অনুবাদ: ফারহানা রহমান
(পর্ব-২৫)
আমি চুপ করে আছি দেখে মিস্টার ফ্রিম্যানের চেহারাটা খুব হিংসুটে নিচু মনের অধিকারী স্থানীয় বদমায়েশ টাইপের এমন সব ছোকরার মতো হয়ে গেলো, যারা কোনো বিশেষ কারণ ছাড়াই সবসময় রাস্তাঘাটে লোকের পেছনে লেগে থাকে। আর অকারণে ঝগড়াঝাটি-রামারি করে বেড়ায়।
তিনি আমাকে এত জোরে জাপটে ধরলেন যে, আমার দম আটকে যেতে লাগলো। তিনি তার দুই’পা দিয়ে আমার কোমরটা দুমড়েমুচড়ে দিতে দিতে বললেন, ‘এই পিচ্চি তোর পেন্টিটা খোল।’ আমি ভীত ও আতঙ্কিত হয়ে চুপ করে থাকলাম। স্তব্ধ হয়ে রইলাম দুটি বিশেষ কারণে। প্রথমত লোকটা আমাকে এতই শক্ত করে আটকে রেখেছে যে নড়াচড়া করার মতো কোনো ক্ষমতা আমার ছিল না। দ্বিতীয়ত আমি একেবারে নিশ্চিত ছিলাম যে, যেকোনো মুহূর্তে মা বা বেইলি এসে আমাকে এই ভয়াবহ পরিস্থিতি থেকে উদ্ধার করবে। আর তা যদি নাও হয়, নিশ্চিতভাবেই সবুজ ভীমরুলগুলো হঠাৎ করেই দরজার ওপর এমনভাবে আছড়ে পড়বে যে, লোকটা আমাকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হবে।
‘শোনো রিটি, আমরা তো আগেও এই খেলাটা খেলেছি, তাই না?’ কথাটি বলেই মিস্টার ফ্রিম্যান তার শক্ত বাঁধন থেকে আমাকে কিছুটা আলগা করে আমার পেন্টিটা হ্যাঁচকা টেনে খুলে দিলেন। এরপর তিনি আবারও আমাকে ভীষণ শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রেডিও সাউন্ড পুরো ভলিওমে বাড়িয়ে দিলেন। ভয়ানক জোরে রেডিওটা বাজতে লাগলো আর তিনি চিৎকার করে আমাকে শাসাতে লাগলেন, ‘শোনো, তুমি যদি চিল্লিয়ে চিল্লিয়ে কোনোভাবে কান্নাকাটি করো, তাহলে কিন্তু আমি তোমাকে গলা টিপে এখানেই মেরে ফেলবো। মনে থাকে যেন। আর যদি কাউকে এসব কথা বলে দাও, তাহলে কিন্তু বেইলিকে খুন করে ফেলবো। মাথায় ঢুকেছে আমার কথাগুলো?’ আমি সবাইকে আসলে কী কথা বলে দিতে পারি, সেতাই তো বুঝতে পারছি না? তিনি এসব বলে কী বোঝাতে চাইছেন? আর বারবার শুধু বেইলিকে খুন করার কথা কেন বলেন? আমরা দুজন ভাইবোন তো কখনোই তার কোনো ক্ষতি করিনি বা তার সঙ্গে কোনো খারাপ ব্যবহার কখনো করিনি। তাহলে তিনি বারবার আমাকে এসব কথা বলে শাসান কেন?
আর এরপরই আমি সেই ভয়াবহ ব্যথার মধ্যে ডুবে গেলাম। এমন ভয়ানক সেই ব্যথা, যা আমার সমস্ত অস্তিত্বকে অবলুপ্ত করে দিয়ে আমার সমস্ত চেতনাকে ছিন্নভিন্ন করে দিলো। আট বছর বয়সী একটি শিশুকে ধর্ষণ করা মানে হচ্ছে, তার শরীরকে ছিদ্র করে একটি মোটা সুঁই ঢুকিয়ে দেওয়া। কারণ শিশুটির পক্ষে এগুলো সহ্য করা সম্ভব নয়। এমন একটি ভয়াবহ পরিস্থিতে যে, একটি অসহায় শিশুর পক্ষে কিছুই করার থাকে না, সেটা কখনোই একজন ধর্ষক বুঝতে চায় না।
আমি ভেবেছিলাম যে আমি আসলে মরেই গেছি এবং বেহেস্তের ভেতর অপূর্ব সুন্দর সাদা দেয়ালে ঘেরা একটি বাড়ির মধ্যে মৃত্যুর পর আবার জেগে উঠেছি। কিন্তু দেখলাম সেখানে মিস্টার ফ্রিম্যানও আছেন। তিনি খুব যত্ন করে আমার শরীর ধুয়িয়ে দিচ্ছেন। মিস্টার ফ্রিম্যানের হাতগুলো থরথর করে কাঁপছিল। কিন্তু তবুও তিনি আমাকে খুব যত্ন আগলে রেখে বাথটাবের ওপর বসিয়ে আমার পা ধুয়িয়ে দিচ্ছিলেন। ‘রিটি! রিটি! বিশ্বাস করো বাচ্চাটা, আমি কিন্তু ইচ্ছে করে তোমকে একটুও কষ্ট দিতে চাইনি। সত্যি বলছি আমি তোমাকে একটুও কষ্ট দিতে চাইনি। তুমি কিন্তু কাউকে এসব কথা বোলো না, বুঝেছ? কারও সামনে এসব নিয়ে একটা শব্দও উচ্চারণ করবে না, বুঝেছ?’
