদের নেবেন কী নেবেন না, এ নিয়ে। যাই হোক, অবশেষে মঠবাড়িয়ায় আমাদের এক নতুন জীবন শুরু হলো। চারদিক কেমন সবুজ আর সবুজ। মায়া মায়া একটা ভাব। সকালে ঘুম থেকে উঠে এক দৌড়ে বাড়ির ছাদে। কী আশ্চর্য সুন্দর! দোতলা বাড়ির পেছনে এক পাশে মস্ত পুকুর। পাড়ঘেঁষেই একটা কৃষ্ণচূড়া আর একটা সোনালু ফুলের গাছ ঝুকে আছে পুকুরের অর্ধেকটা জুড়ে। গাছের ছায়া মেখে পুকুরের জল ডুবে আছে লাল হলুদের পাপড়িতে। দেখে মনে হয় লাল হলুদ ছাপা শাড়ি পেঁচিয়ে আছে কোন গায়ের কিশোরী মেয়ে! একট চিকন মেঠোপথ মাঝখানে রেখে পুকুরের পুরো ডান দিকটাজুড়ে সবুজ আর সবুজ ধানক্ষেত। আর বাম দিকে আমাদের বাড়িটার পাশেই এক বিশাল ফলের বাগান। আমের বাগান থেকে ফলবতি আমগাছগুলোর কয়েকটা আমাদের ছাদে ঝুঁকে আছে। কী আনন্দযজ্ঞ চারিদিকে! কী অদ্ভুত সুন্দর! কী প্রাণময়! আমি সারাদিন আর ছাদ থেকে নামলাম না। বাড়ির সামনে বিশাল বাঁশবাগানের মাথায় একচিলতে চাঁদ দেখে জীবনে প্রথম কবিতার চিত্ররূপ দেখতে পেলাম, ‘বাঁশ বাগানের মাথার উপর চাঁদ উঠেছে ওই।’
খুব অসহায় বোধ করলেই মনে পড়ে সেই নমস্যজনদের উৎসাহ, মনে পড়ে ফেলে আসা সেই রোদ, মেঘ আর সবুজের কথা, মনে পড়ে বাবা-মায়ের আশায় ভরা চোখ।
প্রকৌশলী বাবা আর সাহিত্যানুরাগী মা-দুই বিপরীতমুখী স্রোতের এক মোহনায় মিলে যাবার দারুন দৃশ্য দেখে দেখে বড় হয়েছি আমি ও আমার ভাই। মা টুকটাক লিখতেন। তাতে বাবার উৎসাহ ছিল অপরিমেয়। আর বাবার সব খটোমটো প্রকৌশল বিদ্যার বই রিডিং রুমে কোথায় রাখা তা বাবার চেয়ে মা-ই ভালো জানতেন।
এ পর্যন্ত পড়ে অনেকেই ভাবতে পারেন লেখক হয়ে ওঠার গল্পে এসব কেন। আসলে আমি শুধু একটি শিশুর পারিবারিক ও পারিপার্শ্বিক অবস্থা বোঝাতে চাইছি, যা তার মনোজগৎ বিস্তৃত বা সংকীর্ণ করতে বিশাল ভূমিকা রাখে। বেড়ে ওঠা সময়ের আঁচড় হয় তার মনোজগৎকে রক্তাক্ত করবে নয় দারুণ এক ছবির অবতারণা করবে। আমার চারপাশে এমন এক সতেজতা ছিল যা আমাকে শিশিরসিক্ত করতো। জগৎসংসারের এই অনুষঙ্গই আমায় চলতে শিখিয়েছে সব সত্য, সুন্দর, সততা, স্বপ্ন ও সংকল্পের সঙ্গে; দেখিয়েছে সম্ভাবনা, বুঝিয়েছে সম্প্রীতি। আজ আমরা নিজগৃহে পরবাসী। আকাশ ছুঁতে পারি, তবু এক বাড়ির এক ঘর থেকে আর একঘরের মানুষকে ছুঁতে পারি না। অথচ তখন পুরো পাড়াটাকেই আমার একটা বাড়ি মনে হতো। ভরদুপুরে গল্প শোনাবার ছলে যেকোনো বাড়ির দাদু নানুরা ডেকে নিতেন। সবাইকে গল্প শোনানোর ছলে এক খাটে শুইয়ে দিতেন। গল্প শেষের আগেই ঘুম। এখন মাঝে মাঝে ভাবি, আমরা কতটা ছোট ছিলাম যে, এক খাটে সাত আট জন ঘুমিয়ে পড়তে পারতাম অবলীলায়! আর এখন কত বড় হয়েছি যে, এক খাটে একা ঘুমিয়েও হয় না। নাকি আমাদের উন্নাসিকতা, দাম্ভিকতা, হীন মানসিকতা এতই বড় হয়েছে যে, মানবিকতা আর সহমর্মিতারা খাটের মতোই ছোট হয়ে যাচ্ছে?
