[পর্ব-১৫]
মুহূর্তে ছোট টাপুরে নৌকার মধ্যে একটা যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। শিমুল পাটাতনের ওপর হাঁটু গেড়ে বসে কোলে তুলে নেয় মিলির মাথা। নাকের কাছে মুখ নিয়ে বুঝতে পারে জ্ঞান হারিয়েছে মিলি। জগদীশ আর তমাল উদ্ভ্রান্ত চোখে তাকিয়ে দেখেছে। নতুন ভাবিকে দেখে দুজনেই মুগ্ধ। সবার আগে ভাবিকে দেখেছে , বাড়িতে গিয়ে গল্প করবে।
-তমাল?
-ভাইয়া?
-নদী থেকে পানি এনে তোর ভাবির মুখে দে তো।
হামিজউদ্দিন মাঝি নৌকা ঘুড়িয়ে উজানে বাইতে শুরু করেছে। নৌকা যাচ্ছে প্রবল স্রোতের বিরুদ্ধে একটু একটু করে নদীর তীরঘেঁষে। তীরের ঘোলা জলে স্রোতের বেগ কম। তীর থেকে কচানদীর একটু ভেতরের দিকে স্রোত যাচ্ছে বঙ্গোপসাগরের দিকে। সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছে প্রচুর কচুরীপানা। কচুরীপানার ঝাড়ে বেশ ফুল ফুটেছে। ফুলগুলো এক পায়ের বকের মূর্তিতে দাঁড়িয়ে।
হামিজউদ্দিন বলে, ও তমাল!
-জে কাকা?
-সামনের চরাটি তোলো। চরাটির নিচে পাইলা আছে। পাইলার মধ্যে সেলভারের গেলাস আছে। সেই গেলাস ভইরা পানি দাও তোমার ভাবির চোহে মোহে।
সঙ্গে সঙ্গে নৌকার চরাটি তুলে গ্লাস বের করে নদী থেকে পানি ভরে নিজের হাতে ছিটিয়ে ছিটিয়ে দেয় মিলির মুখের ওপর। দুই তিন বার পানির ছিটা দেওয়ার পর মিলি চোখ মেলে পিট পিট তাকায়। নিজেকে আবিষ্কার করে শিমুলের কোলে। উঠে বসার চেষ্টা করে, আমি কোথায়?
-তুমি এভাবেই থাকো মিলি। উঠতে হবে না। বলে শিমুল।
না, তাকিয়ে দেখে, ওর দিকে মাঝি, জগদীশ আর তমাল কেমন অবাক চোখে তাকিয়ে আছে। নিজেকে ছাড়িয়ে উঠে বসে মিলি। তাকায় সামনের দিকে, হতবাক চোখে দেখে, বিশাল নদীর বুকের এক প্রান্ত ছুঁয়ে ছোট্ট একটা নৌকায় এতগুলো মানুষের যাত্রা। মাঝির দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারে মিলি, দীর্ঘ জীবনের অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে লোলচর্মসার এই মানুষটি নদীর কূলের নাইয়া।
-এখন কেমন লাগছে?
-ভালো। পানি খাবো।
সঙ্গে সঙ্গে তমাল নদী থেকে গ্লাসে পানি এনে সামনে ধরে, নেন ভাবি।
গ্লাসটা হাতে নিয়ে তাকায় শিমুলের দিকে। নদীর পানি সরাসরি কখনো পান করেনি মিলি। যদিও জানে, জাতের মেয়ে কালোও ভালো, নদীর জল ঘোলাও ভালো। কোথায় কবে পড়েছিল, মনে নেই কিন্তু বাক্যদুটো মাথার করোটিতে গেঁথে আছে।
-খাও, অসুবিধা নেই।
মিলি পানির অর্ধেকটা খেয়ে গ্লাসটা ফেরত দিলে, বাকি পানিটা খায় শিমুল, কেমন লাগলো নদীর পানি, যদিও একটু ঘোলা?
-খারাপ না, ভালোই। ঠাণ্ডা।
-নদীর জল তো! দেখেছ বিরাট নদী, এপার ওপার চেনা যায় না। কিন্তু বলো তো তুমি হঠাৎ জ্ঞান হারালে কেন?
