‘কবির কোনো বন্ধু নেই’। এমন একটি কথা বলতেন আল মাহমুদ। এর কারণ তিনি অনেক আগেই দিয়ে রেখেছিলেন তার ‘লোকলোকান্তর’ কবিতায়। লিখেছিলেন,
যখনি উজ্জ্বল হয় আমার এ চেতনার মণি,
মনে হয় কেটে যাবে, ছিঁড়ে যাবে সমস্ত বাঁধুনি
সংসার সমাজ ধর্ম তুচ্ছ হয়ে যাবে লোকালয়।
কবি কোনো বাঁধন মানেন না। না সমাজের, না ধর্মের, না রাষ্ট্রের। স্বভাবতই কবি হয়ে পড়েন নিঃসঙ্গ, নির্বান্ধব, একা। একাকিত্বের যন্ত্রণা তাকে ভোগ করতে হয়। আল মাহমুদের আরেকটি কবিতার কিছু পঙ্ক্তি এখানে উদ্ধৃত করা যাক।
আমি সারা শহর একজন সুহৃদ খুঁজে বেড়াচ্ছি,
এখন আমার একজন বন্ধু দরকার,
আমার সমস্ত চেতনায় একটি কড়া নাড়ার আগ্রহ
একজন বন্ধুর মুখ দেখার বাসনা,
একটি স্বরচিত কবিতা শোনানোর নির্লজ্জতা
রক্তের শব্দের মতো বইতে লাগলো।
আমার একাকী আত্মার পেরেক বিদ্ধ ছিদ্র পথে
রক্তবমির মতো উগরে উঠলো একটি হিব্রু আর্তনাদ
‘এলী, এলী, লামা সবক্তানী।’আমার সমস্ত গন্তব্যে একটি একটি তালা ঝুলছে।
(আমার সমস্ত গন্তব্যে, কালের কলস)
মোহাম্মদ নূরুল হকের ‘লাল রাত্রির গান’ কাব্য শুরুই হয়েছে নিঃসঙ্গ মানুষের গল্প দিয়ে। ‘মানুষের কত গল্প থাকে’ কবিতার শুরুতেই বলেছেন,
মানুষের কত রকম গল্প থাকে
কারও বন্ধুর গল্প
কারও কারও থাকে পূর্বপুরুষের
বীরত্ব গাথা—সমুদ্র জয়ের কথা।
এরপর তিনি মানুষের নানারকম গল্পের বিবৃতি দিয়েছেন। বলেছেন, কারও পূর্বপুরুষের শক্তিমত্তার কাহিনি, অতীত ঐতিহ্য। বলেছেন, কারও সূর্যের মতো জ্বলজ্বলে বর্তমানের কথা। অন্যের বন্ধু ভাগ্যের কথা। কবিতার শেষ স্তবকের আগের স্তবকে বলেছেন নিজের কথা, নিঃসঙ্গতার কথা। লিখেছেন,
আমার কোনো বন্ধু নেই
না সচিবালয়ে না পুলিশে—আর্মি—র্যাবে
তাই আমার কোনো গল্প থাকে না
এসব আড্ডায়।
কবি নির্বান্ধব কারণ রূঢ় বর্তমান। মাইল মাইল রাত্রি— গাঢ় অন্ধকার ঘিরে রেখেছে কবিকে। এভাবেই কবি মোহাম্মদ নূরুল হক আধুনিক কবিতার উত্তরাধিকার বহন করে শুরু করেছেন নিজের পথচলা। এ কাব্যে কবি নিঃসঙ্গ কিন্তু উদ্বাস্তু নয়। বাংলার বিস্তৃত ভুবনে কবির জন্ম, বেড়ে ওঠা। ‘কাচারি ঘরের পালা’ কবিতায় বাংলার অতীত, ঐতিহ্য, গৌরবময় ইতিহাস। কবি লিখেছেন,
তেল চিটচিটে সাদা পাঞ্জাবির কোমল পকেটে
যত্নে রাখা দাদার আঁতর শিশি
যখন হঠাৎ কথা বলে ওঠে
তখন সমস্ত গাঁয়ে নেমে আসে নীল নীল আসমান থেকে
ঝাঁক ঝাঁক আবাবিল!
