[পর্ব-২০]
‘দূরে কোথাও দূরে-দূরে/ আমার মন বেড়ায় গো ঘুরে ঘুরে’
কথা বলার শৈলিতেও যে ব্যক্তিবিশেষের আলাদা এক সৌন্দর্য থাকে, সে কথা প্রথম শুনেছিলাম ননী ভাইয়ের মুখে। ১৯৭০ সালের ডিসেম্বরের এক নাস্তার সকাল। মা আমার মাটির খোলা থেকে এক এক করে নামিয়ে দিচ্ছেন গরম চিতই পিঠা। মুরগির পাতলা ঝোলের সঙ্গে অসাধারণ রসনার মিশ্রণ। সেলিম, রানু ছাড়াও অতিথি আজ ননী ভাই, সকালেই নতুনবস্তী গ্রাম থেকে দুই মাইল হেঁটে বেড়াতে এসেছেন। কলেজে শীতকালীন ছুটি, তাই, ফুপুর বাড়ি।
সবাই চুলার পারে পিঁড়ি অথবা একটু উঁচু টুলে বসে খাচ্ছি, গল্প করতে করতে। গরম ভাপা পিঠাও আমরা একইভাবে খেতাম। আব্বা শুধু চিতই পিঠা খাওয়ার সময় সকালে একটা চেয়ার পেতে বসতেন এসে, খাওয়া শেষ করেই তার কাজে চলে যেতেন তিনি। বাকি সময় মাকে ঘিরে আমরা ছেলে মেয়েরাই থাকতাম, এটা-ওটা এগিয়ে দেওয়ার জন্যে হয় টুলির মা, নয়তো পারুলের মা। সবার খাওয়া শেষ হলে মায়ের সঙ্গে আমরা উঠে যেতাম যার যার পড়ার টেবিলে। সেদিন আব্বা খাওয়া শেষ করে উঠে চলে যাওয়ার পরেই ননী ভাই আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, দিলু, তুমি না খুব সুন্দর করে কথা বলো।
তার এই প্রশংসা ছিলো আমার জন্যে একেবারেই আচমকা, আনকোরা এবং নতুন। উত্তরে কী বলা উচিত, তা বুঝতে পারছিলাম না। কেবল মায়ের মুখের দিকে একবার তাকিয়ে লজ্জায় মাথা নিচু করলাম। চায়ের কাপ হাতে নিয়ে ননী ভাই উঠানের ঝিকিমিকি রোদে গিয়ে বসলেন।
আমার ইনছার চাচার দুই ছেলে রেজা ভাই এবং আমার সমবয়সী কালু পলো নিয়ে বিলে মাছ মারতে যাচ্ছিল, তাদের যাত্রাপথে থামিয়ে দিয়ে ননীভাই তাদের সঙ্গে গল্প শুরু করে দিলেন সেখানে।
বাদল আর ননী ভাইয়ের চেহারায় একদম কোনো মিল ছিল না। বাদল ভাই দেখতে ছিলেন শরৎচন্দ্রের নায়ক শ্রীকান্তের মতো, যে কারণে তরু আপা তার প্রেমে পড়তে বাধ্য হয়েছে। অন্যদিকে ননী ভাই মামার মতো গোলগাল চেহারা পেয়েছিল, ততোধিক জাম্বুরার মতো একটু ভ্যাবলাকান্তমার্কা, বেশ সহজ সরলও।
এই ভালোবাসা তার সঙ্গী খোঁজে মনে মনে, চেনা জগৎ ছাড়িয়ে পরিযায়ী পাখির মতো দীর্ঘ পথ পাড়ি দেয় অচেনাকে চিনতে। অমসৃণ গিরিঘাত পেরুতে গিয়ে কেঁদে কেঁদে বুক ভাসায়। তবু সে চলে, থামে না কখনো।
প্রায়ই লক্ষ করতাম, আমি যা-ই বলি না কেন, ননীভাই আমার মুখের দিকে তাকিয়ে গোগ্রাসে যেন গিলতেন। শোনার ঢঙটিও এমন ছিল যে, মনে হতো—আমার কথার প্রতিটি কণা যেন কদমা বাতাসার মতো চেখে খাচ্ছেন। এই ঘটনার দুদিন পরে নিকট প্রতিবেশী মুন্সীবাড়ির মেয়ে নুরী ফুপির মেয়ে রেখা বেড়াতে এসেছে আমাদের বাড়িতে। আমার সঙ্গে গল্প করার এক পর্যায়ে বললো, খালা, আপনার আঙুলগুলো না খুব সুন্দর। কবি ও শিল্পীদের আঙুলের মতো চিরল চিরল।
-একথা তোমাকে কে বললো?