মিলি এইসব উঠোন বাড়ি সিনেমায় দেখেছে। প্রথম চোখে দেখছে। ভালোই লাগছে। ঘরের সামনে দাঁড়াইতেই পারুল বেগম বললো, এইহানে একটু খাড়াও।
শিমুল, বিরাট লঞ্চে চড়ে তোমার সঙ্গে গ্রামের বাড়িতেও আসলাম। কিন্তু যখন এই পুচকে নৌকায় করে নদীর বুকের ওপর দিয়ে বাড়ি ফিরবে, ভয়ে আমার মুখ শুকিয়ে গিয়েছিল। সেই কারণে তীরেই এক গ্লাস পানি খেয়েছিলাম। আবার যখন এই ছোট নৌকায় চড়লাম, দাঁড়ালাম, নিজেকে আর সামলাতে পারিনি, মনে হয়েছিল জলে ডুবেই যাবো। আর জানি না সাঁতার। একবার ডুবলে চিরদিনের জন্য হারিয়ে যাবো। সেই ভয়ে জ্ঞান হারিয়েছিলাম, বলতে বলতে দেখে নদীর স্রোত আর টাপুরে নৌকার চলাচল।
-এখন তো আপনের ভয় নাই? প্রশ্ন করে তমাল।
হেসে ওর মাথার চুলে আদর করে মিলি, তোমরা থাকতে আমার আয় ভয় কী?
-হ, আমিও তো হেইডা কই, ভাবি বেহুঁশ হইলো ক্যা? হাসে জগদীশ হালদার। হোনেন ভাবি, নদীরে ভয় পাওয়ার কিছু নাই। নদী অইলো আমাগো বন্ধু।
-নদী তোমাদের বন্ধু হলো কেমন করে?
-নদী আমাগো পানি দেয়, মাছ দেয়। নদীর জলে নাও ভাসাইয়া আমরা কত জায়গায় যাই। নদীর অনেক উপকার করে ভাবি।
-দারুণ বলেছ তুমি জগদীশ বাবু। তোমার বাবা কী করেন?
-আমার বাবা উজানগাঁও বাজারের দোকান দেয়।
কচানদীতে জোয়ার চলে আসায় হামিজ মাঝি নৌকার গতি বাড়ে এবং দ্রুতই কচানদীর বিশাল গহব্বর থেকে উজানগাঁও খালের মধ্যে প্রবেশ করে নৌকা।
-এইটা কী?
-খাল!
-কিভাবে হলো? ছোট বাচ্চাদের মতো প্রশ্ন করে মিলি মাহজাবীন।
-কিভাবে হলো, বলতে পারবো না। বলে শিমুল, জন্ম নিয়েই আমরা এই খাল দেখেছি। আমাদের বাপ চাচা এমন কি দাদারাও দেখেছেন। হয়তো ওপর থেকে বর্ষার স্রোতের পানির ধারা নামতে নামতে অনেক অনেক বছর আগে এই খালের জন্ম। এখন বলো, তোমার ভয় কাটছে?
মাথা নাড়ায় মিলি, কাটছে। প্রাথমিক ধাক্কাটা সামলে উঠেছি।
-গুড, হাত বাড়ায় শিমুল, এসো উঠে দাঁড়াও। দেখো গ্রাম বাংলার বিচিত্র রূপ আর খালের ধারা।
শিমুলের হাত ধরে দাঁড়ায় মিলি। তাকায় চারপাশে, ওর চোখে বিস্ময় লাগে, সত্যি সুন্দর। খালে কয়েকটা হাঁস ভেসে যাচ্ছে, আরও বিস্ময় বোধ করে মিলি। ওর এই বিস্ময়ের মধ্যে নৌকা এসে ঘাটে লাগে। সঙ্গে সঙ্গে ব্যাঙের মতো লাফ দিয়ে কাদায় নামে তমাল, তমালের পিছু পিছু জগদীশ। দুজনে লাফ দিয়ে তীরে উঠে দৌড়ে বাড়ির দিকে ছোটে।
মিলি দাঁড়িয়ে আছে। এক অনিশ্চিত মুহূর্তের জন্য অপেক্ষা করছে। বুকটা কাঁপছে অজানা কারণে, কোথায় এলাম আমি? সামনের দিন রাত্রি আমার কী হবে? গ্রামে আমি কিভাবে থাকবো? মিলি বোধ বুদ্ধি বিবেচনা উজানগাঁও খালের পারে এসে আবার লোপ পেতে শুরু করে। মাথাটা গুলিয়ে উঠছে।
-হামিজ চাচা?
-কন বাবাজি।
-আপনি নৌকাটা কাদায় কেন ভিড়ালেন? নৌকাটা ঘাটে নেন।
-আপনের বৌ কি ঘাট দিয়া উঠতে পারবে? এই জায়গাটা উঁচা কম।
-কিন্তু কাদা যে!
