[পর্ব—২৪]
মুক্তিযুদ্ধ ও মিয়াবাড়ির দিনকাল
বাইরের বাড়িতে পৃথকভাবে নির্মিত বৈঠকখানাকে আমরা বলতাম বাংলা ঘর। আব্বার তারুণ্যের সময়ে তিনি মনের মাধুরী মিশিয়ে সাজিয়েছিলেন গ্রামের ভেতরে এক নাগরিক ও জমিদারি স্টাইলের ওই বৈঠকখানা। তিনটি হরিণের মুণ্ডুসমেত শিং। বিশাল আকারের মহিষের সুডৌল কালো একটা মুণ্ডুসহ শিং ঘরের পশ্চিম দেয়ালের মধ্যবর্তী জায়গায় লোহার এঙ্গেলে বসানো ছিল। ঢাল-তলোয়ার দুই সেট, দেয়ালেই ঝোলানো থাকতো। তিন সেট সোফার মতো চেয়ার কোচ দিয়ে বসার ব্যবস্থা ছিল।
সন্ধ্যার সময় দুটো হ্যাজাক জ্বালিয়ে বাংলাঘরের দুই পাশে রাখা হতো। উজ্জ্বল আলোয় ভরে যেতো ঘরখানা। আব্বার বসার চেয়ার ও তার কারুকার্যময় গুড়গুড়ি হুকা রাখার একটা আলাদা জায়গা ছিল। গ্রামের বাসিন্দারা বিভিন্ন অভাব-অভিযোগ ও বিচার শালিস নিয়ে আব্বার কাছে আসতো। আব্বা তখন বাংলাঘরে গিয়ে বসতেন তাদের নিয়ে। বিচার শালিসের সমাধান দিতে দিতে রাখালেরা ভেতরবাড়ি থেকে চা-মুড়ি-বিস্কুট পরিবেশন করতো বার চারেক অন্তত।
বাংলাঘরে উপস্থিত গ্রামবাসীর সবাইকে নিয়ে আব্বা খাওয়াতে খুব পছন্দ করতেন। খাবারের পরিমাণ যাই হোক, আব্বা তা সবাইকে নিয়ে ভাগ করে খেতে খুব ভালোবাসতেন। একবার খুব ঘন করে জ্বাল দেওয়া এক বাটি খিরসা-দুধ মা পাঠিয়েছিলেন বাংলাঘরে শুধু আব্বার জন্যে। ততক্ষণে বাংলাঘরের অতিথি সবাই চলে গেছে। আব্বা রেগে-মেগে সেই ঘনদুধের খিরসা দুধ আর খেলেনই না, বাটিসহ দুধ ছুড়ে ফেলে দিলেন নিচে। আমার মায়ের ওপর আব্বার অভিমান, ঘন দুধের পরিমাণ যাই হোক না কেন, গ্রামবাসীর উপস্থিতিতে কেন পাঠালেন না? একা খাওয়ায় কি সুখ আছে? ছোট বেলায় দেখতাম বাড়িতে বড় কোনো মাছ কিংবা যেকোনো ভালো রান্না হলে আব্বা কেবল মেহমান খুঁজতেন আর বলতেন, আহা, যদি কোনো মেহমান আসতো খুব ভালো হতো।
এছাড়া, আমার বড় চাচার ছেলে সিরাজভাই, ছোট চাচার ছেলে রেজা ভাই, কালু, প্রিয় নাতি সিরাজ ভাইয়ের দুই ছেলে রুনু ও পলকে সব সময় খাবার আগে ডেকে নিয়ে পাটিতে বসে খেতেন আব্বা। সেই সময় সেলিম ছোট হলেও বসতো আব্বার পাশে। এই পঙ্ক্তিভোজনে আব্বা আমাকে কখনো ডাকেননি। গুড়াকাল থেকে ওই দৃশ্য দেখে বুঝে গেলাম, আমি যে, মেয়ে! আমাকে মায়ের সঙ্গে পরে বসতে হবে। কিন্তু যুদ্ধের সময় আমি বেশ বড়। এখন আমার অনেক দায়িত্ব পরিবারের মধ্যে দিয়েই দেশের কাজে একটু-একটু করে যুক্ত হচ্ছি দিনে দিনে।
