(পর্ব-২১)
অ্যাই শফিক, তুমি রেডিওতে প্রোগাম করবা?
খালেক বিন জয়েনউদ্দীন মানুষটা লম্বা, শরীরের রঙ কালো। মাথায় স্বাভাবিক চুল। বাড়ি গোপালগঞ্জ। মাওলানা আবদুল মতিনের লেবার পার্টির অফিসে সন্ধ্যাকালীন চাকরি করেন। কথাবার্তায় এক ধরনের আমিত্ব আছে, নিজেকে জাহির করার মতলবও প্রচ্ছন্ন থাকে। শফিক হায়দারের লড়াই ভালো লাগে। কোথায় মা ভাইবোন ফেলে ঢাকায় এসেছে! লিখতে চাইছে, না হয় দেই একটু হাত বাড়িয়ে। মানুষের ইতিহাস তো প্রমাণ করেছে, মানুষের বাড়িয়ে দেওয়া হাত মানুষকে টেনে নিয়ে যায় অনেক দূরে, সাফেল্যর শীর্ষে।
-কিসের প্রোগ্রাম?
-অন্বেষা, হাই স্কুলের শিক্ষার্থীদের জন্য অনুষ্ঠান। তুমি অংশ নিতে চাইলে আমি ব্যবস্থা করতে পারি। আর টাকাও পাবে।
-আমি অংশ নেবো খালেক ভাই। আগ্রহ ঝরে শফিক হায়দার। রেডিওর অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়া?
শৈশবে বাড়িতে বিনোদনের একটা মাত্র ব্যবস্থা ছিল, ট্রানজিস্টার শোনা। আব্বা তবিবুর রহমানের জীবন ব্যবস্থাপন্ ছিল রহস্যময়তার ঘেরা। কোনো চাষ বাস না, কোনো আয় না, চাকরি না; একটা সংসার, এতগুলো ছেলে-মেয়ে, দুটো বউ নিয়ে সংসার চালিয়ে গেছেন। নিদারুণ টানা-পড়েনের মধ্যে রেডিও ছিল সংসারের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। দিনে-রাতে সব সময়েই ট্রানজিস্টার বাজতেই থাকে। কখনো কখনো ট্রানজিস্টার সেটে গোলমাল দেখা গেলে আব্বা নিজেই বসে যেতেন রাংগতা, আগুন আর ছোট স্ক্রু-ড্রাইভার নিয়ে। ট্রানজিস্টার ঠিক করে ফেলতেন। দুপুরের বাণিজ্যিক কার্যক্রমের অনুরোদের আসরের গান শুনতো শফিক আকুল হয়ে। সন্ধ্যায় চলতো সৈনিক ভাইদের জন্য অনুষ্ঠান দুর্বার। উপস্থাপনা করতেন হাবিবুর রহমান জালাল। কত বিচিত্র গান আর নাটক। আর শিক্ষার্থীদের সেই অনুষ্ঠানও শুনেছে বাড়িতে বসে।
খালেক ভাই বলেছে, সেই শিক্ষার্থীর আসরে অংশ নিতে। শফিক হায়দার অভাবনীয় স্বপ্নের ভেতরে ঢুকে যায়। প্রসঙ্গক্রমে খালেক বিন জয়েনউদ্দীনকে বলে, রেডিওতে আমার দূর সম্পর্কের ভাই আছে।
-কে? কী নাম।
-আবদুল হালিম।
-আবদুল হালিম সরদার?
-সরদার কি না, বলতে পারবো না, তবে তিনি আমাদের দূর সম্পর্কের ভাই।
পরের দিন বিকেলে খালেক বিন জয়েনউদ্দিন এসে জানালেন, হালিম স্যারের সঙ্গে তোমার বিষয়ে আলাপ করেছি। উনি তোমার বাবাকে চিনতে পেরেছেন। উনি তো রেডিওর সহাকারী পরিচালক, মানুষও ভালো। তুমি হালিম স্যারের সঙ্গে দেখা করো।
-দেখা করে কী করবো?
