[পর্ব-১২]
-তুমি ভয় পাচ্ছো কেনো?
-না, একদম ভয় পাচ্ছি না মিলি। কিন্তু তোমাকে দেখছি আর অবাক হচ্ছি!
মিলির কপালে ভাঁজ, কেন অবাক হচ্ছ?
পাশে বসে শিমুল তাকায় মিলির দিকে। কাছে কিন্তু মনে হচ্ছে অনেক দূরের মানুষ। মিলির হাতের মোবাইলে ম্যাসেজ আসার রিংটোন বাজে। খুলে ম্যাসেজটা দেখে, শিমুলের বাসার ঠিকানা। শিমুল আহসান-১৭১ শহীদ স্মৃতি রোড, চারতলা, শংকর, ঢাকা।
-গোটা ব্যাপারটা আমার কাছে ম্যাজিক মনে হচ্ছে। সব মিলিয়ে গতকাল আর আজ, অথচ তুমি কতটা অগ্রসর? বলছ বরিশালের পিরোজপুরে আমার গ্রামের বাড়ি যাবে তুমি। বুঝতে পারছো না মিলি, তুমি কী বলছ?
-না বোঝার কী আছে? মিলি ঘাড়ের ওপর ছড়িয়ে পড়া চুলে একটা ঝাড়া দিয়ে তাকায় শিমুলের দিকে। তুমি ভাবছ আমি গ্রামে তোমার বাড়ি গিয়ে থাকতে পারবো কি না, এটাই তো?
দ্বিধার সঙ্গে ঘাড় নাড়ে শিমুল, অনেকটা তাই। আমি জানি না তুমি কখনো গ্রামে থেকেছ কি না। শহরের আলো ঝলমল আলিশান ফ্ল্যাটে দিন যাপন করা আর গ্রামে কাঁচা মাটির উঠোনে, ঘরে থাকার মধ্যে আকাশ পাতাল পার্থক্য। তুমি জানো আমার বাবা কৃষক। কৃষক মানে কৃষক। বাবা কৃষিকাজ ছাড়া কিছুই জানেন না। জীবনে দুই-একবার খুলনা শহরে গিয়েছিলেন। এই হচ্ছে শহরের অভিজ্ঞতা বাবার। আমাদের ঘরের প্রায় পাশেই গোয়ালঘর। গোয়ালঘর মানে গরুর ঘর। গরুর ঘর থেকে গরুর বিকট গন্ধ এসে নাকে লাগে। মায়ের আছে নিজস্ব জগৎ। শ’খানেক হাঁস-মুরগি পালেন মা। সেই হাঁস-মুরগি সারা দিন ঘর বাড়ি উঠোন ঘুরে বেড়ায়, ঝগড়া করে, লড়াই করে আর যেখানে সেখানে বিষ্ঠা ত্যাগ করে।
-আর একটা ভয়ানক প্রসঙ্গ…
-কী?
-বাথরুম। আমাদের বাড়িতে কাজের মানুষ আর আমরা মিলিয়ে দশ-বারো জন মানুষ। কিন্তু বাথরুম একটাই। ওখানে গিয়ে সবাই কাজ সারে। পানির বদনা নিয়ে যেতে হয়, তবে পাকা। আর গোসল তো ভয়বহ ব্যাপার। খোলামনে খোলা চোখে সবাই খালে অথবা পুকুরে…
-তুমি এসব আমাকে শোনাচ্ছ কেন? তুমি কি মনে করছ শিমুল, এসব শোনালে আমি ভয় পাবো? মিলি হাত ধরে শিমুলের।
-আমার মনে হচ্ছে, তুমি ভয় পাওয়ার মানুষ নও। কিন্তু তোমাকে পরিস্থিতিটা জানানো আমার দায়িত্ব। নইলে বলবে, আগে কেন জানাওনি?
-তুমি তোমার দায়িত্ব খুব ভালোভাবে পালন করেছ। আমি ভীষণ খুশি। কিন্তু তুমি আমাকে বলো, আমাকে নিয়ে তুমি বিড়ম্বিত কি না!
-অবাক প্রশ্ন, তোমাকে নিয়ে আমি বিড়ম্বিত হবো কেনো?