বর্তমান যুদ্ধের সময়, অতীতের খাবার দাবারের ব্যবস্থা অনেক পাল্টে গেছে। প্রত্যেকের বাড়িতেই বেসুমার অতিথি। খাদ্য এখন জীবন বাঁচানোর উপকরণ, রসনার কোনো সুযোগ নেই।
সাত মার্চের ভাষণের পর পরেই বড়’পা চার ছেলে সন্তান নিয়ে স্বামীসহ এসে উঠেছেন বাবার বাড়িতে। ওদিকে জাবরা গ্রাম অনিরাপদ ভেবে আমার মামি, মামাতো বোনেরাও এসেছেন। দর্শনা থেকে নজির ভাই মাজেদা ভাবীকে নিয়ে এসেছেন আমাদের বাড়িতে।(নজিরভাই ছিলেন আমার বড় মায়ের পালিতপুত্র, দর্শনায় একটা ব্যাংকে চাকরিরত ছিলেন তিনি সেই সময়ে) রাখাল-চাকরসহ প্রতিবেলা ২৪/২৫ জনের রান্না এবং খাবার দাবারের ব্যবস্থা করতে হয় মা ও আব্বাকে। গোলায় জমির ধান আছে বিস্তর, কিন্তু সিদ্ধ শুকনা করে ঢেঁকিতে চাল তৈরি করতেও অনেক সময় যায়। ততক্ষণে হয়তো দুই ব্যাচ খাওয়া শেষ করেছে তিন ব্যাচ বসার আগেই ভাত শেষ। এরকম ২/৩ দিন হয়েছে আমাদের বাড়িতে।
ততক্ষণে আমার ছোট চাচির রাখাল আর্জন এবং সিরাজ ভাইয়ের রাখাল গর্জনের সঙ্গে সেলিমও গ্রামের দক্ষিণ ডাউলির দিকে এগিয়ে গেছে, প্রকৃত খবর জানতে। সিরাজ ভাই ভেতর বাড়ি আর বাইরের বাড়ির মধ্যে পায়চারী করছেন।
টুলির মা আজাহারের মা দু’জনে মিলে ঢেঁকিতে নতুন করেচাল করে এনে চুলায় বসিয়ে দিয়েছে বটে, কিন্তু ভাত হতে হতে হয়তো ঘণ্টা খানেক বসে অপেক্ষা করতে হয়। বড়দের জন্যে সেটি কোনো সমস্যা নয়। কিন্তু শিশুরা তো এমনি ক্ষুধায় কাতর, তখন যদি বোঝে ভাত রান্না হলে তবে খেতে দেবে মায়ে বা নানিতে, তখন যে তারা আতঙ্কিত হয়ে পড়ে, তা বুঝতে পেরেছিলাম বড়’পার বড় ছেলে ডিটোর কথায়।
একদিন দুপুরে খাওয়ার আগে বড়’পা কুয়ার পারে ডিটোকে ধরে নিয়ে ঘষে মেজে গোসল করাচ্ছেন। সারাবেলা এদিক ওদিক ঘুরে বেড়ায়, জল কাদায় একাকার। ডিটোর বয়স তখন ৮/৯-এর মতো হবে হয়তো। আপা যতই সময় নিয়ে তার হাত-পা পরিষ্কার করতে চাইছেন। ডিটোর কেবলি ছটফটানি বেড়ে যাচ্ছে। বাধ্য হয়ে মাকে বলছে, তাড়াতাড়ি কর মা, আমারে ছাইড়া দে, ভাত তো ফুরাইয়া যাইবো। বহুদিন ডিটোর এই কথা আমাদের বাড়ির সবার মুখে মুখে ফিরেছে। ভাতের টান পড়তে দেখলেই বলে উঠতো, তাড়াতাড়ি ছাইড়া দে মা, ভাত তো ফুরাইয়া যাইবো।
ডিটোর বাবা আমাদের বড় দুলাভাই মাঝে মধ্যে একসঙ্গে ৮/১০টি ইলিশ মাছ, দুধ ও প্রচুর শাক-সবজি কিনে আনতেন। তিনি মাংস খেতেন না বলে নানা পদের মাছ ও ডিম ছিল তার সারা জীবনের প্রোটিনের উৎস। এজন্যে মাছের প্রতি তার ঝোঁক ছিল খুব।
