নয়া তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তির বিপুল অগ্রগতির ধারাবাহিকতায় প্রতিদিন একটু একটু করে বদলে যাচ্ছে প্রথাগত সংবাদবাস্তবতা। বদলে যাচ্ছেন সাংবাদিক, বদলে যাচ্ছে সংবাদের প্রথাগত উৎস আর উৎপাদনের প্রথাগত প্রক্রিয়া, বদলে যাচ্ছে খোদ সংবাদমাধ্যম নিজে। টেপ-রেকর্ডার, সাঁটলিপির দক্ষতা আর কলম-প্যাডের বদলে সাংবাদিকের হাতে এখন থাকছে স্মার্ট ফোন। প্রিন্ট মিডিয়ার ক্ষেত্রে যেমন একদিন পরের পত্রিকায়, কিংবা সম্প্রচার মাধ্যমে যখন একঘণ্টা পরের বুলেটিনের জন্য সংবাদ নির্মাণের বাস্তবতা ছিল, অনলাইনের সাংবাদিকতা সেখানে প্রতি সেকেন্ডের আপডেট ধারণ করার বাস্তবতা হাজির করেছে।
সংবাদ-প্রতিবেদনের ধরন-আকার-রচনা পদ্ধতিতেও তাই বদল এসেছে। ফ্যাক্সে আসা তথ্য কিংবা বিদেশি বার্তা সংস্থার ফিডকে ছাপিয়ে সংবাদের উৎস হয়ে উঠেছে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম। আর মেইন স্ট্রিম সংবাদমাধ্যমগুলোও বদলে যাচ্ছে ভীষণভাবে। বাংলাদেশের বাস্তবতা বিচার করলেও এর নজির মিলবে অনায়াসেই। প্রধান ধারার এমন কোনো সংবাদপত্র নেই, যার একটি ওয়েবভার্সন নেই। দিনশেষে নয়, সেখানে সংবাদ প্রকাশিত হচ্ছে ক্ষণে-ক্ষণে। টেলিভিশন চ্যানেলগুলোও বাদ যায়নি। তারাও ওয়েবসাইট খুলে প্রতি মুহূর্তে সংবাদ সরবরাহ করছে। এখানেই শেষ নয়। বাস্তবতা এমন এক স্তরে গিয়ে পৌঁছেছে যে, সংবাদপত্র, টেলিভিশন, রেডিও কিংবা ইন্টারনেট পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশিত হওয়ার আগেই মানুষের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে প্রয়োজনীয় তথ্য।
ধরা যাক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো একটা মিছিল-সমাবেশের কথা। ধরা যাক, সেখানে পুলিশি হামলা হয়েছে। প্রাথমিকভাবে এই খবরটি এখন কিন্তু সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমেই পড়ছে মানুষ। ফেসবুকের স্ট্যাটাসে, টুইটারে দেওয়া ছবি কিংবা প্রত্যক্ষদর্শীদের শেয়ার করা অভিজ্ঞতায় জানছেন সবশেষ অগ্রগতি। তারা কে, কী দেখেছেন, তা বলছেন, ভিকটিমরা নিজেরাও বলছে, বিপক্ষের লোকজনও বলছে, পুলিশ হয়তো তাদের ফেসবুক পাতায় নিজেদের অবস্থান জানাচ্ছে। কেউ হয়তো নিজের স্মার্ট ফোনে ভিডিও করে সেখানকার বাস্তবতা হাজির করছে ইউটিউবে। পাঠক নিজেরাও হামলার ন্যায্যতা-অন্যায্যতা বিচার করছে সার্বিক দিক বিশ্লেষণ করে। এই যে একটা সংবাদযোগ্য ঘটনা মূলধারার সংবাদমাধ্যমে হাজির হওয়ার আগেই মানুষের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে, তার কারণ এই নয়া তথ্যপ্রযুক্তির যুগ-বাস্তবতা। প্রথাগত সংবাদবাস্তবতাকে যা বদলে দিয়েছে ভীষণভাবে।
