কবি হিসেবে কাজী নজরুল ইসলাম অবিশ্বাস্য খ্যাতি ও জনপ্রিয়তা লাভ করেছিলেন। তবে ঔপন্যাসিক হিসেবে তিনি বিশেষ খ্যাতি অর্জন করতে না পারলেও তার উপন্যাসগুলোর মধ্যে চেতনা ও দেশপ্রেমের যে অগ্নিশিখা প্রজ্বলিত, তার মূল্য অনেক। একই সঙ্গে ব্যক্তি নজরুলকেও পাঠ করার জন্যে তার উপন্যাস অগুরুত্বপূর্ণ নয়। আর একটি ব্যাপার, নজরুলের উপন্যাসের মান যে পর্যায়ের হোক না কেন তার অবিসংবাদিত কবিখ্যাতির কারণে উপন্যাসগুলো বহুল পঠিত হয়। বিশেষ করে তার ‘কুহেলিকা’ এখনো পাঠকের অধিক আগ্রহের বিষয়। এ উপন্যাসটি ‘বিপ্লবী উপন্যাস’ও বলা যায়।
ব্রিটিশশাসিত ভারতবর্ষের নানামাত্রিক আন্দোলন ও ইংরেজের দুঃশাসন সেসময় অনেক লেখকের রক্ত-কালিতে ফণা হয়ে ফুটে উঠেছিল। নজরুল তাঁদের মধ্যে বিশেষ ও অন্যতম। কবিতার মতো তার উপন্যাসও অগ্নি-বারুদ ফুটে উঠেছিল। কার্যত, সেই সময়কালই ছিল অগ্নি-বারুদের উপর দাঁড়ানো। পরাধীনতার যন্ত্রণার বিষাক্ত ছোবলে নানামাত্রিক সাহিত্য সৃষ্টি হয়েছে, অগ্নিফসলের মতো, যা বুলেটের চেয়েও ছিল ভয়ঙ্কর। বাংলার প্রায় সব প্রধান লেখকই সে-অগ্নিকালকে ধারণ করে সাহিত্যে আগুনের ফসল ফলিয়েছেন, আন্দোলন-সংগ্রামে যুক্ত করেছেন দৃঢ়প্রত্যয়, অপ্রতিরোধ্য জাগরণ। তবে সে সময়ে আন্দোলনের ধারা একরৈখিক ছিল না। একদিকে অহিংস বা আপসকামিতা, অন্যদিকে সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে পরাধীনতা থেকে মুক্তির পন্থা সুনির্দিষ্ট। ধারা দুটি স্পষ্ট। সাহিত্যসৃষ্টিতেও তা লক্ষণীয়।
কবিতা বা প্রবন্ধে অথবা গল্পে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন যেভাবে ব্যাপক প্রভাব রেখেছে, সে-তুলনায় উপন্যাস সৃষ্টি হয়েছে তুলনামূলকভাবে কম। তখনকার প্রধান লেখকদের মধ্যে এক্ষেত্রে উদাসীনতা বা নীরবতার ব্যাপারটি সহজেই অনুমানযোগ্য। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়আনন্দমঠ((১৮৮৭) রাজনৈতিক উপন্যাস না হলেও কালেরযাত্রায় রাজনৈতিক উপন্যাসের তিলকটিই এ-উপন্যাসের কপালে লেগে গেছে। তবে বঙ্কিম সচেতনভাবে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনকে কেন্দ্র করে পূর্ণাঙ্গ কোন উপন্যাস রচনা করেননি। রবীন্দ্রনাথের গল্পে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন কখনো কখনো জায়গা করে নিলেও উপন্যাস হিসেবে পাওয়া যায় ঘরে-বাইরে। স্বদেশী আন্দোলনকে ঘিরে এ উপন্যাস রচিত হলেও রাজনৈতিক পূর্ণাঙ্গ উপন্যাস হিসেবে এটিকে অভিহিত করা যায় না। কারণ স্বদেশী আন্দোলনের প্রকৃত স্বরূপ এ উপন্যাসে ধরা পড়েনি। সন্দ্বীপের ভেতর দিয়ে স্বদেশী আন্দোলন বরং এখানে বিকৃত রূপ লাভ করেছে। স্বদেশী আন্দোলনকে ব্যবহার করে নিজে নেতা হয়ে উঠতে চেয়েছেন—যেখানে ব্যক্তিস্বার্থ বড় হয়ে উঠেছে। স্বদেশী আন্দোলনের নেতাদের চরিত্রের সঙ্গে যা কোনভাবেই যায় না। কারণ তাদের কাছে ব্যক্তিস্বার্থ তো দূরে থাক, নিজের জীবনের চেয়েও দেশের স্বাধীনতালাভ তাদের কাছে বড়। সন্দ্বীপে আমরা তা লক্ষ করি না। অনুমান করা হয় সন্দ্বীপ চরিত্রটি অরবিন্দর ছায়া অবলম্বনে তৈরি। কিন্তু বাস্তবে অরবিন্দর সঙ্গে সন্দ্বীপের আদর্শিক মিলের পার্থক্য অনেক। যদি সন্দ্বীপ অরবিন্দর ছায়ায় তৈরি ধারণা করি, তাহলে অরবিন্দ এখানে বিকৃত হয়েছে। অগ্নিযুগের পুরোপুরি রাজনৈতিক উপন্যাস হিসেবে ঘরে-বাইরে মান্য করা যায় না। প্রসঙ্গত, শরৎচন্দ্রের পথের দাবি রাজনৈতিক উপন্যাস। শরৎচন্দ্র নিজেও রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। কিন্তু খাঁটি রাজনৈতিক উপন্যাস তিনি একটিই লিখেছেন—পথের দাবি। কিন্তু একটিমাত্র কেন—এ প্রশ্নের উত্তর মেলানো ভারি মুশকিল। নজরুলের ‘কুহেলিকা’ উপন্যাস পথের দাবী-র প্রভাব অস্বীকার করা যায় না ।
পথের দাবী নিয়ে শরৎচন্দ্রকে সে-সময় যন্ত্রণা ভোগ করতে হয়। গ্রন্থটি ব্রিটিশদের পড়েছিল। নিষিদ্ধ হয়েছিল গ্রন্থটি। বাংলা-বিহারে গ্রন্থটি নিয়ে তোলপাড় তৈরি হয়েছিল। ‘কুহেলিকা’কে সে-রকম কোন নিয়তি বরণ করতে না হলেও ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনই এ গ্রন্থের মূল উপজীব্য। ‘পথের দাবী’ এবং ‘কুহেলিকা’ উপন্যাস দুটির চরিত্র সে-সময়ের অগ্নি-বিপ্লবীদের চরিত্র অবলম্বনে যে সৃষ্ট, তার প্রমাণ স্পষ্ট। অবশ্য সে সময়ে আরও অনেকেই উপন্যাসের চরিত্র বিপ্লবীদের চরিত্রের ছায়া অবলম্বনে নির্মাণ করেছেন। ‘পথের দাবী’ উপন্যাসের সব্যসাচী নানা ছদ্মবেশ ধারণ করতেন। বিদেশে বৈপ্লবিক সংগঠনের কল্পনাও শরৎচন্দ্র বাস্তব থেকে পেয়েছিলেন। তিনি ‘পথের দাবী’র উপাদানের জন্য তার চেনা বিপ্লবী অভিজ্ঞতা ব্যবহার করেছেন অনুমান করা যেতে পারে। বাস্তবত, এই একই কথা প্রযোজ্য হতে পারে ‘কুহেলিকা’র ক্ষেত্রেও।
‘কুহেলিকা’র চরিত্রের সঙ্গে পথের দাবীর সব্যসাচীর চরিত্রের মিল স্পষ্ট। সব্যসাচী চরিত্র নির্মিত একথাও উল্লেখ্য, প্রমত্ত চরিত্র সৃষ্টির ক্ষেত্রে নজরুলের স্কুল-শিক্ষক নিবারণ চন্দ্র ঘটকের প্রভাব রয়েছে। এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক রফিকুল ইসলামের বক্তব্য স্মরণযোগ্য:
‘‘সিয়ারসোল স্কুলে পড়ার সময় সন্ত্রাসবাদী বিপ্লব ‘যুগান্তর’ দলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট শিক্ষক নিবারণ চন্দ্র ঘটক বিপ্লববাদে নজরুলকে প্রভাবিত করেন। পরবর্তী জীবনে বিপ্লববাদীদের প্রতি নজরুলের যে আকর্ষণ তার সূত্রপাত এখান থেকেই। নজরুলের ‘কুহেলিকা’ উপন্যাসের বিপ্লবী স্কুল শিক্ষক প্রমত্ত চরিত্রে নিবারণ চন্দ্র ঘটকের ছায়া পড়েছে।’’