-রেডিও অফিসে ক্যাজুয়াল হিসেবে নিয়োগ হয়। যদি হালিম স্যার চান, ক্যাজুয়াল হিসেবে তোমাকে একটা চাকরির ব্যবস্থা করে দিতে পারেন। বেতন ধরো আট শ থেকে এক হাজার দেড় হাজার।
-যাবো একদিন আপনার সঙ্গে রেডিওতে।
খালেক বিন জয়েনউদ্দীন কথা রেখেছেন। কয়েকদিন পরে সত্যি রেডিওর অন্বেষা অনুষ্ঠানের একটা চুক্তিপত্র এনে দেন শফিক হায়দারের হাতে। অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ বাবদ সম্মানী পঁচাত্তর টাকা। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে চুক্তিপত্রের প্রতিটি শব্দ পড়ে শফিক। কত সব অবাক নিয়ম, এত সব নিয়ম মেনে অনুষ্ঠান করা সম্ভব?
খালেক ভাই বলেন, চুক্তপত্রের শেষ পাতার আগের পাতায় সই করে আমাকে দিয়ে দাও।
-দিলে?
-আমি নিয়ে রেডিওতে জমা দেবো। জমা দিলে অনুষ্ঠানের প্রযোজক তোমার নামে চেকের ব্যবস্থা করবে। আর জমা না দিলে বুঝবে তুমি অনুষ্ঠান করবে না।
-ঠিক আছে, আমি সিগনেচার করে দিচ্ছি।
শফিক হায়দার রেডিওর অন্বেষা অনুষ্ঠানের চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করে খালেক বিন জয়েনউদ্দিনের হাতে দেয়। তিনি পকেটে রাখেন স্বাক্ষরিত চুক্তিপত্র। বাড়িতে চিঠি লিখে মা-ভাই-বোনদের জানায়, অন্বেষা অনুষ্ঠানের প্রচার সময়। অনুষ্ঠানের প্রচার সময় বেলা সাড়ে বারোটায়। নির্দিষ্ট দিনে সবচেয়ে ভালো প্যান্ট আর শার্ট পরে আগারগাঁও জাতীয় বেতার ভবনে যায় শফিক হায়দার। খালেকই রিসিভ করেন গেটে। নিয়ে যান প্রযোজকের কাছে। প্রযোজক একজন ভদ্রমহিলা। বিশাল বেতার ভেবন- লাল সিরামিক ইটের।
বেতার ভবনে ঢুকেই বিরাট লাউঞ্জ। লাউঞ্জের দেয়ালঘেঁষে প্লাসটিকের বড় বড় চেয়ার। তিনতলা ভবনের নিচতলায় বেতার আধিকারিকদের বসার চেয়ার টেবিল। দোতলায়ও বসার ব্যবস্থা। দোতলার মধ্যেখানে স্টুডিও। অনুষ্ঠানে যারা অংশ নেবেন, তারা সবাই চলে এসেছেন। অনুষ্ঠান পরিচালনা করবেন সিটি কলেজের বাংলার শেখর ইমতিয়াজ।
হালকা পাতলা গড়নের মানুষটির মুখটা সারল্যের সৌন্দর্য মাখানো। আরও দুই জন অংশগ্রহণকারী ছিলেন কিন্তু তারা সাহিত্য সম্পর্কে কিছুই জানতেন না। মূলত অনুষ্ঠানে কী বলা হবে, কে কোন প্রশ্নের ইত্তর দেবে, তার সবই সাজানো লিখিত আকারে।
শফিক হায়দারের প্রখরতায় শেখর ইমতিয়াজ প্রভাবিত। অনুষ্ঠান শেষ কার্ড দিয়ে বললেন, তুমি এসো আমার কলেজে।
শফিক হায়দারের আর একটা দরজা খুলে যায়।
অনুষ্ঠানের পর খালেক বিন জয়েরউদ্দিন দোতলায় সহকারী পরিচালক এম এ হালিমের রুমে নিয়ে যান শফিককে। পরিচয়ের পর হালিম চৌষট্টি পৃষ্ঠার একটা পত্রিকা হাতে দিয়ে বলেন, বাসায় এসো। পত্রিকার ভেতরে বাসার ঠিকানা আছে, মতিঝিল কলোনীতে।
শফিক হায়দারের আর একটা দরজা খুলে যায়।
