[পর্ব-১৪]
-কী ভাবছ মিলি?
নাবিক লঞ্চের দোতলায় কেবিনের পাশের পাশের বারান্দায় দাঁড়িয়ে মিলি মাহজাবিন তাকিয়ে আছে দূরে, বহুদূরে। পাশে দাঁড়ায় শিমূল। রেলিংয়ের ওপর রাখা মিলির হাতের ওপর রাখে নিজের হাত। মিলির দূরের দৃশ্য থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে এনে তাকায় শিমুলের দিকে। হাসে মৃদু। নিজের হাতের মুঠোয় ধারণ করে শিমুলের হাত, আঙুল মটকায়। আরাম লাগে শিমুলের।
-বললে না?
-কী বলবো?
-তুমি কী ভাবছ, সেটা জানতে চাইছি।
সন্ধ্যার লাল ছায়া নেমেছে পৃথিবীর পরে। নাবিক লঞ্চ বুড়িগঙ্গার স্রোত পার হয়ে ইছামতীতে। বুড়িগঙ্গার চেয়ে ইছামতি অনেক বড় নদী। চওড়াও। এই পার থেকে ওই পার দেখা যায় ধু-ধু। সন্ধ্যার লাল চাদর ছড়িয়ে পড়েছে চারদিকে। জলের ওপর সূর্যের শেষ আলিঙ্গন। লাল রঙিন জলের স্রোতে ভেসে যাচ্ছে ছোট বড় নানা ধরনের নৌকা। আরও যাচ্ছে বিচিত্র আকারের লঞ্চ, স্টিমার, মালবাহী জাহাজ। অবাক চোখে দেখছে মিলি, এক ধরনের বড় নৌকা, ঠিক নৌকা নয়, নৌকার মতোই কিন্তু গোটা নৌকাটা পানির মধ্যে ভাসতে ভাসতে যাচ্ছে। একদম ডুবু ডুব।
-ওগুলো কী শিমুল?
বালি বোঝাই টলার বলে এগুলোকে। আবার মালিক বা শ্রমিকেরা বলে বলগেট। এটা লোকাল শব্দ।
বলগেট বলো আর টলার বলো, ডুবে যাবে না?
যাচ্ছে না তো। তুমি তো চোখের সামনেই দেখতে পাচ্ছো, পানিতে ডুবতে ডুবতে বা ভাসতে ভাসতে যাচ্ছে। কিন্তু ডুবছে না। একটা দুইটা নয়, অনেক। তুমি গুনে দেখতে পারো, আমিই গুনি। ইছামতী নদীতে দৃষ্টি ছড়িয়ে দিয়ে গুনতে শুরু করে, এক-দুই-তিন-চার-পাঁচ-ছয়-সাত-আট-নয় দশ-এগার-বারো-তোরো-চৌদ্দ-পনেরো-ষোলো সতেরো। এখানে বা চোখের সামনে আমরা মাত্র সতেরোটা দেখলাম। কিন্তু ইছামতী মেঘনা ধলেশ্বর গোটা বাংলাদেশের নদীর তলদেশ থেকে বালি তুলে ব্যবসা করা এখন অনেক মানুষের কাজ।
-কিভাবে তোলে নদীর তলদেশের বালি?
-ওই যে দূরে নদীর মাঝখানে নৌকা আর টলারগুলো দেখছো, ওর সঙ্গে আছে ড্রেজার মেশিন। ওই মেশিনের লম্বা পাইপ নেমে গেছ নদীর তলদেশে। আর ওপরের স্টিলের যে কাঠামো, সেখানে মেশিন। মেশিন স্ট্রাট দিলে তলদেশে থেকে পাইপে করে বালি বোঝাই পানি এসে পড়ে এইসব বড় নৌকার ওপরে। বালিবাহিত পানি পড়তে পড়তে এক সময়ে নৌকা বা ট্রলার বালিতে বোঝাই হয়ে যায়। তখন টলারের লোকেরা ইঞ্জিন স্টার্ট দিয়ে বালি নিয়ে ফিরে যায় গন্তব্যে। যেমন এখন ফিরছে। দেখেছ, মানুষগুলোর কী সাহস?
