(পর্ব-১৭)
বিশাল জাহাজ সামাদ বুড়িগঙ্গা পার হয়ে ধলেশ্বরীতে পড়েছে।
সন্ধ্যার আলো-আঁধারির অন্ধকার আকাশ, নদী, নদীর তীরে বাড়িঘরে ছড়িয়ে পড়ছে। লঞ্চের ছাদে দাঁড়িয়ে শূন্য গোলাকার পৃথিবীর রূপ আর সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ তাকিয়ে থাকে সবাই। সাধারণত লঞ্চের ছাদের বুয়েটের অধ্যাপকেরা এমন নিরাভরণ মুগ্ধ সুন্দরের মুখোমুখি হননি কখনো। খোলা মাঠে বা বাড়ির ছাদের সন্ধ্যার রূপ আর নদীর বুকে লঞ্চের দাঁড়িয়ে এই অবিনাশী সৌন্দর্যর খোলো তরবারি কখনো দেখার সুযোগ পাননি। একেবারে পলকহীন দৃষ্টিতে ঘুরে ঘুরে দেখছেন অধ্যাপক গোবিন্দ হালদার, মেয়ে সুকন্যা, আবদুল মতিন, অধ্যাপক মোজাফ্ফর হোসেন, অধ্যাপক মোবারক হোসেন। এর মধ্যে আবদুল মতিনই নদী পথের যাত্রী, অনেক বছর ধরে।
গোবিন্দ হালদার বাদামের শেষটা খুটে বাদাম মুখে দিয়ে খোসা নদীতে ফেলে দিয়ে নদীর ওপারে লাল কালো হলুদ আকাশের দিকে বলেন, অমলেন্দু বিয়েটা করে আমাদের নদীর সৌন্দর্য দেখার সুযোগ করে দিয়েছে।
ঠিক বলেছেন গোবিন্দ দা, উত্তর দেন নদীতে ছোট্ট একটা মাছ ধরা ডিঙ্গি নৌকার দিকে চোখ রেখে মোবারক হোসেন, নদী পথের যাত্রাটাই চমৎকার। নদীর তীরের বিচিত্র মনোরম দৃশ্যবলী দেখে দেখে মনটাই একবারে পাল্টে যায়। নদী পারের মানুষেরা মনের দিকে থেকে ভীষণ উদার হয়। কারণ, নদীর উদারতা-বিশালতা মানুষের ওপর প্রকৃতির সৌরভের মতো প্রভাব বিস্তার করে রাখে।
বাহ! হাততালি দেন অধ্যাপক জয়নাল আবেদীন। আপনি তো কেবল বুয়েটের ইলেকট্রিক অ্যাণ্ড পাওয়ার সেল ডিপার্টমেন্টের ডিনই না, প্রকৃতি-গবেষকও।
হাসেন মোবারক, না নদীর এই অসাধারণ প্রকৃতি দেখে মনটা কেমন উদাস হয়ে গেলো তো। কী যে বললাম, কেন বললাম, বুঝতেই পারছি না। খারাপ কিছু কি বলেছি?
না স্যার, আপনি খুব চমৎকার বলেছেন। ওই যে বললেন, নদীর দৃশ্য দেখে মানুষের মনে ভাবের উদয় হয়, সেটাই হয়েছে আপনার এবং আমাদের কমবেশি। পাশে দাঁড়িয়ে মোবারক হোসেনের সমর্থনে জবাব দেয় আবদুল মতিন। অবশ্য আপনাদের যেমন লাগছে, আমার তেমন লাগছে না।
সঙ্গে মৌনতা ভেঙে যায়। একে একে চায়ের কাপ হাতে নেন অধ্যাপক গোবিন্দ হালদার, অধ্যাপক মোজাফফর হোসেন, অধ্যাপক মোবারক হোসেন এবং আবদুল মতিন। সেই সঙ্গে মহুয়া হালদার এবং সুকন্যা।
বলো কী? অধ্যপাক গোবিন্দ হালদার অবাক হলেন আবদুল মতিনের কথায়।
না স্যার, মৃদু হাসে আবদুল মতিন। আমি তো গত ত্রিশ বছর ধরে এই লঞ্চের পথে নদীতে ভাসতে ভাসতে ঢাকা শহরে আসি, আবার ফিরে যাই। প্রতিদিনের দৃশ্য, দেখতে দেখতে চোখে সয়ে গেছে। তবু মাঝে মাঝে নদীর দিকে তাকিয়ে থাকতে খারাপ লাগে না। ভালোই লাগে। বিশেষ করে নদীর দুই পারের বিচিত্র মানুষদের বিচিত্র জীবনযাত্রা আমাকে মুগ্ধ করে।
কেবিন থেকে বের হয়ে অধ্যাপক গোবিন্দ হালদারকে না দেখে এদিক ওদিকে খুঁজতে গিয়ে পায় না স্ত্রী মহুয়া হালদার। কন্যা সুকন্যার সঙ্গে দুজনে ছাত্র জসিম উদ্দিনের সাহায্য নিয়ে এমভি সামাদের ছাদের ওপর চলে আসে। স্ত্রী কন্যাকে দেখে একটু অবাক হলেও খুশি হয়েছেন গোবিন্দ বাবু, তোমরাও এসেছ?
