(পর্ব-৯)
নির্ধারিত বুধবার বাদ হয়ে গেলো। তারপর অনেক বুধবার চলে গেলো। দেশের বাইরে বেশ কিছু সেমিনার ও বোর্ডের সঙ্গেও জরুরি কিছু বিষয় নিয়ে প্রায় দুমাস ব্লুবার্ডে ড. শাহেদ জাহানের যাওয়া হয়ে ওঠেনি। বোর্ডকে কে বা কারা ব্লুবার্ডের বিষয়টিও জানিয়েছে। বোর্ড ভিসিকে তা জানিয়েছেও। বোর্ড তা বিশ্বাস করেছে কী, করেনি কিংবা কতটা কিভাবে ব্যাপারটিকে নিয়েছে—বোঝা যাচ্ছে না। এসব নিয়ে তিনি ড. ফারজানা থেকে একটু দূরত্বও রক্ষা করে চলছেন। কিন্তু তাকে কোনোভাবেই বুঝতে দিচ্ছেন না। কিন্তু ড. ফারজানার মনে এটা নিয়ে বেশ দুশ্চিন্তা। স্যার কী নতুন কাউকে বাহুবন্দি করে, আমাকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছেন! স্যারের তো এ স্বভাব আছে। নতুন ভালো কোন চেহারার মেয়েকে পেলেই সেদিকে গড়িয়ে যেতে মুহূর্ত সময় লাগে না। কিন্তু স্যারের কথায় তো তা মনে হয় না—নতুন কারও সঙ্গে এরকম কিছু ঘটেছে! বিদেশে গিয়েও তো নিয়মিত যোগাযোগ রেখেছেন। বিদেশ থেকে আসাও তো প্রায় দশ বারোদিন হয়ে গেলো। ব্লুবার্ডের কথা তিনি তো মুখেই আনছেন না।
ড. ফারজানা নিজেই ড. শাহেদ জাহানের মোবাইলে কল দিলেন।
বলো, ফারজানা।
স্যার, আপনি কোথায়?
অফিসে। রুমে। কিছু বলবে?
আপনি কি রুমে একা আছেন? একা থাকলে বলবো।
বলো।
স্যার, কোন সমস্যা?
কী বিষয়ে বলো তো।
স্যার, বিষয় তো একটাই ব্লুবার্ড। বলেন তো শেষ কবে গিয়েছি? আপনি বুধবারের কথা বললেন। কত রকমের স্বপ্ন নিয়ে সেই বুধবারের অপেক্ষা করে থাকলাম।একদিন আগেই বললেন, বুধবারের প্রোগ্রামটা আপাতত হচ্ছে না। তারপর কত বুধবার চলে গেছে—বলতে পারবেন, স্যার? আপনার ইচ্ছেটাতে কী নদীর শুকনো চর পড়ে গেলো নাকি অন্যদিকে..!
-আরে না। একটু সমস্যা তো হয়েছেই। ব্যস্ততাও ছিল। বিদেশেও অনেকগুলো সেমিনার গেলো। শোনো, ওখানে আর যাওয়া যাবে না। বোর্ডকে কে বা কারা জানিয়েছে, ওখানে আমি মাঝেমধ্যে একটা মেয়েকে নিয়ে যাই। তোমাকে হয়তো চিনতে পারেনি। তোমার নাম বলেনি।
তাই নাকি! তার মানে আপনার পেছনে কেউ একজন শক্তভাবে লেগেছে!
আমি জানি কে। তোমাকে পরে বলবো।
ঠিক আছে, স্যার। সমস্যা যখন হয়েছে, বোর্ডের কাছে যখন এ ধরনের কথা গেছে, ব্লুবার্ড বাদ দিয়ে অন্য কোনো হোটেলে তো যেতে পারি! ঢাকা না হলে চিটাগং যাবো। দেশেও যদি সমস্যা হয় বিদেশে যাবো। আপনার সান্নিধ্য পাবার জন্য, আমি পৃথিবীর যেকোনো জায়গায় যেতে পারি।
আসলে সমস্যা হয়ে গেছে আমি আর তুমি তো একই প্রতিষ্ঠানে চাকিরি করি। তা না হলে তো কোন সমস্যা ছিলো না।
ড. ফারজানা এ কথা শুনে ভাবে, এক প্রতিষ্ঠানে চাকরি না করলে—আর আপনার ক্ষমতা না থাকলে—ড. ফারজানা আপনার সাথে হোটেলে যেয়ে শুতো নাকি! আমি তো আপনার কাছে শুই না, শুই তো আপনার ক্ষমতার কাছে!
ড. শাহেদ জাহান আবার বললেন, কিছু চিন্তা করছো মনে হয়!