মুক্তিযুদ্ধের সেই সময়ে দেড় টাকা দুই টাকার মধ্যে দেড়/দুই কেজির বড় ইলিশ পাওয়া যেতো। বাড়িতে ফ্রিজ নেই, ইলিশ মাছের ভাজা, রান্না এমনকী আস্ত মাছ সেদ্ধ করে কাঁটা ছাড়িয়ে ঝুরি করতেন মা। একটা সময় ইলিশ মাছ খেতে অরুচি শুরু হলো আমাদের। চতুর্দিকে শোনা যাচ্ছিল যে, অগণিত লাশ নদী-নালা-সমুদ্রেও ভাসছে। এইসব লাশ তো মাছেরাও খায়, কাজেই মাছ খেতেও কেমন যেন অরুচি হতো। মনে হতো মাছের মাধ্যমে আমিও কি তাহলে স্বজনের লাশে আহার করছি?
আব্বা সেই সময়ে কয়েকদিনের জন্যে ঢাকায় গেলেন। আব্বার দীর্ঘদিনের ক্লাইন্ট উজালা ম্যাস ফ্যাক্টরির কাছে প্রেসের অনেক বিল বকেয়া পড়ে আছে, যদি কিছু পাওয়া যায়, সেই আশায় জীবনের মায়া অনেকটা অগ্রাহ্য করেই গেছেন তিনি। আশ্রয়প্রার্থী নিকট অতিথিসহ বাড়িতে এতগুলো মুখে খাবার তুলে দিতে হয়, সেই চিন্তাই প্রধান হয়ে উঠেছে। কত কত দিন চলবে, এমন অবস্থা তাও তো আঁচ করা যাচ্ছে না।
মে-জুন মাসের দিকে, বাড়ির চিরদিকে থৈ থৈ পানি। হঠাৎ করেই আমাদের গ্রামের মধ্যে প্রচণ্ড গোলাগুলির শব্দ। আমাদের নির্জন এই গ্রামে কি পাক বাহিনীও ঢুকে পড়লো শেষাবধি? কিন্তু সঠিক তথ্য কে দেবে, সবাই তো যার যার মতো জীবনহাতে নিয়ে বাড়ির পেছনের দরোজা দিয়ে পালাবার কথা ভাবছে। অতশত ভাবার সময় নেই যে হাতে। মা আমাকে আর ছোটবোন রানুকে বাড়ির পেছনে উত্তর দিকে আমাদের পাটক্ষেতে গলা ডুবিয়ে থাকতে বললেন। আমার আড়াই-তিন বছরের ছোটভাই শীতলকে আমি কোলে নিয়ে দাঁড়ালাম, রানু আমার কোমর ধরে দাঁড়িয়ে থাকলো পাশে। মা তার কাঁসা ও পেতলের যতো তৈজষপত্র আছে ৩/৪টা চটের বস্তায় সেগুলো ভরে মুখ বেঁধে আজাহারের হাতে দিলেন আমাদের পেছন বাড়ির পুকুরে ডুবিয়ে দিতে। লুটপাট হওয়ার ভয়ে মা ঘরের দরোজার খিল বন্ধ করে বসে থাকলেন। পাঁচজন রাখাল বাইরের বাড়িতে লাঠি-বল্লমবাড়িতে যা কিছু আছে তা দিয়ে প্রতিরোধের জন্যে শক্তভাবে দাঁড়িয়েছিল। ঘণ্টাখানেক গুলির শব্দ শুনেই যাচ্ছি, ঠাণ্ডায় রানু কাঁপছে, শীতলের পাদুটো পানির মধ্যে ডুবে আছে। ওকে ঠাণ্ডা থেকে বাঁচাতে মাঝে-মধ্যে আমার কাঁধে তুলছি, বেশিক্ষণ রাখতে না পেরে নামিয়ে আবার কাঁখে নিচ্ছি। কিন্তু গ্রামে কোনো পাকি সদস্যের দেখা নেই। ততক্ষণে আমার ছোট চাচির রাখাল আর্জন এবং সিরাজ ভাইয়ের রাখাল গর্জনের সঙ্গে সেলিমও গ্রামের দক্ষিণ ডাউলির দিকে এগিয়ে গেছে, প্রকৃত খবর জানতে। সিরাজ ভাই ভেতর বাড়ি আর বাইরের বাড়ির মধ্যে পায়চারী করছেন।
দুই.
