কবি ও প্রাবন্ধিক মোহাম্মদ নূরুল হক (১৯৭৬-)। মূলত কবি হলেও একজন অনুসন্ধানী, যুক্তিনিষ্ঠ প্রাবন্ধিক হিসেবে পাঠকমহলে বিশেষভাবে সমাদৃত। শিল্প-সংস্কৃতির নানা পরিপ্রেক্ষিত তার গদ্যভাষায় আভাসিত হয়েছে। লিখেছেন বিবিধ বিষয়ে প্রবন্ধ-নিবন্ধ। তবে সমালোচনা সাহিত্যের নিষ্প্রভতার কালে তার সাহিত্য সমালোচনামূলক গদ্যগুলো বিশেষ অভিনিবেশ দাবি করে। বর্তমান লেখায় এটিই আলোচনার বিষয়।
মোহাম্মদ নূরুল হকের প্রবন্ধগ্রন্থের নাম দেখে আন্দাজ করা যাবে—শিল্পসাহিত্য বিষয়ে তার অনুধ্যান। শিল্পসাহিত্যের নন্দতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ যেমন তার প্রবন্ধে লক্ষণীয়, তেমনই রয়েছে সমকালীন দেশি-বিদেশি ঘটনাপ্রবাহের নিরিখে তুলনামূলক আলোচনাও। মূল আলোচনায় যাওয়ার আগে গ্রন্থগুলোর নাম জেনে নেওয়া যাক। ‘সাহিত্যে দশক বিভাজন ও অন্যান্য’, ‘সমালোচকের দায়’, ‘অহঙ্কারের সীমানা ও অন্যান্য’, ‘সাহিত্যের রাজনীতি’, ‘সমকালীন সাহিত্যচিন্তা’, ‘কবিতার সময় ও মনীষার দান’ ও ‘আহমদ ছফার বাঙালি দর্শন ও অন্যান্য’।
সাহিত্যের অভিনিবেশনির্ভর, যুক্তিনিষ্ট ও বিশ্লেষণধর্মী একটি শাখা প্রবন্ধ। গদ্যভাষায় লেখা এই মাধ্যমে শিল্প, সমাজ ও রাষ্ট্রের নানাবিধ প্রসঙ্গ মননের মানদণ্ডে আলোচিত হয়। প্রাবন্ধিক মোহাম্মদ নূরুল হক প্রবন্ধের এসব বৈশিষ্ট্য স্বীকরণের মধ্যে দিয়ে প্রবন্ধ লেখায় অবতীর্ণ হন। বাংলাসাহিত্যের খ্যাতিমান লেখকদের পাশাপাশি সমকালীন লেখকদের সৃষ্টি নিয়ে লিখেছেন মননশীল প্রবন্ধ। সমকালে দশকধারণা নিয়ে সাহিত্যিক মহলে একধরনের বিতর্ক তৈরি হয়। এই ব্যাপারটির স্পষ্টতা পেয়েছে মোহাম্মদ নূরুল হকের ‘সাহিত্যে দশক বিভাজন’ শীর্ষক প্রবন্ধে। ত্রিশের দশকে বাংলা কবিতার বাঁক বদলকে সুচিহ্নিত করার প্রয়াসে দশকপ্রসঙ্গ এসেছে সত্য। কিন্তু উত্তরকালে দশকওয়ারী সাহিত্যের যে প্রচলন, এটা গৌণ কবি-সাহিত্যকদের উদ্দেশ্যপ্রণোদিত একটা ব্যাপার। মোহাম্মদ নূরুল হক যুক্তির আলোকে এই দশকওয়ারী সাহিত্য বিভাজনের স্থূল রাজনীতিকে খারিজ করে দেন। তিনি বলেন, ‘বাংলা সমলোচনা সাহিত্যের একটি বিষফোঁড়া—দশকিয়া বিশ্লেষণ। এটি যেমন সাহিত্যের জন্য ক্ষতিকর, তেমনি সৃষ্টিশীলতার অন্যান্য বিভাগের ক্ষেত্রেও প্রতিবন্ধক। মহাকালের হিসাবের খাতায় শতকই যেখানে গৌণ, দশক সেখানে অতি তুচ্ছবিষয় মাত্র। তবু দশকবিভাজন নিয়ে মেধাহীনদের আহ্লাদের শেষ নেই। দশকবিভাজনের একটি লক্ষণীয় দিক হলো—প্রতিনিধিত্বশীলতার দোহাই দিয়ে অকবি-অলেখকরাও দশকিয়া সংকলনে স্থান পেয়ে যায়। দশকভিত্তিক সমালোচনা গদ্যের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য।’