চলতি কথায় সহজ করে বললে, একটা ডিজিটাল যুগে বাস করছি আমরা। মানুষে মানুষে বিভিন্ন সংবাদযোগ্য ঘটনার তথ্য বিনিময় হচ্ছে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে। অনেক ক্ষেত্রেই সংবাদমাধ্যমের আগে এবং তার থেকেও দ্রুত গতিতে ছড়িয়ে পড়ছে ঘটনার বিবরণ। তাহলে কী সংবাদমাধ্যমের দিন শেষ হয়ে আসছে? এই নিয়ে দুই রকমের অভিমত রয়েছে বিশ্লেষকদের। কেউ মনে করেন সংবাদমাধ্যম অকার্যকর হয়ে যাচ্ছে। কেউ আবার মনে করেন, প্রথাগত সংবাদমাধ্যমের অপরিহার্যতা থেকেই যাবে। তবে দুই চিন্তাধারার মানুষই মনে করেন, টিকে থাকতে গেলে নতুন প্রযুক্তিকে সঙ্গে নিতে হবে। তার সঙ্গে মূলধারার সংবাদমাধ্যমকে মিথস্ক্রিয়া করতে হবে। আমরা যারা দুনিয়ার বিভিন্ন দেশের সংবাদমাধ্যমের বাস্তবতা সংক্রান্ত খোঁজখবর রাখি একটু-আধটু, তারা জানি যে, বিশ্বজুড়ে মূলধারার সংবাদমাধ্যম নতুন ধারার যোগাযোগপ্রযুক্তিকে নিজেদের অঙ্গীভূত করার চেষ্টা করে যাচ্ছে।
পেশায় একজন সংবাদকর্মী হওয়ার কারণে নয়া যোগাযোগপ্রযুক্তির অভিঘাতগুলোকে আমলে না নিয়ে উপায় থাকে না আমার। গত কয়েক বছরের অভিজ্ঞতাকে পুঁজি করে বলছি: কোনো একটি মৃত্যুসংবাদের প্রশ্ন যদি হয়, আমি ৯০ শতাংশেরও বেশি ক্ষেত্রে দেখেছি, সোশ্যাল মিডিয়া থেকেই সংবাদমাধ্যম প্রাথমিক তথ্যটি পেয়ে যান কারও মৃত্যু হলে। পরে নিজের অনুসন্ধানে নিশ্চিত হয়ে খবরটি প্রকাশ করা হয়। সেই হিসেবে নয়া প্রযুক্তি ব্যবহারের মধ্য দিয়ে সামাজিক মাধ্যম হয়ে উঠেছে সংবাদের আদি-সূত্র। নয়া যোগাযোগ প্রযুক্তির এই অভাবনীয় অগ্রগতির যুগবাস্তবতার ধারাবাহিকতায় কোনো একদিন এসে সংবাদমাধ্যমের দিন শেষ হয়ে যাবে কি না, তা নিশ্চিত করে বলা না গেলেও অবধারিতভাবেই বলা যায়: সংবাদমাধ্যম আর তার উৎপাদিত পণ্য হিসেবে সংবাদ আর আগের জায়গায় নেই। প্রথাগত বস্তুনিষ্ঠতার ধারণা মিথ্যে হয়ে গেছে। পাঠকের সম্পৃক্ততার প্রশ্ন গুরুতরভাবে সামনে এসেছে।
গোটা বিশ্বে বিজ্ঞাপন থেকে সংবাদমাধ্যমের যে আয় হয়, গুগল আর ফেসবুক মিলে তার এক-পঞ্চমাংশ নিজেদের দখলে রাখতে সক্ষম হয়। আমরা কী পড়ব, কী পড়ব না, কী দেখব, কী দেখব না, তার সবকিছুতেই এই একচেটিয়া মিডিয়া মালিকদের নিয়ন্ত্রণ থাকে।