ঘণ্টা দুয়েক পরে ভয়ানক এক খবর নিয়ে ফিরলো রাখালেরা। কিছুদিন থেকে শুনছিলাম, আমাদের গ্রামের পুব দিকের পাড়া ডাউলিতে খুব গরিব ঘরের ৪/৫ জন যুবক নাকি ডাকাতির সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েছে। তারা পাশাপাশি অন্যান্য গ্রামে ডাকাতি করে আসছিল। কিন্তু প্রচার হচ্ছিল মুক্তিযোদ্ধারাই লুটলাট করছে সুযোগ বুঝে। এই সংবাদ যখন মুক্তিবাহিনীর কাছে চলে যায়, তখন দেশব্যাপী মুক্তিযোদ্ধাদের ভাবমূর্তি রক্ষা করতেই মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারের নির্দেশেই এই অপারেশন চালিয়েছিল মুক্তিযোদ্ধাদের ১০/১২ জনের একটি ইউনিট। খবর পেয়ে প্রথমে ডাকাতদের বাড়ি ঘিরে ফেলেছিল, পরে বাড়ি সংলগ্ন ডোবাপুকুরে ঝাঁপিয়ে পড়লে সেখানেই গুলি করে হ্ত্যা করে দু’জনকে, বাকি দু’জনকেও সেদিনই শেষ করে মুক্তিযোদ্ধারা আমাদের এলাকা ছেড়ে যায়। গড়পাড়া গ্রামে মুক্তিযোদ্ধা আছে, এই খবর রটে গেলে যেকোনো সময় আমাদের গ্রামখানি আর ছবির মতো থাকবে না, তছনছ করে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে, হত্যাযজ্ঞে রক্তাক্ত করবে পাকবাহিনী—এমত আশঙ্কায় পুরো গ্রামে নিস্তব্ধতা নেমে এলো।
তিন-চারদিন মায়ের সঙ্গে থেকে হাসপাতালে থাকলাম, এরপরে হাসপাতাল থেকে ছুটি হলে আব্বার বন্ধু কাম ম্যানেজার শামসুদ্দিন কাকার বাসায় এলেন মা। সেখানে আরও তিন দিন বিশ্রাম নিয়ে একটা অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করে আব্বাসহ বাড়িতে এলাম আমরা।
উদ্ভূত পরিস্থিতি বিবেচনা করে আমাদের মা পানি থেকে ডেকে তুলে নিয়ে ঘণ্টা খানেকের মধ্যে ছোট ভাই শীতলকেসহ আমাদের দুই বোনকে নৌকা ভাড়া করে আরও দূর গ্রাম কেরানীগঞ্জে নজির ভাইয়ের শ্বশুর বাড়ি পাঠিয়ে দিলেন। সপ্তাহ খানেক থাকার পরে মা আবার নৌকা পাঠিয়ে বাড়িতে ফিরিয়ে আনলেন।
এরমধ্যে বড়’পার মেজো ছেলে লিটন হারিয়ে গেলো একদিন। আশেপাশে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না তাকে। ব’ড়পা তো কান্নাকাটি শুরু করে দিলেন, পঞ্চমবারের মতো গর্ভবতী মা তিনি। আমার মা বাড়ির তিন শরিকের রাখাল-চাকর ডেকে যতজনকে পেলেন সবাইকে বিভিন্ন দিকে পাঠালেন নাতিকে খুঁজতে। একেকদিকে ছুটে গেলো একেকজন। এদিকে দুলাভাই নেই দেশে, সে এক চিন্তা। কিছুদিন আগেই তিনি বর্ডার পার হয়ে কলকাতা চলে গেছেন। একদা সিরাজগঞ্জ কলেজ-জীবনের সহপাঠী বন্ধু পূরবীর কলকাতার বাসায় উঠেছেন, সেখান থেকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করছেন তিনি। কাজেই তার পরিবারকে রেখে গেছেন আমার মায়ের হেফাজতে। মা নিজেও উদ্ভ্রান্তের মতো এদিক-ওদিক ছুটছেন।
