মানুষের চিন্তাশক্তিই সভ্যতার মূল নিয়ামক। সে সঙ্গে সাহিত্যেরও। কিন্তু কালে কালে, সমাজে, রাষ্ট্রে দুর্বল চিন্তকের প্রাদুর্ভাবে যে পচন ধরে, তাকেই দুর্বলচিত্তের অন্ধ-অনুসারী ও অনুকারকের দল প্রথাবিরোধিতা বলে চালিয়ে দেওয়ার পক্ষে প্রাণান্তকর চেষ্টা করে। সবসময় যে সফল হয়, তাও নয়। কিন্তু একটা সময়পর্যন্ত সাধারণ মানুষের ভাবাবেগ ও চিত্তের দৌর্বল্যকে পুঁজি করে দুর্বল চিন্তকরা একটি তীব্র ও উজ্জ্বল ঝলক দিয়ে যায়। যার আকস্মিকতায় হতবিহ্বল অনুসারী-অনুকারকগোষ্ঠী এতই সম্মোহিত হয়ে পড়ে যে, অধীত পাঠ ও জীবন ছেঁকে আনা অভিজ্ঞতার রসায়নে তাকে যুক্তিতর্কের মাপকাঠিতে বাজিয়ে দেখার প্রয়োজন বোধ করে না। কোনো একটি বিশেষ সমাজে বিশেষ পরিস্থিতি মোকাবিলার প্রয়োজনে কোনো একটি বিশেষ মতবাদ বা আন্দোলনের জন্ম হলে তাকে অনুকারকের দল দৈববাণী জ্ঞান করে প্রচারে নেমে পড়ে। তাদের প্রচারকৌশলের কাছে সাধারণ পাঠকই যে কেবল সম্মোহিত হয়ে পড়ে, তা নয়; স্বয়ং মতবাদের প্রবক্তা ও আন্দোলনের মূল সংগঠকও লজ্জায় রক্তিম হয়ে ওঠে। ফলে মতবাদের প্রবক্তা বিংবা আন্দোলনের পুরোধাও তার মতবাদ অন্তঃসারশূন্য কি না, সে বিষয়টি ভেবে দেখারও সুযোগ পায় না। শেষপর্যন্ত সে প্রগলভতার স্রোতে তাকেও গা ভাসিয়ে দিতে হয়। এজন্য সমকালীন সমাজব্যবস্থায় সুবিধাবাদী অগ্রজ বুদ্ধিবৃত্তিক সমাজও কম দায়ী নয়। পরবর্তী প্রজন্মের প্রথাবিরোধী ব্যক্তির পূজা পাওয়ার হীনমানসে অপচিন্তা ও রুচির বিকৃতিকেও প্রশ্রয় দিতে প্রলুব্ধ হয়। তাই বাংলা কবিতার ইতিহাসে ধ্বনির চেয়ে প্রতিধ্বনির আধিপত্যই বেশি। এ প্রতিধ্বনি ও অনুকরণের দৌরাত্ম্যে অনেক মৌলিক ও সম্পন্ন কবিকেও বহু তত্ত্বের আলোকে বিভিন্ন উপকবির অভিধায় অভিষিক্ত হতে হয়। বিষয়টি অধ্যাপক-গবেষকের জন্য সুখকর হলেও প্রকৃত কবি ও রসপিপাসু পাঠকের জন্য উদ্বেগের। একজন কবির খণ্ডিত পরিচয় কোনোভাবেই কোনো সুফল বয়ে আনে না। বরং কবি ও কবির পাঠকবলয়ের জন্য অস্বস্তিকর হয়ে ওঠে। এ কথা সত্য সার্বভৌম কবি বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন তত্ত্বের প্রবর্তন করে, উপকবি সে তত্ত্বের প্রচার ও চর্বিতচর্বনে আত্মনিয়োগ করে। ফলে উত্তরকালে কবিতার জন্য না হোক, তত্ত্বালোচনায় সে সব উপকবিও অনিবার্যভাবে প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে। সঙ্গতকারণে নতুন নতুন তত্ত্ব আমদানিতে গৌণ কবির আগ্রহ থাকে বেশি। নক্ষত্রকে গ্রহ উপগ্রহের নামাকরণে চিহ্নিত করলে নক্ষত্রের অন্তর্গত লাভার উদ্গীরণে কোনো প্রভাব পড়ে না সত্য; কিন্তু উপগ্রহ ভেবে যে ঝাঁপিয়ে পড়ে, তারই ভষ্মীভূত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। তারা মূলত মতান্ধ। এ মতান্ধের