যদি আপেক্ষিকতা ন্যায়-অন্যায়, ভালো-মন্দের বিচারের ক্ষেত্রে শক্তিশালী প্রত্যয় হিসেবে ক্রিয়াশীল থাকে তবে প্রকৃত অর্থে নীতিবোধের মানদণ্ডে নীতি নির্ধারক হিসেবে ঠিক কোন প্রত্যয়টিকে ধ্রুব বলে ধরা হবে? সময়, পরিস্থিতি, প্রয়োজন, না কি অন্য কোনো কিছু? বস্তুত প্রশ্ন থেকে যায়, যদি পৃথিবীতে প্রত্যেকেই নিজ অবস্থান থেকে সঠিক হয় তবে ভুল কে? আদৌ কেউ কি ভুল?
ব্যক্তির সামাজিক জীবন থেকে শুরু করে পারিবারিক কিংবা ব্যক্তিগত জীবন—প্রায় সব ক্ষেত্রে সমষ্টিগত জীবন যাপনে পরস্পর সম্পর্কযুক্ত একে অন্যের ধ্যাণ-ধারণা, সুখ-অসুখ, সুবিধা-অসুবিধা পরস্পরের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। ক্ষেত্রবিশেষে ব্যক্তির একক জীবনের চাওয়া-পাওয়াও সাংঘর্ষিক হয়ে পড়ে কখনো কখনো। একটি প্রয়োজনের সঙ্গে অন্য প্রয়োজনের দ্বন্দ্ব আজীবন পরিস্থিতিকে ক্রমশ জটিল ও অমীমাংসাযোগ্য করে তোলে। ব্যক্তি এমতাবস্থায় কোন দিককে নিয়ে বেশি সক্রিয় হবেন, তা তার ব্যক্তি স্বাধীনতার আয়তাধীন। তবু বস্তুর আপেক্ষিকতার ব্যাখ্যা না করে মানুষ মূলত বস্তুকে নিজ নিজ অবস্থান থেকে বিচার করেন এবং একমুখী সিদ্ধান্তে উপনীত হন, যা আবার অন্যের জায়গা থেকে প্রশ্নবিদ্ধ হয়।
দুর্বল প্রাণী হিসেবে মানুষ মূলত নার্সিসিজমের অধীনে অধীনস্ত। নিজের প্রতি কোনো এক অদৃশ্য টান ও বিশ্বাস মানুষকে সর্বদা মৌলবাদী ধ্যাণ-ধারণার সাহায্যে পরিচালিত করে, যেখান থেকে মানুষ বস্তুকে যেকোনো একটি জায়গা থেকেই দেখা শেখে এবং দেখে যায়। এরপর আবার কারও কারও কাছে অন্যের দৃষ্টিকোণের কাছে যৌক্তিক জায়গা থেকে পরাজিত হওয়া যেন আত্মহত্যার সামিল। নিজের জায়গায় যেকোনো উপায়ে অনঢ় থাকাকেই কেউ কেউ নিজের অস্তিত্ব খুঁজে পায়। এটা মানুষে মানুষে থাকা বোধের তারতম্যের কারণে হয়ে থাকতে পারে। নিজের আটপৌরে কথাই তখন তার কাছে একমাত্র গ্রহণযোগ্য কথা বলে মনে হয়। আর নবীণ ও প্রবীণ তো বয়ষের অহঙ্কারে এতই বেহুঁশ যে, এই দুই শ্রেণীকে কিছু বলা বা বোঝানোর অভিপ্রায় ব্যক্তিকে, যা দিতে পারে তা হলো ব্যর্থতা।
এমন প্রেক্ষাপটে মানুষের ব্যক্তিগত থেকে সামাজিক, ক্ষুদ্র থেকে বৃহত্তর জীবন-যাপনজনিত রোজকার সমস্যা কী উপায়ে প্রশমিত হতে পারে—এই প্রশ্ন চির প্রাসঙ্গিক। কিন্তু আপেক্ষিকতার ধূম্রজালে বিচারক হবেন কে? আত্মার আওয়াজ যে আমাদের লোকায়ত জীবনের পরিপন্থী সুরে বাজে—তা তো কারও অজানা নয়, তবে কোন তালে আর কোন লয়েই বা ছন্দবদ্ধ আমাদের বিভ্রান্ত গতি বিধি?ভাবার অবকাশ থেকে যায়।
আর এই গ্রহণ করার মানসিকতা বাড়াতে হলে প্রথমেই যেটি করতে হবে সেটি হলো বয়স, অভিজ্ঞতা, সময় শিষ্টাচার ইত্যাদি শব্দকে নমনীয় হতে হবে, যদিও এটিও একটি আপেক্ষিক বক্তব্য।