মানবসভ্যতা ও সংস্কৃতির বিচিত্রবিষয় প্রবন্ধের আঙ্গিকে স্ফূর্তি পায়। চিন্তাচর্চার ক্ষেত্রেও প্রবন্ধের ভূমিকা কম নয়। স্বপ্ন-কল্পনা কিংবা আবেগের প্রাবল্য প্রবন্ধে থাকে না। ফলে এই মাধ্যমে উদ্দিষ্ট বিষয়ের নিরাসক্ত বিশ্লেষণ সম্ভব। একটি জাতির নানাসংকট ও সমাধানের স্পষ্ট নির্দেশনা প্রবন্ধনিবন্ধে পাওয়া যায়। তবে হতাশার কথা এই, বাংলা শিল্পসাহিত্যের ধারায় কবিতা, গল্প, উপন্যাস কিংবা নাটকের তুলনায় প্রবন্ধের ব্যাপারে একধরনের উদাসীনতা লক্ষ করা যায়। সমকালীন প্রাতিষ্ঠানিক টীকাটিপ্পনীনির্ভর প্রবন্ধের বাইরে মোহাম্মদ নূরুল হকের প্রবন্ধ নতুন ভাবনার খোরাক জোগায়। নানাবিষয়ে লেখা তার প্রবন্ধপ্রয়াস সেকথা মনে করিয়ে দেয়। কবিতা, গল্প, উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ, ছোটকাগজ ইত্যাদি যেমন তার প্রবন্ধের বিষয় হিসেবে এসেছে, তেমনি ‘ব্লগার খুন’, ‘বাক-স্বাধীনতা’, ‘বাংলা বানানে বিশৃঙ্খলার জন্য দায়ী কে’, ‘জাতীয় সংগীত বিতর্কের’ মতো সাম্প্রতিক ইস্যু নিয়েও লিখেছেন।
নৈর্ব্যক্তিক ও নির্মোহ বিশ্লেষণের ভেতর দিয়ে তিনি কবিতার সমূহ সংকট নিরূপণে সচেষ্ট হয়েছেন। একটি কবিতা কিভাবে লেখক-পাঠকের মধ্যে সাংঘর্ষিক হয়ে ওঠে।
মোহাম্মদ নূরুল হক মূলত কবি। ফলে তার লেখা প্রবন্ধগুলোর একটা বড় অংশজুড়ে আছে কবিতার কলাকৌশল ও প্রকরণকেন্দ্রিক আলোচনা। এখানে তার কাব্যবোধ ও কাব্যজিজ্ঞাসার সচেতন প্রয়াস লক্ষণীয়। কবিতাবিষয়ক তার প্রবন্ধগুলো হলো—‘কবিতার সৃজনক্রিয়া’, ‘কবিতার সংকট’, ‘কেন ছন্দ অনিবার্য’, ‘কবির ঋণগ্রহণপ্রবণতা ও নতুন কবিতার সৃষ্টি’, এবং ‘বাংলা কবিতার ভবিষ্যৎ এবং ভবিষ্যতের কবিতা’। কবিতা সৃজনপ্রক্রিয়া বরাবই কৌতূহল জাগানিয়া একটি ব্যাপার। কবিতা কখন, কোন পরিস্থিতিতে বাণীরূপ লাভ করে এই নিয়ে ভাবনার অন্ত নেই। মোহাম্মদ নূরুল হক তার ‘কবিতার সৃজনক্রিয়া’ শীর্ষক প্রবন্ধে মাইকেল মধুসূদন দত্ত, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জীবনানন্দ দাশসহ আরও অনেক প্রথিতযশা লেখকের কাব্যজিজ্ঞাসার মুখোমুখি হয়েছেন। কবিতার সৃজনবেদনকেন্দ্রিক পারস্পারিক বোঝাপড়া উপস্থাপনে প্রয়াসী হয়েছেন। সবশেষে উপলব্ধির উপসংহারে এসেছেন এভাবে, ‘কবি প্রকৃতপক্ষে ধ্যানী। তপস্যা ব্যতীত যেমন সিদ্ধিলাভ হয় না, গভীর ধ্যান ছাড়াও কবিতার সৃজনকৌশল আয়ত্ত করা যায় না। ধ্যানসাধ্য প্রতিটি মুহূর্তই কবিতার সৃজনমুহূর্ত। কখন, কিভাবে কবিতা কবির ধ্যানের জগৎকে আন্দোলিত করে, তা একবাক্যে বলা সম্ভব নয়। ধ্যানমগ্ন কবির হৃদয়ই কবিতার অধিষ্ঠান। অকবির মেকি প্রেমকে কবিতা প্রত্যাখ্যান করে বরাবর। তাই অকবির হাজার বাক্যে যে কবিতা ধরা দেয় না, সে কবিতাই কবির প্রেমে আপ্লুত হয়।’