এখানে যে চিত্র ফুটে উঠেছে স্বভাবতই তা মুসলিম পরিবারের চিত্র। নিম্নরেখ শব্দগুলো তারই উজ্জ্বল প্রমাণ। কবি দ্বিধাহীন ভাবে মুসলিম সংস্কৃতি ঐতিহ্যকে ফুটিয়ে তুলেছেন কারণ তিনি মুসলিম পরিবার থেকে উঠে এলেও তার নাড়ি বাংলার মাটিতেই পোঁতা। তার রক্তে, ধমনীতে বইছে বাংলা সংস্কৃতি, ইতিহাস। তাই তো পারিবারিক সংস্কৃতি, বাংলার লোকসংস্কৃতি, ইতিহাস সবকিছু মিলেমিশে তার কবিতায় মূর্ত হয়ে উঠেছে। তিনি লিখেছেন,
এইখানে কথা বলে চাঁদ সদাগর—যুবালখিন্দর
কালো অক্ষরে-অক্ষরে কথা বলে
সূর্যসেন—তিতুমীর
নবাব সিরাজ—
কথা বলে চারুমজুমদার—বজ্রকণ্ঠের শেখ মুজিব।
(কাচারি ঘরের পালা)
তবে আমরা যদি প্রশ্ন করি, ‘লাল রাত্রির গান’-এর মূল সুর কী? তাহলে তার উত্তর হবে, প্রেম। ব্যক্তিক প্রেম। দেশের প্রতি ভালোবাসা যদিও কয়েকটি কবিতায় প্রকাশ পেয়েছে, তবু ব্যক্তিগত হাহাকার, অব্যক্ত বেদনাই এই কাব্যের মূল উপজীব্য। আর এই বেদনাকে কবিতার কালো অক্ষরে বন্দি করার জন্য কখনো তৈরি করেছেন পরাবাস্তব ঘোর, কখনো হেঁটেছেন চিত্রকল্পময় পথে। কখনো হয়েছেন ফবিস্টদের অনুসারী। শব্দালঙ্কার, অর্থালঙ্কারে সাজিয়েছেন কবিতার তনু। সর্বোপরি করেছেন সৌন্দর্যের অনুসন্ধান, হৃদয়সংবেদী পাঠকের মনে জাগাতে চেয়েছেন ব্যঞ্জনার ঢেউ।
আরও পড়ুন: লাল রাত্রির গান: প্রাজ্ঞ আঁধারের যাত্রীর বয়ান ॥ আজিজ কাজল
বর্তমানে একটি কথা প্রচলিত, অধিকাংশ কবিতাই বিষয় বা বক্তব্যনির্ভর। কথাটা যে অমূলক তা নয়। বক্তব্যকে ঘুরিয়ে, বাঁকিয়ে বলাতেই তারা তাদের কাজ শেষ করছেন। ছন্দ, শব্দের গুঞ্জরণ কবিতাকে ‘কানের ভেতর দিয়া মরমে’ নিয়ে গিয়ে হিল্লোল তোলে, সেটা যেন ভুলতে বসেছেন। এই যে কবিতাকে ঐতিহ্য, ধারাবাহিকতা থেকে বিচ্ছিন্ন করে হনুমানের মতো লম্ফ দিয়ে দ্বীপে চলে যাচ্ছেন, সবাই কিন্তু এমন নয়। মোহাম্মদ নূরুল হকও এই ধারণার বাইরে। এজন্য তার শব্দ ছন্দশাসিত। গদ্যছন্দ যে তিনি ব্যবহার করেননি, তা নয়। তার শব্দ অলঙ্কারপূর্ণ, প্রয়োজনে নিরলঙ্কার। তবে বলা যাবে না নতুন উন্মাদনার গড্ডলিকাপ্রবাহে গা ভাসিয়েছেন। কথা না বাড়িয়ে আমরা কিছু নমুন দেখে নেই। অক্ষরবৃত্ত ছন্দে লেখা দুয়েকটি কবিতার নমুন:
০১.
আকাশে ফুটেছে ফুল আলেয়ার নামে
নেমেছে প্রেমের চাঁদ মেঘেদের খামে।
মেঘে- মেঘে রটে গেলে প্রণয় খবর
তারাদের গ্রামে ছোটে প্রেমিকপ্রবর।
(আবহমান)০২.