মতবাদে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় কবিতা। কারণ শিল্পের এ সার্বভৌম শাখায় কোনোরূপ আরোপিত মতবাদের ছায়া পড়লে রসপিপাসু পাঠকমনে বিতৃষ্ণা জন্মে। সে বিতৃষ্ণার জন্ম দেয় মূলত বৃত্তাবদ্ধ চিন্তকরা। যারা মূল ধারার সাহিত্য চর্চায় মৌলিক ও প্রতিভাবানদের সঙ্গে টেকে না, তারাও নিজেদের নাম সাহিত্যসভায় লেখানোর জন্য বিভিন্ন রকমের ছলচাতুরির আশ্রয় নিতে থাকে। সে চাতুর্যের ফল হিসেবেই বিভিন্ন রকমের উপসর্গভিত্তিক মতবাদ লালনে উৎসাহী হয়ে ওঠে।
বাংলা সাহিত্যে মতাদর্শবাদীরা কালক্রমে ও পারিপার্শ্বিক অবস্থার প্রেক্ষাপটে মতান্ধে পরিণত হয়ে যায়। মতবাদীরা মূলত পশ্চিমের ক্লিশে হয়ে আসা বিভিন্ন তত্ত্বকেই জ্ঞানচর্চার অনুষঙ্গ ভেবে সে পথেই নিজেদের মেধা ও প্রতিভার বিপুল অপচয় ঘটান। সে সঙ্গে তাদের অন্ধ অনুসারীগোষ্ঠীর স্তুতিকেই নিজেদের জীবনের চরম সার্থকতা মনে করে আত্মরতিতে ভোগে। তারা প্রকৃতপক্ষে চরম প্রতিক্রিয়াশীল। পোশাক পরে প্রগতিবাদের। তাদের অন্তরে প্রতিক্রিয়াশীলতা, মুখে প্রগতিবাদের বুলি। কার্যত তারা ‘প্রতিক্রিয়াশীল প্রগতিবাদী’। এ ‘প্রতিক্রিয়াশীল প্রগতিবাদী’রা মূলত প্রগতিবাদী তত্ত্বের দোহায় দিয়ে বিকৃত ও প্রতিক্রিয়াশীল চিন্তার সারাংশ দিয়েই বাংলার মানবতাবাদী ও সর্বপ্রাণবাদী চিন্তার ভরকেন্দ্রে আধিপত্য বিস্তার করতে চায়। এ মতবাদীদের ভাষ্যমতে সর্বপ্রাণবাদ কথাটিও নাকি পশ্চিমের আবিষ্কার। গৌতম বুদ্ধের ‘জীব হত্যা মহাপাপ’ ও স্বামী বিবেকানন্দের ‘জীবে দয়া করে যে জন, সে জন সেবিছে ঈশ্বর’-এর মতো সর্বপ্রাণবাদী অমোঘ উচ্চারণও নাকি তারা কোনোকালেও শোনেনি। তারা লালনের আরশিনগর না চিনলেও দেরিদার ‘বিনির্মাণবাদ’ ঠিকই চেনে। এ ধরণের মতাদর্শবাদীরা মূলত সাহিত্যের গুণবিচারবিরোধী।
সাহিত্যের নির্দিষ্ট শ্রেণীবিভাজনের ক্ষেত্রে বিভিন্ন মতবাদের প্রবর্তক ও চর্চাকারীর জন্য কষ্টসহিষ্ণু চিত্তের অধিকারী ও জীবনের বিশেষ অংশে বিশেষ ঘাত-প্রতিঘাতের প্রয়োজন। সে অর্জন ‘প্রতিক্রিয়াশীলপ্রগতিবাদী’দের নেই। মতান্ধদের দলীয় মনোবৃত্তিও বাংলা সমালোচনাসাহিত্যকে কলুষিত করে। কে কোন দলের সঙ্গে জড়িত, কে কোন দলের সমর্থক এ নিয়ে বিপুল বিতর্ক! কেউ কাউকে ছাড় দিতে রাজি নয়। এ দল যদি প্রতিক্রিয়াশীল, ও দল তাহলে প্রগতিবাদী। এ দল যদি ধর্মনিরপেক্ষতার ধ্বজাধারী, ও দল তাহলে ধর্মকেন্দ্রিক রাজনীতিক। এ দলাদলির রেষারেষিতে পড়ে প্রকৃত সাহিত্যের অবমূল্যায়ণ হয়। সাহিত্যিক পরিচয়ের চেয়ে রাজনৈতিক ও মতাদর্শগত পরিচয়ই তখন বড় হয়ে ওঠে। এজন্য কবি ও সাহিত্যিকদের ভূমিকাও কম দায়ী নয়। সাহিত্যের সঙ্গে ধর্মকর্মের প্রসঙ্গ গুলিয়ে ফেলে যারা ধর্মীয় পরিচয়কে ছাড়িয়ে মানুষ হয়ে উঠতে পারে না, তারাই নিছক ধর্মকর্মের বিষয়টি ঢাকঢোল