এ বক্তব্যের পক্ষে ‘কুহেলিকা’তে সমর্থনও আছে। “এমনি দিনে ‘জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরীয়সী’ মন্ত্রে এই কল্পনা-প্রবণ কিশোরকে দীক্ষা দিলেন তাহারই এক তরুণ স্কুল-মাস্টার প্রমত্ত। প্রমত্ত যে বিপ্লববাদী।” আরও অনেক গবেষকই প্রমত্ত-চরিত্রের ক্ষেত্রে নিবারণ ঘটকে কথা বলেছেন। প্রমত্ত-চরিত্র তৈরিতে নজরুলের মনে তার স্কুল-শিক্ষক নিবারণ ঘটকের ছায়া বা প্রভাবের সত্যতা ‘কুহেলিকা’তেই আছে। এটি নিয়ে দ্বি-মত পোষণের সুযোগ নেই। কিন্তু যে ব্যাপারটি গুরুত্বপূর্ণ তা হলো প্রমত্তের পুরো বিপ্লবী জীবনটা যদি বিশ্লেষণ করা হয়, তাহলে এ চরিত্রের ভেতর নিবারণ ঘটক কতখানি আছেন! এবং প্রমত্তের যে নেতা বজ্রপাণি— বাস্তবে নিবারণ ঘটকের ক্ষেত্রে তিনি কে? আদৌ কী কেউ ছিলেন? এ সব প্রশ্নও চলে আসে। কারণ এ উপন্যাসের পুরো প্রমত্তকে আবিষ্কার করতে হলে বজ্রপাণি বাস্তবে কে ছিলেন, সেটিও আবিষ্কার করা জরুরি। নিবারণ ঘটক প্রমত্ত চরিত্র সৃষ্টিতে প্রভাব ফেললেও প্রমত্ত-চরিত্রের বিপ্লবী কর্মকাণ্ড ও বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে বাস্তবের অন্য বিপ্লবী চরিত্র তার মধ্যে অপরিহার্যভাবে যুক্ত হয়ে গেছে কীনা- সেটিও ভাবার সুযোগ রয়েছে।অগ্নিকালের বাস্তবতা সম্মুখে রেখে নজরুলের বিপ্লবীসত্ত্বা ও তার বিপ্লবী অন্যান্য রচনা বিচার করে ‘কুহেলিকা’র চরিত্রবিচারে অগ্রসর হলে সে-অনুমান গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। পরাধীন ভারতের মুক্তির জন্যে যে সব বিপ্লবীরা জীবনবাজি রেখে সংগ্রাম করেছেন, তাদের প্রতি নজরুলের অপরিসীম শ্রদ্ধা ও অকুণ্ঠ সমর্থন ছিল। তিনি ভারতমুক্তির জন্যে অগ্নিলেখনী ধারণ করেছিলেন। সে-জন্য তাঁকে জেল-জুলুম নিপীড়ন-নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে। বিপ্লববাদীদের কাছে নজরুলের লেখা অতি আবশ্যকীয় পাঠ্য ছিল। অগ্নিবীণা, বিষেরবাঁশী, ভাঙার গান, সাম্যবাদী, ধূমকেতু, লাঙল প্রভৃতিগ্রন্থ ও পত্রপত্রিকাগুলো বিপ্লববাদীদের কাছে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ছিল। বিপ্লববাদী বীর বারীন্দ্রকুমার ঘোষকে তিনি তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ অগ্নি-বীণা উৎসর্গ করেন। ক্ষুদিরামকে নিয়ে লেখেন ‘ক্ষুদিরামের মা’, প্রবন্ধটি। যতীন দাসকে নিয়ে লেখেন‘যতীন দাস’ কবিতাটি। বাঘা যতীন, মনোরঞ্জন, চিত্তপ্রিয়কে নিয়ে লেখেন ‘নব-ভারতের হলদিঘাট’ কবিতাটি।নজরুলের উপন্যাসে বিপ্লববাদী প্রেক্ষাপট থাকবে এটিই স্বাভাবিক। ‘কুহেলিকা’ উপন্যাসটির বিশেষ গুরুত্ব সেখানেই। উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র জাহাঙ্গীর একজন বিপ্লববাদী। আগেই উল্লেখ করেছি জাহাঙ্গীরের গুরু প্রমত্তের মাঝে অনেক গবেষক নজরুলের শিক্ষক নিবারণ ঘটকের ছায়া দেখার কথা বলেছেন। আবার কেউ কেউ বারীন্দ্র ঘোষের কথাও উল্লেখ করেছেন। শরৎচন্দ্রের ‘পথের দাবী’র সব্যসাচীর সাথে প্রমত্তের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের মিল রয়েছে।