চিন্তা তো কতোই করি। সত্যি একটা কথা বলবো।
বলো।
স্যার, সত্যি খুব মন চাইছে। আপনার বিরহ অনলে যে পুড়ি.. স্যার, চর্যাপদে পড়েননি।
ণাণা তরুবর মৌলিল বে গঅণত লাগেলী ডালী
একলী সরবী এ বণ হিন্ডই কর্ণকুন্ডল বজ্রধারী।।
স্যার, কী সুন্দর ছবিটা সারা বন ফুলে ভরে আছে। বনের সেই ফুলে ভরা ডাল যেন আকাশ ছুঁয়ে আছে। আমি তো এখন সেই একাকিনী শবরী বালিকার মতো কানে ফুল পরে আপনার জন্য মনের বনে ঘুরে বেড়াচ্ছি।
ড. সাদিক আহসান বললেন, ওই চর্যাটা মনে আছে তোমার?
দবসহি বহুড়ী কাউহি ভঅই।
রাতি ভইলে কামরু জাই।।
মনে আছে স্যার। আমি কিন্তু অই বউয়ের মতো দিনে ভয় পাই না। রাতেও না। আপনি ডাকলেই তা দিবস আর রজনি যা-ই হোক, সবই সমান আমার কাছে। খুব ইচ্ছে করছে স্যার, ‘তো মুহ চুম্বী কমলরস পিবমি।’
ঠিক আছে তুমি আগামীকাল বিকেলে তৈরি থেকো। দুপুরে জানিয়ে দেবো।
স্যার, আমি একদম তৈরি থাকবো। ডিপার্টমেন্ট থেকেই বের হয়ে যাবো।
আমার মনভরা সুন্দর তুমি। আসো। ‘নৈরামণি কণ্ঠে লইআ মহাসুহে’ সময় কাটাবো।
স্যার, চর্যাপদ তো আপনার মুখস্ত!
একসময় পড়েছি।
তাই তো দেখছি। স্যার, দেখবেন, আমাকে দেখে আপনার চোখ ঝলসে যাবে।
ড. শাহেদ জাহান রসিকতা করে বললেন, চোখই যদি ঝলসে যায়, তোমার রূপ দেখবো কী করে! আর পানই বা করবো কিভাবে!
পুরুষ মানুষ কি স্যার নারীর শরীরের রূপ শুধু চোখ দিয়েই দেখে!চোখ দিয়েই পান করে!
পরে কথা বলি বিজনেসের ডিন আসছেন। উনি এলে তো ন্যূনতম একঘণ্টা লাগাবে।
‘লাগাবে’ শব্দটা ড. শাহেদ জাহান পরিকল্পিতভাবে ব্যবহার করেলেন। শব্দটার ভেতর যে একটা অশ্লীলতা আছে—তার ঘ্রাণটা ছড়িয়ে দিলেন। ড. ফারজানাও তা বুঝলেন। তিনিও ঘ্রাণটা অনুভব করে পুলকিত হলেন। কিন্তু তা মনের ভেতরেই থেকে গেলো।
পরের দিন ঠিক বারোটার সময় ড. শাহেদ জাহানের কল পেলেন ড. ফারজানা। বললেন, ফারজানা, তুমি সন্ধ্যা ছয়টার গুলশান পার্ক রোডে হোটেল রিভারে চলে এসো।
ড. ফারজানা ফোনটা রাখতেই আব্দুল করিমের ফোন। ড. ফারজানা, আজ সন্ধ্যায় আপনার কী কাজ?
এ কথা শুনেই ড. ফারজানার বুকের ভেতর কেমন যেন ধক্ করে ওঠে—মনের ভেতর একটা ভূমিকম্প অনুভূত হয়! উনি কি আজকের প্রোগ্রামটা জেনে ফেলেছেন? একরকম কম্পিতকণ্ঠে বললেন, স্যার, কেন বলুন তো?
বলছিলাম আপনার যদি কোন প্রোগ্রাম না থাকে দুজনে রাতে বাইরে কোথাও ডিনার করতাম! আপনার ভাবিও বাসায় নেই। টাঙ্গাইলে গেছেন। ছোটবোনের বাসায়। কাল আসবে। তো ভাবলাম…
ড. ফারজানা কী বলবেন, বুঝে উঠতে পারে না। হুট করেই বানিয়ে বললেন, স্যার, আমার বাচ্চাটা অনেক অসুস্থ। আমি তো এখুনি বেরিয়ে যেতে চাইছি—অনেক জ্বর। রাতে একটুও ঘুমাইনি। বাচ্চাটাও ঘুমায়নি। স্যার, বলুন তো কী করি এখন! আপনার ইচ্ছের মূল্যও তো আমার কাছে অনেক!