আসবো না তো কী করবো? বলেন সুকন্যার মা। তোমারা কেউ রুমে নেই। আমরা দুজন বসে বসে কী করবো? তোমাদের খুঁজতে খুঁজতে চলে এলাম।
এসে ভালো করেছেন বৌদি, বলেন অধ্যাপক মোজাফফর হোসেন। মতিন, দেখো তো একটা চেয়ার পাও কি না বৌদির জন্য।
দেখছি স্যার, আবদুল মতিন ছুটে যায় অন্যদিকে।
মহুয়া হালদার বলেন, না, চেয়ারের দরকার নেই। চারদিকে তাকিয়ে মেয়ের মুখের ওপর চোখে রাখেন, খুব সুন্দর।
হ্যাঁ মা, খুব সুন্দর। তবে সন্ধ্যা হয়ে গেছে।
মহুয়া তাকান স্বামী গোবিন্দ হালদারের দিকে, তুমি আমাদের আগে ডাকলে না কেন?
তোমরা লঞ্চের ছাদে আসবে কি না, সেটাই তো জানতাম না। দেখলাম মা মেয়ে শুয়ে পড়েছো।
মতিন একটা চেয়ার এনে সামনে রাখে, বসুন বৌদি।
না বসবো না। বরং ছাদের ওপরটা ঘুরে ঘুরে দেখি, বলতে বলতে আদিগন্ত নদীর দিকে তাকিয়ে মতিনকে প্রশ্ন করেন, নদী এত বড়?
বৌদি, আমরা মুন্সীগঞ্জ ছাড়িয়ে চাঁদপুরের ত্রিমোহনায় এসে পড়েছি।
ত্রিমোহনা মানে?
এইখানে, চারদিকে তাকিয়ে দেখুন আদিগন্ত বিস্তৃত নদী, দূরে অনেক দূরে গ্রামের ছায়া দেখা যায়। এইজায়গায় মেঘনা, পদ্মা আর ডাকাতিয়া, তিনটি নদী এসে মিশেছে।
তাই না কি? অবাক হলেন অধ্যাপক মোবারক হোসেন। স্রোত কেমন?
স্রোত তো অনেক। চাঁদপুর নদীবন্দরের লঞ্চঘাট প্রতি বছর ভাঙে স্রোতের তোড়ে। আর তিন নদীর মোহনায় কোনো একটা জায়গায় ঘূর্ণি আছে, সেই ঘূর্ণির স্রোতে পড়ে বেশ কয়েকটা ছোট ছোট লঞ্চ আর নৌকা ডুবে হারিয়ে গেছে।
বলো কী? গলার ভেতর থেকে ভয়ার্তস্বর বের হয়ে আসে মহুয়া হালদারের। হাত বাড়িয়ে ধরেন গোবিন্দ হালদারের দিকে। খপ করে স্ত্রীর হাত ধরে নার্ভাস গলায় বলেন, আরে ভয় পাচ্ছ কেন? মতিন বলেছে ছোট লঞ্চ আর নৌকা ঘূর্ণিস্রোতে ডুবে গেছে কিন্তু বড় জাহাজের তো কিছু হবে না। তাকায় মতিনের দিকে, ঠিক কি না মতিন?
জি স্যার, এত বড় জাহাজকে ওইসব ঘূর্ণিস্রোত কিছু করতে পারবে না। গোবিন্দ হালদারকে সমর্থন করলেও আবদুল মতিন বুঝে গেছে জ্ঞানের বহর দেখাতে গিয়ে মস্তবড় ভুল একটা কেরেছে। এই নারী প্রথম এসেছে লঞ্চে, বরিশালের পথে। যতদূর জানে, গোবিন্দ হালদারের বাড়ি কুষ্টিয়ার দিকে। কুষ্টিয়ায় জল নদী খাল তুলনামূলক কম। বন্যা মহামারি একটা হয় না। সুতরাং মিসেস হালদারের সাঁতার না জানার আশঙ্কাই বেশি।
ঠিক এই সময়ে দমকা একটা হাওয়া এলো। সবাই চমকে ওঠে। সন্ধ্যা নেমে গেছে নদী ঘিরে চাঁদপুরের দিগন্ত ঘিরে। সেই সঙ্গে আকাশে জমেছে ঘনকালো মেঘ। মেঘটায় আকাশ ঢেকে ফেলেছে প্রায়। আবদুল মতির ভয় পায়, নিজের জন্য না, এমভি সামাদ লঞ্চের আরোহীদের জন্য। বিশেষ করে বরিশালে যাত্রা করেছে বুয়েটের ছাত্র অমলেন্দু ঘোষের বিয়ের বরযাত্রার জন্য।
লঞ্চের বয় এসে দাঁড়ায় এবং সুরেলা গলায় বলে, চা বিসকিট লাগবে…লাগবে চা বিসকুট?
মতিন ছেলেটা ডাক দেয়, এই চা বিসকিট দে।
আমি খাবো না, মিসেস গোবিন্দ হালদার বলেন, আমি নিচে রুমে যাবো।
বৌদি, এই ডেকে মনোরম এই সন্ধ্যায় চা বিসকিট খাওয়ার সুখই আলাদা। জীবনে হয়তো আরও অনেক দূরে, অনেক যাত্রায় যাবেন কিন্তু মেঘনা ডাকাতিয়া পদ্মা নদীর মোহনায় সন্ধ্যার প্রগাঢ় ছায়া আলোয় চা না খেলে জীবনটাই বৃথা। আবদুল মতিনের আন্তরিকতা কথায় মুগ্ধ সবাই।
হাসেন অধ্যাপক মোজাফফর হোসেন, না তুমি কবি হলে খুব ভালো করতে মতিন। দাও তোমার চা বিসকুটের অর্ডার দাও।
বৌদি, জীবন তো একটাই, আজকে সবাই মিলে চা বিসকুট খাই।
মুহূর্তে পরিবেশটা হালকা হয়ে যায়। লঞ্চের ছেলেটা ছুটে যায় চা বিস্কুট আনতে।
সুকন্যা? ডাকেন গোবিন্দ হালদার কন্যাকে।
বাবা?
এই সন্ধ্যা সত্যি আর আসবে কি না, জানি না। তুমি রবীন্দ্রনাথের সোনার তরী কাব্যর শৈশবসন্ধ্যা কবিতাটা আবৃত্তি করে শোনাও। আমার মনে হচ্ছে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা ১২৯৮ সালের ফালগুন মাসে আজকের জন্য, আমাদের জন্য লিখেছিলেন। আবৃত্তি করো মা।
সুকন্যা কয়েক মুহূর্ত সময় নিয়ে সামাদ লঞ্চের ছাদের ওপর দাঁড়িয়ে আবৃত্তি করতে শুরু করে,
ধীরে ধীরে বিস্তারিছে ঘেরি চারিধার
শ্রান্তি আর শান্তি আর সন্ধ্যা-অন্ধকার,
মায়ের অঞ্চলসম। দাঁড়ায়ে একাকী
মেলিয়া পশ্চিমপানে অনিমেষ আঁখি
স্তব্ধ চেয়ে আছি। আপনারে মগ্ন করি
অতলের তলে, ধীরে লইতেছি ভরি
জীবনের মাঝে—আজিকার এই ছবি,
জনশূন্য নদীতীর, অস্তমান রবি,
ম্লান মূর্ছাতুর আলো— রোদন-অরুণ,
ক্লান্ত নয়নের যেন দৃষ্টি সকরুণ
স্থির বাক্যহীন—এই গভীর বিষাদ,
জলে স্থলে চরাচরে শ্রান্তি অবসাদ।সহসা উঠিল গাহি কোন্খান হতে