এ কথা তো স্বীকার্য, নজরুল সাহিত্যে বাস্তব থেকে অনেক চরিত্র পরিগ্রহণ করেছেন। কবিতা-উপন্যাস সকল ক্ষেত্রেই। ‘কুহেলিকা’র ক্ষেত্রে প্রমত্ত চরিত্রটিকে কেন্দ্র করে নজরুলের শিক্ষক নিবারণ ঘটক, বারীন্দ্র ঘোষ এবং শরৎচন্দ্রের পথের দাবীর সব্যসাচী প্রসঙ্গ আসে। সব্যসাচী চরিত্রটিও বাস্তব থেকে শরৎচন্দ্র গ্রহণ করেছেন। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের বিখ্যাত নেতা এম.এন. রায়ের চরিত্র অবলম্বনে সব্যসাচী চরিত্র নির্মিত হয়েছে। তাহলে প্রমত্ত-ও পুরো চরিত্রটি মূলত কোন চরিত্রটি অবলম্বনে তৈরি হয়েছে, সে-প্রশ্ন খুবই প্রাসঙ্গিক এবং যৌক্তিক বলে ধারণা করি।
তরুণ বিপ্লবীদের কাছে বিনোদবালা ছিলেন পরম শ্রদ্ধা, আশ্রয় ও সাহসের জায়গা। জয়তী চরিত্রটি তৈরির ক্ষেত্রে নজরুলের মনে অবচেতন বা সচেতনভাবে বিনোদবালা প্রভাব রাখতে পারে। ঠিক যেভাবে ‘কুহেলিকা’য় জাহাঙ্গীরদের কাছে জয়তী ছিলেন।
আমরা আরও এক ধাপ এগিয়ে ধারণা করে নিতে পারি ‘কুহেলিকা’য় প্রমত্ত’র নেতা বজ্রপাণি যে চরিত্রটি পরোক্ষভাবে উপন্যাসে উপস্থিত, তার মধ্যে বাঘা যতীনের চরিত্রটি বেশ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। যদিও আরও কিছু চরিত্রের মধ্যে বাঘা যতীনের বিপ্লবী কর্মকাণ্ডের পরিচয় ফুটে উঠেছে। নজরুলের বিপ্লবী জীবনে বাঘা যতীনের প্রভাব যে স্পষ্ট তা তার কবিতাতেও লক্ষণীয়। নজরুলের ‘প্রলয়-শিখা’কাব্যগ্রন্থে ‘নব-ভারতের হল্দিঘাট’ কবিতাটি বাঘা যতীনের বীরত্বগাথাকে কেন্দ্র করে তিনি রচনা করেছিলেন। ব্রিটিশ-বাহিনীর সঙ্গে বীরত্বপূর্ণ এবং প্রথম সম্মুখযুদ্ধ করে বাঘা যতীনের আত্মাহুতি দানের মাধ্যমে ভারত-স্বাধীনতা যে মহাকাব্য রচিত হয়েছিল, তার ভেতর ফুটে উঠেছিল নতুন এক ভারতের স্বপ্ন-বীজ, যার অঙ্কুরোদগম ঘটে বালেশ্বরের বুড়িবালাম নদীর তীরে। কাজী নজরুল ইসলামের মনে বিপ্লবী বাঘা যতীনের বীরত্বপূর্ণ আত্মাহুতি ব্যাপক প্রভাব ফেলে। তার গৌরব-গাথা এই আত্মাহুতি বারুদের মতো ভয়াবহ কবিতা হয়ে ওঠে বিদ্রোহী কবির কলমে। তিনি রচনা করেন ‘নব-ভারতের হল্দিঘাট’ বিখ্যাত কবিতাটি। নজরুলের ভেতর এই বিশ্বাস গ্রোথিত হয়েছিল যে, বালেশ্বরের বুড়িবালামের তীরে ব্রিটিশ-সৈন্যবাহিনীর সঙ্গে বাঙালি বিপ্লবীদের যে প্রথম সম্মুখযুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে, এর মাধ্যমেই ভারতের স্বাধীনতা-অর্জনে হল্দিঘাট হিসেবে পরিগণিত হতে পারে এই বুড়িবালাম নদীর তীর। এ কারণেই নজরুল বাঘা যতীনের মরণ-যুদ্ধের এই স্থানটিকে নব-ভারতের হলদিঘাট বলে অভিহিত করেছেন। উল্লেখ্য, ১৫৭৬ খ্রি. সম্রাট আকবরের সৈন্যের বিরুদ্ধে রানা প্রতাপসিংহ-এর প্রবল যুদ্ধ হয়। সে-যুদ্ধে মেবারের রানা প্রতাপসিংহ পরাজিত হন। পরে প্রতাপসিংহ তার হারানো রাজ্যের অনেকখানি উদ্ধার করতে সক্ষম হন।
যুগান্তর দলের নেতা ছিলেন বিপ্লবী বাঘা যতীন। তিনি ভারতের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে থাকা ছোট বিপ্লবী দলগুলোকে একত্রিত করে যুগান্তর দল গঠন করে তার নেতৃত্ব গ্রহণ করেছিলেন। যুগান্তর নামে একটি পত্রিকা ছিল। সেই পত্রিকাটি ছিল বিপ্লবীদের কর্মকাণ্ডের মূলকেন্দ্র। ‘যুগান্তর নামে দৈনিক সংবাদপত্রে স্বাধীনতার মর্মবাণী প্রসারের ব্যবস্থা করেন স্বামী বিবেকান্দের অনুজ ভূপেন্দ্রনাথ দত্তের সম্পাদনায়।’ পত্রিকাটির নামকরণেই যুগান্তর দল প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। এর আগে অনুশীলন সমিতির মাধ্যমে বিপ্লবীরা তাঁদের কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতেন। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য, ‘অনুশীলন সমিতি অবৈধ ঘোষণা করার সময় যতীন ও নরেন যুগান্তরে কাজ করতেন। আলিপুর মামলার সময় যতীন-নরেন যুগান্তর গ্রুপের পরিচালকরূপে পরিচিত হন। এই পরিচয় হতেই পরবর্তীকালে যুগান্তর সমিতি অনুশীলন সমিতির উত্তরাধিকার হয়।’এর একটি বড় কারণ ছিল সে-সময় বিপ্লবী নেতারা বিশেষ করেন বাঘা যতীন ও এম.এন. রায় অনুভব করেন বিপ্লবী শক্তিকে একক নেতৃত্বে সংঘবদ্ধ করতে হবে। বিপ্লবীদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণ দিয়ে সেই শক্তিকে গোটা ভারতে সম্প্রসারিত করতে হবে। আত্মত্যাগী বিশ্বস্ত বিপ্লবী তৈরি করতে হবে এবং বিপ্লবের মূল উদ্দেশ্যের কথা ভারতবাসীর মধ্যে ছড়িয়ে দিতে হবে। এই কঠিন দায়িত্বটি গ্রহণ করেন বাঘা যতীন। আর বাঘা যতীনের ডান হাত হিসেবে তার পাশে দাঁড়ান এম.এন. রায়। এরা জার্মানি থেকে অস্ত্র এনে ভারত স্বাধীন করার পরিকল্পনা করেন। সে-মোতাবেক কাজও করেন। জার্মান গিয়ে ফলপ্রসু আলোচনা করেছিলেন। সে-আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে সিদ্ধান্ত হয়:
‘জার্মান জাহাজ ম্যাভেরিক ত্রিশ হাজার রাইফেল, আট লক্ষ কার্তুজ ও দুই লক্ষ টাকা নিয়ে জুন মাসে সানফ্রান্সিসকো থেকে যাত্রা করবে। পথে এ্যানি-লারসেন ও হেনরি এস. নামে আরও দুটি জাহাজ ম্যাভেরিকের সংগে যোগ দেবে। জাহাজের এ-সব জিনিপত্র বুঝে নেয়ার দায়িত্ব পড়ে বিপিন গাঙ্গুলি, নরেন্দ্র ভট্টাচার্য (এ.এন. নায়) ও বাঘা যতীনের উপর।’
জার্মান থেকে আসা ম্যাভেরিক জাহাজ-ভর্তি অস্ত্রের ব্যাপারটি ফাঁস হয়ে যাওয়ায় বাঘা যতীনরা অস্ত্র খালাস করতে পারেন নি। খালাসের আগেই অপরিকল্পিত এক সম্মুখ যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে হয় বাঘা যতীনদের। সে যুদ্ধে গুলিবিদ্ধ বাঘা যতীন একদিন (৯ সেপ্টেম্বর গুলিবিদ্ধ হন, মৃত্যুবরণ করেন ১০ সেপ্টেম্বর ১৯১৭ ) পরেই মৃত্যুবরণ করেন। নজরুল ‘কুহেলিকা’তে লিখেছেন, ‘বিপ্লবীদের সেই ভীষণ জার্মান-ষড়যন্ত্র প্রকাশ হইয়া পড়িয়াছে। সারা দেশ ব্যাপিয়া পুলিশ জাল ফেলিয়াছে।’
‘কুহেলিকা’তে জয়তী চরিত্রটি যখন চোখের সামনে উজ্জ্বল আলোর মতো জ্বলে ওঠে, তখন বাঘা যতীনের দিদি বিনোদবালার ছবিটিও চোখের সামনে চলে আসে। এ যেন বিনোদবালার স্বরূপে বিকশিত জয়তী চরিত্রটি। বাঘা যতীনের বাঘা যতীন হয়ে-ওঠার ক্ষেত্রে বিনোদবালার ভূমিকা ছিল অবিশ্বাস্যরকম। তরুণ বিপ্লবীদের কাছে বিনোদবালা ছিলেন পরম শ্রদ্ধা, আশ্রয় ও সাহসের জায়গা। জয়তী চরিত্রটি তৈরির ক্ষেত্রে নজরুলের মনে অবচেতন বা সচেতনভাবে বিনোদবালা প্রভাব রাখতে পারে। ঠিক যেভাবে ‘কুহেলিকা’য় জাহাঙ্গীরদের কাছে জয়তী ছিলেন।
