অনুবাদ: ফারহানা রহমান
[পর্ব-২০]
আমার নানার মতোই আংকেল টমিও ভীষণ কর্কশ স্বরে মুখের ভেতর চিবিয়ে চিবিয়ে কথা বলতেন। অথচ তিনিই ছিলেন আমার সবচেয়ে প্রিয় মামা। খুব সাধারণ বাক্যগুলোও তিনি এমনভাবে উচ্চারণ করতেন, যেন শুনে মনে হতো হয়তোবা কাউকে ভয়ানকভাবে অভিশাপ দিয়ে চলেছেন। আর তা না হলে মনে হতো তিনি কোনো হাস্যরসাত্মক কবিতা আবৃত্তি করে চলেছেন। তিনি প্রকৃতপক্ষেই একজন স্বতঃস্ফূর্ত কৌতুকাভিনেতা ছিলেন। তার ভাঁড়ামিপূর্ণ কথাবার্তার জন্য অন্যরা কেউ হাসাহাসি করছে কি না, সেদিকে তিনি মোটেও ভ্রূক্ষেপ করতেন না। আর সে কখনোই কারও সঙ্গে কোনো নিষ্ঠুর আচরণ করতেন না। তিনি ছিলেন কিপটে ধরনের সংকীর্ণ মানসিকতার একজন মানুষ।
আমাদের বাড়ির পাশের জায়গাটিতে যখন সবাই হ্যান্ডবল খেলতাম, আংকেল টমি কাজ থেকে বাড়ি ফেরার পথে অন্য দিক দিয়ে ঘুরে আসতেন। তিনি প্রথমে এমন ভান করতেন যেন আমাদের দেখেননি পর্যন্ত। কিন্তু পরে দেখা যেতো যে দক্ষ বিড়ালের মতোই তিনি বলটিকে লুফে ক্যাচ ধরতেন আর আমাদের বলতেন যে, ‘খেলার সময় নিজের পেছন দিকটাতেও সূক্ষ্ম ও সতর্কতার সঙ্গে খেয়াল রাখবে। আর তাহলেই শুধু তোমাদের আমি আমার টিমে খেলতে নেবো।’ আমরা বাচ্চারা সবাই তাকে ঘিরে রাখতাম। আর তখনই সেটা সবচেয়ে বেশি করতাম, যখন তিনি হাত প্রসারিত করে বলটিকে বাতাসের গতিতে এমনভাবে ছুড়ে মারতেন, যা লাইটপোস্টের ওপর দিয়ে ভেসে গিয়ে আকাশের তারার সঙ্গে মিশে যেতো।
মামা আমাকে প্রায়ই এই কথাট বলতেন যে, ‘রিটি সোনা! তুমি যে অতটাও সুন্দরী কোনো মেয়ে নও, সেটা নিয়ে কিন্তু একদম দুশ্চিন্তা করবে না। অনেক অনেক অপরূপা সুন্দরীকে আমি আমার এই জীবনে খাদের মধ্যে পড়ে হাবুডুবু খেতে দেখেছি। অনেকের অবস্থা আরও শোচনীয়। কিন্তু তুমি হচ্ছ একজন স্মার্ট মানুষ। খোদার কসম দিয়ে বলছি, আমি চাই তুমি বরং একজন সত্যিকার সৎ ও যোগ্য মানুষ হয়ে বেড়ে ওঠো। তবু পিছিয়ে পড়া কোনো মিষ্টি মেয়ে হওয়ার দরকার নেই।
আমার মামারা প্রায়ই তাদের বংশপরম্পরা নিয়ে দম্ভ ভরে কথাবার্তা বলতেন। তাদের শরীরে ব্যাক্সটার বংশের রক্ত আছে, সে ব্যাপারে তাদের অহঙ্কারের শেষ ছিল না। টমি মামা বলতেন, আমাদের বংশের ছোট ছোট বাচ্চারাও তাদের মধ্যেকার গভীর বন্ধন নিয়ে গর্বিত হয়েই বেড়ে ওঠে। ওদের এসব নিয়ে কোনো কিছু শেখানোর দরকার হয় না। তাদের কথায় আমার বারবার মনে পড়ে যাচ্ছিল সেইসব দিনের কথা, যখন বেইলির বয়স মাত্র তিন বছরের চেয়েও কম; অথচ তখনই সে আমাকে হাত ধরে ধরে হাটতে শেখাতো। সে সময় আমার হোঁচট খেয়ে খেয়ে পড়ে যাওয়া দেখে ও খুবই উদ্বিগ্ন ও অসন্তুষ্ট হতো। সে নিশ্চয়ই বলতো, এটা যেহেতু আমার ছোট বোন তাই আমাকেই তো ওকে হাঁটা শেখাতে হবে, কিছু তো করার নেই। তারা আমাকে এটাও জানিয়েছে যে, আমি আসলে কী করে আমার ‘মাই’ নামটা পেলাম। তারা বললো যে, যখন বেইলি একেবারেই শিওর হয়ে জানতে পেরেছিল এবং বুঝতেও পেরেছিল