-আইচ্চা, আমি ঘাটে ভিড়াইতেছি। হামিজ মাঝি নৌকাটা আবার ঘাটে নিয়ে ভিড়লে, ওপরে এসে দাঁড়ায় দশ পনেরোটা ছেলে মেয়ে। বিচিত্র ওদের আকার। সবার সামনে তমাল আর জগদীশ হালদার। মিলির হাত ধরে খেজুর গাছের ঘাটের ওপর পা রাখে শিমুল।
-এইভাবে ওঠা যায়? কাঁপতে কাঁপতে প্রশ্ন করে মিলি।
-যায়, তোমার অভ্যাস নেই তো, তাই ভয় পাচ্ছ। আমার হাতে ভর দিয়ে একের পর এক পা রেখে উঠে এসো।
-আমি পারবো না!
জগদীশ লাফ দিয়ে নামে কাদার মধ্যে ঘাটের কাছে দাঁড়ায়, ভাবি আপনে ওঠেন। পরবেন না। পারলে মুই ধরমু।
সঙ্গে সঙ্গে ঘাটের অন্যপারে নেমে এসে দাঁড়ায় তমালও, ভাবি আপনে ওঠেন। কোনো ভয় নাই। পরলে ওই পাশে জগদীশ এই পাশে আমি। আপনে ওঠেন।
ওদের আশ্বাসে ভরসা পেয়ে শিমুলের হাত ধরে ধীরে ধীরে ওপরে উঠে আসে মিলি। দাঁড়ায়। হাফ ছাড়ে। সঙ্গে সঙ্গে পায়ের ওপর একটি মেয়ে পরে, পায়ের ধুলো নিয়ে দাঁড়ায়। লম্বা ছিপছিপে মিষ্টি একটা মেয়ে। চোখদুটো ভারি সুন্দর।
-ভাবি, মুই রুপালি। মোর কতা ভাইয়া আপনাকে কয় নাই?
পাশে দাঁড়িয়ে গ্রামের অনেকগুলো ছেলেমেয়ে। বিচিত্র আকার ওদের। সবার চোখে বিস্ময় আর কৌতুক। বুঝতে পেরেছে মিলি, ওরা ঢাকা শহরের কত গল্প শুনেছে, সিনেমা দেখেছে কিন্তু জলজ্যান্ত ঢাকার মেয়ে এই প্রথম দেখছে, কৌতুক বিস্ময় তো লাগবেই।
-বলছি। তোর ভাবিকে, জিজ্ঞেস কর। শিমুলের কথায় ভরসা পায় রুপালি। হাত ধরে মিলির, লন আমার লগে। তাকায় শিমুলের দিকে, ভাইয়া দুইডা বান্দরের কাছে আপনাগো ব্যাগ দিয়া দেন।
-বান্দর!
হিহিহি হাসে রপালি, বান্দর অইলো তমাল আর জগদীশ সাহেব ভাবি।
হাঁটতে হাঁটতে হাসে মিলি মাহজাবীন, তাই বলো।
কানের কাছে মুখ নেয় রুপালি, ভাবি আপনে কিন্তু খুব সুন্দর। সিনেমার নায়িকাগো মতো।
হাসে মিলি, তুমি সিনেমা দেখো?
-গ্রামে কি আর সিনেমা দেখা যায়। মাঝে মইধ্যে টিভিতে দেখি।
-তুমি তো এবার এসএসসি পরীক্ষা দেবে?
ঘাড় নাড়ে রুপালি, হ ভাবি। কিন্তু ইংরেজি একদম পারি না। পরীক্ষায় কী যে অইবো বুঝতে পারতেছি না।
-তুমি চিন্তা করো না, আমি তোমাকে ইংরিজে শেখাবো?