‘কবিতার সংকট’ বোধকরি মোহাম্মদ নূরুল হকের অন্যতম সেরা একটি প্রবন্ধ। নৈর্ব্যক্তিক ও নির্মোহ বিশ্লেষণের ভেতর দিয়ে তিনি কবিতার সমূহ সংকট নিরূপণে সচেষ্ট হয়েছেন। একটি কবিতা কিভাবে লেখক-পাঠকের মধ্যে সাংঘর্ষিক হয়ে ওঠে। কিংবা প্রত্যাশিত অর্থের বিপরীতে হাজির করে অভাবিত কোনো ভাবসম্পদ। কিংবা তাৎক্ষণিক জনপ্রিয়তা লাভ করেও একটি কবিতা কেন সময়ের ব্যবধানে হারিয়ে যায়। এমন মনস্তাত্ত্বিক ও শিল্পতাত্ত্বিক কারণ অন্বেষণ করেছেন যুক্তির নিরিখে। কবিতার সংকট নির্দেশ করতে গিয়ে তিনি বলেন—‘কবিতার সংকট বোঝাতে গেলে, এর পারিপার্শ্ব, স্রষ্টা, রসপিপাসু, সমালোচকের চারিত্র্য সম্পর্কেও কিছুটা আলোকপাত প্রয়োজন। কবিতার সংকট বলতে আসলে কী বোঝাতে চাই, এমন প্রশ্নের সোজাসুজি কোনও উত্তর আপাতত নেই। তবে ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে যা বলা হবে, তার সারাংশ মোটামুটি এ রকম—কবির প্রস্তুতি, খ্যাতির মোহ; ছন্দ-অনুপ্রাস-অন্ত্যমিল; চিত্রকল্প, ভাষা-সংকেত; আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপট; আন্তঃসম্পর্ক যত সুনিবিড় হবে, কবিতাও হবে তত হৃদয়গ্রাহী, বিশ্বস্ত। কিন্তু এ সবের সঙ্গে যদি সাংঘর্ষিক সম্পর্ক সৃষ্টি হয়, তবে কবিতার অপমৃত্যু অনিবার্য।’
এই প্রবন্ধে কবিতার কিছু অনিবার্য উপাদান ও সংকটকে তিনি চিহ্নিত করেছেন কয়েকটি উপশিরোনামে। যেমন ‘দুর্বোধ্যতা’, ‘আঙ্গিকের বৈচিত্র্য ও ছন্দ’, ‘সর্বজনীনতার অভাব’।
কবিতায় ছন্দ জরুরি কি না, এমনতর জিজ্ঞাসা নতুন নয়। এই নিয়ে বিতর্কও রয়েছে। কেউ কেউ বলেন, ‘ছন্দই কবিতা’। কারও কারও মতে, ‘ছন্দ কবিতার অন্যতম একটি উপকরণ মাত্র’। অর্থাৎ কবিতায় ছন্দের প্রয়োগ নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্ব লেগেই আছে। মোহাম্মদ নূরুল হক ‘কেন ছন্দ অনিবার্য’ শীর্ষক প্রবন্ধে এই প্রসঙ্গে সবিস্তারে আলোচনার প্রয়াস পেয়েছেন। প্রবন্ধটি তিনি শুরুই করেছেন ছন্দের অনিবার্যতাকে সাব্যস্ত করেই। বলেন, ‘ছন্দহীন রচনা কবিতা নয়। প্রাণীদেহে স্পন্দন যেমন, কবিতায় ছন্দও তেমন। স্পন্দন থেমে গেলে প্রাণী আর জীব থাকে না, জড়ে পরিণত হয়। তেমনি ছন্দবিবর্জিত রচনাও আর কবিতা থাকে না, কতিপয় শব্দের জড়ভরতে পর্যবসিত হয়। ’