বাংলাদেশ লেবার পার্টির অফিসে থাকার সময়ে শফিক হায়দার মাওলানা মতিনের খুব কাছাকাছি পৌঁছেছিল। প্রথম খুব ভালো বলতে পারতো, মাইকে। লেবার পার্টি পুস্তক বাঁধাই শ্রমিক ও ঠেলাগাড়ি শ্রমিকদের নিয়ে দুটি সংগঠন চালাতেন। সেই সংগঠনের শ্রমিকদের নিয়ে এরশাদ জমানায় বাইতুল মোকাররমের সামনে জনসভার আয়োজন করতেন। সেই জনসভার জন্য ঢাকা শহরে মাইকিং করার দায়িত্ব পায় শফিক হায়দার।
ঢাকায় যেতে হলে কমপক্ষে মেট্রিক পাস করাটা জরুরি। লেখক হওয়ার বাসনাকে বুকের গভীর দেয়ালে এঁকে রেখে নিঃশব্দে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে, অবুজ পাখির মতো।
রিকশার পেছনে মাইকের হর্ন বেঁধে রিকশায় বসে বলে, ভাইসব আসছে অমুক তারিখ, তমুকবার বেলা চারটায় ঐতিহাসিক বাযতুল মোকারমের সামনে বাংলাদেশ লেবার পার্টির উদ্যোগে বিরাটা জনসভার আয়োজন করা হয়েছে। উক্ত জনসভায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্তিত থেকে বক্তব্য রাখবেন বাংলাদেশের শ্রমিক আন্দোলনের প্রাণ পুরুষ, ইসলামের বিশিষ্ট চিন্তাবিদ, জনগণের বন্ধু জনাব আবদুল মতিন। বাংলাদেশ লেবার পার্টি আয়োজিত জনসভায় উপস্থিত থেকে আওয়াজ তুলুন…।
যদিও মাইকে, পোস্টারে বলা হয়েছে বিরাট জনসভা কিন্তু নির্দিষ্ট তারিখে, যথাসময়ে দেখা যেতো বিশাল বাইতুল মোকাররমের নবাবপুর মুখী খোলা প্রান্তরে শ পাঁচেক থেকে হাজার খানের লোক জড়ো হয়েছে ক্ষুদ্র মঞ্চের সামনে। সেই মঞ্চে দাঁড়িয়ে মাওলানা আবদুল মতিন অন্যান্য রাজনৈতিক দলের নেতার মতো গলা কাঁপিয়ে বাংলাদেশ ও বিশ্বকে তুলাধুনো করে বক্তব্য রাখছেন। মনে হচ্ছে, বায়তুল মোকাররমের সামনে লেবার পার্টির এই জনসভার মধ্যে দিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতি তাওয়ায় পোড়া রুটির মতো ঝলসে যাবে, এরশাদের আজকে শেষ দিন। সকালের মধ্যেই বাংলাদেশে নতুন কেউ, এমনকি মাওলানা মতিনও ক্ষমতায় আসতে পারেন। বেওকুফ উপস্থিত জনতা হাততালিও দেয়, শফিক হায়দারও দেয়। কিন্তু মগজের দেয়ালে সেই ছবিগুলো সরে না, একজন শ্রমিকও না আসার পরও মাওলানা মতিন পত্রিকায় বিবৃতি পাঠান, আজ টঙ্গির শ্রমিক এলাকা থেকে কয়েক হাজার শ্রমিক লেবার পার্টির প্রধান মাওলানা মতিনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে এসেছেন। সাক্ষাৎ অনুষ্ঠানে মাওলানা মতিন বলেন…।
রুটি-রুজি আর গ্রামের বাড়িতে অসহায় মা, ছোট-ভাই-বোনদের খাইয়ে পড়িয়ে বাঁচিয়ে রাখার দায় কাঁধে। আপতত আদর্শ প্যান্টের পেছনের পকেটে রেখে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়াই জীবনের ধ্রুব হোক। লেবার পার্টির অফিসে অনেতে থাকার সুবাধে অনেকের সঙ্গে শফিক হায়দারের পরিচয় ঘটে। সেই পরিচয়ের অন্যতম মাহমুদ হাসান, জাকির হোসেন চৌধুরী, শাহ আলমসহ অনেকেই বন্ধু। কিন্তু মাহমুদ অন্যরকম। ওর বাবা মাওলানা। ভান্ডারিয়ার গঞ্জে মামার বাড়ির সূত্রে মাওলানা মতিনের অফিসে আসা ও থাকা। বেকার চব্বিশ ঘণ্টা। খুঁজছে চাকরি।
-লজিং থাকবি? মাহমুদ হাসান জিজ্ঞেস করে।
-মানে? ঢাকা শহরে লজিং পাওয়া যাবে কোথায়?