-হাঁচা? জড়িয়ে ধরে মিলিকে।
-আরে আরে ছাড়ো, লোকেরা দেখছে।
ইতিমধ্যে দল বেঁধে প্রচুর মানুষ রাস্তায় চলে আসছে। ঢাকা শহরের শত শত পথচারীর মধ্যে হাটাচলার অভ্যাস মিলির। কিন্তু কেউ তো এমন করে তাকিয়ে দেখে না। লক্ষ করে না তীক্ষ্ম চোখে। কিন্তু উজানগাঁও গ্রামের মানুষগুলো, নারী ও পুরুষ তীব্র চোখে দেখছে, মনে হচ্ছে আজব প্রাণী দেখেছে।
রুপালি আর মিলির পিছু পিছু আসছে শিমুল আহসান। ও একটু বিব্রত। কেন এত মানুষের আগমন? হাঁটতে হাঁটতে কয়েক মিনিট পর বাড়ি সামনে পৌঁছুলে সামনে দাঁড়ানো কয়েজন মহিলাকে দাঁড়িয়ে দেখে মিলি। রুপালি হাত ধরে একজন ঘোমটা পরা নারীর সামনে দাঁড় করিয়ে বলে, ভাবি এইডা তোমার শাাশুড়ি মিসেস পারুল বেগম।
সঙ্গে সঙ্গে মিলি পায়ের হাত দেয়। পারুল বেগম হাত ধরে তুলে ধরে, আহো মা। ঘরে আহো। রুপালির হাত থেকে মিলির হাত নিজের হাতে নিয়ে বাড়ির মধ্যে ঢোকে। বিরাট নিকানো সুন্দর উঠোন। উত্তর দিকে বিরটা একটা চৌচলা টিনের ঘর। উঠোনে কয়েকটা মোরগমুরগি হেঁটে বেড়াচ্ছে। উঠোনের কোনে কয়েকটা বড় বড় নারকেল , আম, জাম আর কাঁঠাল গাছ। দুপুরের রোদ একটু হেলে পড়েছে। মিলি এইসব উঠোন বাড়ি সিনেমায় দেখেছে। প্রথম চোখে দেখছে। ভালোই লাগছে। ঘরের সামনে দাঁড়াইতেই পারুল বেগম বললো, এইহানে একটু খাড়াও।
কিন্তু হাঁটা অব্যাহত রাখে, হাঁটা থামায় না। মনে হয়, দেখতে চায়, পথের শেষ কোথায়, পথের শেষ কি দেখা যায়? পথ কি কখনো ফুরোয়? পথ তো হাজার হাজার কিলোমিটার নিজেকে ছড়িয়ে দিয়েছে খুনের দিকে।
মিলি দাঁড়ায়। ঘরের ভেতর থেকে তমালের বড় বোন আকলিমা বেগম কুলায় করে দুর্বাঘাস এনে মায়ের সামনে ধরে। পারুল বেগম দুর্বাঘাস নতুন বউ-মিলির মাথায় আর কপালের ওপর ঢেলে দিয়ে হাত ধরে ঘরের মধ্যে নিয়ে যায়। বড় ঘরের পেছনে বড় একটা ঘর, সন্দর পরিপাটি করে সাজানো। বড় একটা খাট। খাটের পাশে একটা টেবিল। টেবিলেরও ওপর সাদা কাপড়ের ওয়ার। কয়েকটা বইও রাখা। দেয়ালে টানানো সুন্দর সুন্দর ছবি।
-বউ, তুমি বও।
ঘরের মধ্যে বাইরের যেসব মানুষ ঢুকছিল, তাদের বলে পারুল বেগম, আপনেরা এহন যান। বউ বড় কষ্ট কইরা কত দূর দিয়া আইচে। দেখতেই পারবেন, বউ তো পলাইয়া যাইতেছে না।
সত্যি সত্যি পারুল বেগমের কথায় সবাই চলে যায়। রুমে ঢোকে রুপালি, হাতে বড় একটা গ্লাসে দুধ। পেছনে ঢোকে আকলিমা, হাতে পিঠার প্লেট।
-ভাবি, খাও। এই পিঠা গত রাইতে মোরা বানাইচি, পাশে বসে বলে আকলিমা বেগম।
আগে আপনে দুধটা খান, এগিয়ে ধরে গ্লাস রুপালি।
মিলি গ্লাসটা হাতে নিয়ে দুধ মুখে দেয়, হালকা চিনি দেওয়া দুধ, খেতে ভীষণ ভালো লাগছে। পুরোটা গ্লাস দুধ খেয়ে বললো, আমি একটু শুই?
-হ্যাঁ ভাবি, শোও তুমি। আকলিমা ঘর থেকে বের হয়ে যায়। কানের কাছে মুখ আনে রুপালি, শোনেন ভাবি, আপনার যা কিছু লাগে আমাকে বলবেন। আমি এনে দেবো। আর একটা কথা।
শুয়ে বালিশের ওপর মাথা রাখে মিলি, কী রুপালি?
-আমার এই যে বড় বোন আকলিমা বেগম, এই মহিলা থেকে দূরে থাকবেন।
বালিশ থেকে মাথা তোলে মিলি, কেন?
-খুব কুটনা একটা মহিলা আমাগো বুইনে। ওর জামাইটা আরও খারাপ। যাউগগা, আপনে ঘুমান। মাথায় হাত বুলায় রুপালি, আমি আছি না?
চলে যাওয়ার জন্য ঘুরে দাঁড়াতেই হাত ধরে মিলি, শিমুল কোথায়?