-হওয়ার অনেক কারণ। আমি তোমার জীবনের সঙ্গে মাত্র জড়ালাম। আর আজকেই বলছি, আমাকে নিয়ে তোমার পালিয়ে বিয়ে করতে হতে পারে। গ্রামে নিয়ে রাখার দরকার হতে পারে। আমার বাবা গোলাম রব্বানী জাঁদরেল সরকারি আমলা। অনেক ক্ষমতা ভদ্রলোকের। সঙ্গে বারুদের মতো আমার মা আসমা রব্বানী যুক্ত হলে তোমাকে সাত ঘাটের পানি খাওয়াবে। তুমিও বুঝতে পারো আমাকে নিয়ে তোমার সামনের দিনগুলো ভালো যাবে না।
-থামলে কেনো?
-জেলেও যেতে পারো।
ওদের দেখেই বুঝতে পারে শিমুল, এই পাঁচ রুমের মেসে চালু করা পদ্ধতি ওরা প্রয়োগ করতে এসেছে।
শিমুল আহসান চুপ। সামনের দিকে তাকিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেমেয়েদির আসা-যাওয়া দেখে। প্রিয় একজন শিক্ষক, আবুল কাশেম ফজলুল হককে হেঁটে যেতে দেখে। না, অধ্যাপক আবুল কাশেম ফজলুল হক ওর ডিপার্টমেন্টের শিক্ষক নন, তিনি বাংলা বিভাগের অধ্যাপক। ভদ্রলোক খুব অমায়িক। আর গভীরভাবে দেশকে ধারণ করেন। যা সত্য মনে করেন, বলেন নির্দ্বিধায়। প্রচুর গবেষণা করেছেন, সরকারি দলের চাটুকার নন। কোনো সরকারি আনুকূল্য কামনা করেন না। একমাত্র পুত্র দীপন মৌলবাদী ঘাতকের হাতে মারা গেছেন নির্মমভাবে, তিনি বলছেন, আমি বিচার চাই না।
-আমি বিচার চাই না, পুত্র হত্যার…কোন পিতা বলতে পারেন? সেই পিতাই পারেন যিনি সকল নিয়ামক শক্তির ঊর্ধ্বে উঠে যেতে পারেন। শোককে অস্বীকার করতে পারেন, তিনিই তো অধ্যাপক আবুল কাশেম ফজলুল হক। এই সময়ের বাংলার শ্রেষ্ঠ চিন্তক। কিন্ত হাড় সব্বোর্স সমাজের কোথাও তিনি নেই…।
-চুপ করে গেলে কেন? শিমুলের হাতটা নিজের হাতের মধ্যে, দেখো জীবনটা ছোট কিন্তু বিস্তার অনেক গভীর। আজ ভালোবাসার নামে সামান্য আবেগ আর অনুভবের কারণে সর্বনাশের স্রোতে সাঁতারের দরকার নেই। তুমি থাকো তোমার মতো, আমাকে নিয়ে শুরুতেই এত যন্ত্রণায় থাকার দরকার নেই। আমি ঠিকই একটা ব্যবস্থা করে ফেলবো শিমুল।
-তাই? মৃদু হাসে শিমুল আহসান।
-হ্যাঁ। এটাই ভালো তোমার জন্য। কেন তুমি তোমার পরিবার আমাকে নিয়ে একটা হেনস্থার মধ্যে পড়বে? লোকজনে কানাকানি করবে। আমি যেখানেই থাকি, তুমি আমার আত্মার মধ্যে থাকবে, শেষের দিকে বিষণ্ন মমতা আর আবেগের সুর ঝরে মিলি মাহজাবীনের কথায়।
দীর্ঘ একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে শিমুল আহসান, -তোমার বলা শেষ? মিলির হাতটা নিজের হাতে নেয় শিমুল আহমান। মিলির হাতটা মাখনের মতো নরম, সুগঠিত আর পেলব।
-হ্যাঁ, শেষ আপতত। কিন্তু যেখানেই থাকো, যেভাবেই থাকো, আমাকে মনে ভুলে যেও না। -সত্যি, বিশ্বাস করো শিমুল, তুমিই আমার প্রথম পুরুষ, যাকে আমি ভালোবেসেছি। আমার হাত স্পর্শ করতে দিয়েছি। আমি আমার সকল সত্তা দিয়ে তোমাকে অনুভব করি। ভালোবাসি…।
দুজনে চুপচাপ, হাত ধরে বসে আছে বটবৃক্ষের নিচে। দুপুর গড়িয়ে বিকেলে দিকে সময়। মিলি মাহজাবীনের ব্যাগের মোবাইল বাজে। শিমুলের হাত ছেড়ে ব্যাগের মোবাইল তুলে তাকায় স্ক্রিনে, চোখ রাখে শিমুলের দিকে, মায়ের ফোন!