বাচ্চাটা আগে। আপনি এখুনি বাসায় চলে যান। অন্য আরও অনেকদিন আসবে।
স্যার, আপনি বড় আশা করে বললেন, অথচ আমার একটা বিপদ!
বললাম তো পরে অন্য কোনোদিন হবে। এখন সোজা বাসায় চলে যান। আমি রাতে ফোন করে খোঁজ নেবো।
আপনি কিন্তু মনে কষ্ট নেবেন না। কষ্ট নিলে আমি অনেক কষ্ট পাবো। আপনি তো জানেন, আমার সবই আপনি। তবু কখনো কখনো মানুষ খুব অসহায়! আমি যেমন এখন খুব ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও অসহায়ত্ব মেনে নিচ্ছি।
সবকিছু মিলিয়েই তো জীবন।
রাতে কথা বলবো স্যার। বলেই মোবাইলটা রেখে দুমিনিট চোখ বন্ধ করে বসে থাকে। ভাবে, কাকে যে কিভাবে সামলাবো! বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজের ক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে—নিজের যে কিছুই থাকছে না—তা কে বুঝবে! সবাই ফারজানা ম্যাডামকে হিসাব করে চলে—জানে তার কথায় এখানে অনেক কিছু হয়। কিন্তু ফারজানা ম্যাডাম তা তৈরি করতে গিয়ে যে বড় কর্তাবাবুদের সুখের দড়ির টানাটানিতে নিজে ছিঁড়ে-ছুড়ে ব্যথায় প্রতিটা মুহূর্ত কাতরায়—সেই বেদনার কথা কাকে বলি! কিভাবে বলি! ভারী একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে ড. ফারজানা।
সিসি আমাকে কয়েকবার বলেছে। গুরুত্ব দেইনি। কিন্তু হুট করে যদি কখনো শোনো, ড. এলিনাকে চেয়ারপারশন করে তোমাকে বাদ দিয়ে দিয়েছে, অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। আপনি তখন কিছু করবেন না?
আব্দুল করিমের মনটা খারাপই হয়ে গেলো। ভাবে, কী-ই বা করার আছে! বেচারির বাচ্চাটা অসুস্থ। কতদিন পরে একটা দিন পেলাম! হুট করে ড. এলিনা রহমানের কথা মনে এলো। তাকে যদি বলি! তার সঙ্গে যদি একটু সময় কাটানো যায়! ব্যাপারটা কি খারাপভাবে নেবেন! ভাবলেন, কথা প্রসঙ্গে বলে দেখি—রাজি না হলে না হবেন। আবার ভাবলেন, না, বলা ঠিক হবে না। তার চেয়ে ফোন করে এমনি কথা বলি।
আব্দুল করিমের ফোন পেয়ে উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে ড. এলিনা রহমান বললেন, আমি তো ভুল করেও ভাবতে পারিনি, এই গরিবকে আপনি ফোন করবেন!
কী যে বলেন ভাবি। আপনি গরিব হলে আমি তো মিসকিন।
তো কী মনে করে এই গরিবের কথা মনে পড়লো! আপনার তো চারদিকে ঝাঁকভর্তি সুন্দরী!
আপনি তো ঝাঁকভর্তি সুন্দরীদের চেয়েও বেশি সুন্দরী। এখন কী করছেন?
সত্যি বলবো?
মিথ্যে বলেন নাকি!
কখনো কখনো যে বলি না, তা নয়। বলি তো। সবাই বলে। কেউ কম বলে, কেউ বেশি বলে।
তা ঠিক।
যদি বলি আপনার কথাই ভাবছিলাম। কাল আপনার কাছে যাওয়ার কথা চিন্তা করছিলাম।
কাল কেন আজই তো দেখা হতে পারে!
আপনি বললে তাও হতে পারে। অফিসে আসবো?
না। এখন অফিসে আসার জন্য রওয়ানা দিলেও পথে যে যানজট, বিকেল হয়ে যাবে।
তাতে কী! একটা কথা আছে না. যদি থাকে বন্ধুর মন, নদী পার হতে কতক্ষণ!
বাহ্! দারুণ তো। মনে হয় খুব রোমান্টিক মুডে আছেন?
আপনার ফোন পেয়ে তা তো কিছুটা হয়েই গেছি। কোথায় আসবো বলেন, অফিসে না বাইরে কোথাও?