বন-অন্ধকারঘন কোন্ গ্রামপথে
যেতে যেতে গৃহমুখে বালক-পথিক।
উচ্ছ্বসিত কণ্ঠস্বর নিশ্চিন্ত নির্ভীক
কাঁপিছে সপ্তম সুরে, তীব্র উচ্চতান
সন্ধ্যারে কাটিয়া যেন করিবে দুখান।দেখিতে না পাই তারে। ওই যে সম্মুখে
প্রান্তরের সর্বপ্রান্তে, দক্ষিণের মুখে,
আখের খেতের পারে, কদলী সুপারি
নিবিড় বাঁশের বন, মাঝখানে তারি
বিশ্রাম করিছে গ্রাম, হোথা আঁখি ধায়।
হোথা কোন্ গৃহপানে গেয়ে চলে যায়
কোন্ রাখালের ছেলে, নাহি ভাবে কিছু,
নাহি চায় শূন্যপানে, নাহি আগুপিছু।দেখে শুনে মনে পড়ে সেই সন্ধ্যাবেলা
শৈশবের। কত গল্প, কত বাল্যখেলা,
এক বিছানায় শুয়ে মোরা সঙ্গী তিন;
সে কি আজিকার কথা, হল কত দিন।
সুকন্যরা কণ্ঠে রবীন্দ্রনাথের কবিতা বিস্ময়কর এক সুন্দরের সৃষ্টি করে, মনটা উদাস করে দেয়, স্মৃতি আর প্রকৃতি আর জীবনের বিন্যাসের সুমিষ্ট ছায়াতলে বিশ্রাম নেয় সবাই। আবৃত্তি শেষ হলেও একটা রেশ রয়ে যায়। চা-অলা একটা ট্রেতে বেশ কয়েক কাপ চা আর দুটি পিরিচে বিস্কুট নিয়ে এসে হাজির, চা বিস্কুট আনছি।
সঙ্গে মৌনতা ভেঙে যায়। একে একে চায়ের কাপ হাতে নেন অধ্যাপক গোবিন্দ হালদার, অধ্যাপক মোজাফফর হোসেন, অধ্যাপক মোবারক হোসেন এবং আবদুল মতিন। সেই সঙ্গে মহুয়া হালদার এবং সুকন্যা।
বিস্কুটে কামড় দিয়ে চায়ের পেয়ালায় চুমুক দিয়ে বলেন মহুয়া হালদার, আসলেই জীবনটা অনেক সুন্দর!
হাসেন গোবিন্দ হালদার, সত্যি আজকের এই সময়টা কখনো ভুলবো না।
সবার মধ্যে এই অনুভূতির প্রকাশের মর্মরিত মুহূর্তে আবার নদীর জল কাঁপিয়ে প্রবল একটা বাতাসের তাণ্ডব বয়ে যায়। একজন আরেক জনের ওপর পড়ে যেতে যেতে সামলে নিয়ে আবার দাঁড়ান। সুকন্যার হাত থেকে কাপ পিরিচ পড়ে যায় ডেকের ওপর। টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে।
দিলি তো কাপটা ভেঙে? হালকা ধমক দেন মহুয়া হালদার মেয়েকে।
বৌদি, আমি দেখছি। আর একটা কাপ পিরিচই তো, আমি দেখছি।আপনারা নিচে যান।
হ্যাঁ, বাতাসটা ক্রমে ভারী হয়ে উঠছে। বলেন অধ্যাপক মোজাফফর হোমেন। আমার শীত লাগছে।
আমারও শীত লাগছে, সমর্থন করেন মোবারক হোসেন। চলুন, নিচে ক্যাবিনে গিয়ে আড্ডা দেই।
হ্যাঁ। চলুন।
সবাই নিচে নেমে গেলে আবদুল মতিন চা-বয়কে নিয়ে নিচতলায়, চায়ের দোকানের সামনে এসে দাঁড়ায়। মতিনের হাতে ধরা চা-বয়ের হাত। এমভি সামাদ লঞ্চের পিছনের, নিচতলায়, ছোট খুপরিতে বসে দুই পা ঝুলিয়ে দিয়ে চা বানাচ্ছে চা অলা। ছোট্ কিন্তু গোছানো দোকানের নাম, রবিশাল টি স্টোর।
রহিম ভাই?
চা বানাতে ব্যস্ত রহিম তাকায়, পরিস্থিতিটা বোঝার চেষ্টা করে, কী অইচে? ছ্যামড়া চা হালাইয়া দিছে?
