(পর্ব-৫)
ভাবছিলাম অন্য কথা। এ রকম ঝরনা আমাদেরও আছে। মাস দুয়েক আগে, ফেব্রুয়ারিতে কেওক্রাডং গিয়েছিলাম। বগা লেক থেকে পায়ে হেঁটে যাওয়ার পথে দুটি ঝরনা পড়েছিল। একটি লতা ঝরনা, অন্যটি চিংড়ি ঝরনা। লতার জলধারা অতি ক্ষীণ। কিন্তু চিংড়িতে ভালোই জল ধরে। আর নাফাখুমে তো অনেক পানি। যে সব জায়গা এ রকম করে সাজানো যায়। কথায় বলে, মানি বিগেডস মানি। টাকায় টাকা আনে।
গাইড পার্থ জানালেন, দার্জিলিং এই রক গার্ডেন সমুদ্র রেখা থেকে ৮ হাজার ৪০০ ফুট ওপরে। যতটা সম্ভব ওপরে চলে গিয়েছিলাম। নিচে তাকালাম। পাখির চোখে দেখছিলাম পুরো রক গার্ডেন। পরীর মতো পাখা থাকলে সোজা শা করে নিচে নেমে যেতাম। আচ্ছা পরীর পুরুষ তো জিন। জিনদের কি পাখা আছে? কোথাও কিন্তু শুনিনি সে কথা। থাকলে মন্দ না। ঈগলের মতো শা করে উড়ে যাবে! সবই কল্পনা, জিন-পরী; সবই। ওপরে ওঠার আগে রাস্তার দক্ষিণে একটা জায়গা দেখেছিলাম। বড় ঝরনাটার দক্ষিণ পাড়ে। অনেক নিরিবিলি। বনের ভেতরে কাঠের গুড়ি পড়ে থাকার মতো বসার জায়গা। আগেই ঠিক করে রেখেছিলাম ওখানে যাবো। তাই করলাম।
ও হ্যাঁ, গার্ডেন যেহেতু; সেহেতু কিছু অর্কিড ফুল, লতাগুল্ম তো থাকবেই। আছেও। সেসব দেখে ধীরে ধীরে নিচে নেমে এলাম। স্টিলের পাটাতন বসানো ব্রিজ পার হয়ে গেলাম অন্য পাড়ে। আগে দেখা সেই জায়গাটাতে গিয়ে দাঁড়ালাম। সরু খালের মতো ঝরনা বয়ে গেছে ঢালু বেয়ে। পাশে পাহাড় কেটে খানিকটা পার্কেল মতো করা। কয়েকটা কাঠের বেশ পুরনো বেঞ্চ। সেগুলো এত নড়বড়ে যে, ভেঙে পড়তে পারে যেকোনো সময়। একটা কাঠের বেঞ্চ দেখে আমার পছন্দ হলো। একপাশে ভাঙা হলেও আরেক পাশটা এন্টিক জেল্লা ছড়াচ্ছিল। আমি যেতে যেতেই স্থানীয় এক তরুণ গিয়ে বসে পড়লো একটা বেঞ্চে। কিছুটা রাগ হওয়ার কথা। হচ্ছিল না। মনে হচ্ছিলো, ছেলেটার চয়েজ আছে বটে! এই জায়গাটা কেবল আমার আর তার পছন্দ। সাহেল ছিল উত্তর পাড়ে। জোরে ডাকলাম, সাহেল এ পাশে চলে আসেন। সাহেল এলে ওই তরুণ চলে গেলো। মোবাইলফোনটা সাহেলকে দিয়ে বললাম ছবি তুলতে। কিন্তু মনমতো হচ্ছিল না। সাহেলের ছবি তুলে ফ্রেম বুঝিয়ে দিলাম। একটু পর জনি আর সাইফুলও এলেন। তাদের নিয়ে বনের ভেতর দিয়ে যতটা সম্ভব ওপরের দিকে উঠে যাচ্ছিলাম। নিখাদ প্রকৃতির মধ্যে বুক ভরে শ্বাস নিলাম।
শেষ পর্যস্ত গাড়িও থামলো না; চলমান গাড়ির জানলা দিয়েও ছবি তোলা হলো না। মিস! অন্যরা বললেন, এরকম আরও বহু পাবেন। আমি মনে হলো, পাবো না। সত্যিই আর পাইনি। সুযোগ হাতছাড়া করতে হয় না।
রক গার্ডেন থেকে ফিরছিলাম। সবাই জিপের কাছে চলে এসেছি। নেই কেবল নুরুল। জনি এসে বললেন, স্যার আমাদের টিমের মধ্যে নুরুল ভাইয়ের কোনো রোল (ভূমিকা) নেই। বিষয়টা ভাবিয়ে তুললো আমাকে। চিন্তা করছি, নাস্তা কিংবা খাওয়ার টেবিলে সবার পরে নুরুল। গাড়িতে উঠতে সবার পেছনে। শপিং করতে গেলে তাকে খুঁজে পাওয়া যায় না। সত্যিই তো! সেবার দুটি ক্রিকেট টুর্নামেন্টে অংশ নিয়েছিল ওয়ালটন। প্রথমটি ২০ ওভারের কর্পোরেট ক্রিকেট। তাতে চ্যাম্পিয়ন। পরে ১০ ওভারের ক্রিটেক। তাতেও চ্যাম্পিয়ন। যার উপহারস্বরূপ এই অফিসিয়াল ট্যুর। কিন্তু ১০ ওভারের টুর্নামেন্টে বল কিংবা ব্যাট করার সুযোগ হয়নি অনেকেরই। তাদের মধ্যে নুরুলও একজন! সবাইকে ডেকে জিজ্ঞেস করলাম, বলেন তো আমাদের ট্যুরে কোন লোকটার কোনো রোল নেই? নো রুল?