ছন্দের অনিবার্যতা বোঝাতে উপরিউক্ত মন্তব্যটি অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ ও যৌক্তিক। কবিতায় ছন্দের অনিবার্যতার প্রশ্নে তার যুক্তিগুলো অত্যন্ত শৈল্পিক। আমরা অনেকেই অন্ত্যমিল যুক্ত পঙ্ক্তিকে ছন্দ ভেবে ভুল করি। আদতে ছন্দ সম্পর্কে অজ্ঞ ব্যক্তির পক্ষেই এমনটি বোধ করি সম্ভব। ছন্দ কেবল গাণিতিক সূত্র নয়। ছন্দের নেপথ্যে আরও কিছু আনুষঙ্গিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তিনি নির্দেশ করেছেন। যেগুলো অভিনব মনে হয়েছে। যেমন, ‘ছন্দে সিদ্ধহস্ত হওয়ার জন্য প্রয়োজন আবেগ, অনুশীলন, অভিজ্ঞতা, কবিকল্পনা ও প্রজ্ঞার সমন্বয়। কারণ ছন্দের সঙ্গে আবেগের সম্পর্ক সুনিবিড়। ছন্দ ও আবেগের সমন্বয়ে কবিতায় গতির সঞ্চার হয়। এজন্য সেই আবেগের কার্যকারণ নির্ণয় করতে গেলে অভিজ্ঞতার শরণাপন্ন হতে হয়। কারণ, ‘ছন্দোবেগের মধ্যে অভিজ্ঞতার বিবিধ প্রবণতা নিশ্চয়ই থেকে যায়’।’’
নোবেলের উপর্যুক্ত বক্তব্যকে যারা সমর্থন করেছে। মোহাম্মাদ নূরুল হক তাদের পাকিস্তানের দোসর এবং উত্তরপ্রজন্ম হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। কারণ সুযোগ পেলেই এই শ্রেণী রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে বিষোদগার শুরু করে।
কবিতাবিষয়ে এমন প্রাসঙ্গিক হৃদ্ধ আলোচনা উপস্থাপিত হয়েছে তার ‘কবির ঋণগ্রহণপ্রবণতা ও নতুন কবিতার সৃষ্টি’, এবং ‘বাংলা কবিতার ভবিষ্যৎ এবং ভবিষ্যতের কবিতা’ শিরোনামের প্রবন্ধে।
মোহাম্মদ নূরুল হকের প্রবন্ধগুলোর মধ্যে একটা বড় পরিধিজুড়ে আছে সমকালীন কবি-সাহিত্যকদের লেখা নিয়ে সাহিত্যসমালোচনা। নন্দনতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিভিন্ন জনের কবিতা, গল্প, উপন্যাস, নাটকসহ নানা বিষয়ের প্রসঙ্গ ও প্রবণতা নিয়ে বিশ্লেষণধর্মী সমালোচনা লিখেছেন তিনি। সমসাময়িক লেখকদের মধ্যে প্রবন্ধসংখ্যা ও সারবত্তার বিচারে এইক্ষেত্রে তিনি অন্যতম-অনন্য। যাদের নিয়ে তিনি প্রবন্ধ লিখেছেন, তারা অনেকেই ইতোমধ্যে প্রতিষ্ঠিত। প্রসঙ্গক্রমে কয়েকটি প্রবন্ধের শিরোনাম উল্লেখ করা যেতে পারে। যেমন: ‘আহমেদ স্বপন মাহমুদের কবিতা: অন্তহীন রহস্যের কথা’, ‘গবেষক-প্রাবন্ধিক তপন বাগচী’, ‘শামীম রেজার কবিতা: বিষয় ও প্রকরণ’, ‘হেনরী স্বপনের কবিতা: সময়ের কাছে মনীষার দান’, ‘নাজিব ওয়াদুদের গল্প: সমাজ-সচেতনতার চিত্র’, ‘জাকির জাফরানের কবিতা: বিষয়ে-প্রকরণে’, ‘রহমান হেনরীর কবিতায় চিন্তার দ্যুতি’ ইত্যাদি।