যদিও বা আমি খুব ক্লান্ত ছিলাম তবু নিজেকে খুব শীতল আর পরিচ্ছন্ন মনে হচ্ছিল। ভীষণ ক্লান্তিতে ভেঙে পড়তে পড়তে বললাম, ‘না না স্যার মিস্টার ফ্রিম্যান! আমি কাউকেই কিছু বলবো না।’ সে সময় আমি সবকিছুর অনেক ঊর্ধ্বে উঠে গিয়েছিলাম। এমনকি কোনো একটি শব্দ উচ্চারণ করার মতোও বোধ বা শক্তি কিছুই আর আমার অবশিষ্ট ছিল না। আমি শুধু এতটুকু বললাম যে, ‘আমি খুবই ক্লান্ত! আমি এখন একটু বিছানায় শুতে চাই। আমাকে একটু দয়া করুন। আমাকে একটু বিছানায় শুতে দিন।’ আমি খুব ক্লান্তভাবে ফিসফিস করে নিচু স্বরে কথাগুলো তাকে বললাম। আমি ভয় পাচ্ছিলাম যদি জোরে কথা বলি তিনি হয়তো ক্ষেপে গিয়ে আবারও আমাকে ব্যথা দিতে পারেন। তিনি কোনোকিছু না বলে আমার সারা শরীর মুছে দিলেন। আর আমার জামাকাপড় আর পেন্টিটা ফেরত দিলেন। তারপর গম্ভীরভাবে বললেন, ‘এগুলো পরো আর সোজা লাইব্রেরিতে গিয়ে পড়াশোনা করো। শোনো, এখনই তোমার মা কিন্তু বাসায় চলে আসবেন। তার সাথে দেখা হলে খুব স্বাভাবিক ব্যবহার করবে কিন্তু। বুঝলে?’
তারপর একটি একটি করে সিঁড়ি ভেঙে ওপরে এসে দেখলাম লিভিং রুমে কেউ নেই। আমি সরাসরি আমার রুমে এসে রক্তে মাখামাখি হয়ে যাওয়া পেন্টিটা এবং জামাকাপড় ম্যাট্রেসের নিচে লুকিয়ে রেখে কোনো রকমে বিছানায় এসে শুয়ে পড়লাম।
লাইব্রেরির উদ্দেশে রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে যখন যাচ্ছি, খেয়াল করলাম যে আমার পেন্টিটা একবারে ভিজে চপচপ হয়ে যাচ্ছে। আমার নিতম্ব মনে হচ্ছে হঠাৎ ফুলে উঠে আমার শরীর থেকে খুলে পড়ে যাচ্ছে। বাচ্চাদের জন্য তৈরি হাতলওয়ালা চেয়ারের মধ্যে আমি আর বেশিক্ষণ বসে থাকতে পারলাম না। ফলে সেখান থেকে উঠে গেলাম। লাইব্রেরি থেকে বের হয়ে খালি মাঠের মধ্যে যেখানে বেইলি একা একা ফুটবল খেলে, সেদিকে এগিয়ে গেলাম। কিন্তু ওখানে গিয়ে বেইলিকে খুঁজে পেলাম না। তবু সেখানেই বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলাম। বড় বড় ছেলেরা ওখানে নিজেদের মধ্যে ধুলো ছোড়াছুড়ি করে খেলছিল। এরপর একসময় নিজের অজান্তেই বাড়ির পথ ধরলাম।
কোনো রকমে ২টি ব্লক পার হওয়ার পরেই বুঝতে পারলাম যে, এ জীবনে হয়তো আর কখনোই হাঁটতে হাঁটতে বাড়ি পৌঁছাতে পারবো না। প্রতিটি পদক্ষেপের সঙ্গেই আমার শরীরের ভেতর ব্যথায় গুঁড়িয়ে যেতে লাগলো। আমি যেন চুরমার হয়ে পথেই ভেঙে পড়তে লাগলাম। আমার দুই পায়ের ভেতরে যেন কেউ আগুন ধরিয়ে দিয়েছে, এমনভাবে দাউ দাউ করে জ্বলতে লাগলো। এরইমধ্যে ব্যথা কমানোর জন্য কতবার করে যে মলম ব্যবহার করেছি, তার ঠিক নেই। আমাকে বুকের ভেতর জড়িয়ে ধরে ওসব কাজ করার সময় মিস্টার ফ্রিম্যানের বুক ধড়ফড় করা যেভাবে বেড়ে যেতো সেভাবেই আমার দু’পায়ের ভেতরে, তলপেটের নিচের দিকটাও ভীষণ ধড়ফড় করতে লাগলো। একেকটা পা ফেলছিলাম আর ভেতরে ধুমধাম করে সব ভাঙচুর হয়ে যাচ্ছিল। অবর্ণনীয় যন্ত্রণা সহ্য করে বাসায় পৌঁছালাম। তারপর একটি একটি করে সিঁড়ি ভেঙে ওপরে এসে দেখলাম লিভিং রুমে কেউ নেই। আমি সরাসরি আমার রুমে এসে রক্তে মাখামাখি হয়ে যাওয়া পেন্টিটা এবং জামাকাপড় ম্যাট্রেসের নিচে লুকিয়ে রেখে কোনো রকমে বিছানায় এসে শুয়ে পড়লাম।
