জন্ম যাতনা থেকে
কবিতা কেন প্রিয়? বিশেষ করে নিজের কবিতা— বহু উত্তর হতে পারে। তবে আমার কাছে এর উত্তর নেই। আমার নিজের কোনো প্রিয় কবিতা নেই। যা আছে তা হল অতৃপ্তি। প্রতিটি কবিতা সম্পন্ন করার পর একরাশ অতৃপ্তি এসে ঘিরে ধরে, হচ্ছে না, হচ্ছে না— যা বলতে চাইছি তা বলতে পারছি না। যে ভাষার খোঁজে আছি, তা এখনো সুদূর। সেই সুদূর থেকে নিজের কিছু কিছু কবিতা আমাকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করে। অনুপ্রাণিত করে।
আমার দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থে (শোকার্ত আলোর নীচে) একটি কবিতা আছে, নাম—শ্মশানময় কর্পূর ছড়িয়ে দিচ্ছে একটি সংক্ষিপ্ত সঙ্গমঘ্রাণ। এই কবিতাটি জন্মরহস্য বেশ অদ্ভুত। কারো কারো কাছে সেটা অনৈতিক বা বিকৃতিও মনে হতে পারে। একটি মৃতদেহের প্রতি প্রবল প্রণয় থেকে এই কবিতাটির জন্ম। প্রেম, আসক্তি নয়। একটি অসুখ আছে, মৃতদেহের প্রতি আসক্তি। সেই ন্যাক্রোফিলিয়া থেকে এই কবিতার উদ্ভব নয়। একটি লাশের প্রতি, তার বয়স বা লিঙ্গ এখানে মুখ্য ছিল না, প্রেম আমাকে বিপন্ন করে তুলেছিল। ভয়াবহ দুঃস্বপ্নে ডুবিয়ে দিয়েছিল। সেই ভীষণ অভিজ্ঞতা থেকে আমাকে মুক্তি দিয়েছিল এই কবিতা।
না, সে রাতে আমার যৌনাঙ্গ উষ্ণ হয়ে ওঠেনি, হৃদয় ব্যাকুল হয়ে উঠেছিল। প্রেমে ভরে উঠেছিল মন। ভক্তিরসে পূর্ণ হয়ে গিয়েছিল আমার নাস্তিক হৃদয়। সেই হৃদয় থেকেই জন্ম নিয়েছে এই কবিতা—
কতকাল পর সে আমাকে ডাকল, কফিনের ভেতর থেকে কর্পূরের গন্ধ মাখানো নামে।
বাইরের দুনিয়ার তাবৎ মূর্খরা তখোন স্বপ্নাবিষ্ট হয়ে হাস্যকর জীবন যাপন করছিল; সে আমাকে ডাক দিল গাঢ় ঘুমে আচ্ছাদিত নাম ধরে।
তার কণ্ঠস্বরের ভেতর বন্দি আমি হবার বদলে চূর্ণবিচুর্ণ হয়ে গেলাম; অতঃপর শিকারির চোখের মতো স্থির হলাম এবং মিশে গেলাম হিমায়িত রোদে।
কতকাল পর আমি তাকে ছুঁয়ে দেখলাম—কেউ জানতে পারেনি কফিনে নিদ্রিত শীতের নিঃরোদ উপাখ্যান; কেউ জানে না শ্মশানময় কর্পূর ছড়িয়ে দিচ্ছে একটি সংক্ষিপ্ত সঙ্গমঘ্রাণ।
(শ্মশানময় কর্পূর ছড়িয়ে দিচ্ছে একটি সংক্ষিপ্ত সঙ্গমঘ্রাণ)
আরেকটি কবিতা আমার শৈশবকে ধরে রাখতে পেরেছে। সেটিও সন্নিবেশিত হয়েছে আমার দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থে। এই সময় নতুন ভাষা ও আঙ্গিকের খোঁজে হন্যে হয়েছিলাম। সে সময় আমাকে ভাষা দিয়েছিল আমারই শৈশব। অষ্টাশির বন্যার হাঁটু জলে নেমে আমি ছুটে বেরিয়েছিলাম অতীতের নানা বাঁকে। শুধু কবিতার খোঁজে—
এখনো স্মৃতিভ্রষ্ট হই নাই।
পুকুরের ঢেউয়ে বালিশ সাজায়ে রাখা অন্যায় হবে— এরকমই বিধান ছিলো আমাদের শৈশবে; মানে মাননীয় এরশাদ যখন বন্যার পানিতে নেমে বাংলাদেশ টেলিভিশনের ক্যামেরার সামনে পোজ দিতেছিলেন।
এরকম শৈশব সবার আসে না। এরকম ডাহুক শিকার সবাই পারে না।
ফাঁদ পেতে বসে থাকতে হয় সুদীর্ঘকাল—ছোট্ট একটা মাছের কথা এখনো মনে আছে; আধডুবো ধানের ভিতরে আশৈশব বসে থেকে মাছটির চোখের রূপালি রঙ চিনতে পেরেছিলাম। রূপালি পর্দার মতো ক্লাইমেক্সে ভরপুর সাঁতার প্রতিযোগিতা চলতেছিলো তখোন সেই চোখে।
মাসকালাই গাছের ডালে টিয়ে যখন কামরাঙা খোঁজে
তখন বুঝতে হয় অনর্থ হয়ে গ্যাছে কোথাও; কোথায়?