হাসে শিমুল আহসান, মিলি এই মানুষগুলো জলের মানুষ। প্রত্যেকে সাঁতার জানে। আবার পরিশ্রমী। এরা দিনে রাতে পরিশ্রম করে আয় করে। এই দেশটার অর্থনীতির চাকার ওপর সচল রাখছে এইসব দরিদ্র কিন্তু পরিশ্রমী মানুষ। কিন্তু অর্থনীতির ইতিহাসে এইসব মহান শ্রমিকদের নাম কখনো লেখা হবে না। এই যে শত শত ট্রলারবোঝাই বালি যাচ্ছে, কোথায় যাচ্ছে? যাচ্ছে শহরে বন্দরে গ্রামে গঞ্জে। যেখানে চলছে বিশাল নির্মাণযজ্ঞ। এক তলা, দুই তলা নয়, দশ তলা-বিশ তলা বিল্ডিংয়ের প্রথম কাঁচামাল পানির অথৈ বুক চিড়ে এই সোনার মানুষগুলো নিয়ে আসে।
-নদীর তলদেশ থেকে যে বালু তোলে, নদীর ক্ষতি হয় না?
-নিশ্চয়ই ক্ষতি হয়। কিন্তু ইছামতী নদী অনেক বড়। তুমি তাকাও, দুই পারের মধ্যে অনেক দূরত্ব। কিন্তু অনেক ছোট নদী আছে, যে নদীতে বড় বড় ব্রিজ আছে, বাড়ি ঘর আছে, শহর বন্দর আছে—সেইসব নদীতে একশ্রেণীর মাফিয়া চক্র বিশাল বিশাল ড্রেজার চালিয়ে বালি তোলে। ফলে পরিবেশের ভয়ানক ক্ষতি হচ্ছে। এই ড্রেজারের ভয়ানক শব্দে নদীর মাছ, শুশুক পালিয়ে যায়। চারপাশের বাড়িঘর ক্ষেতখামারের ক্ষতি হয়। অল্পস্রোতে নদী ভাঙে, মানুষ সর্বহারা হচ্ছে।
-কেউ নেই দেখবার?
-তুমি সাপলুডু খেলেছ কখনো?
-হ্যাঁ, খেলেছি।
-বাংলাদেশটা হচ্ছে সাপলুডু খেলার একটা চমৎকার বদ্বীপ।
-মানে?
এই সুন্দর দেশটায় আইন আছে, আইন বানানোর পার্লামেনট আছে, সরকার আছে, আছে প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি, মন্ত্রী, মন্ত্রী আবার নানা কিছিমের, পূর্ণ মন্ত্রী, অর্ধেক মন্ত্রী, সিকি মন্ত্রী—এদের ওপর আছে সচিব, যুগ্ম সচিব, মহাপরিচালক। সবার ওপরে পুলিশ কিন্তু কাজের সময়ে দেখবে কোনো এক অদৃশ্য ফুয়ে সাপের মুখে গুটি পড়লে যেমন লেজুড়ে নেমে আসে, তেমন সব নেমে গেছে। কাজের নামে অষ্টরম্ভা। দেশটা কেমনে চলে বুঝি না। এইসব নিয়ে পত্রিকায় যখন রিপোর্ট হয়, তখন জেলা প্রশাসক নামের আধুনিক সরকারি জমিদার নড়েচড়ে বসেন। পুলিশ পাঠিয়ে একটু হুমকি-দামকি দেয়, দুই দিনের মাথায় আবার আগের মতো ভাজা তেলে মাছ মাছে আর দাঁদের ওপর দাঁত ফেলে খায়।
-তুমি এতসব জানো কিভাবে?