সাধুসঙ্গ
এবার শুরু করেছিলাম যেই গল্প দিয়ে সেখানেই ফিরে যাবো। পরিদর্শক যখন খাতাটা হেড স্যারকে দেখালেন, তখন দুজন কী সব আলাপ করে বাবাকে ফোন দিলেন। আমার ক্ষুদ্র জ্ঞানে কিছুতেই বুঝতে পারছিলাম না, কী এমন অপরাধ করেছি, যার জন্যে অভিভাবকও ডাকতে হচ্ছে। আমার ভীত-সন্ত্রস্ত চেহারা দেখে হেডস্যার আর পরিদর্শক স্যার দুজনেই খুব আশ্বস্ত করছিলেন। কিন্তু যতই সান্ত্বনা দিক, আমার ভেতরের অস্বস্তি কী করে কাটাই? যাই হোক বাবা এলেন। এরই ফাঁকে পরিদর্শক স্যার আমার কাছে জানতে চাইলেন আমি এমন করে আরও লিখেছি কি না। আসলে অনেক কিছু দেখে বিভিন্ন সময় নানা ছন্দ ঘুরতো মাথায়। এ যে ছন্দ তখন তাও বুঝতাম না। তবে মিলিয়ে মিলিয়ে কথা বলার অভ্যেস ছিল বলে বাবাই একদিন লিখে রাখার বুদ্ধিটা মাথায় ঢুকিয়েছিলেন। কিন্তু তাই বলে যে তা পরীক্ষার খাতায় লিখে রাখা যায় না, তা আমার ক্ষুদ্র মাথায় ঢুকবে কেন?
-স্যার এটা লেখায় কি খুব অপরাধ হয়েছে?
আমার চোখ তখন ছলছল। আমার এহেন অসহায় অবস্থা দেখে হেড স্যার আর পরিদর্শক স্যার দুজন সস্নেহে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন।
-না রে মা। কোনো অপরাধ করিসনি। বরং লিখে রেখে খুব ভালো কাজ করেছিস। কিন্তু কী করে এত সুন্দর ছন্দে লিখলি? কে শেখালো তোকে? তোর বাবাকে ডেকেছি শুধু এইটুকু অনুরোধ জানাতে যেন সে তোর লেখালিখির দিকে বিশেষ নজর দেন। এ বিষয়ে তাকে আমার জানানো প্রয়োজন বলে মনে করছি। আর লেখাটাও তাকে দেওয়া দরকার। তোর প্রথম লেখা।
আমি হতবাক হয়ে চেয়ে রইলাম স্যারের দিকে। পরিদর্শক স্যার আদর করে বললেন, ‘যেদিন অনেক বড় লেখক হবি, সেদিন আমাদের কথা মনে পড়বে তোর। নিশ্চিত জানি তুই অনেক বড় লেখক হবি।’
এই ৪ লাইন লেখা নিয়ে সবাই এত কথা কেন, বলছে বুঝতে পারিনি সেদিন। আজ পাঠকের উদ্দেশ্যে সেই চার লাইনের জীবনের প্রথম লেখাটি নিবেদন করলাম।
দূর বনে বক
ধবল পালক,
উড়ে উড়ে যায়
হায় রে কোথায়।
সেদিন রাতেই বাবা আমার জন্যে এক সঙ্গী নিয়ে এলেন। সে যে সত্যিই আমার এত ভালো বন্ধু হয়ে যাবে বুঝতে পারিনি। বন্ধু,আপনজন সবাই সময়ের প্রয়োজনে রূপ বদল করে। ও তেমনি রয়ে গেছে আমার জীবনে। আমার একলা রাতের কথা বন্ধু। সেই থেকে লিখেই চলেছি। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, চাকরি জীবন, ঘর, সংসার মোট কথা যাপিত-জীবনের প্রতিটি অধ্যায়ে আমি চেষ্টা করেছি লিখে যেতে। কখনো হোঁচট খেয়েছি, বাধা পেয়েছি। তবু থেমে যাইনি। খুব অসহায় বোধ করলেই মনে পড়ে সেই নমস্যজনদের উৎসাহ, মনে পড়ে ফেলে আসা সেই রোদ, মেঘ আর সবুজের কথা, মনে পড়ে বাবা-মায়ের আশায় ভরা চোখ। আমি সাহস সঞ্চয় করি। আবার উঠে দাঁড়াই। চলতে শুরু করি।
ছোটবেলায় খেলতে চাইলেই বাবা বলতেন, লেখ্ না। লেখাও তো একরকম খেলা। শব্দ আর মাত্রার খেলা। আমি চুপ করে শুনতাম। মৃদু হেসে বলতেন, ‘বুঝলি না তো, দুর্গা?’ একার-আকার ঠিক রেখে শব্দ দুটি পালটে দে তো। দেখবি দিব্যি খেলা হয়ে গেছে৷ এবার সেই উলটো শব্দে আকার-একার পালটে দিয়ে দেখ। লেখাটা তখন সোজা খালে পড়ে যাবে। কারণ শব্দ মাত্রা সবই তো উলটে দিয়েছিস। আর শব্দ ঠিক রেখে মাত্রাটা নিয়ে যদি তেমন করে খেলতে পারিস, তাহলে কী হবে, ভেবেছিস ?