বার্তাপ্রেরক হিসেবে সংবাদমাধ্যম আর বার্তাগ্রহীতা হিসেবে পাঠকের সম্পর্কসূত্রে যে একমুখী বাস্তবতা হাজির ছিল, তা বদলে গেছে। বেড়েছে গ্রহীতার সম্পৃক্ততা। ভার্চুয়াল পরিসরে মানুষ নিজেরাই একটি সংবাদক্ষেত্র সৃষ্টি করে ফেলেছেন, যা জনগণের তথ্য আদানপ্রদান ও প্রাপ্তির প্রশ্নে সংবাদমাধ্যমের পূর্ববর্তী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার পরিসরকে ছোট করে ফেলেছে।
দৈনিক পত্রিকার সংবাদ বানানো হয় পরের দিনের জন্য। দ্রুততম সময়ে সংবাদ পাওয়ার জন্য মানুষ তাই টেলিভিশনের ওপর নির্ভর করেছে দুই দশক আগে পর্যন্তও। তবে ইন্টারনেট মিডিয়া টেলিভিশনের থেকেও দ্রুততর সময়ে, বিদ্যুদ্বেগে সংবাদ পৌঁছে দিতে সক্ষম হচ্ছে ঘরে ঘরে। সোশ্যাল মিডিয়ায় থাকা পাঠকদের কাছে, কখনো কেবলই হেডলাইন দিয়ে, কখনো একটুখানি ইন্ট্রোসহ, কখনো আবার একটা প্যারা যুক্ত করে স্টোরি ছাড়া হচ্ছে। জার্নালিজমে ‘ডেভেলপিং স্টোরি’ ধারণাটি নতুন প্রত্যয় যুক্ত করেছে। এই করতে গিয়ে ভুলের পরিমাণ বাড়ছে। প্রতিযোগিতায় টিকতে শুরু হচ্ছে দৌড়াদৌড়ি। তবে ভুল যেমন বাড়ছে, তেমনি বাড়ছে পাহারাদার। খবর এখন আর একমুখী প্রবাহ আকারে হাজির না থাকার কারণে ভুল নিউজ নিয়ে পাঠক মন্তব্য করছে। প্রশ্ন তুলছে।
ডিজিটাল সাংবাদিকতা ভয়াবহভাবে নির্ভরশীল বিজ্ঞাপনের ওপর। সেই বিজ্ঞাপন পেতে গেলে ক্লিক হতে হয়, বাড়তে হয় হিট। এই হিট হওয়া না হওয়ার কর্তৃত্ব এখন পাবলিশারের হাতে নয় কেবল। তার বিপণন ব্যবস্থার পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম হিসেবে ফেসবুক টুইটারও নির্ধারণ করছে এই বিপণন। ক্রমেই সরাসরি সংবাদমাধ্যমে ঢুকে নিউজ পড়ার চেয়ে সামাজিক মাধ্যমকে ভায়া হিসেবে ব্যবহার করে নিউজ পড়ার প্রবণতা বাড়ছে। সংবাদমাধ্যমও তাই সোশ্যাল মিডিয়ায় ফলোয়ার-লাইকার বাড়াতে মনোযোগী এখন। এই সামাজিক মাধ্যমগুলো, যেমন ফেসবুক তার নিজস্ব পদ্ধতি মোতাবেক নিউজ শর্ট করে। কী পাঠকের সামনে আগে আসবে কী পরে আসবে, তা তার হাতে।
নতুন যুগের সাংবাদিকতা সাংবাদিক আর পাঠকের সম্পর্কসূত্র বদলে দিয়েছে। টু ওয়ে কমিউনিকেশন, ব্যক্তিগত প্রোফাইল টুইটারে। যা সাংবাদিক হিসেবে তার ব্যক্তিগত পরিচিতির সুযোগকে অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি করে সামনে এনেছে। আবার পাঠকের জন্যও প্রত্যক্ষভাবে সাংবাদিককে যোগাযোগ করার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। সংবাদের উৎপাদন বণ্টন বেচাবিক্রিতে পরিবর্তন এনেছে। নিউজ বানানোর কৌশল বদলেছে। তা বণ্টনে নিউ মিডিয়া হাতিয়ার। মূলধারার সংবাদমাধ্যম সামাজিক যোগাযোগে ব্যবহৃত নয়া যোগাযোগপ্রযুক্তিগুলোকে নিজের অঙ্গীভূত করেছে।