কানে নেয় মিলি, হ্যালো মা?
-তুমি কোথায় মিলি? আসমা রব্বানীর তির্যক গলা।
-আমি ক্যাম্পাসে মা। কেন?
-ক্যাম্পাসে কোথায়? ক্লাসে তো না।
-না, ক্লাস শেষ হয়েছে। আমি ক্যাম্পাসে বন্ধুদের সঙ্গে আছি। মা কী হয়েছে?
-বন্ধু, না একটা ছেলের হাত ধরে কলা ভবনের সামনে বসে আছ?
-মা! তুমি কি আমার পেছনে স্পাই লাগিয়েছ?
-মানে?
-মানে আবার কী? আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে কী করি, কার সঙ্গে বসে আড্ডা দেই…সেটা তুমি জানলে কিভাবে? এটা কি কোনো মায়ের কাজ?
-তুমি আমাকে মায়ের কাজ শেখানে এসো না। বাসায় আসো। ফোন কেটে দেয় আসমা রব্বানী। হাতের নিঃশব্দ মোবাইলটার দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে মিলি মাহজাবীন। ওর বুক ফেটে কান্না আসছে। অনেক চেষ্টায় কান্না দমন করে মিলি স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করে, দেখো মাত্র দেড় দিনের মাথায় আমার জীবনটা কেমন এলোমেলো হয়ে গেলো?
-দায়ী তো আমি। আবার মিলির ডান হাতটা টেনে নিজের হাতে নেয় শিমুল আহসান।
-তুমি দায়ী হবে কেন?
-আমি তোমার জীবনে আসার সঙ্গে সঙ্গেই তো তোমার সুন্দর জীবনটা কেমন ঘোরটোপে বন্দি হয়ে যাচ্ছে মিলি! কিন্ত শোনো, আমি তোমাকে ভালোবাসি। ভালোবাসলে কেবল চুম্বন করেই দায় সারা যায় না, প্রিয় মানুষটির সব দায়ও নিতে হয়। মিলি, তুমি ভয় পেয়ো না। আমি তোমার সঙ্গে আছি, থাকবো। কখনো সরে যাবো না। শুধু একটা আবেদন।
প্রগাঢ় বোধে আক্রান্ত মিলি মাহজাবীন দুটি চোখ তুলে তাকায়, কী?
-আমাকে কখনো দূরে সরিয়া রেখো না। আমার যেটুকু সাধ্য, সেইটুকু নিয়ে তোমার সঙ্গে থাকবো, আমৃত্যু। আজীবন।
-আমিও। চলো, আমার খিদে পেয়েছে। দাঁড়ায় মিলি। সঙ্গে সঙ্গে দাঁড়ায় শিমুলও। শিমুলের হাতটা নিজের হাতে নিয়ে অপরাজয়ের দিকে হাঁটতে শুরু করে মিলি। মিলির হাত থেকে নিজের হাতটা সরিয়ে নিতে চায় শিমুল। মিলি আরও শক্ত করে ধরে, হাতটা টানছো কেন?
-তুমি তো চাও না আমি তোমার হাত ধরে মানুষের সামনে হাঁটি।
-কিন্তু এখন চাই।
-কেন?
-ওরা দেখুক…
-কারা দেখবে?
-যাদের আমার মা গোয়েন্দা বানিয়ে পাঠিয়েছে। ওরা চোখ ভরে দেখুক, ছবি তুলুক। আমার বলার আগে তোমার পরিচায় ওরা জানুক। -চলো…
দুপুরের দিকে নিজের রুমে বসে মোবাইলে টিভির নিউজ দেখছে শিমুল আহসান। রুমমেট রাতুল গেছে মৌরির সঙ্গে টাংকি মারতে। আধবোঝা দরজাটা খুলে যায়, মোবাইল রেখে তাকায় দরজার দিকে। দরজা পার হয়ে ঢোকে মিলি মাহজাবীন। ওকে দেখে আধশোয়া থেকে দাঁড়ায় শিমুল। সারা মুখে এক ধরনের অপ্রস্তুত অপরাধ মেখে রুমের মাঝখানে মিলি। এগিয়ে এসে সামনে দাঁড়ায় শিমুল।
-শিমুল আমি চলে এসেছি। আজ রাজ রাতে ওরা আসাবে আমাকে আংটি পরাতে। আমি শুধু আমাকে নিয়ে তোমার কাছে চলে এসেছি। আমার আর কিচ্ছু নাই।
জড়িয়ে ধরে শিমুল, তুমিই তো আমার সব। আর কী চাই?