মা রুমে ঢুকেই বললেন, ‘বাহ ছোট্ট লক্ষ্মী মেয়েটা! আজকেই প্রথম তোমাকে দেখলাম কাউকে কিছু না বলেই একেবারে লক্ষ্মী বাচ্চার মতো বিছানায় এসে শুয়ে পড়েছ। তুমি অসুস্থ না হয়ে পারোই না।’
আমি অসুস্থ ছিলাম না কিন্তু আমার পাকস্থলীর ভেতরে কোথাও যেন দাউদাউ করে আগুন জ্বলছিল। কিন্তু কী করে আমি মাকে সে কথা বলবো? এর পরপরই বেইলিও রুমে ঢুকলো আর বারবার জিগ্যেস করতে লাগলো আমার আসলে কী হয়েছে? কিন্তু ওকে তো কিছুই বলার নেই আমার। কিছুক্ষণ পর মা এসে আমাদের দুজনকে ডাইনিং রুমে গিয়ে খেয়ে আসতে বললেন। আমি মাকে জানালাম যে, আমার খিদে পায়নি। আমি খাবো না। আমি চুপচাপ শুয়ে আছি দেখে মা আমার কাছে এগিয়ে এসে তার ঠাণ্ডা হাতটি আমার কপালে ছোঁয়ালেন। ‘মনে হচ্ছে হাম উঠেছে। শুনলাম আশেপাশে অনেক বাসায় বাচ্চাদের হাম হচ্ছে।’ আমার জ্বর মেপে মা বললেন, ‘তুমি সম্ভবত ওদের কাছ থেকেই হাম আর জ্বর বাঁধিয়েছ।’
সেসময় মিস্টার ফ্রিম্যান সারাক্ষণই দরজাটা আটকে দাঁড়িয়ে থাকলেন। আর মায়ের উদ্দেশে বললেন, ‘তাহলে তো বেইলিকে কিছুতেই ওর কাছে ঘেঁষতে দেওয়া যাবে না। বুঝলে? অবশ্য যদি তুমি চাও যে, পুরো বাসাটাই অসুস্থ বাচ্চাদের দিয়ে ভরিয়ে দেবে, তাহলে আলাদা কথা।’
ঘাড় উঁচু করে মা বলে উঠলেন, ‘এখন না হোক পরে হলেও তো একসময় বেইলিরও হাম হবেই। তাহলে ওদের দুজনের একসাথে হওয়াই ভালো। বেইলি এখানেই থাকুক।’ এরপর মিস্টার ফ্রিম্যান মাকে একপ্রকার জোর করেই সেখান থেকে সরে যেতে বাধ্য করলেন। বেইলিকে বললেন, ‘এই যে ছোট্ট বেইলি জুনিয়র! যাও যাও দৌড়ে গিয়ে নিজের বোনের জন্য কিছু ভেজা রুমাল নিয়ে আসো আর ওর মুখটা সুন্দর করে মুছে দাও।’
বেইলি রুম থেকে বের হতেই মিস্টার ফ্রিম্যান আমার বিছানার কাছে এগিয়ে এসে আমার মুখের ওপর ঝুঁকে ফিসফিস করে আমাকে শাসাতে লাগলেন, ‘কাউকে কিছু বলেছ তো বুঝতেই পারছ!’ এরপর আমাকে ভয় দেখানোর জন্য একেবারে কানের কাছে এসে ফিসফিস করে বলতে লাগলেন, ‘যদি ঘুণাক্ষরেও কাউকে কিছু বলেছ তো, তোমার কিন্তু একেবারে সর্বনাশ হয়ে যাবে। একদম মুখ বন্ধ রাখবে বুঝতে পেরেছ?’ তার এসব কথার কোনো উত্তর দেওয়ার মতো কোনো ক্ষমতাই আমার ছিল না। আমি নীরবে ভাবতে লাগলাম যে, লোকটার তো বোঝা উচিত যে, আমি আসলে কাউকেই কিছু বলবো না। তাহলে এমন করছেন কেন? ঠিক সেসময়েই বেইলি ভেজা তোয়ালে নিয়ে রুমে এসে ঢুকতেই মিস্টার ফ্রিম্যান ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন।
চলবে…
আমি জানি খাঁচার পাখিরা কেন গান গায়-২৪॥ মায়া অ্যাঞ্জেল্যু