আপেক্ষিকতার মানদণ্ডে নীতিনির্ধারক হবেন কে বা কী? যদি কেউ না কিছু হয়ও, তবে সে কিংবা সেটা সর্বজনীনভাবে গ্রহণযোগ্য তো নাও হতে পারে! যৌথজীবনে পারস্পারিকসহ অবস্থান নিশ্চিত করণে আমরা মৌখিকভাবে বদ্ধপরিকর, প্রকৃত অর্থে আমাদের কাছে সেটিই সঠিক যেটিকে আমরা নিজ অবস্থান থেকে সঠিক মানি এবং মানতে চাই। অন্যের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে পারার বহু মূল্যবান গুণ আমাদের মাঝে বিরল। কোনো অভিন্ন প্রসঙ্গের আলোচনায় পাঁচ জন ভিন্ন পরিবেশ, ভিন্ন পরিস্থিতি, ভিন্ন প্রয়োজনের, ভিন্ন সময়ের মানুষকে আলাদা আলাদা জায়গায় রেখে যদি তাদের দৃষ্টিভঙ্গি জানতে চাওয়া হয়,নিশ্চিত ভাবে পাঁচ ভিন্ন ভিন্ন বক্তব্য উঠে আসবে। সমস্যা হচ্ছে এটা আমরা জানি, কিন্তু মানি না যে উক্ত পাঁচজন ব্যক্তিই সঠিক। তবে ভুল কি কেউ আছে? এই প্রশ্নের উত্তরও আবার আপেক্ষিক। তবে এই সংকটের সমাধান আপেক্ষিক নয়। সবাই জানেন যে একই বস্তু ব্যক্তির অবস্থান ভেদে বিবিধ রূপ পরিগ্রহ করে। প্রয়োজন শুধু অন্যের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার।
কিন্তু চিত্তে চিন্তার প্রগাঢ়তা কম পড়লে আমরা কোনোভাবেই নিজেকে ছেড়ে অন্যকে মানতে পারি না। তার ওপর কিছু প্রতিষ্ঠিত প্রত্যয় তো আছেই যা যু্ক্তি, সত্য, সঠিক ইত্যাদি শব্দের ওপর একক আধিপত্য বিস্তার করে নতুন ভাব ধারার বিকাশে দাড়ি টেনে রেখেছে। বলছি বয়স, অভিজ্ঞতা, সমাজ শিষ্টাচার ইত্যাদি অনমনীয় বিষয়ের কথা যা মাথা নোয়াবে না স্থান, কাল, পাত্র, ঘটনা পরিস্থিতি—কোনো ক্ষেত্রেই। এগুলো সব ক্ষেত্রে অপরিবর্তনশীন অবস্থান নিয়ে ব্যক্তিকে স্বমহিমায় আন্দোলিত হতে বাধা দেয়। যদি বা কেউ এগুলোর ঊর্ধ্বে গিয়ে কিছু ভাবে তবে অঙ্ক পুরনো বক্ররেখায় ঘুরে নতুন রূপে পুরোনো সংকটের জন্ম দেয় যার নাম অবাধ্যতা, যার নাম অভদ্রতা।
মাথার পেছনে বুলেটের মতো পূর্বপুরুষের চোখ রাঙানি, আমাদের করা হয় না কিছুই। প্রকৃত অর্থে বস্তুর সঠিক অবয়ব জানতে প্রয়োজন দ্বিবাচনিকতা যেখানে একক নয়, অবস্থান ভেদে বিবিধের বক্তব্যকে সমান গুরুত্ব দিয়ে আলোচনায় আনা হবে এবং বিবেচনা করা হবে, কেননা সত্য একের কথায় নয়—নিহিত থাকে একাধিকের কথায়। কেননা একাধিকের কথায় সামগ্রিক চিত্র বা অবস্থান উঠে আসে।
অবশ্য এই সত্যকে কে জীবনে কাজে লাগাতে বা বিশ্বাস করতে বোধ করি প্রয়োজন গ্রহণ করার মানসিকতার, যা নিজের পাশাপাশি অন্যকে মেনে নেয়, অন্যের দৃষ্টিকোণকে মেনে নেয়। আর এই গ্রহণ করার মানসিকতা বাড়াতে হলে প্রথমেই যেটি করতে হবে সেটি হলো বয়স, অভিজ্ঞতা, সময় শিষ্টাচার ইত্যাদি শব্দকে নমনীয় হতে হবে, যদিও এটিও একটি আপেক্ষিক বক্তব্য।