বাঘা যতীনের গ্রামের নাম কয়া। কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালী উপজেলার অতি পরিচিত একটি গ্রাম। এ গ্রামের কোলঘেঁষে বয়ে গেছে গড়াই নদী। এক সময়ের ভীষণ প্রমত্তা গড়াই। তার প্রবল স্রোতের শব্দ শোনা যেতো অনেক দূর থেকে। বাঘা যতীনের খুব সখ্য ছিল এই নদীটির সঙ্গে। এ নদীতে তিনি গোসল করতেন। সাঁতার কাটতেন। খরস্রোতা এই নদীর কাছ থেকেই শিখেছিলেন কিভাবে যুদ্ধ করতে হয়। শহর থেকে ফেরার সময় কখনো কখনো গভীর রাতে নদীটির বুক সাঁতরিয়ে বাড়ি ফিরতেন। এই নদীতে কতো স্মৃতি তাঁর। নদীটি এখন আর আগের মতো নেই। বছরের অধিকাংশ সময়ই শুকনো থাকে। ঝাঁঝালো রোদে পোড়ে নদীর বুক। দাঁড়িয়ে থাকে বালিভর্তি বুকে। হেঁটে বা যানবাহন চালিয়ে সরাসরি পার হওয়া যায়। বাঘা যতীনের স্মৃতিজড়িত প্রমত্তা গড়াই এখন শুকনো এক নদী, বেদনার্ত গল্পের শিরোনাম যেন। নদীটির তীর ঘেঁষা কয়া গ্রামের জন্য তাঁর ছিল অপরিসীম দরদ।
একটু সময় পেলেই ছুটে আসতেন এখানে। এখানকার মানুষের সঙ্গে মিশে যেতেন, মুখভরা হাসি আর বুকভরা ভালোবাসায় হয়ে উঠতেন একাত্ম। ভাগাভাগি করে নিতেন আনন্দ-বেদনা। এ গ্রামের মানুষের কাছেও তিনি ছিলেন পরম আপনজন। এখানেই ছিল তাঁর সবচেয়ে নিরাপদ আশ্রয়। ব্রিটিশ সৈন্যরা বহুবার বাঘা যতীনের খোঁজে এ গ্রামে এসেছে, কিন্তু প্রতিবারই ব্যর্থ হয়ে ফিরে গেছে। কখনো গ্রামবাসীর প্রবল প্রতিরোধে কখনো কৌশলী আশ্রয়ের কাছে তাদের হার মানতে হয়েছে। নারী-পুরুষ সম্মিলিতভাবে তাদের মহান এই সন্তানটির নিরাপত্তা নিশ্চিত করতেন। বুক দিয়ে পরম মমতায় আগলে রাখতেন তাদের এই বীর সন্তানটিকে। বাঘা যতীন তা নিজেও জানতেন গ্রামের এই মানুষগুলো তাঁকে কতোটা ভালোবাসে। কখনো কখনো এমনও হয়েছে বাঘা যতীন কয়া গ্রামেই অবস্থান করছেন, এমন সময়েও ব্রিটিশ সৈন্যরা এসেছে। কিন্তু বাঘা যতীনের টিকিটিও ধরতে পারেনি। তাঁর আদর্শে-স্পর্শে গোটা গ্রামটিই সে-সময় ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের আলোকবর্তিকা হয়ে উঠেছিল। তিনিও বুকের গভীরে এ গ্রামটিকে পরম মমতায় পুষে রাখতেন।
বাঘা যতীনের গ্রাম কয়া। শুধু এ কারণেই এ গ্রামটি বিখ্যাত হয়ে থাকবে। বাঘা যতীনকে বাদ দিয়ে ভারতবর্ষের স্বাধীনতার ইতিহাস হয় না। আর কয়া গ্রামকে বাদ দিয়ে বাঘা যতীন হয় না। বাঘা যতীনের গড়ে ওঠার পেছনে এই সাধারণ গ্রামটির অসামান্য ভূমিকা রয়েছে। কয়া গ্রাম বাঘা যতীনের মামার বাড়ি হলেও এটি পরিচিত হয়ে ওঠে বাঘা যতীনের নামেই। বাঘা যতীনের গ্রাম হয়ে ওঠে কয়া গ্রাম। আর তার বিখ্যাত মামাদের বাইশ বিঘা জমির উপর তৈরি বাড়িটি হয়ে ওঠে বাঘা যতীনের বাড়ি।
বাঘা যতীন তার নিজের গ্রাম-শহরে এমনকি এ বাংলার বর্তমান প্রজন্মের কাছে রূপকথার গল্পের মতো। মানুষের মুখে মুখে বাঘা যতীনের গল্প। যেন এক রাজপুত্র হয়ে ছড়িয়ে আছেন তিনি। হ্যাঁ, রাজপুত্রই তো। বাঙালির রাজপুত্র। এ রাজপুত্র অন্যরকম। প্রাসাদের ভেতরে তুলতুলে বিছানায় ঘুমানো আর রাজ্যের ভোগ-বিলাসে মগ্ন রাজপুত্র নয়। এ রাজপুত্র ব্রিটিশ তাড়ানোর রাজপুত্র। এক বাঙালি রাজপুত্র; যার জন্মগ্রামের একেবারে সাধারণ একটি বাঙালি পরিবারে, মাত্র পাঁচ বছর বয়সেই পিতৃহীন, মামাবাড়িতে গড়ে ওঠা; এই সাধারণ বাঙালি ছেলেটিই স্বাধীনতার মন্ত্রে জাগিয়ে তুলেছিল গোটা ভারতবর্ষ, ব্রিটিশদের পায়ের নিচের শক্ত মাটি কাঁপিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছিল ভারতবর্ষ থেকে তাদের চলে যেতে হবে, পরাধীনতার শেকল ছিঁড়বেই। ব্রিটিশদের ভয়াবহ আতঙ্কের নাম তখন বাঘা যতীন। ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে আক্রমণের ধারা পাল্টে দিলেন তিনি, একক ও বিচ্ছিন্নভাবে আক্রমণ নয়, আক্রমণ শুরু করেন দলবদ্ধভাবে। নব উদ্যমে জেগে ওঠে ভারত। আন্দোলনের এক নতুন ধারা তৈরি হয়। দিশেহারা হয়ে পড়ে মহা শক্তিধর ব্রিটিশবাহিনী। বাঘা যতীনের বালেশ্বরের যুদ্ধ ব্যর্থ হলেও তার তৈরি পথ ধরেই ভারত লাভ করে মহান স্বাধীনতা।
নিজেই বসতবাড়িহীন
যার ভয়ে ব্রিটিশ কাঁপতো, যার কারণে ভারত-স্বাধীনতার মূলমন্ত্র তৈরি হলো, তার নিজ বসতভিটে নিজের নেই। বেদখল হয়ে গেছে অনেক আগে, দখলদারিত্বের শিকার হয়েছে। মালিকানা পরিবর্তন হয়েছে একের পর এক। নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে তাঁর আবাস-অস্তিত্ব। সেখানে গড়ে উঠেছে টুকরো টুকরো বসতবাড়ি। সম্প্রতি গড়ে উঠেছে একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। যে গ্রাম আর গ্রামের মানুষকে বাঘা যতীন অতি আপনজন জানতেন, আর যে গ্রামের মানুষের কাছে বাঘা যতীন ছিলেন সাধনার ধন; সেই গ্রামে এ চিত্র অবিশ্বাস্য। যারা একদিন বুক পেতে ব্রিটিশদের হাত থেকে বাঘা যতীনকে রক্ষা করতেন, তাদের কাছেই অনিরাপদ হয়ে গেলো তার ভিটেটুকু।
বাঘা যতীনের কয়ার ভিটে-মাটিতে কোনো চিহ্ন নেই। বাইশ বিঘা জমির উপরে তাঁদের বিশাল বাড়িটি নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। এখন সেখানে তার বসতবাড়ির একটি ‘ইট’ও নেই। সরকারি বা বেসরকারি কোনোভাবেই তাঁর বসতবাড়িটি রক্ষা করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি। ‘এখানে বাঘা যতীনের বাড়ি ছিল’ এটুকু বলা ছাড়া আর কিছুই নেই তার জন্মভিটায়। এ এক নিদারুণ লজ্জা; দুঃসহ বেদনা।
যার কারণে বাঙালি শির চির উন্নত, যার কারণে প্রত্যন্ত সাধারণ এ গ্রামটি বিখ্যাত হয়ে উঠলো, যার কারণে গ্রামটি অনন্য মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হলো, যে মানুষটি অতি বিখ্যাত হয়েও নিজের গ্রামের মানুষের সামান্য কোনো সমস্যাতে পাগলের মতো ছুটে আসতেন, সেই তিনিই আজ বড় আপনজনদের দ্বারা ভিটে ছাড়া! স্মৃতিহীন তার বসতবাড়ি। এই বসতবাড়ি সম্পর্কে কুষ্টিয়া জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী (সদ্য বদলি হয়েছেন) ধীরেন্দ্রনাথ সরকার তাঁর অফিসে ২৩ জানুয়ারি-২০১০ একান্ত ব্যক্তিগত আলোচনায় এ লেখককে বলেন, ‘আমি কুমারখালী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে বাঘা যতীনের বাড়ি বিক্রি সংক্রান্ত বিষয়ে ভূমি রেজিস্ট্রি অফিসে খোঁজ নিতে বলেছিলাম। তিনি পরে আমাকে জানিয়েছিলেন যে, বাঘা যতীনের মামারা তাঁদের ভিটে-মাটি কোনকিছুই বিক্রি করে যাননি।’