পিটিয়ে ঘোষণা করে। ফলে কবি কিংবা কথাশিল্পী নয়, একজন সম্পন্ন মানুষ নয়, বিশেষ ধর্ম ও মতান্ধ হিসেবেই আত্মপ্রসাদ লাভ করে এবং ব্যক্তিত্বহীন হয়ে পড়ে। আমাদের রাজনীতিক ও ধর্মবিশেষজ্ঞদের মনে রাখা উচিত, ধর্মনিরপেক্ষতার মানে যেমন ধর্মহীনতা নয়, তেমনি সব ধর্মের প্রতি সৌহার্দ্যপূর্ণ অবস্থানও নয়। বরং সব ধর্মের প্রতি সহিষ্ণু মনোভাবসমেত নিস্পৃহ মনোভাবপোষণ করা। অথচ এখানে সব ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাপূর্ণ আচরণের কথা প্রচার করা হয়। একই ব্যক্তির পক্ষে কী করে সম্ভব—পরস্পর বিপরীত মতাদর্শের প্রতি সমান বিশ্বাস ও শ্রদ্ধা প্রদর্শন? ধর্ম প্রাইভেট বিষয়, তাকে পাবলিক বিষয়ে পরিণত করার অর্থই হলো মানবতার প্রতি অপমানের বৃদ্ধাঙুলি উত্তোলন করা। যে ভুল সমকালীন বাংলাসাহিত্যে কেউ কেউ অহরহই করছে। এভাবেই কবি-সাহিত্যিকের ভুলের কারণে এবং মতান্ধের মনোবৃত্তির কারণে, শুধু ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক পরিচয়ের অজুহাতে অনেক বড় শিল্পীও একশ্রেণীর সমালোচকের কাছে অস্পৃশ্য। এসব মতান্ধের কি একবারও মনে হয় না, শিল্পের সঙ্গে যাদের সম্পর্ক, তাদের সঙ্গে প্রতিক্রিয়াশীল রাজনৈতিক দলের সম্পর্ক মানবতাবিরোধিতার শামিল? তারা ন্যায়বোধ ও রুচিবোধের প্রশ্নে জাতির সঙ্গে লুকোচুরি খেলছেন।
বর্তমানে দেশে প্রগতিবাদী, প্রতিক্রিয়াশীল, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাধারী ও মুক্তিযুদ্ধবিরোধী দলে বিভক্ত সাহিত্যসমাজ। মানবতাবিরোধী অপরাধী-প্রতিক্রিয়াশীল রাজনৈতিক দলটি আজও মুক্তিযুদ্ধের সময়ে নিজেদের কৃতকর্মের জন্য প্রকাশ্যে ক্ষমা চায়নি। রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি ও মতাদর্শকেন্দ্রিক সাহিত্য-সমালোচনার ধারা থেকে গুণবিচারী সমালোচকদের বের হয়ে আসতে হবে। মুক্তচিন্তার ধারাকে বিকশিত করার লক্ষ্যে সবধরনের সংকীর্ণতা ত্যাগ করতে না পারলে, প্রথাগত ধর্মের ওপরে মানবধর্মকে স্থান দিতে না পারলে মানুষে মানুষে বিভাজন বিলোপ হবে না। মতান্ধের বৃত্ত থেকে সাহিত্যকে মুক্তি দিতে না পারলে যে বঙ্কিমসম্মিলনের সম্ভাবনা, সে সম্মিলনের পেছনের দরোজায় অশুভ মতাদর্শ বড় হয়ে ওঠে। তখন সাহিত্যের প্রকৃত রূপ ও রীতি সাময়িক উপেক্ষিত থাকে। ঔচিত্যবোধের প্রশ্নে মতান্ধের সঙ্গে ত্যাগও প্রকৃত শব্দ-শিল্পীর জন্য অনিবার্য হয়ে ওঠে। আবার নিছক ধর্মবিশ্বাসের কারণে যারা ধার্মিক কবিকে আধুনিক কবি বলতে অস্বীকার করেন তারাও আংশিক ভুল করেন। কারণ ধার্মিক মাত্রই মৌলবাদী বা প্রতিক্রিয়াশীল নন। আস্তিক্যবাদী দর্শনের সঙ্গে আধুনিকতাবাদের সম্পর্ক কি সাংঘর্ষিক? তাহলে খ্রিস্টিয় ধর্মাবলম্বি ও ঐতিহ্যের অনুসারী টি এস এলিয়ট কী করে আধুনিক কবি হন? কিংবা লিউ টলস্টয়?