-বাবু মামা বলছিলো।
-ওহ্, তাই নাকি।
এবারও আমি হতচকিত, মানুষের আঙুলের কী আলাদা রূপ থাকে নাকি, জানি না তো! শুনিনি তো আগে কখনো। তাহলে বাবু কি ওর ভাগনীর সঙ্গে আমার আঙুলের সৌন্দর্য নিয়ে কথা বলেছে, কী বেহায়া ছেলে!
সাহস থাকলে আমাকেই বলতি, বয়সে ছোট এই ভাগনীর সঙ্গে এসব আলাপ করার মানে হয় কোনো? মুখে আর কিছু না বলে ওকে চা বিস্কুট খাইয়ে বিদায় করে দিলাম।
দুটো ঘটনাই মনের মধ্যে আলাদাভাবে হিজল ফলের মতো আলোড়নের বুদ্বুদ তুলে অন্য রকম এক হাওয়া খেলে হারিয়ে গেলো তা মনের গহীন বনে।
প্রথম চুরি করে উপন্যাস পাঠের কথা মনে হলো। বয়স হওয়ার আগেই বড়দের একটা উপন্যাস পড়েছিলাম লুকিয়ে, ভয়ে ভয়ে সবার চোখের আড়ালে, বইটির নাম মনে নেই আজ। বইটির প্রচ্ছদে উদ্ভিন্ন যৌবনবতী মেয়ের রঙিন একটা ছবি ছিল। আমি মূলত ওই ছবি দেখে বইটি পড়তে আগ্রহী হয়ে উঠেছিলাম। খুব ছোটবেলা মায়ের ‘বিষাদসিন্ধু’ পাঠের শ্রোতা দর্শকের সমাগম দেখেই পাঠ্যপুস্তকের বাইরের বই পাঠের প্রতি একটা দুর্বার আকূতি জন্মেছিল। ফলে দুপুরে খাবার পরে মায়ের আলস্য সময় কাটতো যখন উপন্যাস পাঠে। আমিও তক্কে তক্কে থাকতাম।পড়তে পড়তে মা যখন ঘুমিয়ে পড়তেন, তার হাত ফসকে পড়ে যাওয়া বই নিয়ে পড়তাম মায়ের পাশে বসেই, ঘুম ভাঙার লক্ষণ দেখলেই ধড়মর করে দে ছুট, এক দৌড়ে উঠে চলে যেতাম ছি-বুড়ি খেলতে।
সেই বইতে চম্পক আঙুলের কথা পড়েছিলাম, তর্জনি, মধ্যমা, অনামিকা, কণিষ্ঠা, বৃদ্ধা—পাঁচ আঙুলের পৃথক পাঁচটি নাম। আহা গ্রন্থ পাঠে কত কিছু জানা যায়! ফলে আরও আগ্রহ বেড়ে যায়।
ঔপন্যাসিক নজিবর রহমান রচিত একটি কালজয়ী সামাজিক উপন্যাস আনোয়ারা যে কতবার পড়েছি, মনে নেই। এছাড়া ম গরিবের মেয়ে, মেহের-উন্নিসা, প্রেমের সমাধির মতো তার উপন্যাসগুলো গৃহবধূ মেয়েদের একমাত্র খোলা জানালা ছিল।
আনোয়ারা তার রচিত প্রথম ও সর্বাধিক সার্থক উপন্যাস যা ১৯১৪ সালে কলকাতা থেকে সর্বপ্রথম প্রকাশিত হয়। বাঙালি মুসলমান সমাজে মীর মশাররফ হোসেন রচিত ‘বিষাদ সিন্ধু’র পর এটিই সর্বাধিক পঠিত ও জনপ্রিয় উপন্যাস ছিল আমার মায়েদের কালে।
খুব ছোটবেলায় সুন্দরী ময়ূরীর পা দুটো সম্পর্কে কোনো ধারণা ছিলো না। রঙে-রূপে পাখিকূলের অধীশ্বর মায়াময় ময়ূরের পা-দুখানা যে এত কুৎসিত হবে, কে জানতো। স্বয়ং ভগবান হয়তো অপ্রস্তুতভাবেই কাজটি করে অনেক অনুশোচনা করেছেন। তবু ময়ূরকে চাক্ষুস দেখার আগেই তাকে শৈশব-স্বপ্নে দেখে অনেকেই। মেলায় গিয়ে প্রথম ময়ূরের পাখার বিমুগ্ধ রঙের জৌলুসসহ রূপসী পালকের অচেনা স্পর্শ পেলে যেমন একটা অজানা শিহরণ হয়, মনটা চনমনিয়ে ওঠে নতুন বোধের আলোকে, সেই রকম এক তারুণ্যের রঙে রঙিন ছিল সবকিছু। বয়সটাই যে সেরকম পেখম তোলার সময়।