শিল্প বিপ্লবের যুগে জীবিকার তাগিদে পশ্চিমের বড় বড় শহরে জড়ো হতে শুরু করেছিল বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ। পারস্পরিক চেনাজানাহীন বিচ্ছিন্ন সেসব মানুষের সমাজ পরিচিতি পেয়েছিল ‘ম্যাস সোসাইটি’ তথা গণসমাজ নামে। বিদ্যায়তনিক শাস্ত্রে সংবাদমাধ্যমের উৎপত্তির ইতিহাসে নজর ফেরালে দেখা যায়, গণমানুষের কল্যাণ নয়, নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যেই সৃষ্টি হয়েছিল গণমাধ্যমের। নো’ম চমস্কি আর এডওয়ার্ড হারম্যান তাদের ‘ম্যানুফ্যাকচারিং কনসেন্ট: দ্য পলিটিক্যাল ইকোনমি অব ম্যাস মিডিয়া’ নামের বইতে দেখান, একটি ঘটনাকে সংবাদ হিসেবে প্রকাশ হতে গেলে তাকে ৫টি ফিল্টার অতিক্রম করে আসতে হয়। সেই ফিল্টারগুলো পার হতে মালিকানার প্রতি ইতিবাচক থাকা, বিজ্ঞাপনদাতাদের অনুগত থাকা, সামগ্রিকভাবে নব্য উদারবাদী বাজারব্যবস্থার পক্ষে মতাদর্শ সরবরাহ করা, বিভিন্ন এজেন্সির হুমকি-ধমকিকে আমলে নেওয়া এবং সেইসঙ্গে মতাদর্শিক পরিসরে ভিন্ন ভাবধারার সঙ্গে শত্রুভাবাপন্ন মনোভাব বজায় রাখা (স্নায়ুযুদ্ধের আগে কমিউনিজম, এখন সেই জায়গা নিয়েছে ইসলাম) অত্যাবশ্যক।
জর্জ অরওয়েল তাই যথার্থই মনে করেন, সাংবাদিকতার নামে দুনিয়ায় যা প্রচলিত, তার বেশিরভাগটাই জনসংযোগ। সে কারণেই আমজনতার মৃত্যু নিউজ না, রাষ্ট্রনায়কের সর্দি লাগলেও তা নিউজ হয়। সে কারণেই ৮০ শতাংশ শ্রমিক-কৃষকের দেশের সংবাদমাধ্যমে তাদের জন্য ৮ শতাংশ জায়গা বরাদ্দ থাকে বড়জোর। সে কারণেই ২১ শতকের জীবনধারা উপস্থাপিত হয়, আড়াল হয় ক্ষুধা আর দারিদ্র্য।
টাইম ওয়ার্নার, ওয়াল্ট ডিসনি, ভায়াকম, নিউজ কর্প, সিবিএস কর্পোরেশন, এনবিসি ইউনিভার্সাল; এই ৬টি দানবীয় মিডিয়া প্রতিষ্ঠান যুক্তরাষ্ট্রের যাবতীয় মিডিয়ার মালিক। সংবাদপত্র, সাময়িকী, প্রকাশনা, টিভি নেটওয়ার্ক, ক্যাবল চ্যানেল, হলিউড স্টুডিও, সঙ্গীত উৎপাদন প্রতিষ্ঠান, জনপ্রিয় সব ওয়েবসাইটের মাতৃসংগঠন ওই ছয় প্রতিষ্ঠান। যুক্তরাজ্যে জাতীয় পর্যায়ের সংবাদমাধ্যমের ৭১ শতাংশ নিয়ন্ত্রিত হয় ৩টি বড় কোম্পানির হাতে। স্থানীয় দৈনিকগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করছে ৫টি কোম্পানি। গোটা দুনিয়ার বাস্তবতা বিচার করলে ওয়াল্ট ডিসনি, কমকাস্ট, টুয়েনটি ওয়ানথ সেঞ্চুরি ফক্সকে ছাপিয়ে ফেসবুক আর গুগল এখন সব থেকে বড় মিডিয়া মালিক। গোটা বিশ্বে বিজ্ঞাপন থেকে সংবাদমাধ্যমের যে আয় হয়, গুগল আর ফেসবুক মিলে তার এক-পঞ্চমাংশ নিজেদের দখলে রাখতে সক্ষম হয়। আমরা কী পড়ব, কী পড়ব না, কী দেখব, কী দেখব না, তার সবকিছুতেই এই একচেটিয়া মিডিয়া মালিকদের নিয়ন্ত্রণ থাকে।