হাফপ্যান্টের পকেটে এসবের কোন উত্তর থাকতো না।মালতি। আমাদের মধ্যে তুইতো সবচে’ ভালো সাপলুডু খেলতি। সেজন্যই কি ওঝা সর্দার তোকে গোপন করেছিলো এক রাতের জন্য।। ফিরে এসে আর কোনোদিন লুডুর বোর্ডে হাত দিসনি। তারপর থেকে তুই আগুন ভালোবাসতি খুউব। আমি জানতাম; আমরা দেখেছিলাম এক ভোরে আগুনের সাথে তোর ভষ্মদীর্ণ মিলন ছাই।
আমাকে কি তোর মনে আছে আফিয়া বানু? অন্ধচোখে কীভাবে স্বপ্ন দেখা যায়, আমাকে শেখাবি? আফিয়া, আফিয়া লো, তুইও শেষমেশ শিখে গেলি নাগরিক নিঃশ্বাস! ভুলে গেলি ভালোবাসার মতো আর কিছুই ছিলো না তোর, কেবল বাম বাহুর জ্বলজ্বলে টিকার দাগ ছাড়া—একটি নীরব কিশোর যার পাণিপ্রার্থী ছিলো।
কতটা উচ্ছন্নে গেলে মালতির স্বপ্নে সুরেশ নেমে আসে?
কতটা উচ্ছন্নে গেলে সুরেশের চোখে আফিয়ার স্বপ্ন দেখা যায়?কলসেন্টারের কোকিল কণ্ঠীরা উত্তরহীন; নিঃশব্দে কাঁদে— জুনের দুপুরে সড়কের পাশ ঘেঁষে বসে থাকা কুমোরের মাটির হাড়িতে এইসব শৈশব রক্ষিত আছে জেনে।।
(রুপালি চোখ, আগুন আর বাম বাহুর টিকার দাগ)
আরও একটি কবিতা আছে ‘শোকার্ত আলোর নীচে’-তে। আমি যা বলতে চেয়েছি, যে ভাষায়, এই কবিতাটিতে তা আমি মনে হয় কিছুটা করতে পেরেছি। আমার নিরিশ্বরবাদী মন বার বার ছুটে যেতো দেবীর অধরে— প্রতিমা থেকে পুরাণে। সেই ভ্রমণ থেকেই উঠে এসেছে এই কবিতা। কোনো দর্শন বা রাজনীতির বাহুল্য নেই, কেবল প্রেম ছুঁতে চেয়েছে এই শিকারী কবিতা—
আমি তার কিন্নর কণ্ঠ শুনতে পাই।। সে আমার নাভীদেশে হলুদ ফুলের সন্ধান করে বেড়ায়।। মৃত মৃগের অস্থির ভেতরে তলিয়ে যায় তার প্রসিদ্ধ যৌবন— রতিসংলাপ।।
আদ্যশক্তি, আর কত নিদ্রা যাবে? এবার আমার স্পর্শের প্রত্যুত্তর কর।। তোমার নক্ষত্র খচিত পাঁজর থেকে আমি তাকে মুক্ত হতে দেখেছি।। তার হাতে ক্রুশবিদ্ধ জেরুজালেম— উলঙ্গ যিশুর সামনে সুনীল শৈশবে বেড়ে উঠছে নিষ্পাপ জুডাস।।
দেবী, হে সিক্ত-যোনী মহামায়া, আমার নাভীমূলে প্রবল চুম্বন দাও— সে মৃত হরিণের মজ্জার ভেতরে জুডাসের গোপন দীর্ঘ রাত।।
(মৃগয়া)
আমার বয়স তখন সাতাশ। লিখে ফেললাম অটোবায়োগ্রাফি। এই কবিতা কী করে উপেক্ষা করি আমি? এটিও রয়েছে আমার দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থে।