সমকালীন সাহিত্য আলোচনার এমন ব্যাপ্তি দেখে বাংলা সাহিত্যের দু’জন খ্যাতিমান লেখকের কথা স্মরণে আসে। তারা হলেন যথাক্রমে বুদ্ধদেব বসু ও আবদুল মান্নান সৈয়দ। স্বভাবে কবি হয়েও তারা বাংলা প্রবন্ধ তথা সমালোচনা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন। তাদেরই উত্তরসূরি মোহাম্মদ নূরুল হক বাংলা সাহিত্যের অগ্রজ খ্যাতিমান লেখকদের সৃষ্টি নিয়েও বেশকিছু প্রবন্ধ লিখেছেন। যেমন—‘নজরুলের কবিতায় পঙ্ক্তিবিন্যাস ও মাত্রাচেতনা’, ‘জীবনানন্দ: আবেগে-অনুরাগে’, ‘সুধীন্দ্রনাথ দত্তের কবিতা: মনীষা প্রসঙ্গে’, ‘আত্মবিদ্রূপ ও সমর সেনের কবিতা’, ‘আরজ আলী মাতুব্বর: মনীষার দ্রোহ’, ‘আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের উপন্যাস: জীবন ও শিল্পের যৌথ পাঠ’, ‘আবদুল মান্নান সৈয়দের কবিতা: সার্বভৌম উচ্চারণ’, ‘আহমদ ছফার বাঙালি দর্শন’, ‘মহাদেব সাহার কবিতা: বিশুদ্ধ শিল্পের আখ্যান’, ‘হুমায়ূন আহমেদের গল্প: জটিল জীবনের সহজ গাথা’, ‘জ্যোতি প্রকাশ দত্তের কয়েকটি গল্প: সামাজিক বাস্তবতা’, ‘হেলাল হাফিজের কবিতায় মনীষার সন্ধানে’, ‘আবিদ আনোয়ারের কবিতায় মনীষার সন্ধানে’, ‘আবু হাসান শাহরিয়ারের কবিতা: নিরীক্ষা প্রসঙ্গে’ প্রভূতি।
মোহাম্মদ নূরুল হক সাহিত্যসমালোনা ছাড়াও সমকালীন নানা পরিপ্রেক্ষিত নিয়ে কিছু প্রবন্ধ লিখেছেন। যেখানে ক্ষুরধার যুক্তির আলোকে সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কে বিশ্লেষণ করেছেন। দিয়েছেন নিজস্ব নির্মোহ অভিমতও। বোধকরি একজন লেখক সময় ও সমাজবিচ্ছিন্ন কেউ নন বলেই নানাসংকট নিয়ে তাকে কলম ধরতে হয়। ‘জাতীয় সংগীত বিতর্ক: মুখোশ যখন খসে পড়ে’ প্রবন্ধটি তার এমন ভাবনাপ্রসূত সৃষ্টি। যেখানে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও তার লেখা দেশের জাতীয় সংগীতকে হেয় করার প্রবণতার বিরুদ্ধে তার অবস্থান লক্ষণীয়। ‘নোবেল’ নামে একজন তরুণ কণ্ঠশিল্পীর দেওয়া নেতিবাচক মন্তব্যের পক্ষে এদেশের মুষ্টিমেয় কিছু লোক সহমত পোষণ করে আদতে রবীন্দ্রবিরোধিতাই প্রদর্শন করেছেন। ইউটিউব-ভিত্তিক একটি সাক্ষাৎকারে নোবেলের মন্তব্য করেছেন, ‘‘আমি মনে করি যে, আমাদের জাতীয় সংগীত, ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ আমাদের দেশটাকে যতটা এক্সপ্লেইন করে, তার থেকে কয়েক হাজার গুণ বেশি এক্সপ্লেইন করে প্রিন্স মাহমুদ স্যারের এই গানটা। আমাদের জাতীয় সংগীত যেটা আছে, সেটা হয়তো অনেক রূপক অর্থে অনেক কিছু বুঝিয়ে দেয়, বাট এটা কিন্তু (অস্পষ্ট) আমাদের ইতিহাস, আমাদের ঐতিহ্য, আমাদের আবেগের স্থানটা, সবকিছু কিন্তু প্রপারলি আমাদের কাছে তুলে ধরে।’’
