পর্ব-০৪.
ড. ফারজানা সাধারণত সিএনজি বা উবারেই ভার্সিটিতে আসা-যাওয়া করেন। আব্দুল করিমের সামনে বসে নিজের মাথার চুল নাড়তে নাড়তে মন খারাপ করে বললেন, যাতায়াত করা কঠিন হয়ে গেছে। ঠিকমতো সিএনজি পাওয়া যায় না। পেলেও ধূলাবালি। উবারেও অরেক সমস্যা, ঠিকমতো পাওয়া যায় না। মাঝেমধ্যে বাসেও যাতায়াত করতে হয়। এখন আর করি না। পরিবেশটা ভালো না। আজকে প্রায় একঘণ্টা সময় দাঁড়িয়ে ছিলাম, সিএনজিও পাই না, উবারও পাই না। খুব বিরক্ত লেগেছে। ভেবেছিলাম, একটু আগে আগে এসে আপনার সাথে সময় কটাবো। ভাবি এক, হয় আর এক। একবার ভেবেছি, আপনাকে ফোন করি। আবার ভাবলাম, ফোন করে কি হবে! আপনি তো গাড়ি পাঠাতে পারবেন না। অফিসের গাড়ি। ড্রাইভারগুলো যে শয়তান! পুরো বিশ্ববিদ্যালয়ে ছড়ায়ে ছাড়বে!
আব্দুল করিম বললেন, আমিও ভাবছিলাম আপনি এখনো আসছেন না কেন! সামনে ফার্মেসির একজন ফ্যাকাল্টি ছিলেন। এজন্য আমিও ফোন দিইনি। আচ্ছা, আপনি এভাবে যাতায়াত করেন কেন বলুন তো! এতে মাসে খরচ তো একদম কম যায় না। একটা গাড়ি নিলেই তো পারেন।
গাড়ি নেবো টাকা পাবো কোথায়?
কেন? এখন তো কিনতে পারেন। বেতন তো এখন একেবারে কম নয়। বেতনের সাথে এক্সট্রা লোড কোর্সের টাকা—সব মিলে লাখখানেক তো প্রায় হয়েই যায়। সে সাথে আপনার হাজবেন্ডের ইনকাম।
জানেন আমার বাচ্চা কয়টা?
জানি তো। বলছিলেন—একটা।
হ্যাঁ, একটাই। কিন্তু আসলে দুটো। আমার হাজবেন্ডও আমার কাছে বাচ্চার মতোই। কিচ্ছু করেন না। কী সব ছাইপাশ কবিতা লেখে। দুতিনটে বই বের হয়েছে। সে টাকাও আমাকেই দিতে হয়েছে। কেউ ওসব পড়ে বলে মনে হয় না। ও লিখে শান্তি পায়—লেখে। কিছু কবিবন্ধু আছে—তাদের সঙ্গে দিনরাত আড্ডা দেয়—কখন বাসায় ফেরে না-ফেরে—ঠিক নেই। একদম এলোমেলো জীবন। আমি প্রথম প্রথম একটা নিয়মে আনার চেষ্টা করেছি। দেখি, একই রকম—কোনো লাভ হয় না। কবিখ্যাতির জন্য মরিয়া হয়ে থাকে। একটা রাজনৈতিক দলের সঙ্গেও লেগে আছে—নেতাদের পিছে পিছেও ঘোরে—একটা বড় পুরস্কার নিয়েই ছাড়বে—এরকম ভাব!। এসব বলে আর কী—আমি নীরবে শুনি।
আপনি এরকম একটা পাগলের সঙ্গে ঘর করেন কী করে?
ফেঁসে গেলে কোনো উপায় থাকে না। করতে হয়। চাকরিটা কিভাবে করি দেখেন না! যা হোক, যা বলছিলাম, এই পাগলটাকেও আমাকে বাচ্চার মতোই চালাতে হয়। এখন বলুন, গাড়িটা কোত্থেকে কিনবো? আর কিনলেও গাড়ির পেছনে যে খরচ, তা পাবো কোথায়?