আরে না। আমার এক অতিথি যাত্রী একটা কাপ আর পিরিচ ভেঙেছে। কত জরিমানা দেবো? আর সঙ্গে চা বিস্কুটের দাম?
হাসে রহিম মিয়া, আপনে আইচেন আমার লগে মশকরা করতে?
মানে?
কাপ পিরিচ ভাঙছে আপনের মেহমান? ছ্যামড়া ভাঙে নাই? এই পর্যন্ত ছ্যামড়া আটজোড়া কাপ পিরিচ ভাঙছে। অরে আমি আর লঞ্চেই আনমু না। অর মায় আইয়া আমার কাছে কাইন্দা কইলো…
আবদুল মতিন একেবারে কাছে এগিয়ে যায়, দাঁড়ায় শরীরঘেঁষে রহিম মিয়ার, বিশ্বাস করুন কাপ পিরিচ আমার মেহমানরাই ভাঙছে। আপনার ছেলেটার কোনো দোষ নাই।
মতিন কী করবে? অসহায় আক্রোশে চোখে জল আসে ওর। নদী ঝড়ের জলের প্রবাহের মধ্যে দাঁড়িয়ে চোখের জলে কী করতে পারে একজন আবদুল মতিন?
ঠিকাছে, আপনে যকন কইছেন, তহন বিশ্বাস করলাম। তয় আপনে আইছেন, কাপ পিরিচের দাম লাগবো না। আপনে চা বিস্কুটের দাম দেন।
কিন্তু আপনের তো লস হলো।
সামনে দাঁড়ানো এক ক্রেতাকে পান দিতে দিতে হাসে, জীবনটাই লসের রে ভাই, জূীবনটাই লসের। আপনে চা বিস্কুটের দামই দেন।
আবদুল মতিন পকেট থেকে টাকা বের করে রহিম মিয়াকে টাকা দেয়। টাকা দিয়ে ফেরার জন্য ফিরে দাঁড়ালে ডাকে রহিম মিয়া, ভাইজান?
বলেন! ফিরে তাকায় আবদুল মতিন।
খেয়াল করছেন আইজকের বাতাসটা?
না তো?
আজকেই মেলা ঝড় অইবে, জাহাজ নাচবে, সাবধানে থাইকেন।
এমভি সামাদ লঞ্চে বরিশাল থেকে ঢাকা, ঢাকা থেকে বরিশাল নিয়মিত আসা-যাওয়ায় লঞ্চের কেরানি, সুকানি, চায়ের দোকানদার সবাইকে চেনে আবদুল মতিন। সেই পরিচয়ের সূত্রে রহিম মিয়া নদীর আবহাওয়া জানায় মতিনকে।
মতিনও বুঝতে পেরেছে, আসা যাওয়ায় বেশ কয়েকবার ঝড়ের কবলে পড়েছে। কিন্তু সঙ্গে যারা আছে, চিন্তিত মনে আবদুল মতিন নিচতলা থেকে ওপরের দিকে আসাতে থাকে সিঁড়ি বেয়ে। বুঝতে পারছে বাতাসের বেগ বাড়ছে। ঢেউ আছড়ে পড়ছে এমভি সামাদের বিশাল শরীরের ওপরে। ঢেউ সামলে এমভি সামাদ এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু লঞ্চের যাত্রীরা ইতোমধ্যে ভয় পেতে শুরু করেছে।
প্রবল ঢেউয়ের দোলায় এম ভি সামাদ ঢেউয়ের ওপর উঠছে আবার নিচে নামছে। দুই পাশ দিয়ে পানি প্রবল বেগে দূরে ছিঠকে পড়ছে লঞ্চের শরীরে ধাক্কা লেগে। নিচতলায় সিঁড়ির সঙ্গে কয়েকজন বয়স্ক মানুষ বসেছিল হাপ ছড়িয়ে, সেই মানুষগুলো ভয়ে জড়সড়ো হয়ে আল্লাকে ডাকছে। আর একজন আজান দিতে দাঁড়িয়ে গেছে…আল্লাহু আকবার। কিন্তু ঢেউয়ের প্রবল ধাক্কায় দাঁড়িয়ে আজানও দিতে পারছে না। পড়ে যায় আবার উঠে আজান দেয়, হাইয়ালাস সালা….হাইয়ালাস সালা…।
নিচতলা থেকে কোনোভাবে দোতলায় নিজেদের রুমে এসে অবাক আবদুল মতিন, দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। জলের ছিটায়, লঞ্চের দুলুনিতে দাঁড়িয়ে থাকা প্রায় অসম্ভব। রেলিং ধরে দরজায় ধাক্কা দেয় মতিন। কয়েকবার ধাক্কা দেওয়ার পর দরজা খুলে যায়, ভেতরে ঢুকে আরও অবাক। গোটা রুম বমিতে ভেসে যাচ্ছে। রুমের মধ্যে খাটের ওপর শুয়ে দুহাতে খাট ধরে আছেন অধ্যাপক মোজাফফর হোসেন, অধ্যাপক মোবারক হোসেন। আবদুল মতিন কী করবে, বুঝে উঠতে পারছে না। যেটুকু বুঝছে, ঝড় মাত্র শুরু হয়েছে। কখন, কবে থামবো, আদৌ থামবে কি না, শুরুতেই যদি এই অবস্থা হয়, সারা রাত কাটবে কী করে?