-চোখ কান খোলা রাখলেই সব চেনা বা জানা যায়। কিন্তু দরিদ্র শ্রেণীর মানুষের কাধের জোয়াল কখনো নামবে, সেইসব মানুষেরা একটু শান্তি পাবে, আমার মনে হয় না মিলি।
সন্ধ্যার গাঢ় অন্ধকার চারদিকে নেমে আসছে ইছামতীর নদীর বিশাল বক্ষজুড়ে। চারদিকে বিষণ্ন অন্ধকারের ঢেউ। নাবিক নদীর পানি চিড়ে এগিয়ে যাচ্ছে। পাশের কেবিন থেকে ভেসে আসছে নারী পুরুষের হাসির হল্লা। শিমুলের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে অবাক চোখে মিলি।
-কী দেখছ তুমি?
-কিছু না, নিজের বুক জোড়া এবং খাড়া নাকটা স্থাপন করে শিমুলের বুকের ওপর। তুমি অনেক ভালো একটা মানুষ।
-আমি জানি।
-কী জানো?
-আমি ভালো একজন মানুষ।
শিমুলের বুকের ওপর থেকে নিজেকে সরিয়ে নেয় মিলি মাহজাবীন। মুখ ভেংচায়, একটু প্রশংসা করলাম বাবুর দাম বেড়ে গেছে!
-হাহাহা। শিমুল নিজেই জড়িয়ে ধরে, শোনো গো রূপসী, প্রত্যেক মানুষ নিজেকে জেনে। কিছুটা হলেও চেনে। আমি সেই চেনা থেকে বলছি, মানুষটা আমি খারাপ না। জোরে জড়িয়ে ধরে মিলিকে।
-ছাড়ো, ব্যথা লাগছে।
-কোথায় ব্যথা লাগছে? ছেড়ে দেয় মিলিকে।
-সারা শরীরে। তুমি একটা জানোয়ার। এই কয়দিনে রাতে আমাকে নিয়ে যা করেছ! আমি তোমার নামে মামলা দেবো।
-সত্যি?
-মাথা নাড়ায় মিলি মাহজাবীন, হ্যাঁ। তুমি ডাকাতের চেয়েও ভয়ঙ্কর।
-ডাকাত আমি? হাত ধরে টানে, চলো।
-কোথায়?
-তোমাকে আমার ডাকাতি করবো, রুমে চলো।
-এখন? অসম্ভব। আমি পারবো না।
-লাগে চানাচুর… ঝালা চা না চুর…
-চানাচুরঅলা আসায় মিলির হাত ছেড়ে দেয় শিমুল। মিলি রেলিংয়ে ভর দিয়ে সন্ধ্যার মোহনীয় নদীর জলের দিকে তাকায়।
-দাও তো চানাচুর। আমারটা ঝাল দিও। আর একটা কম ঝাল দিও।
চানাচুরঅলা দুজনকে চানাচুর দিয়ে টাকা নিয়ে অন্যদিকে চলে যায়, চানাচুর। লাগবে চানাচুর?। সেই সঙ্গে বাজায় ঘন্টাও। দুজনে, মিলি আর শিমুল অন্ধকারের নদীর বুকে নাবিক লঞ্জের কেবিনের সামনে দাঁড়িয়ে চানাচুর চিবায়। মদৃ বাতাসে গোটা পরিস্থিতি অন্যরূপ নেয়।
-মিলি?
-বলো।
তুমি একটা কিছু ভাবছিলে, সেই বিকেল থেকে। বলো তো, কী ভাবছ? তোমার ভাবনা যদি আমাকে না জানাও আমি বুঝবো কী করে? তুমি বিয়ের পর থেকে কিন্তু স্বাভাবিক ছিলে, হাসিখুশি, উচ্ছল। কিন্তু আজ দুপুর থেকে তোমার মধ্যে পরিবর্তন দেখছি। ভুলও হতে পারে…কিন্তু তোমার ভাবনাটা জানতে চাই। যদি তোমার কোনো সমস্যা না থাকে, একটানা বলে থেমে যায় শিমুল আহসান।
চানাচুর খাওয়া শেষ করে, কাগজের ঠোঙ্গাটা নদীতে ফেলে দেয় মিলি মাহজাবীন, তুমি ঠিকই দেখেছো শিমুল। সত্যি আমি চিন্তিত। না, তোমাকে নিয়ে নয়, আমি চিন্তিত আমাকে নিয়ে।
-কোনো?