আব্দুল করিম ভাবতেও পারেননি ড. এলিনা রহমানের কাছ থেকে এরকম একটা উত্তর পাবেন। যা মোটেও প্রত্যাশিত ছিল না। বললেন, হোটেল কন্টিন্টোলে ছটা সাতটার দিকে আসতে পারবেন? একসঙ্গে ডিনার করবো।
তা তো অবশ্যই পারি। কিন্তু ড. ফারজানাও থাকবেন নাকি!
আরে না না। উনাকে আবার বলেন না যেন আমরা একসাথে ডিনারে যাচ্ছি।
না, তা কেন বলবো! আমি একটু তৈরি হয়ে এখুনি বেরুচ্ছি। ড. এলিনা রহমান ভাবেন, মেঘ না চাইতেই জল!
আব্দুল করিম বিস্ময়ে ভাবলেন, ড. এলিনা রাজি হয়ে গেলেন এবং কী স্বতস্ফূর্তভাবে! বিস্ময়কে হারা মানায়! আচ্ছা এরা যে আমাকে এত গুরুত্ব দেয়—এটা কি আমাকে না আমার চেয়ারকে! যাক ওসব ভাবনা। ড. এলিনা আসলেই সুন্দর। দেখতে যেমন সুন্দর, মনও তেমন। ভোরের ভেজা তাজা লাল টকটকে গোলাপ যেন! পিয়নকে বললেন, ভালো করে এক কাফ কফি দে।
ড. ফারজানার ইচ্ছে ছিল অফিস থেকে পাঁচটা সাড়ে পাঁচাটায় বেরুবেন। কিন্তু আব্দুল করিমের সঙ্গে কথা বলার পর সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে ফেলেন। ভাবেন, অফিসে অত সময় থাকলে, সিসি জানতে পারলে সমস্যা হবে। বাচ্চার অসুখের কথা বলে অফিসে থাকলে, ব্যাপারটাকে ভালোভাবে নেবে না। ভাবলেন, তার চেয়ে এখুনি বেরিয়ে পার্লারে যাই। কতদিন পরে ভিসি স্যারের সাথে একান্ত সময় কটাবো। স্যারের চোখ ভরে দেওয়ার মতো করে নিজেকে একটু সাজিয়ে নেবো। ভাবনামাত্রই ড. ফারজানা বের হয়ে পার্লারে যান। পার্লার থেকে বেরুতে বেরুতে সাড়ে পাঁচটা বেজে গেলো। ড. শাহেদ জাহান ফোন করে বললেন, ফারজানা, আমি চলে এসেছি। রিসেপশনে তোমার কথা বলা আছে। তোমার নাম বললেই হবে।
ড. ফারজানা পথে যতটা যানযটের কথা ভেবেছিলেন, অতটা যানজট নেই। ভেবেছিলেন হয়তো সাতটারও বেশি বেজে যাবে। স্যার হয়তো রাগে গোখরা সাপের মতো ফোঁসফোঁস করতে থাকবেন! ধানমন্ডি থেকে বেরুতেই তো এক দেড়ঘণ্টা লেগে যায়। অনেকটা আশ্চর্যজনকভাবে তিনি সোয়া ছটায় হোটেল রিভারে পৌঁছে গেলেন।
ড. শাহেদ জাহান পলকহীনভাবে তার দিকে তাকিয়ে থাকেন। ড. ফারজানা দুঠোঁটে মোনালিসার ছবির মতো হাসি নিয়ে একঠাঁই চোখে চোখ রেখে দাঁড়িয়ে থাকেন। ভাবেন, আমি তো এমনটাই আজ আশা করেছিলাম—মুগ্ধতায় বুঁদ হয়ে যাবেন!
সম্বিৎ ফিরে ড. শাহেদ জাহান বললেন, তুমি এমনিতেই অনেক সুন্দর। আজ আরও বেশি সুন্দর লাগছে। বলেই বললেন, আমি তো ভেবেছিলাম, পথে যে অবস্থা, আরও দেরি হবে!
স্যার, বসতে বলছেন না যে!