বজ্রপাণি ও প্রমত্ত দুটি চরিত্র বাঘা যতীন ও এম.এন. রায়-এর চরিত্র অবলম্বনে সৃষ্টি, তা এখন অনুমেয়। নজরুল বাঘা যতীনের বিপ্লবী কর্মকাণ্ড দ্বারা যে প্রভাবিত হয়েছিলেন তা তার সাহিত্যে স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান। ভারতমাতাকে মুক্ত করার জন্য বাঘা যতীন ও এম.এন. রায় যে সশস্ত্র বিপ্লবী প্রক্রিয়া শুরু করেছিলেন, ‘কুহেলিকা’র বজ্রপাণি এবং প্রমত্ত-র ভেতর তা লক্ষণীয় :
‘যতীন মুখার্জীর ব্যক্তিত্ব ১৯০৬ সালের মধ্যে তাকে (এম.এন. রায়) অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবে আকর্ষণ করে একজন নিঃস্বার্থ কর্মযোগী হিসেবে। কখন কি কাজ কার দ্বারা সম্ভব হবে, যতীন তা সহজেই অনুমান করতে পারতেন এবং সেই অনুপাতে দায়িত্ব আরওপ করতেন। তিনি কখনও ব্যক্তিগতভাবে কারো সম্পর্কে আলোচনা-সমালোচনা করতেন না। এ ধরণের স্বাভাবিক সম্বন্ধ স্থাপিত হওয়ার পর তিনি নরেন (এম.এন. রায়)কে তার ডান হাত বলে মনে করতেন। জেলে দুইজন অত্যন্ত ঘনিষ্ঠভাবে অন্তরঙ্গতা স্থাপন করেন। যতীনের প্রকৃত ব্যক্তিত্ব এ সময় নরেনের নিকট প্রকাশিত হয়। নরেন স্থির করেন, বিপ্লব পরিচালনার জন্য তিনিই একমাত্র সঠিক নেতা। অতএব কারাগার হতে অব্যাহতি পাওয়ার পর উভয়ের কর্মপন্থা কি হবে, তা নিয়ে বিশদভাবে আলোচনা হয়। সর্বপ্রথম প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয় বিপ্লবী শক্তিকে একক নেতৃত্বে সঙ্ঘবদ্ধ করা, উপযুক্ত প্রশিক্ষণ প্রদান করা এবং সারা ভারতব্যাপী বিপ্লবী শক্তির বিস্তৃতি করা। তার মধ্যে আত্মত্যাগী বিশ্বস্ত মুক্তিযোদ্ধা সৃষ্টি করে উপযুক্ত ব্যক্তিকে উপযুক্ত কাজ প্রদান করা; বিপ্লবের বাণী বিভিন্নভাবে সমাজের বিভিন্ন স্তরে বিস্তার করা।’
বজ্রপাণি সম্পর্কে প্রমত্ত বলেছেন, ‘লোকটি আসলে ছিল একটু বেশি রকমের ভাল-মানুষ।… আমাদের অধিনায়ক বজ্রপাণি মহাশয়কে আমি আমার ভগবানের চেয়েও শ্রদ্ধা করি।’ এবার লক্ষ করা যাক এম.এন. রায় তার অধিনায়ক বাঘা যতীনের সম্পর্কে কী ধারণা পোষণ করতেন। এম.এন. রায় লেনিন, ট্রটস্কি, সুন-ইয়াৎ সেন, কারাঞ্জা প্রভৃতি মহাপুরুষদের সঙ্গে রাজনীতি করেছেন, কাছে থেকে তাঁদের দেখেছেন। তিনি এসব মহাপুরুষের সঙ্গে তার নেতা বাঘা যতীনের তুলনা করে লিখেছেন:
‘দাদা (বাঘা যতীন) ছিলেন ভালোমানুষ। অন্যরা সব মহাপুরুষ, মহাপুরুষদের চাঁদের হাটে ‘ভালোমানুষে’র নাম পাওয়া যায় না। এই ভাবেই চলতে থাকবে সব কিছু— যতদিন না ‘ভালোমানুষ’ হওয়াটা মহাপুরুষ হওয়াটা মহাপুরুষ হবার প্রধান লক্ষণ বলে আমরা মানতে শিখছি।…আমার জীবনে একটি মাত্র মানুষকে একপ্রকার অন্ধের মতো অনুসরণ করতাম, সেই মানুষটির আদেশ আমি ভুলতে পারতাম না।…তিনি আমাদের দাদা ছিলেন বটে, কিন্তু তিনি আমাদের সর্বাধিনায়কও ছিলেন।’