-কারণ, আমি কে? আমি কোথায় যাচ্ছি? কেনো যাচ্ছি? একজন মানুষের একদিনের একটা হটকারী সিদ্ধান্তের বা বাজে কাজের জন্য আমি যে সিদ্ধান্ত নিলাম, সেটা কতটুকু সঠিক? আর তোমাকে তো চিনি আমি মাত্র সাত আট দিন। যে ভাইটাকে চিনতাম পঁচিশ বছর ধরে, তাকে, আমার প্রিয় মা বাবা ভাইবোন রেখে, শহরের জীবনের মেলা রেখে আমি কোথায় যাচ্ছি। তোমাদের গ্রামের বাড়ি বরিশালের উজানগাঁওয়ের যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছি আর এই ভাবনাগুলো আমার মধ্যে জেগে উঠছে। এবং আমি…
-বলো এবং আমি!
-এবং আমি হতাশার মধ্যে ডুবে যাচ্ছি।
-হতাশার মধ্যে ডুবে যাওয়াই স্বাভাবিক মিলি।
-স্বাভাবিক! অবাক মিলি।
-হ্যাঁ। কারণ, তুমি সাজানো গোছানো একটা জীবনের বেড়াজাল ভেঙে নতুন কিন্তু অনিশ্চিত একটা জীবনের দিকে যাত্রা করেছো। পরিবেশ একেবারেই ভিন্ন। সুতরাং তোমার ভাবনাকে আমি অস্বাভাবিক বলতে পারছি না। আমিও জানি না, গ্রামের বাড়ি তে তোমার আমার জন্য কী পরিস্থিতি অপেক্ষা করছে। আমি বাবা-মাকে ভাইবোনদের জানিয়েছি তোমার সম্পর্কে। আমার ছোট বোন রূপালী তো তোমার অপেক্ষায় আছে। মা খুব চাপা স্বভাবের মানুষ কিন্তু অন্তরের বহিয়া যায় স্নেহের স্রোত। বাবা চিরকাল নির্বিরোধী মানুষ, সারা জীবন চাষবাস আর সংসার নিয়েই কাটালেন। বয়স হয়েছে।
-তোমাদের বাড়িতে আমার কী ভূমিকা হবে? শুনেছি গ্রামের মানুষজন শহরের মেয়ে দেখলে হামলে পড়ে! নানা ধরনের মন্তব্য করে?
-মিলি! মানুষ যখন মন্তব্য করে, তখন আর শহর গ্রাম বাছাই করে না। মানুষ নিজের চারপাশ থেকে অর্জিত অভিজ্ঞতার নানা ধরনের মন্তব্য করে, কিন্তু সেই সব মন্তব্য বাতাসে ভেসে যায়। খুব গ্রাহ্য করার দরকার নেই। আর সবার ওপরে তো আমি আছিই। জড়িয়ে ধরে বুকের সঙ্গে, আমার ওপর ভরসা রাখো। আমি তোমার সবার ভালোবাসার প্রতীক হয়ে থাকবো।
-আমি জানি! ফিসফিসিয়ে কানের কাছে বলে মিলি মাহজাবীন। কিন্তু কোথা থেকে মনের মধ্যে নানা ধরনের কুচিন্তা আসে।
-আসাটাই স্বাভাবিক কিন্তু সবকিছুর জন্য আমাদের প্রস্তত থাকতে হবে। বুকের ওপর থেকে ছেড়ে দেয় স্ত্রী মিলি মাহজাবীনকে। ধরে হাত, চলো ঠাণ্ডা বাতাস বইছে। চলো, কেবিনের মধ্যে।
-চলো, দুজনে কেবিনের মধ্যে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেয়।
