পর্ব-২
বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে একটা সাইনবোর্ড। ওই সাইনবোর্ডের সঙ্গেই বিএসএফ (বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স) চৌকি। কিছু সশস্ত্র বিএসএফ সদস্য দাঁড়িয়ে। তারা কিছুই জানতে চাইলেন না। সাইনবোর্ড পার হয়ে সামনে গেলাম। পাশেই পুরনো গ্রাম্য হাঁটের মতো একটা জায়গা। ভাঙাচোরা টিনের ছোট ঘর। বারান্দায় দুই ভারতীয় ইমিগ্রেশন কর্মকর্তা বসে। পাসপোর্ট চেক করলেন। সঙ্গে কত টাকা আছে জিজ্ঞেস করলেন। কোনো বাংলাদেশি টাকা সঙ্গে আছে কি না, ইত্যাদি। ডলার বা রুপি থাকলে সমস্যা নেই। বাংলাদেশি টাকা থাকলেই ঝামেলা। আমরা আগেই সে বিষয়টি জানতাম।
এরপর কয়েক মিটার সামনে এগোলাম। ভাঙা বেড়ার একটা দোচালা ঘরে প্রবেশ করলাম। সেখানেই ইমিগ্রেশন কর্মকর্তারা বসেন। পাসপোর্ট জমা দিলাম। মিনিট পাঁচেক পর নাম ধরে ডেকে সিল মেরে পাসপোর্ট ফেরত দিলেন। কোনো ঝামেলা নেই। দুই পাশের অফিস মিলিয়ে সময় লাগলো দুই ঘণ্টা। ওপাশে কোনো ‘উপকারী’ লোকের দরকার পড়লো না।
বাংলাদেশ অংশে পাকা বহুতল ভবন। স্থায়ী চেক পোস্ট। ভারতীয় অংশে সবই অস্থায়ী। তারপরও আমাদের লোকদের ‘খাই খাই’ স্বভাব। এটা ‘মনের অভাব’।
পাসপোর্ট পাওয়ার পর ডলার ভাঙিয়ে রুপি করলাম। তৎক্ষণাৎ খিদে অনুভব করলাম। খাওয়ার মতো তেমন কিছু নেই। কিছু মুদি দোকান ছিল। চানাচুর, বিস্কুট কিনলাম। আমরাই নির্দেশনা দিয়ে ডিম আর লুচি মিলিয়ে ভ্রাম্যমাণ দোকান থেকে মজাদার একটা খাবার বানিয়ে খেলাম। টিউবওয়েল থেকে পানি তুলে পেট ঠাণ্ডা করলাম।
সবকাজ ভালোভাবে হলেও বিপত্তি বাধলো অন্য খানে। কথা ছিল সীমান্তের ভারতীয় অংশে শ্যালমীর একই রকম গাড়ি থাকবে। সেটি আমাদের নিয়ে যাবে শিলিগুড়ি। কিন্তু বাস নেই। কেন নেই? ১৪ মে পশ্চিমবঙ্গে পঞ্চায়েত নির্বাচন। তাই নাকি বাস রিক্যুজিশন দিয়ে নিয়ে গেছে পুলিশ! হুম, ঘটনা একই। সীমান্তের এপার-ওপার একই সিস্টেম!
পড়ে গেলাম ফাঁপরে। কী করা যায়? কিছু প্রাইভেটকার, খোলা জিপ ছিল। চারটা গাড়ি ভাড়া করলাম। প্রাইভেট কার নিয়ে রওনা হলাম শিলিগুড়ির উদ্দেশে। ১৫ জন চার গাড়িতে। আমাদের চালকের নাম মদুল সওদাগর। মুসলমান। দাদার আমলে ভারতে গিয়েছিলেন তারা। বাংলাদেশে তার চাচারা থাকেন।
চ্যাংড়াবান্ধা পড়েছে কুঁচবিহার জেলায়। শিলিগুড়ি পড়েছে জলপাইগুড়ি জেলায়। চ্যাংড়াবান্ধা থেকে শিলিগুড়ি যেতে সময় লাগে ৩ ঘণ্টা। দূরত্ব ৯০ কিলোমিটার। শিলিগুড়ি থেকে দার্জিলিঙ ৬৫ কিলোমিটার। দার্জিলিঙ নামটা শুনলেই সবার আগে আসে চায়ের কথা। চা বাগানের কথা। চোখ বুঁজে দেখতে পাই বিস্তীর্ন চা বাগান। ছায়া গাছ। শান্ত শীতল প্রকৃতি।