তোমার অপরূপ সৌন্দর্যে ভুলে গেছি। সোফা থেকে উঠে ড. ফারজানাকে দুবাহুর ভেতর জড়িয়ে নিতেই, তার থেকে অনেক বেশি গভীর ও শক্ত করে তাকে জড়িয়ে ধরলেন ড. ফারজানা নিজেই। আবেগের প্রমত্ত ঝড় একটু শান্তু হলে ড. ফারজানা অভিমানের পুরো একটা মেঘ যেন কণ্ঠে তুলে নিয়ে, ড. শাহেদ জাহানের আলগা কাঁচা-পাকা লোমশ বুকে আঙুলের ছোঁয়ায় নিজের নাম লিখে বললেন, বলেন তো কতোদিন পরে এমন নিবিড় করে পেলাম! জানেন আমি অনেক মন খারাপ করেছিলাম। চোখের পানিও ফেলেছি।
শোনো, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি করতে এসে কত যে বাজে অবস্থার ভেতর থাকতে হয়! তুমি তো নিজেও কিছুটা তা অনুধাবন করতে পারো। পাবলিকে যখন ছিলাম, তখন তো এটা কল্পনাতেও ছিল না। যারা বিশ্ববিদ্যালয় বোঝেন না, তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের মালিক। তাদের মর্জির ওপর সব চলে। আসলে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির কোনো ক্ষমতা নেই। বাইরে থেকে অনেকে অনৈক কিছু মনে করেন, ভিসির না-জানি কতো ক্ষমতা! মালিকের কোনো আত্মীয় যদি বিশ্ববিদ্যালয়ে পিয়নেরও চাকরি করে, তার ক্ষমতাও ভিসির থেকে বেশি।
স্যার, আপনার মনটা আজ খারাপ?
হ্যাঁ, একটু খারাপ তো আছেই। চাকরিটা করা কঠিন হয়ে যাচ্ছে। মালিকপক্ষ তাদের প্রতিনিধি বসিয়ে রেখেছে আমার ঘাড়ের ওপর। তুমি চিন্তা করতে পারো সিসির ক্ষমতা ভিসির থেকে বেশি! একটা আইএ পাস ছেলে। মেজর ছিল। তার রিপোর্টের ওপর নির্ভর করে আমার তোমার সবার ভাগ্য। ব্যাপারটা অদ্ভুত নয়!
স্যার, আনন্দ করতে এসে বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা শুনতে ভালো লাগছে না। ওসব তো আপনার রুমে বসেও শুনতে পারবো।
সময় তো আছে। আজ একটু বেশি সময় নিয়ে থাকবো। ধরো বারোটা একটা। তোমার বাসায় সমস্যা হবে!
আপনি বললে সারারাতও থাকবো। কোনো সমস্যা নেই।
গুড। লক্ষ্মী মেয়ে। ড. শাহেদ জাহান বললেন, কিছুই তো মুখে নিচ্ছ না!
একটা কিছু খাও।
আপনিও তো নিচ্ছেন না! অন্যদিনের সঙ্গে আজকের আপনার অনেক পার্থক্য। ব্লুবার্ডে গেলে তো আপনি কেমন বুনো হয়ে উঠতেন। আমার কাছে এটার পরিবেশ ও কোয়ালিটি ব্লুবার্ডের থেকে অনেক উন্নত। মনেই হচ্ছে না এটা আমাদের দেশের! একবারে বিদেশি মনে হচ্ছে—সেই রকম!
হাঁ, এটা অনেক উন্নতমানের। আচ্ছা বলো তো, সিসি লোকটা কেমন?
আমি তো অতো মিশিনি। তারপরও যতোটুকু মনে হয়, লোকটা সুবিধার নয়। মেয়েদের শুঁকে বেড়ানোর স্বভাব আছে।
সে আমার নামে ট্রাস্টি বার্ডে রিপোর্ট করেছে—আমি ব্লুবার্ডে মাঝেমধ্যে একটা মেয়েকে নিয়ে যাই। বিদেশে সেমিনারে গেলেও নাকি এখান থেকে কোনো না কোনো কৌশলে ফিমেল ফ্যাকাল্টি নিয়ে যাই!
স্যার, আমার নাম বলেনি তো! আর সে ব্লুার্ডেও কথা জানলোইবা কিভাবে?
জেনেছে কোনোভাবে! তোমার নাম বলেনি। শুধু একটা মেয়ে নয়, অনেক মেয়ের কথা বলেছে। আমি নাকি সুযোগ-সুবিধা দিয়ে তাদের ব্যবহার করি। এটা নিয়ে বোর্ডে মিটিং হয়েছে। গোপনে ব্লুবার্ড থেকে রিপোর্টও নিয়েছে।
স্যার, তাহলে তো সমস্যা।
সমস্যা তো বটেই। দেখো, আমি নাকি ফিমেলদের নিয়োগ বেশি দেই! আমার রুমে নাকি ফিমেল ফ্যাকাল্টি সবসময় ভরা থাকে! ডিপার্টমেন্টের চেয়ারম্যানরাও ঢুকতে পারে না! এরক বহু অভিযোগ সে করেছে।
এতো কিছু, স্যার?