সারারাতের যাত্রার পর সকাল দশটার দিকে নাকিব লঞ্চ এসে থামে তেলিখালী। ঘুম থেকে উঠে নাস্তা করে দুজনে ছোট্ট দুটি ব্যাগ নিয়ে অপেক্ষা করছে। লঞ্চ থামলে অনেকের সঙ্গে নামে শিমুল আহসান আর মিলি মাহজাবীন। মিলির হাত ধরে সিঁড়ি বেয়ে নামে দুজনে। লঞ্চ থেকে নামতেই দেখে ছোট ভাই তমাল আর তমালের বন্ধু জগদীশ দাঁড়িয়ে আছে। দুজনের পরনে প্যান্ট। গায়ে নতুন শার্ট। বুঝতে পারে, শহরের নতুন মেহমানকে বরণ করার জন্য ওদের এই নতুন জামা প্যান্টের আয়োজন।
-ভাইয়া, আমার আতে ব্যাগ দেন…শিমুলের হাত থেকে ব্যাগ নিয়ে যায় তমাল।
-লঞ্চঘাটে প্রচুর মানুষের ভিড়। হাটবার। শুক্রবার। অনেক লোক এসেছে। বাজারের অনেকে এসেছে লঞ্চ দেখতে। নেমে একটু দূরে, লোকজন এড়িয়ে দাঁড়ায় শিমুলেরা। লঞ্চ ইতোমধ্যে ছেড়ে দিয়েছে, ব্যাগার দিয়ে পেছনে ছুটছে লঞ্চ। শিমুল তাকায় মিলির দিকে। মিলি অবাক চোখে দেখছে, গ্রাম, গ্রামের নদী, নদী পারের মানুষ আর লুঙ্গি পাঞ্জাবি পড়া দাড়িঅলা বিচিত্র মানুষ। বুঝতে পারছে না, কোথায় এলো?
-মিলি? ডাক দেয় শিমুল।
-তাকায় মিলি, বলো।
এইটে তোমার দেবর মি তমাল। সারাদিন বাড়িতে টোটো করে ঘুরে বেড়ায়। আর এই ভদ্রলোক হচ্ছে মি তমালের বন্ধু মি জগদীশ হালদার। ইহারা দুজনে জানের দোস্ত।
-ওরা কি করবে বুঝতে পারছে না। এগিয়ে এসে মিলি তমালের মুখটা তুলে ধরে, মিষ্টি মুখ।
-তমাল একটা মিষ্টি একটা গন্ধ পায়। আর শুরু থেকেই অবাক চোখে দেখছে, বড় ভাইয়ের স্ত্রী, ভাবিকে। শহরের মেয়েরা এত সুন্দর?
-কী দেখছ? আমাকে পছন্দ হয়নি?
-আপনে খুব সুন্দর…আচমকা বলে জগদীশ।
-তাই নাকি! হাসে মিলি।
-হাসে সবাই।
-তমাল? শুধু তোরা দুজন এসেছিস?
-মাথা নাড়ায় তমাল, হ। আর নৌকা লইয়া আইচি।
-আগে বলবি না? কার নৌকা? কই?
-আইতো হামেজইদ্দিন কাকার নৌকা। জগদীশ এগিয়ে যায় মিলির কাছে, আপনের ব্যাগটা মোর কাছে দেন। এক প্রকার টেনেই ব্যাগটা নিয়ে নৌকার দিকে হাটতে শুরু করে। ওর পেছনে পেছনে সবাই হাঁটতে শুরু করে। তীরে দাঁড়িয়ে ছোট ডিঙ্গি নৌকা দেখে অবাক মিলি।
নৌকাটা প্রবলভাবে দুলে ওঠে, মিলি ছটফট করতে করতে চিৎকার করে নৌকার মধ্যে শুয়ে পড়ে, শিমুল! আমাকে বাঁচাও।
তমাল আর জগদীশ পেরী কাদা ভেঙে নৌকায় উঠে পা ঝুলিয়ে পায়ের কাদা পরিষ্কার করে পা ঝাঁকিয়ে। মিলির দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারে শিমুল, মিলি নামতে পারবে না কচানদীর কাদায় পা মেখে। চুপচাপ দাঁড়িয়ে নদীর স্রোত আর ভেসে যাওয়া কচুরীপানা দেখছে।
-আমি তোমাকে কোলে করে নৌকায় তুলি! পাশে দাঁড়িয়ে ফিসফিসিয়ে বলে শিমুল আহসান।
-না, লজ্জায় আড়ষ্ট মিলি। চারদিকে এত লোক তাকিয়ে আছে!