মতিন দাঁড়িয়েছে রুমের জানালার রড ধরে। ওকে কাছে ডাকছে ইশারায় অধ্যাপক মোজাফফর হোসেন। জানালার রড, খাটের বাতা ধরে ধরে, লঞ্চের দুলুনি সহ্য করে যায় মতিন। সঙ্গে সঙ্গে একটা হাত ধরে মতিনের, বাজান মরে গেলে লাশটা আমার বাসায় পৌঁছে দিও।
স্যার, কিচ্ছু হবে না, চিৎকার করে উত্তর দেয় মতিন। ঝড় থেমে যাবে।
চিৎকার করে বলেন পাশের খাট থেকে অধ্যাপক মোবারক, মতিন তুমি গোবিন্দ বাবুদের একটু খবর নাও, যদি পারো।
সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ে যায় গোবিন্দ হালদার, গোবিন্দ হালদারের স্ত্রী মহুয়া হালদার আর মেয়ে সুকন্যাকে। ঘণ্টাখানেক আগে, ত্রিমোহনার ঘূর্ণিতে হারিয়ে যাওয়া লঞ্চ আর নৌকার ঘটনা শুনে যেভাবে ভয় পেয়েছিলেন। মতিন রুম থেকে বের হওয়ার জন্য দরজায় দাঁড়ায়। সঙ্গে সঙ্গে এম ভি সামাদ লঞ্চটার ওপর লঞ্চের চেয়ে তিনগুণ লম্বা একটা ঢেউ আছড়ে পড়ে। গোটা লঞ্চটা জলের নিচে চলে যায়। আর প্রবল পানিতে তোড়ে লঞ্চের মধ্যের যাত্রীরা ভিজে একাবার। সেই সঙ্গে মাল জিনিস যা আছে, সবই ভিজে ছপ ছপ করছে। আর লঞ্চটা খোলামকুচির মধ্যে দুলতে থাকে পানির মধ্যে। বড় ঢেউটা সরে গেলে, লঞ্চটা একটু স্বাভাবিক হলে মতিন রুম থেকে বের হয়ে বারান্দায় আসে। বারান্দা পার হয়ে অনেক কষ্টে তিনটি রুম পার হয়ে গোবিন্দ হালদারের রুমের সামনে এসে এসে দেখে, রুমটা খোলা। খাটে কেউ নেই। বুকটা ছ্যাঁত করে ওঠে মতিনের। জলে পড়ে গেলো?
একটা বিকট বজ্রপাতের সঙ্গে বিদ্যুৎ চমকায় এবং বিদুতের আলোয় দেথদে পায়, গোবিন্দ হালদার, মহুলা হালদার এবং সুকন্যা নিচে শুয়ে আছে। পানিতে রুম সয়লাব এবং কারও জ্ঞান নেই। তিনটি জ্ঞানহীন দেহ জলে ভিজছে, আর লঞ্চের দুলুনিতে এদিক থেকে ওদিকে যাচ্ছে।
মতিন কী করবে? অসহায় আক্রোশে চোখে জল আসে ওর। নদী ঝড়ের জলের প্রবাহের মধ্যে দাঁড়িয়ে চোখের জলে কী করতে পারে একজন আবদুল মতিন?
চলবে…