তার মানে মোদ্দা কথা দাঁড়াল, সংবাদমাধ্যম পুরনো যুগের গণবিরোধী ভূমিকা থেকে সরে আসেনি একটুও; নয়া যোগাযোগপ্রযুক্তিকে সঙ্গে নিয়ে বরং আরও বেশি করে প্রচার-প্রচারণা জোরালো করতে সক্ষম হয়েছে।
সংবাদমাধ্যমের বিশ্লেষকরা এই বাস্তবতাকে ‘বৈশ্বিক করপোরেট নিয়ন্ত্রণের নেটওয়ার্ক’ নামে ডেকে থাকেন। এটা মাদার জোনস, নিউইয়র্ক টাইমস, ব্রেইটবার্ট বা ফক্স নিউজ কার কাছ থেকে আসল তা খুব একটা ব্যাপার নয়। এই কাঠামোর মাধ্যমে আপনার কাছে যা কিছু আসুক তা আপনার মনকে দ্বিধাগ্রস্ত করে আর আপনার আবেগকে উসকে দিয়ে উদাসীনতা ও ধীরতা ফেলে দিয়ে আপনাকে ক্রোধের একটি জটিল বিশৃঙ্খলায় ফেলে দেয়। কারণ এই ক্ষমতা কাঠামোগুলো পিএলওএস ওয়ান জার্নালের এক নিরীক্ষায় বর্ণিত ‘বৈশ্বিক কর্পোরেট নিয়ন্ত্রক নেটওয়ার্ক’-এরই অংশ।
সুইস ফেডারেল ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির ব্যবস্থা তাত্ত্বিকদের একটি দল নিরীক্ষাটি লিখেছে। তারা বলছে, বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর ৪৩ হাজার বহুজাতিক সংস্থা ১৩১৮টি কোম্পানির মাধ্যমে পরিচালিত হয়। আর এসব প্রতিষ্ঠানও মাত্র ১৪৭টি ‘সুপার এনটিটি’ কোম্পানির অধীন। তাই যেসব সংবাদমাধ্যম আমরা পড়ি, দেখি ও শুনি তাদের বেশিরভাগই কাঠামোগতভাবে একটি বিশেষ স্বার্থগত নেটওয়ার্কের শর্তাধীন। এসব স্বার্থ আত্ম-সমর্থনের ও আত্ম-প্রতিষ্ঠার। তাই ফেক নিউজ আর প্রকৃত সংবাদের মধ্যকার পার্থক্যগুলো অলীক ও অসৎ। এই কাঠামোর কারণে বস্তুত আপনি ‘সংবাদ’ হিসেবে যা কিছু দেখেন তার সবই সূক্ষ্ম বা প্রত্যক্ষভাবে প্রোপাগান্ডার উপাদান। এর মাধ্যমে আপনাকে সবকিছু চালনাকারী প্রকৃত ঘটনা থেকে দূরে রাখা হয়। এটা মাদার জোনস, নিউইয়র্ক টাইমস, ব্রেইটবার্ট বা ফক্স নিউজ কার কাছ থেকে আসল তা খুব একটা ব্যাপার নয়। এই কাঠামোর মাধ্যমে আপনার কাছে যা কিছু আসুক তা আপনার মনকে দ্বিধাগ্রস্ত করে আর আপনার আবেগকে উসকে দিয়ে উদাসীনতা ও ধীরতা ফেলে দিয়ে আপনাকে ক্রোধের একটি জটিল বিশৃঙ্খলায় ফেলে দেয়। তো কী অবস্থা বিশ্বের সব থেকে বড় মিডিয়া ওনার গুগলের?