ভালোই বলেছেন। আব্দুল করিম অনেকক্ষণ হাসলেন। বললেন, এরকম হাজবেন্ড থাকা একদিক থেকে ভালো। বউ’র ওপর খবরদারি খাটাতে পারে না। আপনি এখন যেভাবে চলছেন, যেভাবে আছেন, হাজবেন্ডের প্রাতিষ্ঠানিক প্রতিষ্ঠা ও আর্থিক অবস্থা আপনার থেকে ভালো হলে, আপনি এত স্বাধীনতা পেতেন না। এভাবে চলতে পারতেন না।
তা হয়তো ঠিক। কিন্তু সেটা হলেই বোধ হয় ভালো হতো। এরকম জীবন চালাতে চালাতে আমি তো হাঁপিয়ে উঠেছি। আর পারছিনে। আজ উঠি স্যার। কাল আবার কথা বলবো।
উঠছেন তো! গাড়ি কেনার কী হলো?
বাদ দেন তো। ও হবে না।
বাদ দেবো কেন? আপনি কিছু টাকার ব্যবস্থা করেন। আমি নিজে কিছু টাকা দেবো। আর যেটা বাকি থাকে, সেটা লোন নিলেই গাড়ি হয়ে যাবে।
লোনের কিস্তি দিতে হবে না? সংসার চলবে কিভাবে?
আরে একরকম হয়ে যাবে।
আপনি দিবেন?
প্রয়োজন হলে দেবো।
শোনেন স্যার, এখন হয়তো আমার সবকিছু আপনার ভালো লাগে, আমার জন্য অনেক কিছু করতে চান। করতে পারেনও। করেনও। যদি কোনোদিন কোনো কারণে আমাদের এই সম্পর্কটা এমন না থাকে—দূরত্ব তৈরি হয়ে যায়—তখন আমি কী করবো? কিভাবে চলবো—কিভাবে গাড়ির লোনের কিস্তি দেবো? আবেগ ভালো—বেশি আবেগ ভালো না স্যার—জলে সব ভেসে যায়—কূলকিনারা খুঁজে পাওয়া যায় না। তাতে মরণই বেশি হয়।
এত হিসাব করবেন না তো!
স্যার, হিসাব করতে হয়। আপনি যদি আমাকে গাড়ি কিনতে টাকা দেন, কেউ যদি কোনভাবে তা জানে—আপনার চাকরি থাকবে না। আমার তো থাকবেই না। আর এমনও হতে পারে আপনার ঘরও যেতে পারে। তখন কি করবেন? আপনি আমাকে খুব ভালোবাসেন—আমিও আপনাকে অনেক ভালোবাসি। আচ্ছা, বলুন তো, আপনি আমাকে বিয়ে করতে পারবেন?
কেন পারবো না? অবশ্যই পারবো।।
পারবেন না। আপনি ইমোশনাল হয়ে গেছেন। বাস্তব অনেক কঠিন স্যার। আমি চাই না আমার জন্য আপনার এমন কোন ক্ষতি হোক—যেখানে মান-সম্মান চাকরি-বাকরি নিয়ে টানাহেঁচড়া শুরু হোক। আর একটা কথা স্যার, আমার আর আপনার সম্পর্কটা তো একান্ত। বিশেষ ব্যক্তিগত সম্পর্ক। আমার প্রণয়ের পুরুষ তো আপনিই। সব কিছু ঠিক রেখে যেভাবে চলছি—এভাবেই চলি, স্যার। দুজনেই মান-সম্মান নিয়ে ভালো থাকবো।
তুমি যেটা ভালো মনে করো!
আমি গাড়ি কিনলে আপনি খুশি হবেন আমি জানি স্যার। আপনাকে বলি গাড়িটা আমি কিনবো—আপনার সম্মানেই কিনবো।
টাকা?
আমার এক বন্ধু আছে, খুব বড় ব্যবসায়ী। তাকে বললে না করবে না। যদিও কখনো তাকে আমি এরকম কিছু বলিনি।
তার টাকা নেবেন? আমারটা নেবেন না!
আব্দুল করিম ডান হাতটা ড. ফারজানার হাতের কাছে বাড়িয়ে দিলেন। ড. ফারজানা তার হাতের তালুতে ফুলের একটা ছবি এঁকে, তার ওপরে লিখলো, ‘আমার প্রণয়ের পুরুষ’। লিখেই ড. ফারজানা মুখটা নিচু করে বসে থাকলো।
স্যার, আমরা একসাথে এখানে চাকরি করি। অনেক হিসাবের ব্যাপার আছে। তারপর আমার আপনার একটা বিশেষ সম্পর্ক আছে। কোনোভাবে একটু এদিক ওদিক হলেই ব্যাপারটা কী দাঁড়াবে আপনি চিন্তা করতে পারেন? আপনি বোঝেন না স্যার—আমি আপনাকে ‘তুমি’ সম্ভোধন করি না। আপনাকেও করতে দিই না। আমাদের সম্পর্ক কি ‘আপনি’র মতো?