মাহমুদ বলে, পাওয়া যাবে না, পাওয়া গেছে। এখন তুই রাজি থাকলে ক। রামপুরার উলন রোডে কয়েকটা লজিং পাওয়া গেছে। আমি একটা নেবো, তুই নিবি?
শফিক হায়দার হিসাবে বসে যায়, আত্মীয় এমএ হালিমের কল্যাণে রেডিওতে চুক্তিভিত্তিক একটা চাকরি হয়েছে। নো-ওয়ার্ক নো-পে-চুক্তি এক মাসের, যেদিন যাবে অফিসে সেদিনের বেতন পাওয়া যাবে মাসের শেষে হিসাব করে, যেদিন অফিসে যাবে না, সেদিনের বেতন হবে না। গড়ে মাসে বেতন সাড়ে সাত শত টাকা। এই সাড়ে সাতশত টাকা সম্বল করে, একটা লজিং পেলে তিন বেলার খাওয়া দায় থেকে মুক্তি পেলে বেশ কিছু টাকা বাড়িতে পাঠানো যাবে। আর রাজনীতির এই ভণ্ডামির আখড়া থেকেও মুক্তি মিলবে।
মাহমুদের প্রস্তাবে রাজি হয় শফিক হায়দার, ঠিক আছে, লজিং থাকবো।
কিন্তু একটা সমস্যা আছে।
-কী সমস্যা?
-থাকতে হবে নিজের খরচে। শহরের বাড়ি, লজিং মাস্টারের থাকার জায়গা দিতে পারবে না।
-তুই থাকবি কী করে?
-যে বাড়িতে পড়াবো, সেই বাড়ির আশেপাশে একটা মেস ভাড়া নিয়ে থাকবো।
-পড়াতে হবে কোন কোন শ্রেণীর?
-দুইটি মেয়ে, ওরা পড়ে ওয়ানে আর একটি ছেলে। ছেলেটি পড়ে থ্রিতে।
সপ্তম শ্রেণীতে পড়ার সময়ে বাবা তবিবুর রহমান হঠাৎ মারা গেলে, সংসারে নেমে আসে ক্ষুধার আক্রা। একবেলা খাওয়া জোটে তো আর একবেলা জোটে না। এই ত্রিশঙ্কু অবস্থায় বড় ভাইয়ের সহায়তায় নবম শ্রেণীতে পড়বার সময়ে বাড়ি থেকে অনেক দূরে, মোড়েলগঞ্জের সুতালড়ি গ্রামে একটি বাড়িতে লজিং নিয়ে চলে যায়। জীবনে প্রথম লজিং।
গ্রামীণ পরিবেশ। ছোট ছোট তিনটি ছেলেকে পড়ানোর বিনিময়ে থাকা খ্ওায়া। তিনটি ছেলে নয়ন, আপন আর চয়ন। নয়ন থ্রি, আপন টু আর চয়ন ক্লাস ওয়ানে পড়ে। পকেট খরচের জন্য খুলনা থেকে খালাতো ভাই আনোয়ার হোসেন পাঠায় পঞ্চাশ টাকা। নবম শ্রেণীর ছাত্র বিধায় শফিক লজিং মাস্টার হয়েও পরিবারের সঙ্গে মিশে যায়। গাছের ডাব