মার্কিন সংবাদমাধ্যম মিডিয়া.কম-এর অধীনে সাংবাদিকতা পর্যবেক্ষণকারী সংস্থা ইনসার্জ ইন্টিলিজেন্স ২০১৫ সালে বের করে আনে এক ভয়াবহ খবর। তা হলো, গুগল সার্চ ইঞ্জিনের একেবারে গোড়ার সংকেতগুলোর বিকাশ ঘটানোর সময় এর অর্থায়ন করেছিল দুই মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ, এনএসএ। এভাবেই ম্যাস-মিডিয়া মুষ্টিমেয় দানবীয় করপোরেশনের একচেটিয়া বাজার-ব্যবস্থার অধীনে একই ভাবধারার আধেয় সরবরাহ করে। আজকের যুগে দুনিয়াজুড়ে পাশ্চাত্য নব্য উদারবাদী ভাবধারার পক্ষে জনসংযোগ করাই মিডিয়ার কাজ।
ব্যক্তিগতভাবে বাংলাদেশের একটি প্রধান ধারার সংবাদমাধ্যমের আন্তর্জাতিক সংবাদ তত্ত্বাবধানের পেশাগত দায়িত্ব পালনের অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি, পাশ্চাত্য সংবাদমাধ্যম কী করে জনজীবনের গুরুত্বপূর্ণ খবরগুলোকে আড়ালে রাখে অথবা ফোকাস না করে অন্ধকারে রেখে দেয়। যুক্তরাষ্ট্রের একটি উদাহরণ হাজির করছি। আমেরিকা বলতেই আমাদের চোখের সামনে যে উজ্জ্বল-চাকচিক্যময় আভিজাত্যের বাস্তবতা হাজির হয়, যুক্তরাষ্ট্রের সামগ্রিক সমাজের অবস্থা তেমন নয় মোটেই। এখনো দারিদ্র্যের কবল থেকে মুক্তি মেলেনি দেশটির কয়েক কোটি মানুষের। বছরে লাখ লাখ মানুষ প্রাণ হারাচ্ছে ওই দারিদ্র্যের কারণেই। শিশুসহ স্বাস্থ্যসেবা বঞ্চিত লাখ লাখ মানুষ। মাথার ওপর ছাদ নেই লাখ লাখ মানুষের। এমন বাস্তবতায় অর্ধশতাব্দী আগে নোবেলজয়ী মানবতাবাদী অধিকারকর্মী মার্টিন লুথার কিং-এর ‘দরিদ্র জনতার আন্দোলন’ কর্মসূচির (পুওর পিপল ক্যাম্পেইন) পুনর্জাগরণ ঘটেছে সে দেশে।
নতুন করে সংগঠিত সেই ক্যাম্পেইন দাবি তুলেছে অর্থনৈতিক পুনর্গঠন ও গণতান্ত্রিক সংস্কারের। দুজন সাধারণ মার্কিন অধিকারকর্মীর ঘোষিত ৪০ দিনের কর্মসূচিতে ঢল নেমেছিল মানুষের। দেখা গেছে, নিজেদের অর্থ খরচ করে পুলিশি বাধা উপেক্ষা করে এই ডাকে সাড়া দিয়েছে রাজধানী ওয়াশিংটনসহ ৫০টি অঙ্গরাজ্যের লাখো মানুষ। প্রধান ধারার সংবাদমাধ্যমে এ সংক্রান্ত সংবাদের জন্য তেমন কোনো জায়গা মেলেনি। আমি আমার কর্মস্থলের জন্য এ সংক্রান্ত কাভারেজ করতে গিয়ে তা সংগ্রহ করেছি বিকল্পধারার মিডিয়া থেকে।
তবে পাঠক, বিনীতভাবে মনে করিয়ে দিচ্ছি, আপনি যে আধেয় হাজির করবেন ওয়ার্ল্ডওয়াইড ওয়েবে (ডব্লিউডব্লিউডব্লিউ) তা মানুষের কাছে পৌঁছাবে কি না, কত জনের কাছে পৌঁছাবে সেসব সিদ্ধান্ত কিন্তু আপনার হাতে না। এটা গুগল নামের সেই সার্চ ইঞ্জিনের হাতে, যার সঙ্গে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থার আঁতাত রয়েছে। নিজস্ব একটি সংবাদমাধ্যম বানিয়ে সেটায় একটি আধেয় পোস্ট করে আপনি সেটা ফেসবুকে শেয়ার করলেন। এখন আপনার কত জন বন্ধু সেই খবরটি দেখতে পাবে, ফেসবুকই তা