মতান্ধদের আরও একটি গুরুতর প্রবণতা দশককেন্দ্রিক চিন্তা। দশকিয়া সংকলনে একদশকের ধারণাসম্মত প্রবণতা শনাক্তির মধ্য দিয়ে একেকটি দশকের অর্জন নিয়ে বেদবাক্য রচনা করে প্রকৃত কবিদের বাদ দেওয়ার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হওয়াও তাদের একটি অন্যতম কাজ। এ দশকীয়াগোষ্ঠী মূলত উৎসবকেন্দ্রিক কবি। বিভিন্ন দিবসকেন্দ্রিক উৎসব পালন করে উৎসবের রেজিস্ট্রার খাতায় যত বেশি কবির নাম নিবন্ধন করতে পারেন, তত বেশি কবি উৎপাদন করতে সক্ষম হয়েছেন বলে আত্মতৃপ্তির ঢেঁকুর তোলেন। চিৎপ্রকর্ষের কোনো চেষ্টা তাদের কবিতা কিংবা দশকীয়া নিবন্ধে থাকে না। তার জন্য কোনো চেষ্টাও তারা করে না। দশকবাদীদের প্রকোপ মূলত স্বাধীনতা-উত্তর কালখণ্ডে বেড়েছে বহুগুণ। এ সময় হাজার বছরের বাংলা কবিতার ধারাবাহিকতায় তৃতীয় শ্রেণীর উপকবিদের অর্জন ও কৃত্যের মান এতই অনুল্লেখ্য যে, তারা বিশেষ ধারার কবিতা নিয়ে আলোচনা করতে গেলে তাদের অনেকের নামও উল্লেখ করার মতো কোনো কারণ নেই। ফলে শুরু হয় বিশেষণহীন অন্তসারশূন্য দশকীয়া সংকলণের প্রকোপ। এ দশকবাদীদের প্রাদুর্ভাবে অসংখ্য গুরুত্বহীন দশকীয়া সংকলন বের হতে থাকে।
মার্ক্সবাদ, সমাজতন্ত্রাবাদ, পুঁজিবাদ, নারীবাদ, গণতন্ত্রবাদ, সন্ত্রাসবাদ, সাম্রাজ্যবাদ, পরাবাস্তবাদ, উত্তরাধুনিকতাবাদের মতান্ধরা ভুলেও চিন্তা করে না যে, একদশকে যেমন সাহিত্যের কোনো যুগরুচি গড়ে উঠতে পারে না, তেমনি কোনো তত্ত্ব দিয়েও সাহিত্যের প্রবণতা বোঝা যায় না। সাহিত্যের কোনো প্রবণতা উপলব্ধি করতে হলে দশক কিংবা মতবাদ নয়, নয় কোনো তত্ত্বকেন্দ্রিক চিন্তাও; তার জন্য চাই নির্দিষ্ট প্রকরণের সামগ্রিক রূপ। একটি কবিতা, গল্প কিংবা উপন্যাসের ভেতর একইসঙ্গে বিভিন্ন তত্ত্ব ও প্রকরণ যেমন থাকতে পারে, তেমনি একটি কবিতা গল্প কিংবা উপন্যাস একটি বিশেষ দশকে রচিত হয়েও রসগুণে তা চিরকালীন হয়ে উঠতে পারে।
যৌন বিষয়ে বাংলাদেশে কড়াকড়ি বাড়বাড়ি রকমের। এখানে প্রায় কবিই যৌন বিষয় প্রকাশের ক্ষেত্রে অবদমিত। রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, সমাজকর্মী ও সমাজচিন্তকের বিনিময় প্রত্যাশা থাকে। তারা অবদমিত হতে শেখেনি; প্রয়োজনের মর্মজ্বালা উপলব্ধি করতে ব্যর্থ। কিন্তু যিনি চরাচরের বিভিন্ন ঘটনা ও আচরণের সংঘর্ষে আপন