পাড়া, পুকুরের মাছ ধরা, সংসারের বাজার করা সবই করে। গৃহস্বামী, নয়নদের বাবা মোতালেব হোসেন থাকে মোড়েলগঞ্জ বন্দরে। বন্দরে বিরাট মুদির দোকান চালায়। গ্রামের বাড়ি দেখাশোনা করে নয়নের দাদা, তোবারক হোসেন। মোতালেব হোসেন সহজ সরল হলেও পিতা তোবারক হোসেন খুব হিসেবী। লজিং ছয় সাত মাস চলে যাবার পর তোবারক হোসেন একদিন ডেকে বললে, শোনো শফিক আমি আর লজিং মাস্টার রাখবো না। আজ মাসের পঁচিশ তারিখ। তুমি আগামী মাসের এক তারিখের পর কোথায়, থাকবে ঠিক করে নিও।
শফিকের মাথার ওপর শুধু আকাশ না, আকাশের সঙ্গে পাহাড় পর্ব্বতও ভেঙে পড়ে। এই বিজন এলাকায় কোথায় পাবে লজিং। পরের দিন দক্ষিণ সুতালড়ি এইচ এম জেকে এম হাই স্কুলের শিক্ষক বিমল সমাদ্দরকে জানায়, স্যার আমাকে তো লজিং রাখবে না।
সব সময়ে কালো শরীরের সাধা ধুতি আর সাদা পাঞ্জাবি পরিহিত বিমল সমাদ্দার প্রশ্ন করে, কেন?
বিমল সমাদ্দার উজানগাঁওয়ের জামাই। বিয়ে করেছেন শফিক হায়দারের বাড়ির পূর্ব দিকে, পূর্ব পাড়ায়। বড় ভাই রুহুল আমিনের সঙ্গে পরিচয় ছিল। সেই সূত্রে অত দূরের এলাকায় লজিং নিয়ে যাওয়া শফিক হায়দারের। শফিক তো জীবনের যাত্রা ঠিক করেছে, লেখক হবো। লেখক হতে হলে মেট্রিক পাস করা ছাড়া উপায় নেই। লেখক হওয়ার জন্য যেতে হবে ঢাকায়। ঢাকায় যেতে হলে কমপক্ষে মেট্রিক পাস করাটা জরুরি। লেখক হওয়ার বাসনাকে বুকের গভীর দেয়ালে এঁকে রেখে নিঃশব্দে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে, অবুজ পাখির মতো।
বিমল সমাদ্দরের প্রশ্নে জবাব দেয় শফিক, তোবারক দাদা জানিয়েছেন, বাড়িতে লজিং মাস্টার রাখলে তিন বেলা খাওয়ার খরচ, থাকার খরচ কমপক্ষে পঞ্চাশ টাকা। মাসে কত টাকা? এক হাজার পাঁচশত টাকা। আর একজন টিউশনির মাস্টার রাখলে মাসে খরচ মাত্র তিনশো টাকা। তো আমি তোমারে আমার বাড়িতে কেন রাখবো?
মৃদু হাসে, তোমাকে এমন বলেছে?