এরমধ্যে আমাদের রাখাল আজাহার লিটনকে কোলে নিয়ে আমার মায়ের কাছে দিলো। শহরে বাস করা শিশু এরা। গ্রামের পথ ধরে একাই হাঁটতে হাঁটতে এক সময় পথ হারিয়ে ফেলেছে। নানাবাড়ি খুঁজে না পেয়ে পথের মধ্যে দাঁড়িয়ে কান্না শুরু। আর যায় কোথা!গ্রামে যা হয়, হারানো শিশুকে ঘিরে জটলা বাড়তে বাড়তে অনেক বড় হয়েছে। কারবাড়ির মেহমান সে, তার নাম-ধাম পরিচয় কিছু বলতে পারছে না। এখন উপায় কী?
নানা রকম প্রশ্নের উত্তরে কেবল বলতে পেরেছে, আমার নানাবাড়িতে অনেক বড় একটা ষাঁড় গরু আছে। এবার গরুর লড়াইতে ফার্স্ট হয়েছে। রাখাল আজাহারই সখের বশে প্রতি বছর ষাঁড় গরু প্রস্তুত করতো লড়াইয়ের জন্যে। আমাদের এলাকার বৈকণ্ঠপুরের মাঠে পৌষসংক্রান্তির দিন ষাঁড়ের লড়াই হতো, প্রতিবছর আমাদের বাড়ির গরু নিয়ে আজাহার ষাঁড়ের লড়াইতে নিয়মিত অংশ নিতো। কোন বছর কোন বাড়ির গরু লড়াইতে ফার্স্ট হলো, মুখে মুখে তা রটে যেতো প্রত্যেক বাড়ির দেঁউড়ি বেড়া অবধি। কাজেই কারও চিনতে অসুবিধা হয়নি যে, এই শিশু নিশ্চয় মিয়া সাবের নাতি।
তাদেরই মধ্যে থেকে দুই-তিন জন লিটনকে কোলে নিয়ে আমাদের বাড়ির দিকে আসছিল, পথিমধ্যে আজাহার তাকে পেয়ে নিজেই কোলে তুলে নিয়ে এসেছে। কেরানীগঞ্জ থেকে ফিরে এসে আমাদের রান্ধন ঘরের পেছনে জামতলায় আমি সেলিম আর রানু মিলে একটা বাংকার খুঁড়ছি কয়েকদিন থেকে। আমাদের অন্য সহায়তাকারী বড়’পার বড় ছেলে ডিটো। কোদাল, শাবল দিয়ে কিছুটা খোঁড়ার পরে ডিটো দা দিয়ে সেই মাটি সমান পলিশ করে চলেছে। গর্তের ভেতর থেকে আমি মাটি ওপরে তুলছি। এক ফাঁকে সে আমার তর্জনি ওপরের ভাগে বাম হাতের পাতায় দা চালিয়ে দিলো, বেচারা না দেখে। রক্তে ভেসে গেলো হাত। মা তার পুরনো নরম কাপড় ছিঁড়ে হাতব্যান্ডেজ করে দিলো। আপাতত পরিখা খননের কাজ বন্ধ হয়ে গেলো। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের সেই স্মৃতি চিহ্ন জ্বলজ্বল করে আজো ফুটে আছে আমার বাম হাতের উপরিভাগের পাতায়।