হাঁ। দেখো, এখানে কিন্তু নিয়োগে আমার খুব বেশি কিছু করার থাকে না। বোর্ডের মেম্বারদের আত্মীয়-স্বজন ক্যান্ডিডেট থাকলে, তাদের চাকরি দিতেই হয়। সাজানো একটা বোর্ড থাকে। দেখো, এখানে অফিসার লেভেলে যারা আছে, সবই তাদের আত্মীয়-স্বজন। ফ্যাকাল্টিদের ক্ষেত্রেও একই। তারা সিসির রিপোর্ট অনুযায়ী যাকে যখন খুশি বাদ দিচ্ছেন, সে দোষও আমার—বাইরে সবাই জানছে আমি চাকরি খাচ্ছি।
ভেতরে কেমন যেন শুকিয়ে আসে ড. ফারজানার। ভাবে, ভিসি স্যারের নামে যখন রিপোর্ট গেছে, আমার নামেও নিশ্চয় গেছে। কী যে হবে! তারপরও ড. শাহেদ জাহানকে খুশি করার জন্য এসব গুরুত্ব না দিয়ে, বললেন, স্যার, এসব চিন্তা বাদ দেন। সব জায়গাতেই সমস্যা থাকে। সমস্যা নিয়েই জীবন। আপনার মতো এতো ট্যালেন্ট এতো পাওয়ারফুল ভিসি এরা কোথায় পাবে! গোটা দেশে একনামে আপনাকে চেনে।
তা আমিও জানি। কিন্তু বোর্ডের কাছে এসবের কোন দাম নাই। বোঝ না ব্যবসা করে! এরা এসবের কী বুঝবে! এরা দেখবে কিভাবে টাকা আসবে, কিভাবে কাকে কত টাকা কম দিয়ে কাজ করানো যায়। এখানে তো বেতনের কোন অবকাঠামোই নেই। যাকে যেমন পারে দিয়ে, চালাচ্ছে। একটা নিয়ম থাকবে না? আমি অনেকবার বলেছি। কাজ হয় না। তোমার বেতন বাড়াতে গিয়েই কত কথা হয়েছে—তুমি চিন্তাও করতে পারবে না। আর বাংলা বিভাগের তো নামই শুনতে পারে না। ড. এলিনাকে তো বাংলা বিভাগে নিয়োগ দেওয়ার কথা ভাবছে। সিসি আমাকে কয়েকবার বলেছে। গুরুত্ব দেইনি। কিন্তু হুট করে যদি কখনো শোনো, ড. এলিনাকে চেয়ারপারশন করে তোমাকে বাদ দিয়ে দিয়েছে, অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।
আপনি তখন কিছু করবেন না?
হয়তো আমি জানতেও পারবো না। জানো, আমাদের যে প্রফেসর ফরিদুল ইসলাম, চেনো তো?
চিনি তো স্যার। সায়েন্সের ডিন।
কিন্তু ড. এলিনা রহমান যে আমার পুজোর পথে বড় বাধা এখন—মন্দির সেও যে শক্ত করেই দখলে নিতে চাইবে—পুজোটা সেও যে পুরোটাই দেবে—ভগবান কার পুজো নেবে আর কার পুজো না-নেবে—এ তো এখন নতুন করে অগ্নিখেলা শুরু হয়ে গেলো আমার জন্যে।
তিনি কোথাও প্রফেসরগিরি করেছেন? কোথাও করেননি। ব্যবসা করতেন। বোর্ডের চেয়ারম্যানের বন্ধু। ব্যবসাতে লোকসানগ্রস্ত হয়ে যখন ব্যবসা আর চালাতে পারেননি, চেয়ারম্যান এখানে টেক্সটাইল ডিপার্টমেন্টের প্রফেসর করে নিয়োগ দিয়েছেন। অবশ্য তার কপালও ভালো ছিল, তখনকার ভিসির সঙ্গে আগে থেকেই একটা পারিবারিক সম্পর্ক ছিল। দেখো, কোনোদিন কোথাও কোনো চাকরি না করে, টেক্সটাইলে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া একজন মানুষ ব্যবসায়ী থেকে ফুল প্রফেসর এবং একইসঙ্গে ডিন হয়ে যোগদান করেছেন। এখানে কী না সম্ভব, বলো!