নির্ধারণ করবে। সে আপনার কাছে টাকাও চাইবে, বেশি বেশি মানুষের কাছে আপনার কনটেন্ট পৌছে দেবে। আপনি যত টাকা দেবেন, তত বেশি মানুষের কাছে আপনার বার্তা পৌঁছাতে পারবেন। তার মানে মোদ্দা কথা দাঁড়াল, সংবাদমাধ্যম পুরনো যুগের গণবিরোধী ভূমিকা থেকে সরে আসেনি একটুও; নয়া যোগাযোগপ্রযুক্তিকে সঙ্গে নিয়ে বরং আরও বেশি করে প্রচার-প্রচারণা জোরালো করতে সক্ষম হয়েছে।
এখন কথা হলো, শাসকদের পক্ষের জনসংযোগ মানুষের কী কাজে লাগে? কোন রানী হিল পরা অবস্থায় আছাড় খেয়ে পড়লেন, সেটা জেনে আমাদের কী কাজ? ভিনদেশি প্রধানমন্ত্রী আমাদের দেশে সফরে এসে কী কী খেলেন, কোথায় ঘুমালেন আর কোথায় প্রাকৃতিক কাজকর্ম সারলেন তা জেনে আমাদের কী হবে? শাসক-রাজনীতিকদের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের খবর, সংসদীয় গালাগালি, ক্ষমতাতন্ত্রের ধারাবাহিক পুরনো বয়ানের নতুন উপস্থাপন; এইসব দিয়ে মানুষের কী কাজ হয়? হয় না। হয় না বলেই মানুষ এইসব খবর পড়ার আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। এইসব খবরকে পক্ষপাতহীন ভাবতেও আস্তে আস্তে অস্বীকৃতি বাড়ছে মানুষের মধ্যে। ২০১৮ সালের এডেলম্যান ট্রাস্ট ব্যারোমিটার নামের জরিপে দেখা গেছে, সংবাদ হিসেবে বিভিন্ন মাধ্যমে যা দেখা যায়, সেসবের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে সন্দিহান থাকেন ৫৯ শতাংশ মানুষ। অন্যদিকে এই ফেক নিউজ বা ভুয়া খবরকে ‘অস্ত্র’ হিসেবে ব্যবহারে উদ্বিগ্ন প্রতি ১০ জনের সাতজন।
প্রথাগত সংবাদবাস্তবতা বদলের প্রশ্ন তাই সামগ্রিক সমাজের রূপান্তরের প্রশ্ন। ছোট ছোট ব্যক্তিক/সামষ্টিক প্রতিরোধ সেই লড়াইকে এগিয়ে নেবে একটু একটু করে, আশাবাদী মানুষদের তেমনই বিশ্বাস।
অ্যাডেলম্যান ট্রাস্ট ব্যারোমিটার নামের জরিপে অংশগ্রহণকারীদের ৬৩ শতাংশই জানেন না, গুজব বা মিথ্যা খবর থেকে সৎ সাংবাদিকতাকে কীভাবে আলাদা করতে হয়। অর্থাৎ বিশ্বব্যাপী সাধারণ মানুষের মধ্যে সৎ সাংবাদিকতার বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে ধারণা অস্পষ্ট। আর এই অস্পষ্টতা গত দুই দশকে সমাধানমূলক সংবাদ, জীবনযাপন সংক্রান্ত সংবাদ, ইতিবাচক সংবাদের উৎপাদন ও এর চাহিদা বাড়িয়েছে ইন্টারনেটের পরিসরে।
সুবিখ্যাত মার্কিন রাজনীতি বিশ্লেষক নো’ম চমস্কির লেখা থেকে জেনেছিলাম, ১৮ শতকে ইংল্যান্ডে শ্রমিকদের দুর্দান্ত সব পত্রিকা ছিল। শ্রমিকরাই সেগুলোর সংবাদকর্মী-সম্পাদক ছিলেন। এক লাফে ছাপা আর কাগজের দাম কয়েকগুণ বাড়িয়ে পত্রিকাগুলোকে বন্ধ হয়ে যেতে বাধ্য করা হয়েছিল। তবে নয়া যোগাযোগপ্রযুক্তির যুগে কোনো সংবাদ প্রতিষ্ঠানকে তো দূরের কথা, একজন ব্যক্তিকেও প্রকাশিত হওয়া থেকে থামানো কঠিন। ওই মাধ্যমের প্রাযুক্তিক বৈশিষ্ট্যই