তাকে না বলা যায় প্রেম, না ভালোবাসা, না মোহ—নতুনকে জানবার অদম্য এক মনজাগানো অনুভূতির পরশ, অনুরণন, যা শরীর-মনকে উদীপ্ত করে রাখে সারাক্ষণ। শরীরিক বৃদ্ধির পাশাপাশি মনও দিনে দিনে লতার মতো বেড়ে ওঠে কামনা-বাসনার সুতীব্রতায়। পৃথিবীর জ্ঞান-চিন্তা-চেতনার সূর্যালোকে স্নাত এক অনন্যবোধে, বড়দের সকল কিছুর সঙ্গে একাত্ম বোধ এবং অংশীদারীত্বের গৌরব ও গরিমায় সুসজ্জিত নতুন এক সময়। যখন শুধু দু’পায়ে ভর নয়, অদৃশ্য ডানায় উড়ে চলে মন-পাখি।
দূরে কোথাও দূরে নব জাগরণী মন কেবলি খুঁজে ফেরে অচিনপুরের ঠি কানা। মনের অতলে যে লুকানো বাঁশি, সেই বাঁশির সপ্তসুরে, সঙ্গীতের মাধুর্যে নিজেকেই আবিষ্কার করে সে ভালোবাসার আলোককুঞ্জে।
এই ভালোবাসা তার সঙ্গী খোঁজে মনে মনে, চেনা জগৎ ছাড়িয়ে পরিযায়ী পাখির মতো দীর্ঘ পথ পাড়ি দেয় অচেনাকে চিনতে। অমসৃণ গিরিঘাত পেরুতে গিয়ে কেঁদে কেঁদে বুক ভাসায়। তবু সে চলে, থামে না কখনো।
দুই.
আমি নতুনবস্তির মামা বাড়িতে জায়গীর থাকার ফলে পুরোনো আত্মীয়তা নতুন করে ফুঁলে ফেপে উঠলো দিনে দিনে। শীতের মধ্যেই বাইসাইকেল চালিয়ে বাদল ভাই এলেন একদিন। মা তাকে ভালোভাবে আপ্যায়ন করে খাওয়ালেন দুপুরে পোলাও মাংস রেঁধে। বিকেলে এককাপ চা বানিয়ে দিলাম আমি। আমার হাত থেকে কাপটি তুলে নিতে নিতে বললেন, তোমার মতো দরদি আমার একটি ছোট বোন থাকলে খুব ভালো হতো।
তবে জ্ঞানও শিক্ষার ক্ষেত্রেআপস করবো না কখনো। তামাম বিশ্বকে জানতে হলে জ্ঞান খুব জরুরি, সেটিও বুঝেছিলাম শৈশবেই।
এই কথাটি কেন সেদিন বলেছিলেন, আজো আমি তার হদিস খুঁজে বের করতে পারিনি। কেননা, বাদল ভাইয়ের মাথার ওপরে বড় তিন বোন থাকলেও আমার কাছাকাছি বয়সের ছোট বোনও ছিল একজন। তবু কেন আক্ষেপে, ঠিক আমারই মতো একজন ছোট বোনের আকূতি প্রকাশ করলেন, বুঝতে পারলাম না। এর মীমাংসা সেদিন খুঁজে পাইনি, এখনো নয়।
রাতে থেকে ভেজানো পিঠা গরম এবং ঠাণ্ডা দুভাবেই খেয়ে যেতে অনুরোধ করলেন মা।কিন্তু কী যেন কাজের দোহাই দিয়ে সন্ধ্যানাগাদ বাদল ভাই চলে গেলেন সেদিনই। যথারীতি রাতে ভেজানো পিঠা তৈরির প্রস্তুতি চললো। সে এক মহাউৎসব। বিয়ে বাড়ির মতো আনন্দ যেন সবার মনে। সকালের নাস্তার চিতই তো যখন তখন হতো। কিন্তু ঘনজার পড়লে তখনই মা ভেজানো পিঠা বা দুধ চিতই বানাতেন, যেন শীতে কাঁপতে কাঁপতে পিঠার গভীর স্বাদ লেগে থাকে জিহ্বায়। আব্বা ঢাকা থেকে এলেই তবে এই ধরনের মেগা আয়োজন সম্পন্ন হতো।