ফুলবাড়ি থেকে ডানে টার্ন নিয়ে সোজা উত্তরে। ৩ ঘণ্টায় চ্যাংড়াবান্ধা থেকে শিলিগুড়ি পৌঁছলাম। শরীর ক্লান্ত, মন অবসন্ন। কিন্তু সব কিছু ছাপিয়ে শিলিগুড়ির সৌন্দর্য আমাদের চাঙা করে তোলে। শিলিগুড়ি বাসস্ট্যান্ড থেকে শহরের ভেতরে ঢুকছিলাম। গন্তব্য হোটেল স্বস্তিকা।
চা বাগান দেখব বলে মনের ভেতরটা আকুপাকু করছিল। অবাক হলাম, লালমনিরহাটের পাটগ্রাম থেকেই চা বাগান দেখছি। অনুমান করছিলাম, সীমান্তবর্তী এলাকার ওই বাগানগুলো হয়তো ভারতীয়দের। সে যারই হোক। বাগান দেখেই আমরা সন্তুষ্ট।
সীমান্তের এপার-ওপার তেমন কোনো পার্থক্য নেই। একটা ব্যাপার না বললেই নয়, আমাদের এখানে যেমন বাড়ির সাথে পালান অথবা জমিতে শাক সবজির চাষ করি; ওরা করে চায়ের চাষ। বড় বাগান কম। গেরস্থের জমিতেও চা চাষ। সম্ভবত চায়ের পাতা তারা কারখানা মালিকদের কাছে বিক্রি করে দেয়।
ফিরোজ আলম বললেন, এগুলো চা বাগান না। তাহলে কী? এগুলো চা ক্ষেত। কিভাবে? বিশাল এলাকা নিয়ে চা গাছ থাকলে সেটা বাগান। এখানে দ্যাখেন, আমাদের ধান ক্ষেত, কচু ক্ষেতের মতো ছোট ছোট প্লট। সুতরাং এগুলো চা ক্ষেত। কথা সত্য।
আমাদের ঠিক আগে একটি মোটরভ্যান যাচ্ছিল। সেটা ভরা চা পাতা। জালে প্যাঁচানো পাতা বাতাসে ছড়িয়ে যাচ্ছিল। তার মানে এইসব ছোট ক্ষেত থেকে পাতা তুলে বিক্রি করা হয়। ওরকম ভ্যানে করে চলে যায় কারখানায়। সেখানে ওজন করে কেজি দরে বিক্রি হয়।
ড্রাইভার মদুল সওদাগর বাংলায় কথা বলে। ভালো লাগলো বিষয়টা। জিজ্ঞেস করলাম, জলপাইগুড়ির ভাষা কী? জানালেন, কুঁচবিহার, জলপাইগুড়ি, শিলিগুড়ির ভাষা বাংলা। আর দার্জিলিঙে? ওখানে বাংলাও চলে। আছে হিন্দির প্রচলন। কেউ কেউ ইংরেজিও পারেন। স্থানীয় একটি ভাষাও আছে। যার নাম তার জানা নেই।
২০ কিলোমিটর পর পেলাম ময়নাগুড়ি বাইপাস। ওখান থেকে পূর্ব দিকের রাস্তা চলে গেছে আসাম, অরুনাচল, মিজোরাম ওই অঞ্চলে। সেখান থেকে এক ঘণ্টার একটু বেশি পথ ফুন্টশিলিং। যেখান দিয়ে সড়কপথে ভুটান যাওয়া যায়। আমরা সোজা পশ্চিমে চলছিলাম, শিলিগুড়ির দিকে। শিলিগুড়ি থেকে পশ্চিমে কোলকাতার রাস্তা, উত্তরে সিকিম এবং দার্জিলিঙ।
আড়াইঘণ্টা যাওয়ার পর হঠাৎ মোবাইলফোনে বাংলাদেশের নেটওয়ার্ক! ঘটনা কী? ড্রাইভার জানালেন, সেখান থেকে বাংলাদেশের সীমান্ত খুব কাছে। মাত্র ২ কিলোমিটার। তাই নাকি? তাহলে ওইপথ দিয়ে আমরা যাইনি কেন? এই পোর্টের নাম কী? ফুলবাড়ি। বাংলাদেশ অংশে বাংলাবান্ধা। কপাল! এখান দিয়ে এলে তো আড়াইঘণ্টা সময় বাঁচতো।
ফুলবাড়ি থেকে ডানে টার্ন নিয়ে সোজা উত্তরে। ৩ ঘণ্টায় চ্যাংড়াবান্ধা থেকে শিলিগুড়ি পৌঁছলাম। শরীর ক্লান্ত, মন অবসন্ন। কিন্তু সব কিছু ছাপিয়ে শিলিগুড়ির সৌন্দর্য আমাদের চাঙা করে তোলে। শিলিগুড়ি বাসস্ট্যান্ড থেকে শহরের ভেতরে ঢুকছিলাম। গন্তব্য হোটেল স্বস্তিকা।
চলবে…
দার্জিলিঙে বৃষ্টি, কালিম্পঙে রোদ-১॥ উদয় হাকিম