-উঠানে ভাইয়া গ্রামের লোকজনের সঙ্গে কথা বলছে।
-আর আমার শ্বশুর কোথায়?
-আব্বা গোছল করতেছে পুকুরে। সবাইকে দেখতে পাবেন, এহন একটু বিশ্রাম হরেন। আবার মাথায় আদর করে চলে যায় রুপালি। আকলিমা বেগমের ব্যবহার দেখে তো মনেই হয় না, জটিল মনের মানুষ! রুপালি কি কোনো ঝামেলা তৈরি করতে চাইছে? বাড়ি ঘর যতটা খারাপ বলেছিল শিমুল তেমন তো খারাপ নয়। মা তো খুব ভালোভাবেই মেনে নিয়েছেন। শিমুল হারামজাদাটা সেই খালের পার থেকে লাপাত্তা। আসুক একবার, চুল টেনে ছিঁড়ে ফেলবো। ঘুমিয়ে যায় মিলি।
হাতে ব্যাগ নিয়ে হাঁটতে শুরু করে শফিক হায়দার। বেশ কিছুদূর আসার পর দেখতে পায় জগন্নাত বিশ্ববিদ্যালয়। শুনেছে মানুষের মুখে, সদরঘাটে নামলেই জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। ধীরে ধীরে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় পার হয়ে সামনে এগুতেই ডান দেখতে পায়, বাহাদুর শাহ পার্ক।
বাহাদুর শাহ? দিল্লির শেষ মুগল সম্রাট। ইংরেজ বেনিয়ারা যাকে সিংহাসন থেকে উৎখাত করে দিল্লি দখল করেছিল আর সম্রাট বাহাদুর শাহকে নির্বাসনে রেঙ্গুনে পাঠায়। হায়, নিজের সাম্রাজ্যেও থাকার সুযোগ হয়নি বয়োবৃদ্ধ সম্রাটের। তিনি কবিতা লিখতেন।
একটা দীর্ঘশ্বাস বেড়োয় শফিকের, সকালে বাদশা সন্ধ্যায় ফকির। গানটা শুনেছে ট্রানজিস্টারে। শফিক বাহাদুর শাহ পার্ক পার হয়ে জনসন রোড ধরে হাঁটতে হাঁটতে ইংলিশ রোডে এসে পড়ে। চৌমাথা। কোন দিকে যাবে?এক লোক দাঁড়িয়ে সিগারেট টানছে, জিজ্ঞেস করে শফিক, ভাই আমি সেগুনবাগিচা যাবো।
সামনের ছোট রাস্তা দেখিয়ে বলে, এই রাস্তা ধরে সোজা হেটে যাবেন। এই রাস্তার নাম নবাবপুর রোড। সোজা হেঁটে যেতে যেতে সামনে পড়বে বাইতুল মোকাররম সমজিদ। ওই মসজিদের ডান পাশে সচিবালয়। সচিবালয়ের ডানে প্রেস ক্লাব। প্রেস ক্লাবের উল্টো দিকেই সেগুনবাগিচার রোড। লোকটা সিগারেটটা ফেলে দেয় মাটিতে, পায়ের বুট জুতা দিয়ে পিষে চলে যায় উল্টো দিকে।
শফিক হায়দার নবাবপুরের রাস্তায় ঢোকে, বামে রেখে ইংলিশ রোড়ের বারবণিতাদের খামার। খুব খিদে অনুভব করছে শফিক। কিন্তু কী খাবে? ঢাকা শহরের কোন হোটেলে কী পাওয়া যায়, সে জানে না। শুনেছে, ঢাকার হোটেলে ঢুকে না জিজ্ঞেস করে খেলে, পরে অনেক টাকা বিল করে। এমনকী জামা খুলেও রাখে। না বাবা, আগে সেগুনবাগিচায় মাওলানা মতিনের লেবার পার্টির অফিসে পৌঁছাই। সেখানের পরিস্থিতি কেমন, কে জানে? থাকতে না পারলে কোথায় থাকবে? ফুটপাতে?
শরীর ভেঙে আসে শফিক হায়দারের। ঢাকা শহরে লক্ষ লক্ষ মানুষ, কিন্তু একজনও পরিচিত নয়। একটা মহাশূন্যের মধ্যে এসে পড়ে শফিক হাসান। কিন্তু হাঁটা অব্যাহত রাখে, হাঁটা থামায় না। মনে হয়, দেখতে চায়, পথের শেষ কোথায়, পথের শেষ কি দেখা যায়? পথ কি কখনো ফুরোয়? পথ তো হাজার হাজার কিলোমিটার নিজেকে ছড়িয়ে দিয়েছে খুনের দিকে।
চলবে…