-সত্যি বলছ?
বুকের ওপর থেকে সরিয়ে মিলির চোখে চোখ রাখে, সত্যি বলছি। বসো। দুজনে বসে খাটে। শিমুল আহসান মোবাইল হাতে ফোন দেয় রাতুলকে। মোবাইল বেজে বেজে থেমে যায়। আবার ফোন দেয়, এবারও বেজে থেমে যায়। চিন্তিত শিমুল।
-কী করছ?
-রাতুলকে ফোন দিচ্ছি কিন্তু রিসিভ করছে না।
সঙ্গে সঙ্গে রাতুলের ফোন। কানে নেয়ই শোনে রাতুলের খিস্তি, শালা আবসুল, একটু প্রেম করবো তাও পারবো না তোর মতো ইতরপ্রাণীদের জন্য? কেন ফোন দিয়েছিস?
-রাতুল, মিলি চলে এসেছে।
-কোথায় চলে এসেছে?
-আমাদের মেসে।
-কী চায়?
-তুই জানোস না?
-আচ্ছা, আসতেছি।
-আয়।
মোবাইল রেখে তাকায় মিলির দিকে। মিলি উঠে দরজা বন্ধ করে এসে আবার জড়িয়ে ধরে ওর মুখটা রাখে শিমুলের বুকের ওপর, আমাকে অপমান করবে না তো?
-ওর মাথার চুলে হাত বোলায় শিমুল, না। -কখনো না।
-আমাকে মারবে না তো?
-কী পাগলের প্রলাপ বকছো মিলি? কেন তোমাকে মারবো? মারার প্রশ্ন আসছে কেন?
-আমাকে এমন করে রাখবে তো?
-চিরকাল রাখবো।
দরজায় খট খট শব্দ।
দুজনে চমকে ওঠে! কে আসতে পারে? রুমে তো দুজন, শিমুল আর রাতুল। তিনতলা জুড়ে পাঁচটা রুম। মাঝারি কিন্তু রেলিংঘেরা মাঝারি আকারের বারান্দাটা ওদের বাড়তি পাওনা। কারণ, এই মেসটা বানিয়েছে রাতুল। বাড়িঅলা থাকে অস্ট্রেলিয়ায়। সাত তলা বাড়ির ম্যানেজার বাড়িঅলার শ্যালক পিন্টু সমাদ্দার। কিন্তু ভাবখানা লোকটার প্রাচীনকালের সম্রাট। শুরুতে মেস ভাড়া দিতে চায়নি। কিন্তু মোবাইলে বাড়িঅলার সঙ্গে কথা বলে রাজি করিয়েছে রাতুল। প্রায়ই বাড়িঅলা জয়নুল হোসেনের সঙ্গে আলাপ করে ও। এখন শ্যালক পিনটু সমাদ্দারের চেয়ে জয়নুল অনেক বেশি নির্ভর করে রাতুলের ওপর, বাড়ির খোঁজ খবর বিষয়ে। সুতরাং মেসের কেইু ঘাটাতে চাইবে না।
আবার খট খট।
মিলি মাহজাবীনকে ছেড়ে দেয় বুকের ওপর থেকে শিমুল, তুমি বসো। আমি দেখছি।
খাটের ওপর বসতে বসতে বলে মিলি, আমার ভয় করছে।
-ভয়ের কিছু নেই। তুমি চুপচাপ বসো, আমি দেখছি।
শিমুল দরজা খুললে পাশের রুমের অজিত রায়, মোহসীন আহমেদ হাসিমুখে সামনে দাঁড়ানো। হাতে প্লেট। প্লেটে তন্দুরী রুটি আর ভুনা মাংস গুরুর। পাশে সাজানো বোরহানির দুটি বোতল, সস আর টিস্যু। অজিত দুপায়ের আঙুলের ওপর করে শিমুলের কাঁধের ওপর থেকে তাকায় ভেতরে। এক পলক দেখে মিলি মাহাচাজীনকে। ওদের দেখেই বুঝতে পারে শিমুল, এই পাঁচ রুমের মেসে চালু করা পদ্ধতি ওরা প্রয়োগ করতে এসেছে।