নোবেলের উপর্যুক্ত বক্তব্যকে যারা সমর্থন করেছে। মোহাম্মাদ নূরুল হক তাদের পাকিস্তানের দোসর এবং উত্তরপ্রজন্ম হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। কারণ সুযোগ পেলেই এই শ্রেণী রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে বিষোদগার শুরু করে। প্রাবন্ধিকের ভাষায়—‘‘এখন প্রশ্ন দাঁড়াচ্ছে, তাহলে নোবেলের ভক্তরা তার এমন ‘অবিবেচনাপ্রসূত বক্তব্য’কে সমর্থন করছেন কেন? এই প্রশ্নের সমাধান করতে গেলে পেছনে ফিরে তাকাতে হবে। পাকিস্তান আমল থেকে শুরু করে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের ষড়যন্ত্রকারীদের স্বভাব-কর্মকাণ্ডকে স্মরণ করতে হবে। তাহলে বোঝা যাবে, এমন দাবি নতুন নয়, পুরনো। যে দাবি পাকিস্তানপ্রেমী থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারীরা বারবারই করে এসেছে। এই দাবি বিষয়ে যাদের চেতনাগত মিল রয়েছে, তারা স্বাভাবিকভাবেই নোবেলকে সমর্থন দেবে।’’
এই সময়ে তিনি কবিতার পাশাপাশি বিপুল পরিমাণ শিল্পসমালোচনামূলক প্রবন্ধ-নিবন্ধ লিখেছেন। শিল্পসাহিত্যের নানা শাখায় প্রকরণপরিধি নিয়ে তার লেখা শত্রুকেও ভাবিত করে।
বাংলা ভাষার শুদ্ধ প্রয়োগ নিয়ে আমাদের মধ্যে যে উদাসীনতা দেখা যায়, এটি সত্যিই দুঃখজনক ব্যাপার। ভাষার জন্য যারা প্রাণ দিয়েছেন, তাদের রক্তের সঙ্গে বেঈমানির নামান্তর। সম্প্রতি ভাষার প্রয়োগ ও বানান বিশৃঙ্খলার দায়হীন প্রবণতা শুরু হয়েছে। মোহাম্মদ নূরুল হক এই বিশৃঙ্খলার জন্য আমাদের প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষিত শ্রেণীর কাণ্ডজ্ঞানহীন উদাসীনতাকে দায়ী করেছেন। ‘বাংলা বানানে বিশৃঙ্খলার জন্যদায়ী কে’ শিরোনামের প্রবন্ধে দেখাতে চেয়েছেন প্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক বানান-বিশৃঙ্খলার হেতু। অফিস-আদালত ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যারা দায়িত্বে আছেন, তারা নিজেদের খেয়ালখুশি মতো শব্দের বানান লিখে দিচ্ছেন। এতে একই শব্দের একাধিক বানান অনুসৃত হচ্ছে। এ ধরনের বিশৃঙ্খলা একটি আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি প্রাপ্ত ভাষার জন্য লজ্জাকর বৈকি। তাহলে প্রশ্ন জাগে, প্রতিবছর একুশে ফেব্রুয়ারি এলে ভাষা ও ভাষা-শহিদদের স্মরণে আমরা যে আবেগের উচ্ছ্বাস প্রদর্শন করি, তা নিছক লোক দেখানো?
বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি দায়িত্বশীল সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোও শুদ্ধ বানান প্রয়োগে উদাসীন। প্রজ্ঞাপন, অফিস আদেশ, সাইনবোর্ড, বিলবোর্ড ইত্যাদিতে যেন ভুল বানানের মহোৎসব চলে। সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল ব্যক্তি এসবের দায় এড়িয়ে যেতে পারেন না। মোহাম্মদ নূরুল হক ‘বাংলা বানানে বিশৃঙ্খলার জন্য দায়ী কে’ শীর্ষক প্রবন্ধে এ ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনা উপস্থাপন করেছেন।
সর্বোপরি, জীবনের অন্তর্গত বোধ ও জ্ঞানবিজ্ঞানের প্রকৃত সুলুকসন্ধান প্রবন্ধের মাধ্যমে যেভাবে প্রকাশ করা যায়, অন্য আঙ্গিকে তেমনটি নয়। বাংলাদেশের প্রবন্ধসাহিত্যকে নিজস্ব মনীষার দ্বারা অনেকে দীপিত করেছেন। তারা হলেন আবুল ফজল, আব্দুল হক, আহমদ শরীফ, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, সৈয়দ আলী আহসান, হাসান হাফিজুর রহমান, বদরুদ্দীন উমর, সৈয়দ শামসুল হক, হুমায়ুন কবির, আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ, হায়াৎ মামুদ, আহমদ ছফা, আবদুল মান্নান সৈয়দ, সৈয়দ আকরম হোসেন, শামসুজ্জামান খান, আবুল কাশেম ফজলুল হক, সলিমুল্লাহ খান, রফিকুল্লাহ খান, গোলাম মুরশিদ প্রমুখ। মোটাদাগে তাঁরা বাংলাদেশের অগ্রজ প্রবন্ধ লেখক। মোহাম্মদ নূরুল হক এই গুণিজনদের পথেই হাঁটছেন। আশা করি, বাংলা প্রবন্ধ তথা সমালোচনা সাহিত্যে কবিতার পাশাপাশি তিনি হবেন যোগ্য উত্তরসূরি। বুদ্ধদেব বসু কিংবা আবদুল মান্নান সৈয়দের মতো বাংলা সমালোচনাসাহিত্যেও রাখবেন স্মরণীয় অবদান। এই সময়ে তিনি কবিতার পাশাপাশি বিপুল পরিমাণ শিল্পসমালোচনামূলক প্রবন্ধ-নিবন্ধ লিখেছেন। শিল্পসাহিত্যের নানা শাখায় প্রকরণপরিধি নিয়ে তার লেখা শত্রুকেও ভাবিত করে। পৃথিবীর অনেক মহৎ কবি কিংবা শিল্পীই কবিতার পাশাপাশি এমন সুরভিত শিল্পসমালোচনামূলক গদ্যের পথে হেঁটেছেন। বাংলা কবিতা ও প্রবন্ধশাখায় তার কালপর্বে তিনি অন্যতম।