এই সময়ে কালিহাতী থেকে পুলিশ খালা-খালু আমাদের বাড়িতে উঠেছেন, একটা সময় পর্যন্ত খালুজান চাকরি রক্ষার্থে থানায় ডিউটি করেছেন, কিন্তু কালিহাতীতে কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনী শক্তি সঞ্চয় করার পরে খালুজানসহ আরও কয়েকজন পুলিশ সদস্য তাদের রাইফেল মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে সমর্পণ করেন, খালুজান বড়’মাকে নিয়ে প্রায় এক কাপড়ে পালিয়ে চলে আসেন আমাদের বাড়িতে। এরমধ্যে মায়ের শরীর খুব খারাপ, সম্ভবত তার একটা অ্যাবরশন হয়েছে, কিন্তু রক্তপাত কিছুতেই থামছে না। প্রচুর রক্তক্ষরণে মায়ের চেহারা একটা হলুদ পাখির মতো হয়ে গেলো। মাথা ঘুরিয়ে পড়ে গিয়ে একদিন জ্ঞান হারালেন তিনি। অবস্থা বেগতিক দেখে খালুজান মাকে ঢাকার নেওয়ার ব্যবস্থা করলেন।
আমাদের বাড়ি থেকে মানিকগঞ্জ পর্যন্ত যেতে কোনো গাড়ি-ঘোড়ার ব্যবস্থা নেই। অগত্যা বীড়ির চারজন রাখাল সাইঙে (স্ট্রেচার মতো, কাঠ বা বাঁশ দিয়ে তৈরি) করে বিশেষ ব্যবস্থায় মানিকগঞ্জ নিয়ে অ্যাম্বুলেন্সে ঢাকায় নিয়ে গেলেন, বাড়িতে ছোট ভাই-বোন সবাইকে দেখার দায়িত্ব আমার ওপর পড়লো। এই সময়ে বড়’পা মাসখানেকের জন্যে তার শ্বশুরবাড়ি গয়হাটা গেলেন। ডেলিভারির আগ দিয়ে আপার বাবার বাড়ি আসবেন, এমনই একটা পরিকল্পনা রয়েছে তার।
আব্বা আগেই মিডফোর্ড হাসপাতালে অপেক্ষা করছিলেন, মাকে ভর্তি করে দিয়ে খালুজান বাড়ি চলে এলেন, যেহেতু আমরা তখন অভিভাবক শূন্য প্রায়। সপ্তাহখানেক মায়ের কোনো খবর না পেয়ে আমি ঢাকায় যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। খালুজানও বললেন, তোমার মায়ের সেবার জন্যে তোমার যাওয়াই দরকার। উস্তর বয়সের মেয়ে পাক-বাহিনীর চোখ এড়াতে খালাম্মার বোরকা পরে মানিকগঞ্জ পর্যন্ত হেঁটে গিয়ে মানিকগঞ্জ টু ঢাকার একটা বাসে চাপলাম। ভয়ে কাঁচুমাচু সারা পথে, দোয়া ইউনুস জপতে জপতে পৌঁছে গেলাম মিডফোর্ড হাসপাতালের গাইনি বিভাগে।
খালুজানের কাছ থেকে বেড নম্বর নিয়ে এসেছিলাম। কাজেই খুঁজে পেতে বেগ পেতে হলে না। মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে আমি হতভম্ভ; দেখি, আরও কাঁচা হলুদের মতো রঙ হয়েছে তার। ভাগ্যিস সেইসময় তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্তে মাকে হাসপাতালে আনা হয়েছিল, নইলে বাঁচানো সম্ভব হতো না। তিন-চারদিন মায়ের সঙ্গে থেকে হাসপাতালে থাকলাম, এরপরে হাসপাতাল থেকে ছুটি হলে আব্বার বন্ধু কাম ম্যানেজার শামসুদ্দিন কাকার বাসায় এলেন মা। সেখানে আরও তিন দিন বিশ্রাম নিয়ে একটা অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করে আব্বাসহ বাড়িতে এলাম আমরা।
চলছে…
বালিকার চরৈবেতি-২৩॥ দিলারা হাফিজ