দার্জিলিংয়ের চা বাগান আর জুলজিক্যাল পার্ক
দার্জিলিং ভ্রমণ করবো অথচ চা বাগানে যাবো না, তাই কি হয়!
রক গার্ডেন থেকে ফিরছিলাম। তখনই প্রশ্নটা করলাম। গাইড পার্থ বাসনেত বললেন, অপেক্ষা করুন। অবশ্যই যাবো। ট্যুরের দ্বিতীয় দিনের আইটেনারিতে অবশ্য এটা ছিল।
এক পথ দিয়ে গিয়েছি। ফিরছিলাম অন্য পথে। এই বিষয়টি সবসময় উপভোগ করি, এক পথ দিয়ে যাওয়া, অন্যপথ দিয়ে আসা। কিন্তু ফেরার পথটা ছিল বেশি বিপজ্জনক। অনেক খাড়া। কোনো কারণে জিপ যদি স্লিপ খায় একেবারে পগার পার। লাশও পাওয়া দুষ্কর।
ভয়ঙ্কর সব বাঁক পাড়ি দিয়ে ওপরে উঠছিল জিপ, ভয়ে অন্তরাত্মা পিপ পিপ। অবশ্য রাস্তার দুপাশে চায়ের বাগান। বাগানের সৌন্দর্যও দেখছিলাম। আবার ভয়ও পাচ্ছিলাম। এমনকি রাস্তার পাশে ছায়া গাছও নেই। ওই পাহাড়ের ঢালুতে অনেকেই চায়ের পাতা তুলছিলেন। একটা জায়গায় দেখলাম বেশ কয়েকজন মহিলা। রাস্তার পাশে স্তূপ করে রাখা চায়ের পাতা। ব্যাপার কী? আর কিছুই না, বাগানের বিভিন্ন জায়গা থেকে সংগ্রহ করা পাতা সেখানে ওজন করা হচ্ছিল। কে কতটুকু পাতা তুললো, সেখান থেকে যাওয়ার কথা কারখানায়।
ড্রাইভারকে বললাম গাড়ি থামাতে। এর একটা ছবি চাই-ই চাই। কিন্তু জায়গাটা বেশ ঢালু। তাই চালক গাড়ি থামালো না। কী আর করা। মিলটনকে বললাম গাড়ি থেকেই ছবি তুলতে। তার ক্যামেরা রেডি না। ফিরোজ আলমকে বললাম। ক্যামেরা রেডি করতে করতে অনেকটা ওপরে চলে গেলাম। বাঁক ঘুরে ওই জায়গাটির ওপরে যেতেই আবারও সুযোগ এলো ওপর থেকে স্ন্যাপ নেওয়ার। শেষ পর্যস্ত গাড়িও থামলো না; চলমান গাড়ির জানলা দিয়েও ছবি তোলা হলো না। মিস! অন্যরা বললেন, এরকম আরও বহু পাবেন। আমি মনে হলো, পাবো না। সত্যিই আর পাইনি। সুযোগ হাতছাড়া করতে হয় না।
চা বাগান প্রসঙ্গে পরে আবার আসছি। রক গার্ডেন থেকে গেলাম পদ্মাজা নাইডু হিমালয়ান জুলজিক্যাল পার্কে। শহরের মাঝখানে এটি। বিশাল একটা পাহাড়ের ওপরে। টিমের সবাই ছিলাম, ‘ওরা ১৫ জন‘। গাইড পার্থ সবার আগে। চিড়িয়াখানা দেখে আমি মজা পাই না। বাঘ, ভাল্লুক, শেয়াল, কুকুর, বানর, সাপ এসব আমাকে টানে না। খাঁচার ভেতর প্রাণী রেখে সেগুলো দেখা মোটেও ভাল্লাগে না। তবে রেপটাইল জোনে গিয়ে সাপ দেখলাম বেশ কিছু প্রজাতির। এই একটা জিনিস আমি একেবারেই অপছন্দ করি, সেটা সাপ। (ছোটবেলায় একবার সাপে কামড়েছিল আমাকে। ভাগ্য ভালো এখনো বেঁচে আছি।) শুধু রাসেল ভাইপার ভালো করে দেখলাম। এই প্রজাতির সাপ দেখা যায় রাজশাহীর বরেন্দ্র অঞ্চলে। খুব বিষাক্ত এবং ধূর্ত সাপ এটি। চলেও খুব দ্রুত। কয়েকদিন আগে রাজশাহীর দুই সাংবাদিক তানজিমুল হক আর মেহেদীকে নিয়ে গিয়েছিলাম বাবু ডাইং নামে এক বরেন্দ্রভূমিতে। স্থানীয় ভাষায় ডাইং মানে উঁচু জায়গা। এটি চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোল ও গোদাগাড়ি এলাকায় অবস্থিত। মেহেদী বলেছিলেন, সেখানে ওই সাপের দেখা মেলে।
চলবে…
দার্জিলিঙে বৃষ্টি, কালিম্পঙে রোদ-৪॥ উদয় হাকিম