তার বসতবাড়িতে একটি কলেজ স্থাপিত হয়েছে। নামকরণ করা হয়েছে ‘কয়া কলেজ’। কলেজটি প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়া ১৯৯৩-৯৪এর দিকে শুরু হয়। তখন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) শাসনকার্য পরিচালনা করছে। কিন্তু তখন কুষ্টিয়া-৪ (কুমারখালি-খোকসা)-এর সাংসদ ছিলেন আওয়ামী লীগ থেকে নির্বাচিত আবদুল আওয়াল মিয়া (বর্তমানে জাতীয় পার্টি-এরশাদ এর সাথে যুক্ত)। সেসময় কলেজটির নাম বাঘা যতীন করার দাবি জানালেও ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীর কাছে এটি পাত্তা পায়নি। কলেজটি এমপিওভুক্ত হয় ১৯৯৯ সালে। তখন আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায়। দুর্ভাগ্যক্রমে তারাও কলেজটি নামকরণ বাঘা যতীন করার ক্ষেত্রে কোন ভূমিকা গ্রহণ করেনি। সংকীর্ণতা আর হীনমনতার ঊর্ধ্বে কেউই উঠতে পারেনি। ব্রিটিশকাঁপানো এ বিপ্লবীর বাড়িতেই গড়ে ওঠা প্রতিষ্ঠানে অবলীলায় তাঁকে বাদ দেয়া হয়। যেমন বাদ দেয়া হয়েছে ঊনবিংশ শতাব্দির শ্রেষ্ঠ মুসলিম কথাসাহিত্যিক মীর মশাররফ হোসেনকে, তারই বাড়ির পাশে গড়ে ওঠা গড়াই সেতুকে তার নামে না-করে।
বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর এই সেতুর নাম পরিবর্তন করে মীর মশাররফ হোসেন সেতু করা হয়েছে, সেটি সাইনবোর্ড সর্বস্ব। সরকারি নথিপত্রে এটি এখনো সৈয়দ মাছউদ রুমী সেতু। কয়া কলেজের নাম এখনো বাঘা যতীন কলেজ করা হয়নি। আরও দুর্ভাগ্য হলো, এ কলেজের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে ওহিরুদ্দিন মালিথার নাম রয়েছে। তিনি ’৭১-এর মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের বিরোধী শক্তি ছিলেন। বাঘা যতীনের সব ধরনের স্মৃতিই এখান থেকে মুছে ফেলার অপচেষ্টা চলে আসছে অনেক আগে থেকেই। একশ্রেণীর মানুষ ক্ষুদ্রস্বার্থে আত্মবিক্রয় করে এসব বিখ্যাত মানুষদের বিশাল অবদান তুচ্ছজ্ঞান করে। যা কখনোই কল্যাণের আলো বয়ে আনে না। এতে নিজেদের অকৃতজ্ঞতা আর ক্ষুদ্রতাই প্রকাশ হয়।
বাঘা যতীন কয়া গ্রামের মানুষকে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে একটি পরিবারের মতো করে ভালোবাসতেন, ধর্ম-বর্ণের ভেদাভেদ ভুলে সবাইকে বুকের ভেতরে আগলে রাখতেন। এ-গ্রামের এই ছেলেটি নিজের মহা-মূল্যবান আত্মদান দিয়ে ভারতবর্ষকে স্বাধীনতার মন্ত্র শেখালেন; আমাদের জন্য রেখে গেলেন হীরকখণ্ডের মতো দ্যুতিময় সম্মান। অথচ আমরা কত সহজেই তাঁকে ভুলে যেতে পারি।
আমরা এপারের বাঙালিরা ক’জন মনে করি বাঘা যতীন আমাদের বীর-সন্তান, আমরা ক’জন তাগিদ বোধ করি তার সম্মানে কিছু একটা করার। আমরা সহজেই সবকিছু ভুলে যাই। বিস্মৃতপ্রবণ জাতি। ভুলতে ভুলতে নিজের শেকড়টিকেও ভুলে যাই। এটি আমাদের লজ্জা এবং দুর্ভাগ্য। যিনি গোটা ভারতবর্ষের একটি স্বাধীন ভূখণ্ডের জন্য অবিশ্বাস্য সাহসিক বিদ্রোহ করলেন। আত্মাহুতি দিলেন, আমরা তাকে সামান্যতম স্মরণ করতেও ভুলে যাই। এ দীনতা আমাদের।
বাঘা যতীনের কয়ার ভিটে-মাটিতে কোনো চিহ্ন নেই। বাইশ বিঘা জমির ওপরে তাদের বিশাল বাড়িটি নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। এখন সেখানে তার বসতবাড়ির একটি ‘ইট’ও নেই। সরকারি বা বেসরকারি কোনোভাবেই তার বসতবাড়িটি রক্ষা করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি। ‘এখানে বাঘা যতীনের বাড়ি ছিল’ এটুকু বলা ছাড়া আর কিছুই নেই তার জন্মভিটায়। এ এক নিদারুণ লজ্জা; দুঃসহ বেদনা।
আরও পড়ুন: বিপ্লবী বাঘা যতীনের তিন সহযোগীর আত্মদানের শতবর্ষ