-জি, মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে শফিক, আরও বলেছে দাদা, এই মাসের পর আগামী মাস থেকে খাবার বন্ধ করে দেবে। এই সময়ের মধ্যে আর একটা লজিং ঠিক করে নিতে।
দক্ষিণ সূতালড়ি এইচ এম জে কে এম হাই স্কুলের লম্বা বারান্দায় দাঁড়িয়ে আলাপ করছে শফিক আর বিমল সমাদ্দার। স্কুলের সামনে রিবাট মাঠ। মাঠের পর একটা বড় পুকুর। পুকুর আর স্কুলের লাগোয়া সুতালড়ি বাজার। বাজারের পেছনে সোঁতার মতো একটা খাল। খালের ওপর একটা কাঠের ভাঙা পুল আদ্যিকালের ক্লান্তি নিয়ে ঝুলছে।
হোসেন আরা গভীর আয়াত দৃষ্টি মেলে তাকায়, আপনি যেদিন আমাদের ক্লাসে এসেছেন, সেইদিন থেকে লক্ষ্য করেছি খুব হাসি-খুশি মানুষ আপনি। কখনো আপনাকে বিষণ্ন দেখিনি। কিন্তু গতকাল, আজ আপনি খুব বিষণ্ন। আপনার কি টাকা-পয়সার দরকার? আমাকে বলতে পারেন। এখন নিলেন, পরে শোধ করে দেবেন। একলা থাকেন, প্রয়োজন তো হতে পারে।
শফিকের মাথায় হাত রাখে বিমল সমাদ্দার, তুমি চিন্তা করো না শফিক। আমি দুই-একদিনের মধ্যে তোমার জন্য আর একটা লজিং ঠিক করে দেবো।
বিমল সমাদ্দারের অভয় বাণী মাথায় নিয়ে ক্লাসে ঢোকে শফিক। ক্লাসে পড়াচ্ছেন লাল মিয়া। মাঝারী গড়নের স্বাস্থ্য স্যারের। সময়ে পড়েন হাফ শার্ট আর প্যান্ট। গোলাকার মুখের ওপর মানানসই গোলকার চশমা। লাল মিয়া পড়ান ইতিহাস। আর ইতিহাস খুব প্রিয় সাবজেক্ট শফিকের। ইতিহাস পাঠের মধ্যে দিয়ে নিমিষে যাওয়া যায় ফেলে আসা হাজার বছরের কাছে।
ক্লাসে ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা পঞ্চাশ। নিয়মিত আসে ত্রিশ থেকে পয়ত্রিশ জন। ছাত্রী দশ থেকে পনেরো জন। আসে নিয়মিত সাত থেকে আট নয়জন। কল্পনা সমাদ্দার খুব সুন্দরী, ভারী স্বাস্থ্য। মাথায় প্রচুর চুল দুপাশে ছড়িয়ে রাখে। ওর প্রতিও ক্লাসের সব ছেলের আকর্ষণ। কিন্ত শফিকের আকর্ষণ হোসনে আরার প্রতি। হোসনে আরার গড়ন হালকা পাতলা। মুখটা একটু বেশি শ্যামলা। গোলাকার শ্যামলা মুখের ওপর চোখ দুটি কালো ভ্রমের ছবির মতো জেগে থাকে, আর আয়াত দৃষ্টির মধ্যে লুকিয়ে থাকে কালো পদ্ম।
হোসনে আরার প্রতি মাঝে মাঝে তাকায় শফিক। হোসনে আরা বোঝেও। চোখে চোখ পড়লে হালকা পলক নাড়ায় হোসনে আরা। এই পরিস্থিতিতে লজিংয়ের হঠাৎ অনিশ্চিত ঝামেলায় শফিক হায়দার ভেতরে ভেতরে টালমাটাল।
লাল মিয়ার ইতিহাস ক্লাসটা ভালো লাগার অন্যতম কারণ, যখন যে চ্যাপটার পড়ায়, সেই চ্যাপটারের চরিত্রগুলো ক্লাসের ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে বণ্টন করে দেয়। যেমন পড়াচ্ছে মুগল সম্রাট আরঙ্গজেব। তিনি একজনকে আরঙ্গজেব, আর একজনকে সম্রাট শাহজাহান, আর একজনকে সম্রাট শাহাজানের প্রিয় কন্যা জাহানারা, আর একজনকে রওশন আরা, আর একজনকে শাহজাদা দ্রাাশিকো বানিয়ে পড়াতেন। ফলে, কঠিক পড়াটা খুব সহজ হয়ে যতো। আর এইসব চরিত্র বা ইতিহাসের ঘটনাবলী আগে থেকেই জানে শফিক, লাল মিয়া আর শফিকের মধ্যে জমে ওঠে। আজ আর ইতিহাসের কোনো চরিত্র প্রবেশষ কবরছে না শফিক হায়দারের করোটিতে। একটাই চিন্তা, কী হবে আর পাঁচদিন পরে?