বজ্রপাণি আর প্রমত্তর সম্পর্ক ও বিপ্লবী কর্মপন্থা ছিল বাঘা যতীন আর এম.এন. রায়ের নরেনের অনুরূপ। প্রমত্ত বিপ্লবী কর্মকাণ্ড পরিচালনা ও আন্দোলনকে সংগঠিত করার লক্ষে বিভিন্ন সময়ে নানা ধরনের লেবাস বা রূপ ধারণ করতেন। অসংখ্য ভাষাতেও কথা বলতে পারতেন। অন্য দেশে গিয়েও সেদেশের মানুষের মতো হুবহু নিজেকে তৈরি করে নিতে পারতেন এবং সেদেশের ভাষা তাদের মতো করে বলতে পারতেন। সেকারণে তিনি যে ভিন দেশি এটা বোঝা মুশকিল ছিল।
বাঘা যতীন ও এম.এন. রায়ের ‘আইকন-তত্ত্ব’ ক্রমশ বিচ্ছুরিত হয়েছে নজরুলের বিচিত্র চরিত্রের আভ্যন্তরিক ও আন্তর্জালিক আবহে। সেক্ষেত্রে ‘কুহেলিকা’ উপন্যাসের বিধৃত বিপ্লবপন্থা অর্জন করে নতুন মাত্রা।
তাকে গ্রেফতারের জন্যে বিভিন্ন দেশে নানাভাবে চেষ্টা করা সত্ত্বেও তার বহুরূপী রূপ ধারণের কারণে বারবার আইন-শৃঙ্খলার বাহিনীর চোখ এড়িয়ে নিজের বিপ্লবী কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে পেরেছিলেন। যেটি শরৎচন্দ্রের সব্যসাচী এবং নজরুলের প্রমত্তর ভেতর লক্ষণীয়। অনেকে এক্ষেত্রে নিবারণ ঘটকের পক্ষে। কিন্ত বাস্তবতার প্রেক্ষিতে প্রমত্তর চরিত্র অঙ্কনে চরিত্রকাঠামো-বিন্যাস-ভাষাদর্শী-বহুভাবে ছদ্মবেশ ধারণ-বহু নামধারী ও রাজনৈতিক কারণে বিভিন্ন দেশ পরিভ্রমণ—এসব বিচারে এম. এন. রায়ের চরিত্রই প্রমত্ত চরিত্র নির্মাণে প্রভাব রেখেছে সে-ধারণা করা অমূলক নয়।
‘কুহেলিকা’ উপন্যাসে নিবারণ ঘটকের ছায়ায় প্রমত্ত চরিত্রটি অঙ্কিত বলে অনেক গবেষকের অভিমত রয়েছে। নজরুলের শিক্ষক হিসেবে তার মনে নিবারণ ঘটক প্রভাব ফেলবেন এটিই স্বাভাবিক। কিন্তু প্রমত্ত চরিত্রটি যেভাবে অঙ্কিত হয়েছে, বাস্তব প্রেক্ষিতে সেটি কতোটা গ্রহণযোগ্য সে প্রশ্ন একেবারে উড়িয়ে দেয়া কঠিন। নিবারণ ঘটক একজন শিক্ষক ছিলেন। তিনি দেশের প্রয়োজনে একাধিক দেশে গিয়েছেন কীনা, অসংখ্য ভাষায় কথা বলতে পারতেন কীনা, বিভিন্ন দেশে গিয়ে নিজের দেশের বিপ্লবের প্রতি সমর্থন ও সংগঠিত করার লক্ষে প্রয়োজনে একেবারে সে দেশের মতো নিজের লেবাস তৈরি করে সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে অবস্থান করার মতো অসংখ্য ঘটনার নায়ক তিনি ছিলেন কীনা—এরকম তো অনেক প্রশ্নই উঠতে পারে। জার্মান ষড়যন্ত্রের যে কথা বলা হয়েছে, সেখানেতো নিবারণ ঘটক নেই। তাহলে প্রমত্ত চরিত্রটি নিবারণ ঘটকের কীভাবে হয়! চুলচেরা বিচার-বিশ্লেষণ করলে সেটি তো এম.এন. রায়ের চরিত্র অবলম্বনে নির্মিত বলেই ধারণা হয়। ভারতীয় বিপ্লবীদের সবচেয়ে সংগঠিত বিপ্লব-প্রচেষ্টা ছিল ‘জার্মান-ষড়যন্ত্র’।
প্রথম মহাযুদ্ধের সময় ব্রিটিশ শাসকদের বিপদের সময় নিয়ে আর ইংরেজদের শত্রু জার্মানদের সহায়তায় ভারতের বড় অংশ জুড়ে সশস্ত্র অভ্যুত্থানের পরিকল্পনা হয়েছিল। এর অন্যতম নেতা ছিলেন যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, ওরফে বাঘা যতীন এবং তার প্রধান শিষ্য এম.এন. রায়। উপন্যাসে বজ্রপাণিকে কখনো সামনে আনা হয় নি, কিন্তু তিনিই দলের সর্বোচ্চ নেতা— বাস্তবে বাঘা যতীনও তাই ছিলেন। উপন্যাসের একপর্যায়ে দেখি, নায়ক জাহাঙ্গীর তার দীক্ষাগুরু বিপ্লবী নেতা প্রমত্তকে সংকোচের সঙ্গে জানায়, সে হয়তো বিয়ে করতে চলেছে। প্রমত্ত সান্ত্বনা দিয়ে বলেন, ‘সত্যিকারের দেশপ্রেম থাকলে বিবাহিত জীবনও বিপ্লবীর কাজের প্রতিবন্ধক নয়: আমাদের বজ্রপাণিও তো বিবাহিত। শুধু বিবাহিতই নন, ছেলে-পিলে ঘর সংসার আছে।’