মেসের নাম কৃষ্ণমেস। বাইরের কেউ এমনকি অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী মালিক জয়নুল হোসেনও জানে না। জানবে কী করে? কেউ তো জানায়নি ভদ্রলোককে। পাঁচ রুমের একুশ বাইশজন তরুণ থাকে। প্রায় প্রত্যেকেরই প্রেমিকার সঙ্গে সময় যাপন করে ওরা। কোনো প্রেমিকা রুমে এলে রুমের সবাই বাইরে যায় আর ঘণ্টার পর ঘন্টা খাবার সাল্পাই দিতে থাকে। সেই সঙ্গে টুকরো টুকরো খুচরা খুনসুটি চলতে থাকে। শিমুলের কাঁধের ওপর দিয়ে অজয় রায় রুমের ভেতরে তাকালেও মিলির মুখ দেখতে পারে না। মিলি বিপরীতে তাকিয়ে পাশের বাড়ির দেয়ালে এক জোড়া শালিক দেখছে। একে অন্যের চঞ্চুতে চঞ্চু মিলিয়ে কিচির মিচির করে ডানা ঝাপটিয়ে দুজন দুজনকে একটা কিছু বলছে।
-শিমুল ভাই, দেখতে পারছি না। কিন্তু মনে হইতেছে ঝাক্কাস জিনিস ভাগাইছেন। রুমে আইসেন, পায়ের ধুলা লইয়া মাথায় দিুম। যদি আমার কপালে।
-যাও। বদের হাড্ডি। হালকা ধমক দেয় শিমুল।
তেতত্রিশ পাটি দাঁত বের করে হাসতে হাসতে ওরা চলে যায়। শিমুল দরজা বন্ধ করে খাবারের থালা এনে রাখে খাটের ওপর, মিলির সামনে।
-দেখো তো ওদের কাণ্ড!
-কী করেছে ওরা?
-তোমাকে আমার রুমে দেখে ওরা, মানে পাশের রুমের বন্ধুরা খারার নিয়ে এসেছে।
ওরা খুব ভালো কাজ করেছে। কারণ, আমার ভীষণ ভীষণ খিদে পেয়েছে। গত রাত থেকে আমার পেটে কিছু পড়েনি।
-বলো কী! সামনে বসে অবাক তাকায় শিমুল। -গত রাত থেকে কিছু খাওনি?
মিলির মুখের দিকে বুভুক্ষু দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে শিমুল, মিলি এত সুন্দর!
শিমুলের দিকে একবার তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নেয় অন্যদিকে। রুটির সঙ্গে মাংস জড়িয়ে ওকে খাওয়াতে মিলির মুখের কাছে নিয়ে যায়, মিলি মুখ ফিরিয়ে দেখে, মুখের সামনে খাবারসহ শিমুলের হাত। একান্ত বাধ্যগত শিশুর মতো মুখ খোলে মিলি। হাতের খাবারটা ওর মুখের মধ্যে ঢুকিয়ে দেয় আলতো করে। শিমুলের হাতের আঙুলের সঙ্গে হালকা স্পর্শ লাগে মিলির সাদা ঝকঝকে সাদা কস্তুরী দাঁতের। মিলি চিবুতে শুরু করে, ওর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে শিমুল।
মুখের খাবার চিবুতে চিবুতে দুচোখে পানি নামে মিলির। অবাক দৃশ্য, মিলি খাচ্ছে, মিলি নিঃশব্দে কাঁদছে। বিস্মিত শিমুল খাবার প্লেটটা সরিয়ে ওর কাছে যায়। মুখটা দুহাতে ধরে কাছে আনে, কী হয়েছে? কাঁদছ কেনো?
-জানি না, ওড়নায় মুখ মুছে মুখের ভেতরের খাবার শেষ করে মিলি, পানি দাও।
টেবিলের ওপর পানির জগ আর গ্লাস রাখাই ছিল। জগ থেকে পানি গ্লাসে ঢেলে মিলির হাতে দেয় শিমুল। একটানে পুরোটা পানি খেয়ে আবার গ্লাটাটা ফিরিয়ে দেয় শিমুলের হাতে। শিমুল গ্লাসটা টেবিলের ওপর রেখে আবার বসে খাটে। প্লেট থেকে রুটি আর মাংস ছিঁড়ে মিলির মুখের কাছে নেয়, মিলি মুখে নিয়ে চিবোয় আর অন্যরকম দৃষ্টিতে তাকায় শিমুলের দিকে।
হাসে শিমুল আহসান, কী হয়েছে? তাকিয়ে আছ কেন?