নৌকার ঘাটের উঁচু পারে অনেক লোক জড়ো হয়েছে মিলি মাহজাবীনকে দেখার জন্য। এত সুন্দর মেয়ে ওরা কেবল রূপকথায় আর গল্পে শুনেছে। সেই গল্পের মেয়ে সামনে দাঁড়িয়ে, দেখতে তো চাইবেই।
-তাহলে? অসহায় লাগে শিমুলের। নৌকায় না উঠলে বাড়ি যাবো কী করে?
-শিমুল!
-কী?
-এই এতটুকুন নৌকায় করে এই বিশাল নদী পার হতে হবে!
-হ্যাঁ। ভয় পাচ্ছ কেন? ওই দেখো, কচানদীর মাঝ খান দিয়ে কত নৌকা যাচ্ছে!
-মিলি মাহজাবীন তাকায়। সত্যি, অনেকগুলো নৌকা ছোট বড় নদীর মাঝ বরাবর চলছে। ঢেউয়ের সঙ্গে নৌকাগুলো দুলছে। কিন্তু চলছে সামনে। মিলির বুকটা হিম হয়ে আসে। ভয়ের ওষ্ঠ শুকিয়ে যায়। পানি থেকে ইচ্ছে জাগে কিন্তু কিভাবে বলবে?
-আমাকে বল, কোনো দ্বিধা করো না। তোমার ভয় লাগলে নৌকায় যাবো না। যাবো হেঁটে।
-হেঁটে, জিহবা দিয়ে ঠোট চাটে মিলি।
-তুমি পানি খাবে?
-মাথা নাড়ায় মিলি।
-তমাল?
-ভাইয়া?
নৌকায় উঠে জগদীশ আর তমাল একদৃষ্টিতে কেবল মিলিকে দেখে। তমাল তো আনন্দে আত্মহারা, এত সুন্দর ভাবী পেয়ে। ওর চিন্তা, কখন সুন্দর ভাবীকে বাড়ি নিয়ে যাবে। কিন্তু ভাবী কেন নৌকায় উঠছে না!
-তুই চায়ের দোকান থেকে এক গ্লাস পানি নিয়ে আয়!
-তমালের নামার আগেই চট করে কাদায় নেমে যায় জগদীশ, তুই নৌকায় থাক তমাল। আমি পানি আনি।
জগদীশ নেমে দৌড়ে কূলে উঠে যায়। মিলি চারপাশে আরও তাকিয়ে দেখে, নৌকায় অনেক মানুষ উঠছে নামছে। পায়ে কাদা লাগছে, সেই কাদা নৌকায় পাছা রেখে দুই পা নদীর পানিতে ঝাকা দিয়ে ধুয়েও নিয়ে নৌকায় চমৎকারভাবে উঠে বসছে। বুঝতে পারে, এসব জন্ম-জন্মান্তরের অভ্যাস। হঠাৎ, আকাশ থেকে এক চিল নেমে এসে কিভাবে অভ্যস্ত হবে?
তৃষ্ণায় বুটা ফেটে যাচ্ছে। অথচ সামনে, কয়েক হাতের ব্যবধানে নদী। বিশাল নদী। কচানদী। নদীর এইপার থেকে ওই পার চেনা যায় না। বিপুল স্রোত। সেই নদীর পারে দাঁড়িয়ে তৃষ্ণায় কাতর মিলি মাহজাবীন। অথচ নদীর পানি পান করতে পারছে না। থাকতে নদী মিটলো না তৃষ্ণা। লালন কী এই মুহূর্ত ভেবে গানটা লিখেছিলেন?