কী হবে বাবা? উৎসুক হয়ে প্রশ্ন করতাম। বাবা বলতেন, ওই লেখাই লাখে একটা হয়ে যাবে৷
আমি সেই লাখে একটা লেখার সাধনা করছি বাবা। পেলে ভালো, না পেলেও দুঃখ নেই। বাবার সঙ্গে নতুন করে নতুন ভুবনে লেখা লেখা খেলা হবে ফের। জাদুর ট্রাংক লিখতে গিয়ে কতবার মনে হয়েছে , তুমি যদি পড়ে জানাতে, তোমার দুর্গা আদৌ শব্দ আর মাত্রা নিয়ে খেলতে শিখলো কি না।
যে আমারে দেখিবারে পায় অসীম ক্ষমায়
সুসাহিত্যিক জয়া মিত্র আমার ‘জাদুর ট্রাংক ও বিবর্ণ বিষাদেরা’ গল্পগ্রন্থটি কেমন করে পেয়েছিলেন, জানি না। পরে দেখি কলকাতার এক দৈনিকে বইটি সম্পর্কে লিখেছেন ,‘‘জাদুর ট্রাংকে মাটিলগ্ন মানুষের উঠে দাঁড়ানোর শক্তির কথা আছে । আছে আশপাশের সেই ‘মাটি’র কথা বলার সৌকর্যও।’’ আমার লেখা নিয়ে নিজে বরাবরই অস্বস্তিতে থাকি। একেকবার মনে হয় কিছুই হয়নি। প্রচুর কাটাকুটি করি। আবার নতুন করে শুরু করি।
এরাই আমার চলার শক্তি, লেখার অনুপ্রেরণা, বলার গৌরব। বেলা কি দ্রুত ফুরিয়ে যায়? তবু আর একবার যদি যাওয়া যেতো সেই প্রকৃতির সন্তানদের কাছে।
এলান পো-এর ‘Rhythmical creation of beauty’র কথা মনে পড়ে। এই রিদম, বা বলতে পারেন একটা ঘ্রাণ যে লেখক তার লেখার মধ্য দিয়ে পাঠক অব্দি পৌঁছে দিতে পারলেন তিনি পাঠকের সঙ্গে তত বেশি সংযোগ স্থাপনে সার্থক হলেন। আমি গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ যাই হোক, তাকে তেমন করেই দেখতে চেয়েছি সবসময় আর চেয়েছি যে যেমন করে আলো ফেলবে, সে যেন তেমন করেই লেখার রঙটা ধরতে পারে। যেমন পিকাসোকে একবার জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, ‘গুয়ের্নিকায় এই দুই প্রাণী কিসের প্রতীক?’ তিনি বলেছিলেন, ‘এই ষাঁড় হচ্ছে ষাঁড় আর ঘোড়া হচ্ছে ঘোড়া। আমার ছবিতে যদি আপনি এর অন্য কোনো অর্থ খুঁজে পান…তা হয়তো সত্যিও হতে পারে, তবে আমি এর কোনো অর্থ জুড়ে দিতে চাইনি। আমি শুধু পেইন্টিংটাই করতে চেয়েছি। যে বস্তু যেমন আমি তেমনই এঁকেছি।’ আমিও ঠিক তেমন করে লিখে লিখেই পাঠকের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের চেষ্টা করে যাচ্ছি মাত্র।
ছেলেবেলার উৎসাহ ছিল পুরস্কারপ্রাপ্তি। গল্প,কবিতা,ছড়া, যেকোনো কিছু লিখে পুরস্কার পেলেই মনে হতো আমি পেরেছি। এখনো যেকোনো স্বীকৃতিতে আনন্দ পাই বটে। তবে, অনুভবের জায়গা থেকে সতর্ক হই। আরও দায়বদ্ধ হই। ক্ষুরধার আর যোগ্য মস্তিষ্কের সমালোচনাকে মাথায় করে রাখি। তারাই আমার সত্যিকারের শিক্ষক। এই লেখাই এনে দিয়েছে অসংখ্য মানুষের ভালোবাসা। এই লেখার মাধ্যমেই খুঁজে পেয়েছি কিছু অসাধারণ বন্ধু। আমি কৃতজ্ঞ প্রত্যেকের কাছে।