ঠিক আছে। তোমার সব কথা—সব যুক্তি মেনে নিলাম। আচ্ছা আমি তো অনেক ব্যবসায়ীকে চিনি। আপনার বন্ধুর কী নাম বলুন তো চিনতে পারি কি না।
চিনবেন না। না, চিনতেও পারেন। কিন্তু নামটা আমি বলতে চাইছি না।
আপনার কেমন বন্ধু?
কঠিন প্রশ্ন। কিভাবে যে উত্তরটা দিই! আচ্ছা উত্তরটা না দিলে কি মন খারাপ করবেন?
এটা আপনার ব্যক্তিগত ব্যাপার। মন না চাইলে প্রয়োজন নেই।
জানি মন খারাপ করছেন। আমাকে খুব পছন্দ করেন। ওয়েস্টিনে একটা অনুষ্ঠানে পরিচয় হয়েছিল। তারপর দিনে দিনে কথা গল্পে ভালো বন্ধু হয়ে গেছি। জানেন ও তো প্রথমে ভেবেছিল, আমি আনম্যারেড। অবশ্য তখন আমার বেবি হয়নি। বিয়েটা বছরখানেক হয়েছিল। একেবারে বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে বসলো। আমি তো অবাক। যখন জানলো আমি ম্যারেড, অনেক মন খারাপ করেছিল। কিন্তু পরে দিনে দিনে কথা গল্পে সাক্ষাতে আমরা ভালো বন্ধু হয়ে আছি।
কয় বছর হলো?
তা তো চার বছর হবেই।
শুধুই বন্ধুত্ব? না কি বন্ধুত্বের চেয়েও বেশি কিছু?
আমি জানতাম এ প্রশ্নটা আপনি করবেন। সব পুরুষমানুষের একই স্বভাব। নিজের প্রেমিকার অন্য কারও সাথে বন্ধুত্ব মেনে নিতে পারে না।
অবশ্য মেয়েরাও তাই। আপনার ক্ষেত্রেও এমনটি হলে আমিও একই প্রশ্ন করতাম।
যা হোক আমি কিন্তু অতকিছু ভেবে প্রশ্নটা করিনি। বলতে পারেন করে ফেলেছি। অত সিরিয়াসলি নেওয়ার দরকার নেই।
একটা কথা বলবো?
বলুন।
কিছু মনে করবেন না তো।
মনে করার কিছু নেই তো।
দেখুন ঘরে আমার স্বামী আছে। বলতে পারেন একটা নির্বোধকে নিয়ে আমি ঘর করি। আর যার কথা বলছি, সে সত্যি আমার খুব ভালো বন্ধু—বন্ধুই—এর বেশি কিছু নয়। তবে আমি আপনার কাছে লুকাবো না, সে আমাকে অসম্ভব পছন্দ করে। আমি যদি এখনি তাকে বলি, চলো আমরা অন্য কোনো দেশে গিয়ে এক সাথে থাকি। বা যদি বলি, আসো আমরা সব বাদ দিয়ে নতুন করে বিয়ে করি—সে একটুও দ্বিধা না করে আগে-পরে একটুও কিছু না ভেবে রাজি হয়ে যাবে। ওর যে একটা বউ আছে, আমার যে স্বামী সন্তান আছে, এসব কিচ্ছু ভাববে না। আমার প্রতি ও এত অন্ধ! কিন্তু বাস্তবে এসবের এখন কোনো মূল্য নেই। আমরা শুধুই বন্ধু—খুব ভালো বন্ধু। আর আপনারটা বলবো?
বলুন।
আপনি আমার স্বামীও নন, বন্ধুও নন।
বলবেন আপনি আমার বস—এই তো! ও আমি আগেই জানতাম—এ কথা বলবেন।
না, জানেন না। আপনি ঈর্ষাবোধ করছেন।
হ্যাঁ, তা তো একটু ঈর্ষা হচ্ছেই। অস্বীকার করি কিভাবে!
আপনি অনেক মন খারাপ করে কথা বলছেন। মন খারাপ করে দিয়েছি?