হৃদয়কে রক্তাক্ত করার মতো ইচ্ছার অবদমনের শিকার, তার অক্ষম আক্রোশে দুরারোগ্য ব্যাধির মতো মস্তিষ্কের কোষে কোষে অনুরণন তোলে অতৃপ্ত কামনা। সেখানে নীতিবোধ নিতান্ত তুচ্ছ বিষয়। প্রেমে কামের আবেদন চিরন্তন; কিন্তু সংকীর্ণমনাদের বিধিনিষেধ পবিত্র কামকে করেছে কলুষিত। স্বভাবতই কবি মন হয়ে উঠেছে সংশয়বাদী। একদিকে মনোদৈহিক আকাঙ্ক্ষা; অন্যদিকে বৃত্তাবদ্ধ চেতনার ধারক সামাজিক প্রথার নিষেধের তর্জনি। এ দুয়ের দ্বন্দ্বে কবিমনে যে প্রতিক্রিয়া সক্রিয় হয়ে ওঠে তাতে আত্মগানিতে নীল হতে হয় কবিকে। বাঙালি মাত্রই অবদমনের শিকার। নৈতিকতার প্রশ্নে ছদ্মবেশী। মনোদৈহিক নিবেদনে দৃঢ়কণ্ঠী সে নয়; কিছুটা জাড্য তার কণ্ঠে চাঁদের কলঙ্কের মতো অনিবার্য।
বাঙালি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষালাভের সময় বিশ্বাস করতে বাধ্য হয় তার মৌলিক চাহিদা পাঁচটি। (অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান-চিকিৎসা-শিক্ষা)। তাবৎ জ্ঞানী-গুণি সে মিথ্যাচারকেই সত্য গণ্যে অনুমোদন দিয়েছেন কোনো রকম প্রশ্ন না তুলেই। কিন্তু গভীরভাবে চিন্তা করলে যে সত্য রৌদ্রকরোজ্জ্বল দুপুরের সূর্যের মতো অস্তিত্বময়, তা হলো মানুষের পেটের ক্ষুধা নিবারণের পরপরই যৌনক্ষুধা জাগে। সঙ্গত কারণে মৌলিক চাহিদা হওয়া উচিত ছিল—অন্ন-যৌনতা-বস্ত্র-বাসস্থান-চিকিৎসা-শিক্ষা। অবদমিত মন সবসময় নৈতিকতা-অনৈতিকতার প্রশ্নে দ্বান্দ্বিক। তার কাছে যে কোনো সত্য আপেক্ষিক। সে যা বলে তা বিশ্বাস করে না, যা বিশ্বাস করে, তা করার সাহস তার থাকে না। বাঙালির এ মানবিক সংকটের কারণে প্রচুর পরিমাণে কালোত্তীর্ণ সাহিত্য রচনা সম্ভব হয় না। দ্বিধাজড়িত চিত্তের পক্ষে স্বরাট উচ্চারণ অসম্ভব। যে যৌনতার প্রশ্নে বাঙালির নৈতিকতার মানদণ্ড নির্ধারিত, সেখানে হৃদয় ও মননের সংঘাত-সংঘর্ষের আশঙ্কা সার্বক্ষণিক। সুতরাং শঙ্কাহীন আপন স্বভাবের উদ্বোধন ব্যতীত শ্রেষ্ঠ সাহিত্য রচনা প্রশ্নসাপেক্ষ। যে উদ্দাম যৌনাচারের ফলে ‘নরকে এক রাত্রি’ কিংবা ‘ল্যাডিচ্যাটার্লিজ লাভার’ সৃষ্টি সম্ভব হয়েছিল, স্বাভাবিক প্রবৃত্তির অবদমনে ন্যাকামিপূর্ণ কামহীন ক্লেদাক্ত প্রেম অসম্ভব হলেও যেখানে প্রেমের ফসল আনন্দের না হয়ে বিষাদের ও কলঙ্কের হতে বাধ্য।