তাই তো ভাবছি, স্যার।
তুমি ড. এলিনার কথা বলো সায়েন্সে পড়েছে! বাংলায় পড়েনি। ভাষাতত্ত্বে এম এ করেছে। তাতে কী হয়েছে! ডক্টরেট তো করেছে। বোর্ডকে যদি বোঝাতে পারে বাংলায় ডক্টরেট। বেশ! হয়ে গেলো। এখানে সবকিছুই সম্ভব, ফারজানা।
জানি, এসব শুনে তোমার প্রমত্ত আবেগটা প্রায় নিভে গেছে।
এসব শুনে খারাপ তো কিছুটা লাগছেই। কিন্তু ওরকম কিছু না। আপনার সান্নিধ্য আমার কাছে অন্যরকম।
আমি তা জানি। তোমাকে আর একটা কথা বলে রাখি, ড. এলিনা কয়েকদিন আগে আমার রুমে এসেছিল। তার সাথে কথা বলে আমার যা মনে হয়েছে, বোর্ডের চেয়ারম্যানের সাথে তার পরিচয় আছে। পারিবারিক কোনো সম্পর্কও থাকতে পারে। আমি ঠিক জানি না। সিসির সাথেও সে একটা সম্পর্ক তৈরি করে নিয়েছে বলে আমার অনুমান। আর সে দেখতেও তো বেশ সুন্দরী কিন্তু। কথাবার্তায় স্মার্ট। এসব চিন্তা করেই আমি ওকে ইংরেজি বিভাগের চেয়ারম্যানকে বলে জিইডি কোর্সে ক্লাস দিয়েছি। না হলে ঝামেলা হতো। তুমি ওর ব্যাপারে খুব সাবধান থাকবে।
আমিও কিছুটা বুঝতে পারছি। ও আমাকে এখানে শান্তিতে থাকতে দেবে না।
একদম ঠিক ধরেছ। তবে, আমি তো আছি। অত চিন্তা করো না।
বেশ কিছুদিন ধরেই আপনি যে মানসিকভাবে ভালো নেই, আমি তা বুঝতে পারছিলাম। কারণ যে আপনি আমাকে পাওয়ার জন্য সবসময় উন্মত্ত থাকেন, কোনো না কোনোভাবে সুযোগ খোঁজেন। সেই আপনি কেমন নিস্তেজ শান্ত—সবসময় কিছু না কিছু ভাবেন—অন্যমনস্ক থাকেন। বুঝতে পারছিলাম কিছু একটা হয়েছে বা হতে যাচ্ছে! কিন্তু জানার সুযোগটা হচ্ছিল না। খুব মন খারাপ করে ড. শাহেদ জাহানের বুকের ’পর মাথা রাখেন ড. ফারজানা।
কথায় কথায় অনেক রাত হয়ে গেছে তাই না! দেখো বারোটা ছুঁই ছুঁই।
বাজুক। সারা রাত এখানেই থাকবো। যাবো না। আদুরী আবেগে কণ্ঠে ফারজানা বললেন।
বাসায় সমস্যা হবে না? আদিত্য কিছু বলবে না?
হলে হবে! ওসব ভাবতে চাইনে।
কী যে বলো তুমি! আমার বাসাতে তো আগুন ধরে যাবে।। আমি তোমার ম্যাডামকে ম্যাসেজ দিয়ে রেখেছি, বোর্ডের সাথে দীর্ঘ মিটিং চলছে। ফিরতে অনেক রাত হবে।
ড. ফারজানা দুষ্টুমি করে বললেন, বোর্ডের সাথে মিটিংয়ের কথা না লিখে লিখে দিতেন—ড. ফারজানার সঙ্গে মধ্যনিশিতে ডেটিং চলছে।
তা লিখতে পারলে তো ভালোই হতো। কিন্তু ড. ফারজানা তা তো পারা যায় না। বলেই ড. ফারজানাকে বুকের ভেতর টেনে নিয়ে বললেন, আর বেশিক্ষণ থাকা ঠিক হবে না।
ফারজানাও নিজেকে পাপড়ির ভাঁজের মতো খুলে বলে, আপনি কিচ্ছু বোঝেন না! আপনাকে আমার একটুও ছাড়তে ইচ্ছে করে না।
বাসায় ফিরে বিছানায় যেতে প্রায় আড়াইটা তিনটে বেজে গেলো ড. ফারজানার। দুচোখের পাতা কিছুতেই এক হয় না। ড. শাহেদ জাহানের কথাগুলো দুঃস্বপ্নের আগুনের চেয়েও বেশি ভয়ঙ্কর হয়ে যেন চোখের ভেতর জ্বালাময় হয়ে ওঠে। যে চাকরিটা রক্ষা করে, বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজেকে প্রভাবশালী করে রাখার জন্য নিজেকে এত নিচে নামিয়ে, বাইরের বাতাসে সম্মানী মানুষ হয়ে ভেসে বেড়াই, এখন তো সেই চাকরিটা যে কয়দিন থাকে! মোবাইলটা হাতে নিয়ে সাইলেন্ট করে ঘুমানোর চেষ্টা করে।
সকালে ঘুম যখন ভাঙলো তখন প্রায় এগারটা। মোবাইলটা হাতে নিয়ে আঁতকে ওঠেন—সিসির এত কল! পনেরটা কল! ভাবলেন, রাতেই তাকে একটা ফোন দেওয়া লাগতো! বাচ্চার অসুখের কথা বলে যেহেতু তাকে সময় দেইনি। অবশ্য তাকে ফোন দেওয়ার মতো তো পরিবেশও ছিল না। এখন কল দিয়ে সরি বলি।
কল দিয়ে ঘুমঘুম কণ্ঠে ড. ফারজানা হ্যালো বলে সরি শব্দটা উচ্চারণও করতে পারেননি, আব্দুল করিম খুশিতে প্রায় আছড়ে পড়া ঢেউয়ের মতো শব্দ করে বললেন, আরে আপনি মোবাইল সাইলেন্ট করে ঘুমোচ্ছেন, এ দিকে তো বিশ্ববিদ্যালয়ে আপনার ভিসি নাই হয়ে গেছেন।
বিস্ময়কণ্ঠে ড. ফারজানা বললেন, ভিসি স্যার নাই হয়ে গেছেন মানে!