ভেজানো পিঠা বানানো মানে হলো সন্ধ্যার আগখান দিয়ে টুলি ও আজহারের মায়ে মিলে দুই চুলায় দুজন মাটির খোলা থেকে চিতই তুলে তুলে জমা করতো একটা বড় গামলায়। শতখানেক পিঠা বানানো শেষ হলে, একটা চুলা অব্যাহত রেখে অপর চুলায় দুধ আর খেজুর গুড় মিলিয়ে দীর্ঘসময়ব্যেপে অনবরত নেড়ে ঘন করা হতো। এরপর চিতই পিঠার পিঠের দিকটা একটা সাদা নরম কাপড় ভিজিয়ে আলতো করে মুছে একটা একটা করে পিঠা ছেড় দিতো সেই ঘন দুধে। দুধের মধ্যে পিঠাগুলো বলকাতে শুরু করলেই ম-ম সুগন্ধে ভরে যেতো চারপাশ। মা অবশ্য গরম মশলা কিছু ছেড়ে দিতেন দুধজ্বালের সময়।
পাশের শরিক বাড়ি স্বজনেরা বুঝতে পারতো মেজ আম্মার চুলার পারে আজ পিঠা হচ্ছে। অনেকেই উঁকি দিয়ে দেখে যেতো। শুকনো পিঠার দিকে তাকিয়ে কেউ কেউ নানা রকমের পরামর্শ দিতো, কী করলে পিঠা ভিজবে ভালো। চিতই ভেতরে শক্ত থাকলে ভিজবে না, এজন্যে টুলির মাকে নির্দেশ দিতো পিঠার গোলায় একটু পানি বাড়িয়ে দিতে। ভেজানো পিঠার পুরো প্রক্রিয়া শেষ হতে রাতের ৯টা বেজে যেতো। বাকি রাতভর দুধে ভিজে ভিজে পিঠাগুলো ফুলে টুইটুম্বর। এজন্যে আমরা ভেজানো পিঠা বলতাম।
মনে পড়ছে একবার আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের বান্ধবী সাইদা তার বরিশালের বাড়ি থেকে রসের পিঠা এনে আমাদের খাইয়ে ছিল শামসুন্নাহার হলে। রসের পিঠা মানে শুধুই কাঁচা রস দিয়ে চিতই পিঠা ভেজানো, সেখানে দুধের কোনো বালাই নেই। আমাদের মানিকগঞ্জ এলাকায় দুধবিহনে কেউ ভাবতেই পারে না ভেজানো পিঠার কথা। অঞ্চলভেদে খাওয়া-দাওয়া পিঠা আটার অনেক তফাৎ অতীতেও ছিল আজও আছে।
সূর্য ওঠার আগে খুব ভোরের বেলা শীতে কাঁপতে কাঁপতে সবাই মিলে খাওয়ার মধ্যেই যেন এই পিঠা-উৎসবের ঐক্য নিহিত ছিল। প্লেটে প্লেটে শরিক বাড়ি পাঠানো ছাড়াও কাছে, দূরে আত্মীয় বাড়িতে ভেজানো পিঠা পাঠানো এক ধরনের অলিখিত রেওয়াজ পালন করতে দেখেছি আমার মাকে। শীতকালে যেকোনো বাড়ির চুলার পার বোধ করি একটু বেশিই সরগরম থাকতো।
শীতকালে আমার মায়ের জোড়া-চুলার পারে বসলে উষ্ণ ধোঁয়ায় ভরে যেতো, সকালটা। স্বাদে গন্ধে যেন একাকার। মাটির চুলারকাঠ-কয়লার আগুনের উষ্ণতা অন্য রকম এক নস্টালজিক শীত তাড়ানো আনন্দ-মঞ্চ ছিল আমাদের। মা মানেই অধিকাংশ চুলার পারের স্মৃতি-বিজড়িত সময়।