ক্লাস শেষে সবাই বের হয়ে গেলেও বসে থাকে শফিক। যা স্বভাববিরুদ্ধ। ক্লাস শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে স্যারের পিছু পিছু বের হয় ও। রুমের মধ্যে আটকে থাকাটা ওর স্বভাব বিরুদ্ধ। হোসনে আরাও বের হয়ে যায় কমন রুমের দিকে। খেয়াল করে না আজ হোসনে আরার গতি।
মন খারাপ? সামনে তাকায় শফিক। সামনে দাঁড়িয়ে হোসনে আরা। বই নিয়ে পড়ের প্রিয়ডের জন্য আগেই চলে এসেছে রুমে। দাঁড়িয়ে শফিকের মুখোমুখি।
অবাক শফিক দাঁড়ায়, নাহ।
একটা রুমের মধ্যে বসে আছেন যে? গলায় প্রচ্ছন্ন আবেগ।
এমনিই…কী বলবে বুঝতে পারে না শফিক হায়দার। এমন একটা কস্তুরীগন্ধ মেয়েকে কী করে বলে, আমার লজিং নাই। কী খাবো, কোথায় যাবো, ভেবে কুল পাচ্ছি না। এড়িয়েই যাওয়াই উত্তম।
ও! হোসনে আরা আর শফিক টের পায় কমনরুম থেকে অন্যরা আসছে, পায়ের শব্দ আসছে। হোসনে আরা দ্রুত নিজের বেঞ্চে বসে। ক্লাস চলে গণিতের। এ্যলজাবরা করাচ্ছেন স্যার। গণিত অনেকর কাছে খুব সহজ..। কিন্তু শফিকের জীবনের শত্রু। কিভাবে সবাই অ্যালজাবরার সূত্র মেলায়, বুঝতে পারে না ও। গণিতের ক্লাসের সময়ে মাথাটা ঝিম ঝিম করে। কত হাজার এ প্লাস টু হোলেস্কোয়ারের ফরমুলা মুখস্ত করতে চেয়েছে, হাজা হাজার বার পড়েছে কিন্তু কোনোদিন মুখস্থ হয়নি। আর গণিতের সরল, ঐকিক আর সুদকষা মনে হয়েছে বিরাট বিরাট গাছের গুঁড়ি, মগজের ওপর দিয়ে চলে যাচ্ছে।
আপনার কী সমস্যা? গণিতের ক্লাস শেষ। স্যার চলে গেছেন শিক্ষক রুমে। পেছনে পেছনে গেছে ছাত্রীরা। টিফিন পিরিয়ড শুরু হয়েছে। ক্লাসে কেউ নেই দুই-জন ছাড়া। একজন হোসনে আরা। আর একজন শফিক হায়দার। কিন্তু হোসনে আরা পেছনে থেকে রয়ে গেছে রুমে।
দাঁড়ায় শফিক। দুজনে মুখোমুখি। কী জবাব দেবে, বুঝতে পারছে না শফিক হায়দার। কিন্তু এক অজানা আনন্দে বুক শরীর মন কাতর হয়ে উঠেছে। হোসেন আরা গভীর আয়াত দৃষ্টি মেলে তাকায়, আপনি যেদিন আমাদের ক্লাসে এসেছেন, সেইদিন থেকে লক্ষ্য করেছি খুব হাসি-খুশি মানুষ আপনি। কখনো আপনাকে বিষণ্ন দেখিনি। কিন্তু গতকাল, আজ আপনি খুব বিষণ্ন। আপনার কি টাকা-পয়সার দরকার? আমাকে বলতে পারেন। এখন নিলেন, পরে শোধ করে দেবেন। একলা থাকেন, প্রয়োজন তো হতে পারে।
চলবে…
মোকাম সদরঘাট-২০॥ মনি হায়দার