-ভাবী, পানি নেন।
-সামনে দাঁড়িয়ে জগদীশ। হাতে পানির গ্লাস। পানির গ্লাসটা পিতলের। গ্লাসটা নিয়ে পানি পান করে, ফিরিয়ে দেয় জগদীশকে।
-থ্যাংক ইউ জগদীশ।
-আইচ্চা, হাসতে হাসতে জগদীশ হালদার গ্লাসটা নিয়ে ছুটে যায় তেলিখালী বাজারের মধ্যে, গ্লাসটা দিয়ে আসতে। মিলি সিদ্ধান্ত নেয়, সবাই যদি কাদা মেখে নৌকায় উঠেতে পারে, আমিও পারবো। শিমুলকে আর বিড়ম্বনায় ফেলার দরকার নেই।
-শিমুল?
-বলো।
তুমি আমার হাত ধরো। আমি পারবো উঠতে।
শিমুল কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থাকে মিলির দিকে। বোঝার চেষ্টা করছে, মিলি কি অহসায়বোধ করছে? নাকি বোঝার চেষ্টা করছে জীবনের এই মুখোমুখি পরিস্থিতি!
-পারবে? গলায় কুণ্ঠা। হাত বাড়ায় ও।
-পারবো, শিমুলের বাড়িয়ে ধরা হাত ধরে নিজের মঠোয় শক্ত করে, পায়ের জুতো খুলে কচানদীর পারের কাদায় পা রাখে ঢাকা শহরের কন্যা মিলি মাহজাবীন। কাদা নরম, সুন্দর ফর্সা পায়ের সঙ্গে কচানদীর পারের কাদা মিলেমিলে পাদুটাকে গিলে ফেলেছে। এক পা দুই পা করে নিচে নামতে নামতে এক সময়ে নৌকার কাছে এলে, হাত বাড়িয়ে দেয় তমাল।
ভাবী, আমার হাত ধরেন।
তমালের হাত ধরে মিলি নৌকায় কোনোভাবে বসে। মিলির পায়ে মাথা কাদা নদীর পানি দিয়ে ঢলে মুছে দেয় শিমুল। কী করবে মিলি? পারের লোকগুলো দেখছে। আড়ষ্ট শরীর, মন। জীবনের বিপরীতে এক জীবনের মোহনায় এসে দাঁড়িয়েছে স্বেচ্ছায়, ভালোবাসার এক টংকারের সূত্রে।
-পাজোড়া ওপরে নাও মিলি, শিমুল বলে।
-মিলি তাকিয়ে দেখে, পায়ে কাদা নেই। দ্রুত নদীর জলে পায়ের কাদা বিদায় নিয়েছে। জগদীশ গ্লাস দিয়ে ফিরে নৌকায় উঠেছে। মাঝি জমিরউদ্দিন নৌকা ছঅড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। শিমুল কচানদীর পানিতে পাদুটো ধুয়ে নৌকায় গলুইয়ে বসেছে আসন গেড়ে। সামনেই দুই পায়ের ওপর ভর দিয়ে নৌকায় বসেছে মিলি। চোখে মুখে প্রবল ভয়। মিলির অবস্থা দেখে হাসি পাচ্ছে খুব। কিন্তু সামলে নিয়ে বলে, মিলি! ওভাবে বসছো কেন? আমাদের মতো পা মুড়ে বসো।
-হয় ভাবী, আমাগো মতো বহেন। আরাম পাইবেন, অভয় দেয় তমাল।
-মিলি ওদের মতো বসে। বসেই ভালো লাগে।
মাঝি নৌকা ছাড়ে। কচানদীর মাঝ বরাবর একটা বড় স্টিমার গেছে। নৌকা ঘাট থেকে একটু দূরে গেছে, সেই স্টিমার যাওয়ার ঢেউ এসে আছড়ে পরে নৌকার ওপর। নৌকাটা প্রবলভাবে দুলে ওঠে, মিলি ছটফট করতে করতে চিৎকার করে নৌকার মধ্যে শুয়ে পড়ে, শিমুল! আমাকে বাঁচাও।
চলবে…