সারা বছর নানা পদের জ্বালানি ব্যবহৃত হতো এই মাটির চুলাদ্বয়ে। গোবরের ঘষি, নলা, চিটা ধান, ঢেঁকিছাটা ধানের তুষ, বাঁশপাতা, আমপাতা, নাড়া-খড়, শুখনা ধইনচা গাছ, পাটখড়ি, সর্বশেষ বর্ষাকালের জন্যে অবধারিত জমানো থাকতো বইন্যা অথবা আম-জাম গাছ কেটে লাকড়ির আয়োজন। কাজের মায়েরা যখন ধান সেদ্ধ করতো বড় বড় ডেকচিতে, তখন অবধারিত ছিল লাকড়ির ব্যবহার, আমরা বলতাম চলা। তার সঙ্গে গোবরের ঘষি, পাটখড়ি ও চুলার মুখে তুষ ছিটিয়ে দিয়ে আগুনের শক্তি বা জোড় বাড়ানো হতো, নইলে ধান যে সেদ্ধ হবে না সহজে। খোলা আকাশের তলে চুলার চারপাশ কমলা রঙের আগুনে আলোকিত হয়ে উঠতো, সেই আলোতে টুলির মা, আজাহারের মা, পারুলের মায়ের উজ্জ্বল মুখে ফুটে উঠতো এক অনিন্দ্য কান্তি। দুদিন আগে পানিতে ভেজানো ধান মাটির চার থেকে বড় ডেকচিতে তুলে শেষরাতের দিকেই সাধারণত সেদ্ধ করতো তারা। যেন সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে সেদ্ধ ধানগুলো ছড়িয়ে দিতে পারে তার সোনালি আলোর ছটায়। কাজেই আগের দিনে গোবর দিয়ে লেপে উঠান প্রস্তুত করে রেখে দিতো তারা দুজনে মিলেই। দুই/তিন রোদেই যেন ধান শুকিয়ে ঘরে তোলা যায়। এই সময়টাতে ধানের মলন, কুলায় ধান উড়ানো, ধানসেদ্ধ, ঢেঁকিতে ধান ভানা, চিড়া কোটা, মুড়িভাজার তালবেলামে অপরূপ এক সময় গ্রামের নিস্তরঙ্গ জীবনও নবান্ন উৎসবের আনন্দে যেন ঝলমল করে উঠতো।
বিশেষভাবে আমন ধানকাটার এই নবান্নের সময় দেখতাম, টুলি, বৈরানী ওদের আরও সঙ্গী-সাথীসহ আনন্দে হল্লা করতে করতে বিভিন্ন ক্ষেতে খামারে ঘুরে ঘুরে ইঁদুরের গর্ত থেকে ধান তুলে আনতো। জমির মালিকেরা কখনো ইঁদুরে নেওয়া পাকা ধানের মালিকানা দাবি করতো না। কাজেই ভূমিহীন বর্গাচাষিদের ছেলে মেয়েরাই এইসব ধান গর্ত খুঁজে কুড়িয়ে নিতো। দিনে পাঁচ কেজি থেকে ৭/৮ কেজি ধানও সংগ্রহ করতো কেউ কেউ। এসব ধান চাল করে তারাও পিঠা বানিয়ে খেতো এই শীতের সময়ে, তাদের সামর্থ্য মতো। দারিদ্রসীমার নিচে যে অর্ধেক জীবন, তারও পাঠ গ্রহণ করেছিলাম আমার খেলার সঙ্গীদের সূত্রেই, সুদূর শৈশবেই। সহানুভূতির অপরূপ এক ছায়াতলে আমি বাস করেছি তাদের নিয়ে। কলেজে প্রবেশমাত্রই সমাজতন্ত্রের দীক্ষা আমাকে টেনেছিল গভীরভাবে। সরকারি উদ্যোগে আমাদের বাড়ির সামনের হালটে মাটি ফেলে উঁচু রাস্তা তৈরি হলো যখন। অনেক নারী শ্রমিককে প্রথম আমি মাটির সাঁজি মাথায় নিয়ে ছয় ফিট নিচে থেকে ওপরে রাস্তায় মাটি ফেলতে দেখে বেদনাহত হয়েছিলাম। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, এই নারীদের ভাগ্য উন্নয়নে কাজ করবো, নিজের সঙ্গতি থাকলেও ওদের মতোই আমিও দুটো সুতি শাড়ি দিয়েবছর চালিয়ে নেবো, ওদের মতোই স্বল্পখাদ্যে, মিনিমাম প্রয়োজন মিটিয়ে বেঁচে থাকতে চেষ্টা করবো। তবে জ্ঞানও শিক্ষার ক্ষেত্রেআপস করবো না কখনো। তামাম বিশ্বকে জানতে হলে জ্ঞান খুব জরুরি, সেটিও বুঝেছিলাম শৈশবেই।
চলবে…
বালিকার চরৈবেতি-১৯॥ দিলারা হাফিজ