লিখতে চেয়েছিলাম আমার লেখক হয়ে ওঠার গল্প। সত্যি বলতে কী, লেখক হওয়ার কিছুমাত্র যোগ্যতা আজও অর্জন করতে পারিনি। লিখতে গেলেই মনে হয়, আরও পড়া দরকার। আর পড়তে গেলে মনে হয় কিছুই তো জানি না। কত কিছু জানার বাকি রয়ে গেলো। না জেনে লিখি কী করে? মনের মাধুরী মেশানো যে ছবি তাকে পরিচ্ছন্ন করে প্রকাশ না করলে পুরো চিত্রকল্পই যে তার সৌন্দর্য হারাবে। তবু মন মহাশয় মাঝে মাঝে অবাধ্য হয়। অতৃপ্তিতে ভর করেই তখন হাতে কলম তুলি। ভাবি, হলোই না হয় কিছু রেখাপাত। এই এলোমেলো শব্দসম্ভার জড়ো হতে হতে ফুটিয়েও ফেলতে পারে কোনো ঘাসফুল সাহিত্যের বাগিচায়।
গোছানো বাক্যে জীবন ও পরিবেশ থেকে নেওয়া কিছু সত্যাশ্রয়ী ঘটনাপুঞ্জ প্রেম,ভালোবাসা,পরিমিত আবেগ,ধৈর্য আর কিছু আলোকিত শব্দ প্রকাশের মধ্য দিয়েই একজন লেখকের মুন্সিয়ানা খুঁজে পাওয়া যায়। সামগ্রিক দৃশ্যায়নের সুচারু সম্পাদনায় একজন লেখক ঋণী থাকে, অনেক কিছুর কাছে। আর সে ক্ষেত্রে আমারও কিছু ঋণ আছে। আমি ঋণী সেই কৃষ্ণচূড়া আর সোনালু ফুলের কাছে, যাদের রঙের প্রলেপ মাখাতে চেয়েছি আমার লেখায়। আমি ঋণী সেই ঝিঁঝি পোকা আর ব্যাঙ এর কাছে যারা আমায় শিখিয়েছে কী করে ছন্দে আবদ্ধ হতে হয়,জোনাক আর বাবুই শিখিয়েছে মৌলিকত্ব। যেই মানুষগুলোর ভালোবাসা আমার লেখাকে ঋদ্ধ করেছে, যে সবুজ আমার লেখায় সতেজতা ধারণ করেছে প্রত্যেকের কাছে আমার অনেক ঋণ। লিখতে গিয়ে অধৈর্য হলেই মনে পড়েছে, সেই সব শিক্ষা গুরুকে, যারা অসীম ধৈর্য নিয়ে আমার সব প্রশ্নের উত্তর দিতেন। শব্দে,বাক্যে নিগূঢ় প্রেম এঁকেছি আমার মা-0বাবার নিঃশব্দ প্রেম দেখে।
সমাজ ও দেশের প্রতি দায়বদ্ধতা শিখেছি সেই পরিদর্শক ও হেড স্যারের কাছ থেকে, যাদের জন্যে আমার প্রথম লেখাটি আজও বেঁচে আছে। ভালোবাসা ও উদারতার নিপাট বুননে যে স্নেহময় শীতল পাটি বুনেছিলেন আমার শিক্ষক, গুরুজন,বাবা,মা আর বন্ধুরা মিলে, সেই পাটিতে বসে আমি কেন, যে-কেউই লিখে ফেলতে পারবে কালজয়ী সব লেখা। আমি বরং লজ্জিত,অনুতপ্ত সেই সব ভালোবাসার কাছে, যাদের যোগ্য সম্মান দিতে পারিনি। শুধু মনে হয়, প্রকৃতির এই সফেদ সন্তানদের কাছে শিখেও আমি আজ অবধি তুলে আনতে পারিনি সেই সাবলীলতা আমার লেখায়। জানি জীবনের ধন তবু কিছুই যাবে না বৃথা। এরাই আমার চলার শক্তি, লেখার অনুপ্রেরণা, বলার গৌরব। বেলা কি দ্রুত ফুরিয়ে যায়? তবু আর একবার যদি যাওয়া যেতো সেই প্রকৃতির সন্তানদের কাছে। সেই আদিগন্ত বিস্তৃত সবুজের কাছে গিয়ে যদি বলা যেতো—‘তোমারে যা দিয়েছিনু সে তোমারই দান / গ্রহণ করেছো যত, ঋণী তত করেছ আমায়’।