যে, আমি আসলে ওর ছোট বোন, তখন থেকেই ও আমাকে মার্গারেট বলে ডাকতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল। বরং সে যখনই আমাকে ডাকতো তখনই ও বলতো, ‘মায়া সিস্টার’ বলে। পরবর্তী সময়ে সেই বছরগুলোয় যখন আমাকে স্থানে স্থানে বক্তৃতা দিয়ে বেড়াতে হচ্ছিল, আর আমার বিশাল বড়সড় পদিবিটিকে ছোট করে ফেলাও খুব প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল, তখন বেইলির দেওয়া আমার সেই নাম, ‘মাই’ কে একটু বড় করে মায়া করে ফেললাম।
আমরা প্রায় অর্ধেক বছর জুড়ে আমাদের নানা-নানির সঙ্গে ক্যারোলাইন স্ট্রিটের সেই বিশাল বাড়িটিতে থাকতাম। আর তার পরপরই আমাদের মা আমাদের তার নিজের কাছে যেখানে তিনি থাকতেন, সেখানেই নিয়ে চলে গেলেন। এমন একটি যৌথ পরিবার যেখানে সবাই মিলে একসঙ্গে বসবাস করতো, সেখান থেকেই হঠাৎ করে আমাদের সরিয়ে নেওয়া হোলো। অথচ এমন একটি ব্যাপারও তখন আমার কাছে একেবারে মূল্যহীন হয়ে পড়েছিল। আমি এসব নিয়ে একেবারেই তখন আর আসলে চিন্তিত ছিলাম না। কারণ ততদিনে আমরা দুজনেই এসব ঘটনায় একদম অভ্যস্ত হয়ে গেছি। আমরা বুঝে গিয়েছিলাম এসবই আমাদের জীবনের জন্য আসলে একেবারে স্বাভাবিক একটি ঘটনা। আমরা অবাক হয়ে ভাবতাম অন্যসব বাচ্চাদের জীবনেও কি এসব ঘটনা ঘটতে থাকে? ওরাও কি আমাদের মতোই দুদিন পরপর এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় এভাবে স্থানান্তরিত হয়ে যায়? আর যদি তা না হয়ে ওরা ওদের জীবন একটি নির্দিষ্ট স্থানে থেকে স্থিরভাবে কাটাতে পারে তাহলে বুঝতে হবে যে এসবই আমাদের পোড়া কপালের দোষ। এ পৃথিবীতে অন্যান্য বাচ্চাদের তুলনায় আমরা আসলে অভাগা। আমাদের দুর্ভাগ্য যে আমরা এমন কপাল নিয়ে জন্মেছি। আর এই বাসাটাও আসলে অন্য সব বাসার মতোই খুব সাধারণ। শুধু পার্থক্য হচ্ছে এখানে আমাদের সঙ্গে আমাদের মাও থাকেন।
আর আমার মা যখন ঘর থেকে বাইরে যেতেন মিস্টার ফ্রিম্যান অধীর হয়ে তার দিকে এমনভাবে তাকিয়ে থাকতো, যেন সে কিছুতেই চায় না আমার মা কখনো বাড়ির বাইরে পা রাখুক।
বেইলি অনেকটা জেদ ধরেই মাকে মাদার ডিয়ার বলতেই লাগলো। যতদিন না পর্যন্ত শব্দটি একটু নরম সুর নিয়ে ‘মাহ ডিয়ার’ না হয়ে উঠলো, ততদিন সে মাদার ডিয়ারই বলতো। শেষপর্যন্ত এটি ‘এম ডিয়াহ’ হয়ে গেলো। আমার মায়ের মৌলিকতা নিয়ে আমার মধ্যে কখনো কোনো প্রকারের সংশয় কাজ করতো না। তিনি এতই সুন্দরী আর এতই ঝটপটে ছিলেন যে, যখন তিনি সদ্য ঘুম থেকে জেগে উঠতেন আর তার চোখ দুটো ঘুমে জড়িয়ে থাকতো আর চুলগুলো সব এলোমেলো হয়ে ছড়িয়ে থাকতো, তখন তাকে দেখে আমার কুমারী ‘মা মেরির’ কথাই মনে পড়তো। কিন্তু যাকে বলা হয় যে মা-মেয়ের সঙ্গে বন্ধুত্ব বা গভীর বোঝাপড়া এমনকী একজনের প্রতি অন্যের যে মায়া-মমতা থাকে, তার কিছুই আমাদের মধ্যে ছিল না।