এ কথা বাঘা যতীনের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। বাঘা যতীন তিন পুত্র এবং এক কন্যা সন্তানের জনক ছিলেন। তিনি স্ত্রী-সন্তান-সংসারকে দেশের স্বার্থে সবসময়ই ক্ষুদ্রস্বার্থ হিসেবে বিবেচনা করেছেন। তিনি বিপ্লবের নামে মরণযুদ্ধকেই বেছে নিয়েছিলেন, তিনি বলেছিলেন, ‘বৃহৎ স্বার্থে ক্ষুদ্র-স্বার্থ ত্যাগ করতে হয়।’ অনুমান করা বোধ হয় অযৌক্তিক হবে না বাঘা যতীনই নজরুলের বজ্রপাণি, আর বজ্রপাণির শিষ্য প্রমত্তই হচ্ছে এম.এন. রায়।আরও একটি প্রসঙ্গ উল্লেখ করা যেতে পারে, পিণাকীর ফাঁসির ঠিক আগ-মুহূর্তে ম্যাজিস্ট্রেট তৎক্ষণাৎ মাথার টুপি খুলে তাকে যে অভিবাদন জানিয়ে বলেছিল, ‘আমি তোমায় প্রণাম করি বালক! মৃত্যু-মঞ্চই তোমার মতো বীরের মৃত্যুঞ্জয়ী সম্মান। তোমার মত বীরের বন্দনা করবার সম্মান জীবনের নাই।’ বাস্তবে তা পরিলক্ষিত হয় বাঘা যতীনের ক্ষেত্রে। বাঘা যতীনের মৃত্যুর আগ-মুহূর্তে চার্লস টেগার্ট তাঁকে বিচলিত কণ্ঠে বলেছিল, ‘Tell me Mukherjee, What can I do for you?’ বাঘা যতীনের মৃত্যুর পর চার্লস টেগার্ট মাথার ক্যাপ খুলে তাকে স্যালুট করে বলেছিলেন, ‘I have high regard for him. I have met the bravest Indian, but- I had to perform my duty’। বাঘা যতীনের বিপ্লব-পন্থা ও মৃত্যু এ উপন্যাসে নানাভাবে পরিগৃহিত হয়েছে তা অনুমান করা যেতে পারে। অগ্নিযুগের মহানায়কদের প্রতি নজরুলের প্রশ্নাতীত সহানুভূতি ও সমর্থন ছিল। তার উপন্যাস-গল্প-কবিতা-প্রবন্ধে লক্ষণীয়।
বাঘা যতীন ও নজরুল দুজনই বিপ্লবী-বিদ্রোহী। পথ ভিন্ন। কিন্তু গন্তব্য ছিল এক এবং সুনির্দিষ্ট। এই দুই মনীষী যেন একই বীণায় দুটি তার— কিন্তু সুর একই—অগ্নিঝাঁঝালো। যে সুর ব্রিটিশদের কাছে ভয়াবহ আতঙ্কের হয়ে উঠেছিল, একই সাথে সেই সুরেই নিহিত ছিল ভারত-মাতৃকার মুক্তির মূলমন্ত্র।
‘কুহেলিকা’ উপন্যাসে নজরুলের ভাবুকমন যে বিপ্লবপন্থায় প্ররোচিত হয়েছে তার পরিণাম উপর্যুক্ত অংশে অনুরুদ্ধ হয়েছে। বাঘা যতীন ও এম.এন. রায়ের ‘আইকন-তত্ত্ব’ ক্রমশ বিচ্ছুরিত হয়েছে নজরুলের বিচিত্র চরিত্রের আভ্যন্তরিক ও আন্তর্জালিক আবহে। সেক্ষেত্রে ‘কুহেলিকা’ উপন্যাসের বিধৃত বিপ্লবপন্থা অর্জন করে নতুন মাত্রা। একই সঙ্গে বিপ্লবপন্থার পরিণামেও ‘কুহেলিকা’ হয়ে ওঠে নবতর শিল্পাঙ্গিক।
প্রসঙ্গত, ‘কুহেলিকা’র অনালোচিত এ অংশটি বর্তমান পাঠ-গবেষণায় যে নতুন অভিমুখে চিহ্নিত হয় তা একইসঙ্গে অনন্য এবং অন্যতর মাত্রার দ্যোতক। ‘কুহেলিকা’ নজরুল চেতনার নতুন প্রয়াসমাত্র বললেও বিন্দুমাত্র ভুল হয় না।