গণতান্ত্রিক হওয়ার কারণে এমনটা হয়েছে। একটা ডোমেইন আর একটুখানি হোস্টিং কিনে গোটা দুনিয়ার সামনে আজ তথ্য হাজির করা সম্ভব, সেই তথ্য লেখা-চিত্র-ভিডিও-অডিও সবমিলেই সামনে আনা সম্ভব। নয়া যোগাযোগপ্রযুক্তি উইকিলিকস-এর মতো বিকল্প সংবাদমাধ্যমের জন্মের প্রেরণা হয়েছে। এককভাবে উইকিলিকস গত প্রায় এক দশক ধরে গোটা দুনিয়ার সামনে ক্ষমতাশালী সরকার আর ব্যক্তিকে উন্মোচন করে যাচ্ছে, এটা তো নয়া যোগাযোগপ্রযুক্তির কারণেই সম্ভব হয়েছে। জন-সাংবাদিকতা (সিটিজেন জার্নালিজম) বিকশিত হতে শুরু করেছে নয়া যোগাযোগপ্রযুক্তির হাত ধরে।
মূলধারার সংবাদমাধ্যমগুলোও সেই জন-সাংবাদিকতাকে নিজেদের অঙ্গীভূত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তবে এইসব প্রচেষ্টা খুব সামান্য কাজই করতে সক্ষম হয়েছে। বিপরীতে নয়া যোগাযোগপ্রযুক্তি ক্ষমতাশালীদের ক্ষেত্রেই জোরালো হাতিয়ার হয়েছে নিজেদের ভাবধারা বিক্রি করার। দুনিয়াজুড়ে নজরদারি জোরালো করতেও ক্ষমতাশালীদের হাতিয়ার হয়েছে নয়া যোগাযোগের প্রযুক্তি। তবে নয়া যোগাযোগপ্রযুক্তির আবির্ভাবের আগে বিকল্প-বিরোধী-ভিন্ন ভাবধারা যেমন সামনে আসার কোনো সুযোগই ছিল না, এখন সেই বাস্তবতা আর নেই। নয়া যোগাযোগপ্রযুক্তি অন্তত আমাদের বলার সুযোগ দিয়েছে, তা কতজন মানুষ শুনল সেটা পরের কথা। ব্যক্তিগতভাবে আন্তর্জাতিক সংবাদ নিয়ে কাজ করতে গিয়ে আমি কখনো শক্তিশালী দুই রাষ্ট্র আর মুষ্টিমেয় গ্লোবাল কংগ্লোমারেট-এর নিয়ন্ত্রণাধীন এপি-এএফপি-সিএনএন-বিবিসি-রয়টার্স-ভয়েস অব আমেরিকার ওপর নির্ভর করি না। আমি ইন্টারনেট খুঁজে ‘ডেমোক্র্যাসি নাউ’ নামের ওয়েবটি বের করেছি।
আমি ইন্টারসেপ্টের ওয়েব ঠিকানা জানি। আমার কাছে জি-নেটের ঠিকানাও আছে। আছে গুড নিউজ, পজিটিভ নিউজসহ বিকল্পধারার বেশকিছু ওয়েবসাইটের ঠিকানা, বিশ্বাসযোগ্য আর জনমুখী সংবাদ কিংবা সংবাদভাষ্য নির্মাণে যারা অনন্য ভূমিকা পালন করে যাচ্ছেন। একমুখী একক নব্য উদারবাদী সাম্রাজ্য ব্যবস্থায় নির্মিত আধেয়র বাইরে জনগুরুত্বপূর্ণ ইস্যুগুলো নিয়ে এরা সোচ্চার। বাংলাদেশের মানুষকে আমি সেইসব জায়গা থেকেও খবর দেওয়ার চেষ্টা করি। তবে এইসব চেষ্টা ছোট ছোট প্রতিরোধ তৈরি করলেও প্রথাগত সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে পেরে ওঠার মতো নয়। নয়া যোগাযোগপ্রযুক্তিতে পুঁজি বিনিয়োগ করে তা করায়ত্ত করছে তারা। সামগ্রিক পৃথিবীই যেখানে একটি বাজারে রূপান্তরিত, তথ্যও সেখানে বেচাকেনার উপাদান ছাড়া আর কিছু হবে না; এটাই তো স্বাভাবিক। প্রথাগত সংবাদবাস্তবতা বদলের প্রশ্ন তাই সামগ্রিক সমাজের রূপান্তরের প্রশ্ন। ছোট ছোট ব্যক্তিক/সামষ্টিক প্রতিরোধ সেই লড়াইকে এগিয়ে নেবে একটু একটু করে, আশাবাদী মানুষদের তেমনই বিশ্বাস।