চিরকাল বাউল ছিলাম
এখনো তেমন
রাত্রিকে বেসেছি ভালো
নদীকে যেমন…
কখনো উদাস হলে
দিয়েছি তো ডুব
নদীও বেসেছে ভালো
বলেছিল চুপ
(চিরকাল বাউল ছিলাম)
‘আবহমান’ কবিতাটি পুরোটাই (৮+৬) ১৪ মাত্রার পয়ারে লেখা। প্রেমিকের অব্যক্ত হাহাকার তুলে ধরার জন্য তিনি যেন আবহমান কাল ধরে চলে আসা পয়ারকেই বাহন করছেন। দ্বিতীয় উদাহরণে ‘চিরকাল বাউল ছিলাম’ কবিতার দুইটি স্তবক তুলে ধরা হয়েছে। কবিতাটি তিনটি স্তবকে সম্পূর্ণ হয়েছে। প্রথম স্তবকের প্রথম লাইনে মাত্রা সংখ্যা দশ। দ্বিতীয় লাইনে মাত্রা সংখ্যা ছয়। তবে তৃতীয় লাইনে মাত্রা সংখ্যা আট এবং চতুর্থ লাইনে মাত্রা সংখ্যা ছয়। এভাবে পরবর্তী দুই স্তবকের প্রথম এবং তৃতীয় লাইনের মাত্রা সংখ্যা আট, দ্বিতীয় ও চতুর্থ লাইনে মাত্রা সংখ্যা ছয় ব্যবহৃত হয়েছে। এছাড়া, অসমপর্বের অক্ষরবৃত্ত ছন্দে লেখা হয়েছে অনেক কবিতা।
এই কাব্যের কিছু কবিতা আছে স্বরবৃত্ত ছন্দে লেখা। ‘ক্ষণিকা’ কাব্যে রবীন্দ্রনাথে স্বরবৃত্তের শক্তিমত্তার পরিচয় ছাড়াও আজ পর্যন্ত অনেক কবি সেই এই ছন্দের শক্তির ক্ষেত্রকে বিস্তৃত করেছেন। এরপরও কোনো কোনো অর্বাচীন স্বরবৃত্তকে লঘুভাব প্রকাশের বাহন মনে করে থাকে। অবশ্য শতবার বললেও তাদের এই ভ্রান্তি দূর হবে না। তাই ‘লাল রাত্রির গান’ থেকে স্বরবৃত্ত ছন্দের দুয়েকটি নমুনা উদ্ধার করাই ভালো।
০১.
আকাশজুড়ে মেঘের অভিমান
তারারা সব তোমার চুলের মালা
চাঁদের বুকে ঢেউ খেলে কোন নদী
প্রেমে-কামে সাজায় বরণডালা?
(রাত সিরিজ-১)০২.
দুলিয়ে কোমর শাড়ির ভাঁজে তুললে যখন ঢেউ
আমার তখন দৃষ্টিজুড়ে উড়ন্ত গাঙচিল
ফেললে ছায়া প্রেমিক হাঙর মাতাল কোনো রাতে
নদীর বুকে স্রোতের পদ্যে ছায়ারা ঝিলমিল…
(চৈত্রে কেন)
এই কাব্যে মোহাম্মদ নূরুল হক কয়েকটি গানকেও কবিতার মর্যাদা দিয়েছেন। সেই গানে শরীর নির্মাণ করেছেন লোকশব্দের টেরাকোটা দিয়ে। বলতে ভুলে গিয়েছিলাম, রঙের নানাবিধ ব্যবহার এই বইয়ের কবিতাগুলো নানা রঙে রঙিন করে তুলেছে। এ কাব্যের বৈশিষ্ট্যগুলো নির্ণয় করতে গেলে রঙের কথা আসবেই আসবে। এছাড়া কবিতাগুলো প্রাণ পেয়েছে বেশকিছু ব্যতিক্রমধর্মী চিত্রকল্পের জন্য। ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ ছাড়াই কিছু চিত্রকল্প উদ্ধৃত করছি।
০১. পোয়াতি লাউয়ের ডগা কেঁপে কেঁপে উঠছে ভীষণ
০২. সম্ভ্রান্ত আন্ধারে দেখে উড়ে যায় ডানাঅলা হাঙর—কুমির।
০৩. দুপুর ঝুলে থাকুক তোমাদের দেয়াল ঘড়িতে!
০৪. গাছেদের ছায়া কাঁপে মেঘেদের বেহায়া সঙ্গমে
০৫. হৃৎপিণ্ড ছেঁড়া দুপুরের গান করো যদি ফকির বাউল/বুড়ো সূর্যকে ক্ষেপাও কেন?’
কবিতা কিছু না বুঝিয়ে সৌন্দর্য সৃষ্টি করে। তাই বলে কবিতা যে অর্থহীন, তা কিন্তু নয়। ওই জীবনানন্দ দাশ বলে গিয়েছেন, কবিতা অনেক রকম। আসলেও তাই। তাই কবিতা কখনো অধিকার আদায়ের হিরণ্ময় হাতিয়ার। কখনো মনের অনির্বচনীয় অনুভূতিকে মেঘের মতো ব্যক্ত করার অন্যতম মাধ্যম। সে যাই হোক। কবিতায় যারা নিজেকে খুঁজে ফেরেন, মোহাম্মদ নূরুল হকের ‘লাল রাত্রির গান’ শোনার জন্য তাদের আহ্বান জানাই।
লাল রাত্রির গান
মোহাম্মদ নূরুল হক
প্রচ্ছদ: কাব্য কারিম
মূল্য: ২০০ টাকা
প্রকাশক: দৃষ্টি
বইমেলা: লিটলম্যাগ চত্বর