আমি তখন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের এক অথবা দুই ক্লাসের শেষ বেঞ্চে; নিরীহ মানবশাবক। খাপছাড়া লম্বাটে এক বালিকা আমাকে বিরক্ত করে। স্কুল ছুটির পর পিছু নিতে ভুলে না মেয়ে। হাত ধরে টেনে নিয়ে যায় ঘুরপথে; যে পথে ছড়িয়ে থাকে দমকা বাতাসে উড়ে আসা পাখির বাসা, ভেঙে যাওয়া ডিম; চোখ না ফোটা পাখিশাবক। শিমুলদিঘির পথে জাদু ছড়ানো মরা রোদ; শীতঋতু; মরাদিঘির বুকে ভীনদেশি পাখি; পাখির চোখের মতো মায়াবি জলের স্বচ্ছতায় ভেসে আছে কলাপাতারঙ কচুরিপানার ফাঁকে নীলরঙা তাজা কচুরিফুল।
প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহপাঠী বালিকা আমাকে টেনে নামায় সেই নীলকষ্টের কাছে; একেবারে নীলের কাছাকাছি; তখন ভাষার সীমানায় ‘নীল’ শব্দটি হয়ে ওঠে কষ্ট প্রকাশের পরিপূরক ধ্বনি; কষ্টপ্রকাশ, সূচকধ্বনি।
বিদ্যালয়-ফেরা সেই সন্ধ্যায় ডাহুক ডেকে ওঠে। আমি চেতনা ফিরে পেলে আমাকে পেয়ে বসে ডাহুকনেশা। আর তখন ময়েন কাকা শিমুলদিঘির কিনারায় দাঁড়িয়ে থাকা তালপাতার শরীরজুড়ে মৌদেহ তালরস সংগ্রহে বিভোর। খেজুরপাতার ধারালো তীক্ষ্ণতা ভেদ করে জেগে ওঠে মিইয়ে পড়া জীবন্ত বিকেল। সহসা চোখ খুলে গেলে, সন্ধ্যার কাছাকাছি সেই বিদ্যালয়ফেরত ঘরেফেরা বিকেল হাটুভেঙে বসে থাকে শিমুলদিঘির জলের ওপর; যেন-বা রূপকথা ভেসে আছে সন্ধ্যার জলে। আর তখন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সেই শ্যামারঙের মেয়েটি আমার চোখ বরাবর তার চিকন সবুজ আঙুল উঁচিয়ে দেখায়, ওই যে, ওই দূরে সীমাহীন দূরে, দিনের আলো ডুবে যায়।
আর তখন, দিগন্তের ওপর মৃতপ্রায় আলোর ওপাড় থেকে ঝাঁক-ঝাঁক ভূতের নিঃশ্বাস ঝাঁক বেঁধে এসে আমাদের শরীরে ভর করলে আমরা ভুলে যাই অবিনাশ স্যারের যোগ-বিয়োগের জাদু। সেই রহস্যে মোড়ানো জাদু সন্ধ্যার ভাষাদেহ অতিক্রম করে ভেসে থাকে মায়াকাতর আকাশের গায়ে।
যেভাবে বকশাবকের মৃত্যুর পর বকপিতা অথবা বকমাতা সন্ধ্যার শেষ সীমানায় বসে অপেক্ষায় থাকে, কখন কিভাবে বকশাবকের ধবধবে দেহ শিমুল দিঘির জলে ভেসে উঠবে; অথবা জেগে উঠবে ডাহুকশিশুর কণ্ঠধ্বনি; রাতদুপুরের চিরায়ত সংগীত।