তার তো চাকরি নাই।
চাকরি নাই! ভিসি স্যারের চাকরি নাই!
জি! সকাল সাড়ে ন টায় তিনি পদত্যাগ করেছেন।
পদত্যাগ করলেন কেন?
তিনি তো মেয়েমানুষ ছাড়া কিছু বোঝেন না। দামি দামি হোটেলে ফিমেল ফ্যাকাল্টি নিয়ে ফুর্তি করেন। আর নিজের অফিসরুম তো সুন্দরী ফ্যাকাল্টিদের নিয়ে নিজের স্থায়ী ঘর বানিয়ে ফেলেছিলেন! আরে শোনেন, সেমিনারের নামে ফিমেল ফ্যাকাল্টি নিয়ে দেশের বাইরেও এসব নষ্টামি করতেন! এখন তো সবই বেরুচ্ছে! অফিসে আসেন সব জানতে পারবেন। আমি আপনাকে বলতাম না, ভিসি লোকটা ভালো না! তার রুমে বেশি যাবেন না! গায়ে দাগ লেগে যাবে। কী এখন আমার কথা সত্য হলো তো!
ঠিকই স্যার। বলেই বললেন, আমি এখুনি আসছি, স্যার।
মাথায় যেন বিনামেঘে বজ্রপাত ভেঙে পড়ে ড. ফারজানার মাথায়। ভাবেন, তার গায়ের রাতের গন্ধ এখনো আমার গায়ে লেগে আছে। কী হবে এখন! আমার নামও কী এখন তার নামের সঙ্গে উঠে আসবে! ভিসি স্যার, কী আমাকে ছাড়াও আরও অন্য মেয়েদের নিয়ে হোটেলে যেতেন! নিশ্চয় ওরকম কিছু ছিল—তা না হলে এতো বড় ঘটনা কী করে ঘটে! আমার চাকরি থাকবে তো! ব্লুবার্ডে আমি তার সঙ্গে থেকেছি। গতরাতে তো রিভারেও থেকেছি। এসব যদি সবাই জেনে যায়! আমার চাকরি তো দূরে থাক, মান-সম্মান সব ধূলোয় লুটোপুটি খাবে। আমার নাম দুর্গন্ধ হয়ে বাতাসে উড়বে। মানুষের সামনে মুখ দেখানোই বিপদ হয়ে যাবে।
ভাবে, যেভাবেই হোক চাকরিটা আমার বাঁচাতে হবে। যে পুজো ভগবান মনে করে ভিসি স্যারকে এতদিন দিয়েছি, এখন সিসি স্যারকে সেই একই পুজো দিতে হবে। এতদিন সিসি স্যারকে যে পুজো দিয়ে এসেছি, তাতে চাকরি বাঁচবে না—পুজোটা আরও অনেক বেশি করে দিতে হবে —অনেক বেশি নিবেদিত হয়ে দিতে হবে—মনপ্রাণদেহ সব সমর্পণ করতে হবে। কিন্তু ড. এলিনা রহমান যে আমার পুজোর পথে বড় বাধা এখন—মন্দির সেও যে শক্ত করেই দখলে নিতে চাইবে—পুজোটা সেও যে পুরোটাই দেবে—ভগবান কার পুজো নেবে আর কার পুজো না-নেবে—এ তো এখন নতুন করে অগ্নিখেলা শুরু হয়ে গেলো আমার জন্যে। বাঘা যতীন বিশ্ববিদ্যালয়ে আর ক’দিন যে থাকতে পারবো!
চলবে…