কবিতা ও ঐশীবাণীর অন্তর্গত সুর এক না হলেও পরস্পর বিরোধী—এমন অপবাদ নিরাসক্ত-নৈরাশ্যবাদীও দেবেন বলে মনে হয় না। তাই অনেক সময় কবিতার স্বর ও সুর ঐশীমন্ত্রের মতো শোনায়। বিষয়টা শ্রুতিকটু না ঠেকে মর্মে দোলা দেয়। কবিতা ও ঐশীবাণীর ঐকান্তিক সুরে অনেক সময় মানবমনে করুণ রসের উদ্বোধন ঘটে। সে করুণ রসও শ্রোতার গ্রহণক্ষমতার তারতম্যের ভেতর দিয়ে কখনো কখনো শান্তরসে রূপান্তরিত হয়। তখন মনে হয় কবিতা ও ঐশীবাণীর উৎসবিন্দু এক-অভিন্ন। এ কারণে কবিতা সংস্কৃতিবান মানুষের পাশাপাশি ধার্মিকেরও চিৎপ্রকর্ষের প্রেরণা হয়ে ওঠে।
যুদ্ধ-বিগ্রহ, ক্ষুধা-দারিদ্র্য, হত্যা-লুণ্ঠন, সন্ত্রাস-কালোবাজারি, রাজনীতি, সামাজিক ও অর্থনৈতিক সংকট সচেতন কবিকে ভাবিত না করে পারে না। সৎ কবি কখনো নিজেকে এসব আর্থসামাজিক পটভূমি থেকে সরিয়ে রাখেন না। ফলে তাকেও এসব সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় কর্মযজ্ঞে অংশগ্রহণ করতে হয়। এককালের প্রশংসিত কাজও উত্তরকালে ঘৃণার বিষয়ে পর্যবসিত হতে পারে। তার জন্য সে কাজের পরিকল্পনাকারী, বাস্তবায়নকারী কিংবা সমর্থনকারীকে দোষ দেওয়া যায় না। সময়ের বির্বতনে মানুষের বিশ্বাস ও আচরণে পরিবর্তন আসে। তখন স্থান-কাল ভেদে মানুষের ভাললাগার-শ্রদ্ধার-ভক্তির বিষয়ও পরিবর্তিত হতে পারে। সেসব তুচ্ছ বিষয় মনে রেখে প্রকৃত কবিকে অবজ্ঞা করা আত্মঘাতী আচরণের নামান্তর মাত্র।
বিশ্ববাসী ক্ষমা করে দিয়েছে হিটলারের নাৎসীবাহিনীর সক্রিয় সদস্য গুন্টারগ্রাসকে। নাৎসীবাহিনীর কর্মকাণ্ডকে বাচবিচারহীনভাবে সমর্থন করার দায়ে অভিযুক্ত এজরাপাউন্ডকেও এখন তেমন দোষারোপ করা হয় না। সমগ্র বিশ্বকে ঔপনিবেশ বানিয়ে রাখা ব্রিটিশদের সাম্রাজ্যবাদী শোষণ থেকে আইরিশরা আজও মুক্তি পায়নি। অথচ ভাষাগত আচরণে বিনয়ী, শাসন-শোষণে চতুর বৃটিশদের দোষের চেয়ে গুণাবলী নিয়ে বিশ্ববাসী প্রশংসা করে। কিন্তু অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক দিক থেকে পিছিয়ে পড়া জাতিগুলো কেবল রিরংসা জিইয়ে স্বগোত্রের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি দ্বন্দ্ব লালন করতে চায়। ফলে কে প্রগতিবাদী, কে মৌলবাদী—এ প্রশ্ন বড় হয়ে ওঠে। তাদের লক্ষ্য মূলত বিন্দুকেন্দ্রিক। অর্থাৎ বিন্দুর শাসনে তারা স্বেচ্ছায় শোষিত হতে চায়। নিজের শাসনভার নিজের হাতে নেওয়ার মতো মনোদৈহিক সামর্থ্য