ঠিক তখন, মেঘবিহীন আকাশ অথবা শুকিয়ে ওঠা দিঘি জলকাদার একপাশে শুয়ে থাকা একটি ধবধবে শাদা বক; আমরা বকশাবকের কাছে ছুটে গেলে অবাক হই; কী হতবাক বিস্ময়ে ঘুমিয়ে আছে বকশাবক। আমি হাত বাড়িয়ে দেই বকশিশুটির দিকে; নীরব নিথর ওর শরীর। আমি বুঝি না কেনই বা এই ভর সন্ধ্যায় অসময়ে এভাবে ঘুমিয়ে আছে বকশাবক কচুরিঝোপের পাশে, একা! ঠিক তখন, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহপাঠী বালিকা আমাকে পৃথিবীর প্রথম পাঠ শেখায়, যে পাঠের শিরোনাম, ‘মৃত্যু’। বকশাবক মৃত।
আমি বুঝে উঠতে পারি না এই সত্য। আমি মেনে নিতে পারি না এই সত্য। আমি বহুদিন বিদ্যালয়ের ব্যাকবেঞ্চে বসে অথবা বহু বহু দিন বিদ্যালয় থেকে ফিরে গিয়ে মা-র কাছে, বাবার কাছে অথবা দাদি অথবা চাচার কাছে ফুপুর কাছে জানতে চেয়েছি; অথচ আমার জানা ছিল না, কী আমার জিজ্ঞাসা, মৃত্যু বিষয়ে কী-ই বা আমার জানার আছে! শুধু ক্ষত বিঁধে থাকে, মেনে নিতে পারি না, কেন একক সন্ধ্যায়, একাকী ধবধবে দেহ নিয়ে, একাকী শুয়ে থাকে মৃত ধবধবে বকশাবক? ক্ষত বিঁধে থাকে, প্রশ্ন জেগে ওঠে; অথচ সেই প্রশ্নকে ভাষার শরীরে গেঁথে নেওয়ার মতো কোনো শব্দ আমার বোধে নেই।
সুতরাং আমার কষ্টকে চিহ্নিত করতে না পারার যন্ত্রণা থেকে এক ধরনের অবদমন অবযাতনা অথবা অবকষ্ট আমাকে ক্রমাগত ভাষাবোধের দিকে ঠেলে দিতে থাকলে একদিন অথবা বহু বহু দিন পর আমি বুঝতে শিখেছিলাম আমার সেই প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বালিকা বন্ধুটি আমাকে কতটা ভালোবাসতো।
অথচ সেই ভালোলাগা বুঝে নেওয়ার মতো কোনো ‘ভাষাবোধ-আশ্রিত-শব্দ’আমার মেমোরিতে তখনো জমে ওঠেনি; সুতরাং আমি তখন ভাষাবোধহীন বিস্ময়-আক্রান্ত মানবশাবক। অথচ কী এক অমোঘ প্রাত্যহিক সহজাত তাড়না আমাকে সেই বালিকা বন্ধুর পিছে ছুটিয়ে নিয়ে বেড়ায়।
অতপর একদা আমার বোধে ভাষাবোধ জেগে উঠলে, অথবা বোধের শরীরে সারার্থের সবুজ-আভা জেগে উঠলে আমি অপেক্ষায় থাকি, যেভাবে বকশাবকের মৃত্যুর পর বকপিতা অথবা বকমাতা সন্ধ্যার শেষ সীমানায় বসে অপেক্ষায় থাকে, কখন কিভাবে বকশাবকের ধবধবে দেহ শিমুল দিঘির জলে ভেসে উঠবে; অথবা জেগে উঠবে ডাহুকশিশুর কণ্ঠধ্বনি; রাতদুপুরের চিরায়ত সংগীত।
চিরায়ত সেই সংগীত বকপিতাকে অথবা বকমাতাকে ভাষাশিক্ষা দেয়। আর যখন সেই ভাষাশিক্ষার অবারিত পাঠ ছুঁয়ে দেই আমি, তখন সেই ভাষার শরীরে ভর দিয়ে বুঝে যাই, সেই প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সবুজ-সীমানায় জেগে থাকা বালিকা-বন্ধুটির নাম ছিল ‘কবিতা’।