-তুমি খুব ভালো! হৃদয়ের অতল থেকে এমন করুণ ভালোবাসার সঙ্গে বলে মিলি মাহজাবীন, বুকটা ভেঙে যায় শিমুলের। বুঝতে পারে শিমুল, নগরের কন্যা, জৌলুশে বড় হয়েছে কিন্তু নিবিড় পারিবারিক স্নেহ মমতা পায়নি। ফলে, একটু স্নেহ ভালোবাসায় কাতর হয়ে পড়ে।
-একটা কথা…
-বলো, রুটির সঙ্গে মাংস মাখাতে মাখাতে বলে শিমুল।
-আমাকে সারাজীবন এমন করে ভালোবাসবে তো?
-তোমার সন্দেহ যায় না কেন? বলছি তো চিরকাল এমন করে ভালোবাসবো তোমায়।
-ভালো না বাসলে…থেমে যায় মিলি মাহজাবীন।
-ভালো না বাসলে!দুহাতে গলা ধরে সাঁড়াসির ঢংয়ে, তোমাকে এভাবে গলা টিপে মেরে ফেলবো।
হাসে শিমুল, মেরে ফেললে ভালোবাসবে কে?
-সে জন্যই তো মারবো না। কেবল ভয় দেখাবো। এখন ছাড়ো, আমি খাই। শিমুলের হাত থেকে প্লেটটা নিজের কাছে নিয়ে রুটিতে মাংস লাগিয়ে হাত বাড়ায় শিমুলের মুখের দিকে, নাও।
-আমিও খাবো?
-মাথা নাড়ায় মিলি, জি খাবে।
শিমুল হা করে। ওর মুখের মধ্যে খাবার দেয় মিলি। খাবার ঢুকিয়ে হাত বের করার সময়ে আলতো কামড় দেওয়ার চেষ্টা করে।
-কপট রাগ দেখায় মিলি, রাক্ষস।
খুনসুটির মধ্যে খাবার শেষ হলে মিলি আড়মোড়া ভেঙে প্রশ্ন করে, এখানে ভয় নেই তো?
-কিসের ভয়?
-কেউ তো ডিসটার্ব করবে না?
একদম না। শিমুল পাশে বসে বুকের সঙ্গে জড়িয়ে নেয় মিলিকে, তুমি এখানে নিশ্চিন্তে থাকতে পারো। এই বিল্ডিংয়ের পাঁচতলায় পাঁচটা রুমে আমার একুশজন ছেলে থাকি। প্রায় প্রত্যেকের প্রেমিকা আসে। বলা লাগে না, সবাই পাহারা দিয়ে রাখে।
-বাহ, নিরাপদ প্রেমকানন!
-ভালো নাম দিয়েছ।
-আমি একটু শুই তোমাদের প্রেমকাননে। বিছানার ওপর শুয়ে পড়ে মিলি মাহজাবীন।
সঙ্গে সঙ্গে শিমুল মাথার নিচে বালিশটা দিয়ে, পা দুটো তুলে দেয় বিছনার ওপর। ফ্যানের গতিটা একটু বাড়িয়ে দিয়ে পাশে বসে তাকায় ওর মুখের দিকে। মিলি নির্নিমেষ ওর মখের দিকে তাকিয়ে আছে। চোখে চোখ পড়তেই দৃষ্টি ফিরিয়ে শিমুলের হাত ধরে হ্যাচকা টান মানে নিজের দিকে। শিমুল আছড়ে পড়ে মিলির বুকের ওপর, চোখে চোখ রাখে দুজনে। আমার ভীষণ ভয় হচ্ছে শিমুল।
দুহাতে সাপটে ধরে শিমুল আহসান, কিসের ভয়?
তুমি ভয়ানক বিপদে পড়তে যাচ্ছ আমার জন্য।
বলছি তো, আমি প্রস্তুত। হয়তো আমার শক্তি কম, খুব নগণ্য কিন্তু আমি লড়ে যাবো তোমার জন্য।
শিমুলের কপালে আলতো চুমু দেয় মিলি, লক্ষ্মী ছেলে। এবার চুপচাপ বসে বসে আমাকে পাহারা দাও। আমি ঘুমাই। শিমুলকে ছেড়ে ওর দিকে পাশ ফিরে সত্যি সত্যি চোখ বোঝে মিলি। মিলির মুখের দিকে বুভুক্ষু দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে শিমুল, মিলি এত সুন্দর!
চলবে…
মোকাম সদরঘাট-১১॥ মনি হায়দার