তাদের নেই। ফলে পরশ্রীকাতরতা, ঈর্ষাপরায়ণতা তাদের ভেতর ব্যাধির মতো বাসা বাঁধে। নিজের দেশের কমলালেবু-আম লিচু না খেয়ে বাইরের কেমিক্যাল মিশ্রিত জুস খাওয়ার মধ্যে আভিজাত্য খুঁজে বেড়ায়। জা পল সাঁত্রে মানবতাবিরোধী সাম্র্রাজ্যবাদী শক্তির হাত থেকে নোবেল নিতে পর্যন্ত অস্বীকার করেছিলেন। সেটি তুচ্ছ কোনো চমক সৃষ্টির অসৎ উদ্দেশ্যে নয়। মানুষের রক্তে রঞ্জিত হাত থেকে নোবেল গ্রহণ করতে মানবতাবাদী শিল্পী রাজি হননি। বিপরীতে আমাদের দেশের প্রধান কবি-কথাসাহিত্যিকরা তুচ্ছস্বার্থের জন্য প্রতিক্রিয়াশীল রাজনৈতিক দলের ছায়ায় নিজেদের আবাস কামনা করেন। কিন্তু কেন? তারা কি জানেন না—কলকারখানার বর্জ্যপ্রবাহিত ড্রেন প্রবহমান নদীকে কিছু দিতে পারে না। যা দেয়, তাতে প্রবহমান নদীর বিশুদ্ধতা নষ্ট হয়। ড্রেন নদীতে গিয়ে পড়লে ড্রেনের মর্যাদা বাড়ে সহস্রগুণ, কিন্তু নদীর তাতেই ক্ষতি। প্রবহমান হলেও ড্রেন থেকে পতিত আবর্জনা নদীর বিশুদ্ধতাকে কলুষিত করে।
মানবিকগুণরহিত রাষ্ট্রবিজ্ঞানী যখন কবিতাবিমুখ হয়ে ওঠেন, তখন আদর্শ রাষ্ট্রে কুকুর দার্শনিকের মর্যাদা পায়। অথচ কবির ভাগ্যে জোটে নির্বাসন। প্লেটোর প্রবল বিতৃষ্ণা সত্ত্বেও কবিতা মানুষের মন থেকে মুছে যায়নি। যাবেও না। উল্টো প্লেটোর দর্শন ভুল প্রমাণ করে পাবলো নেরুদার মতো শ্রেষ্ঠকবিরা রাষ্ট্র পরিচালনার কাজে সহযোগিতা করেছেন। বিপরীত দৃশ্যও কি নেই? রাষ্ট্রনায়ক কিংবা সামরিক বাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার সঙ্গে কবির বন্ধুত্বকে আমাদের এখানে সন্দেহের চোখে দেখা হয়। পরশ্রীকাতর সমালোচকরা হয়তো জানেন না—রাষ্ট্রনায়ক কিংবা সমরনায়ক কারও সঙ্গে কবি সাহিত্যিকদের প্রত্যক্ষ কোনো যোগাযোগ কিংবা রাষ্ট্র পরিচালনানীতি ও সমরনীতি সম্পর্কে বাস্তব ধারণা না থাকায় আমাদের মুক্তিযুদ্ধের মতো এত বড় ঘটনা নিয়েও বিশ্বস্ত কোনো মহৎ কাব্য কিংবা উপন্যাস রচনা সম্ভব হয়নি। কোনো মতান্ধের মতাদর্শ কিংবা বৃত্তাবদ্ধের স্বার্থচিন্তা নয়; নয় কোনো তুচ্ছ তত্ত্বের প্রতি মোহগ্রস্ত পক্ষপাত। বিশুদ্ধচিত্তে সাহিত্যকে সাহিত্যের ভেতর অন্বেষণই প্রকৃত কবি-সাহিত্যিক-সমালোচক-পাঠকের লক্ষ হওয়া উচিত। উৎকৃষ্ট সাহিত্যের প্রযত্ন যদি রাষ্ট্রনায়কও হয়ে ওঠেন, তার সে ঔদার্যকে স্বাগত জানাতে দোষ কী?