আমাদের মা আমাদের জন্য শুধু একটি থাকার জায়গারই ব্যবস্থা করেছিলেন। আর আমরা আসলে তাতেই বর্তে গিয়েছিলাম। আমাদের দুজনেরই দুটো করে বেড কভারসহ আলাদা আলাদা থাকার রুম ছিল। আমাদের খাওয়া-দাওয়া করার মতো যথেষ্ট খাবার থাকতো। পরার জন্য ছিল অনেক জামাকাপড়। আর যত যাই হোক না কেন আসলে তাকে এসবের কোনো কিছুই তো খেয়াল করতে হতো না। আর যদি এমন হতো যে আমরা তাকে খুব বিরক্ত করছি বা অসম্মান করছি অথবা তার কথা শুনছি না, তাহলে তো তার কাছে খুব সহজ একটা উপায় সবসময়ই খোলা ছিলই। তা হচ্ছে আমাদের ঘাড় ধরে আবারও স্ট্যাম্পসে পাঠিয়ে দেওয়া। দারুণ প্রশংসায় ভাসিয়ে দেওয়া বা হুমকিধামকি দেওয়া, যা আমরা মা’র কাছে ফিরে আসার পর আসলে কখনোই পাইনি। আর সেটাই হয়তো বা আমার শিশুসুলভ মনের ওপর প্রভাব ফেলেছিল। আর এসব কারণই হয়তো আমার শিশুসুলভ বোধকেও একেবারে আবেগহীন করে তুলেছিল। আমাকে সেসময় সবাই বুড়ি বলেই ডাকতো। আর শীতকালের গুঁড়ের মতো করে গুটিসুটি করে চলাফেরা করার জন্য আর গুরুগম্ভীভাবে কথাবার্তা বলার জন্য সবাই আমাকে শুধু বকাঝকা করতো।
আমার মা’র বয়ফ্রেন্ড মিস্টার ফ্রিম্যান আমাদের সঙ্গেই থাকতো। না কি আমরাই তার সঙ্গে থাকতাম? সেটা অবশ্য পরবর্তী সময়ে কখনোই আর বুঝতে পারিনি। তিনিও অত্যন্ত বড়সড় দৈত্যের মতোই একজন দক্ষিণের মানুষ ছিলেন। তবে তিনি কিন্তু শান্তশিষ্ট নন বরং কিছুটা চঞ্চল প্রকৃতির মানুষ ছিলেন। তিনি যখন বাসার মধ্যে শুধু পাতলা গেঞ্জি বা আন্ডারওয়্যার এসব পরে আমার সামনে ঘোরাফেরা করতেন, তার স্তনগুলো দেখে আমি খুবই বিব্রতবোধ করতাম। ওগুলো দেখলে মনে হতো যেন তার বুকের মধ্যে মেয়েদের মতো দুটো স্তন গজিয়েছে।
আমার মা যদি ফর্সা চামড়ার আর সোজা চুলের এত অপূর্ব সুন্দরী কোনো নারী নাও হতেন, তবু তিনি অনেক সৌভাগ্যবান একজন মানুষই হতেন। আর সেটা তিনি খুব ভালো করেই জানেন। আমার মা ছিলেন উচ্চ শিক্ষিত একজন নারী। আর তিনি একটি অত্যন্ত সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মেছিলেন। আর সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে তিনি সেন্ট লুইসের মতো বড় একটি শহরে জন্মেছিলেন এবং ওখানেই বেড়ে উঠেছিলেন। আরও বড় একটা ব্যাপার হচ্ছে, তিনি ছিলেন একজন প্রাণোচ্ছল প্রফুল্ল চিত্তের ফুর্তিবাজ একজন নারী। তিনি হাসিঠাট্টা আর কৌতুকে সবাইকে ভরিয়ে রাখতেন। আর তাই মিস্টার ফ্রিম্যান সবসময় এজন্য মার প্রতি কৃতজ্ঞ ছিলেন। তিনি আসলে আমার মায়ের চেয়ে বয়সেও অনেক বড় ছিলেন। তিনি একেবারে একজন বুড়ো লোকের মতোই দেখতে ছিলেন। বুড়ো বয়সে অল্পবয়স্ক একটি মেয়েকে বিয়ে করলে যেমন সবসময় নিজেকে খুব নিচু মনে হয়, তিনি সবসময় সেভাবেই হীনন্মন্যতায় ভুগতেন। বুড়ো লোকটা সারাক্ষণ আমার মাকে চোখে চোখে রাখতো। আর আমার মা যখন ঘর থেকে বাইরে যেতেন মিস্টার ফ্রিম্যান অধীর হয়ে তার দিকে এমনভাবে তাকিয়ে থাকতো, যেন সে কিছুতেই চায় না আমার মা কখনো বাড়ির বাইরে পা রাখুক।
চলবে…
আমি জানি খাঁচার পাখিরা কেন গান গায়-১৯॥ মায়া অ্যাঞ্জেল্যু