বেড়ে ওঠা ছাড়া আর কিছুই হতে পারিনি। তোমার দিকে তাকালেই সময়ের মানচিত্র দেখি, ভূগোল, ইতিহাস এবং ত্রিকোণমিতির ফলিত রূপ দেখি কী ভীষণ স্বচ্ছতায়। ছুঁয়ে দাও— অর্থ খুঁজে নেবো স্থবিরতার, হৃৎস্পন্দণের, ফুসফুসের অবিরাম পরিশ্রমী শিল্পের। কয়েকটি পোড়ামাটি এক করে জানিয়েছি, আমরা জেনে গেছি পিতামহীর সপ্তকোটি নাম, করোটির মেঘ, চিবুকের সঠিক পরিমাপ; জেনে গেছি, এখানে একদা গোপনে প্রোথিত ছিলেন কোন এক রজঃমানবী, তার কটিবন্ধের সুঘ্রাণ এখনো বর্তমান প্রত্নবিভাগের পশ্চিম ঘরে। এ সত্য টের পাই তোমার ঘামঘন নিবিড় শীৎকারের মুহূর্তে— টের পাই, বাজির ঘোড়া কেবলি হেরে যায় এ সাতাশে এসেও তেমন,
(ব্যক্তিগত প্রত্নবিদ্যা)
একটি কবিতা, আমার ব্যক্তিগত প্রেমের সঙ্গে সম্পর্কিত। দু’হাজার এগার সালের মে মাস। আমি তখন প্রেমে মশগুল সময় পার করছিলাম। তখন কবি মুক্তি মণ্ডল তার পেশাগত কাজে নোয়াখালী গিয়েছিলেন। সেই সময়ের কথা। আমরা, মানে আমি, মুক্তি মণ্ডল ও আরো কয়েকজন আড্ডা দিচ্ছিলাম মাইজদি কোর্ট রেল স্টেশনে। তুমুল বৃষ্টি। সেই বৃষ্টি ভেদ করে একসময় স্টেশনে ঢোকে উপকূল এক্সপ্রেস। কী রাজকীয় ভঙ্গি, হঠাৎ প্রাণচাঞ্চল্য দেখা দেয় স্টেশনে। আমাদের আড্ডাও জমে ওঠে পাল্লা দিয়ে। বিশাল ট্রেন যেন এক ধাতব হাতি, যার উপর ঝরে পড়ছে বৃষ্টি। সেই রাতে জন্ম নেয়, ‘ইস্টিশনে বিষ্টি’ নামে আমার একটি কবিতা। যা শুরু হয়েছে ট্রেনের গাম্ভীর্যের প্রতি মুগ্ধতা দিয়ে, আর শেষ হয়েছেপ্রেয়সীর শরীরে বৃষ্টি পড়ার দৃশ্য কল্পনা করে। সেই বৃষ্টির ফোঁটা যেন কোমল পয়ারের মতো তার শরীর ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছিল— কবিতাটি স্থান পেয়েছে আমার তৃতীয় কাব্যগ্রস্থ ‘প্রেম ও অন্যান্য কবিতা’য়।
আমরা পার করছি আর্দ্র সময়;
বিশাল হাতির মতো ট্রেন আসে ধীরে মুষলবৃষ্টিতে,
জীবন ফিরে পায় স্টেশান; তুমুল হর্ষ তুলে মালগাড়ি
থেমে পড়ে লৌহকংক্রিটে।তুমি আমি দর্শকবিন্দুতে বসে দেখছি
ত্রিশ মে’র বৃষ্টিরাশি পড়ছে অতিকায় ট্রেনে;ধাতব সংঘর্ষ ছাপিয়ে বৃষ্টিশব্দে মুখর হয়
আমাদের স্টেশান, স্মৃতিকাতর দ্বৈত আচরণ
বিপুল ধ্বনিধর্ষণ করে চলে গ্যালে ট্রেন
বিমর্ষ পেয়ালারা পিরিচের উপর বসে ঢলাঢলি করে।আমি তিরিশ বছর পুরোনো জন্মকল্পের দিকে ফিরে যাই
তোমার দেহপায়রার উপর অবিরল ঝরে চলে বৃষ্টির পয়ার
(ইস্টিশনের বিষ্টি)