কিছুটা তো মন খারাপ হয়েছেই।
আপনার ডান হাতটা দেখি।
কেন?
চেয়েছি। দিন।
আব্দুল করিম ডান হাতটা ড. ফারজানার হাতের কাছে বাড়িয়ে দিলেন। ড. ফারজানা তার হাতের তালুতে ফুলের একটা ছবি এঁকে, তার ওপরে লিখলো, ‘আমার প্রণয়ের পুরুষ’। লিখেই ড. ফারজানা মুখটা নিচু করে বসে থাকলো।
আব্দুল করিম নিজের হাতের তালুটা কয়েকবার দেখলো—মনটা অপার্থিব এক আনন্দে ভরে গেলো। নিজের হাতের তালুতে নিজেই কতবার চুমু খেলো। তারপর উঠে গিয়ে ড. ফারজানার মুখটা নিজের মুখের কাছে টেনে নিলো।
ড. ফারজানা বললো, অফিসে কেউ দেখে ফেললে ঝামেলা হবে। দুজনেরই সম্মান যাবে। আপনি চেয়ারে গিয়ে বসেন।
অনুগত বালকের মতো ড. ফারজানার মুখটা ছেড়ে আব্দুল করিম নিজের চেয়ারে বসে মুখটা নিচু করে চোখ বন্ধ করে টেবিলে কী একটা আঁকিবুকি করতে থাকে। একটু পরে চোখ তুলে দেখে ড. ফারজানা চলে গেছেন। ভাবে, ব্যাপারটাকে কী সে খারাপভাবে নিলো! না হলে এভাবে চলে যাবে কেন! উত্তরটা নিজের ভেতর মেলাতে পারে না।
আব্দুল করিমের অফিস থেকে বেরুতে বেরুতে প্রায় সন্ধ্যা পার হয়ে গেলো। গাড়িতে উঠেই বললো, ফারজানা, সরি, আমার অতটা করা ঠিক হয়নি। আপনি অন্যভাবে নেবেন না। আবেগটা ধরে রাখতে পারিনি।
সরি বলছেন কেন? আমি তো আরও বেশি আশা করেছিলাম। বাসায় অনেক গেস্ট। কথা বলার পরিবেশ নেই। শুনুন মশায়, অতটুকুতে আমার মন কিন্তু ভরবে না।
বাসাটা ফাঁকাই ছিল—ড. ফারজানা ইচ্ছে করেই মিথ্যে বললো। কথায় শুধু আবেগের ঢেউটা তুলে দিলো। যাতে আব্দুল করিম তার কথা বলার অনাগ্রহটা বুঝতে না পারে।
আব্দুল করিমের উত্তরের কোনো অপেক্ষা না করেই ড. ফারজানা মোবাইলফোনটা রেখে দেন। আব্দুল করিমের বুকের ভেতর জমে ওঠা দ্বিধাদ্বন্দ্বের পাথরটা মুহূর্তেই গলে যায়।
ঠিক এমন সময়ে আব্দুল করিমের মোবাইলফোনে আর একটা কল আসে। হ্যালো বলতেই সালাম দিয়ে বললেন, আমি ড. এলিনা রহমান। সাবেক মেজর আকিজ রহমানের ওয়াইফ।
মেজর আকিজ রহমান! হ্যাঁ চিনি তো। উনি তো আমার দুব্যাচ সিনিয়র ছিলেন। বলুন তো ম্যাডাম, কী জন্যে ফোন করেছেন?
ম্যাডাম না বলে আমাকে ‘ভাবি’ সম্বোধন করলে বেশি খুশি হবো। আর হিসাবেও তো তাই হয়। তাই না? আপনি আমার হাজবেন্ডের জুনিয়র। আমি তো আপনাদেরই পরিবারের সদস্য।
ওকে ভাবি। এবার বলুন তো কী জন্য ফোন করেছেন?
আপনার সাথে দেখা করে বলতে চাই। আপনি যদি আমাকে অনুগ্রহ করে একটু সময় দেন।
অনুগ্রহ বলছেন কেন আপনি! কখন আসতে চান?
আগামীকাল সকাল এগারোটায়।
ওকে। আমি অপেক্ষা করবো।
অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। বলেই ড. এলিনা রহমান মোবাইলফোনের লাইনটা কেটে ভাবেন, লোকটা ভদ্র হবেন নিশ্চয়। সুন্দর করে কথা বলেন।
চলবে…