ঝরনার মুখে বাধা দিলে তার গতি থামে না, বরং দ্বিগুণ গতিতে লাফিয়ে চলে। সত্যসন্ধানীকে কোনো প্রলোভন কিংবা ভয় দেখিয়ে নিরস্ত করা যায় না, তাতে তার সংশয় বাড়ে, বাড়ে অন্বেষণ ক্ষমতাও। সমাজে যখন একজন প্রথাবিরোধী মানুষের আবির্ভাব ঘটে, তখন সমাজপতিরা সামাজিক শৃঙ্খলা, প্রথা, আইন ও ধর্মের অজুহাতে তার বিরোধিতা করে। তবে, এই ধর্মান্ধ ও সুবিধাবাদী সমাজপতিতের রক্তচক্ষুর ভয়ে সত্যসন্ধানী কখনো থেমে যান না। বাধা এলে সেখানে রুখে দাঁড়ানোই তার স্বভাব। দ্রোহী সত্তা তাকে আপসহীন করে তোলে। সমাজ এই অনাপসকে দেখে ভয়ের চোখে, অপবাদ দেয় নান রকম। তার চিত্তের দার্ঢ্যরে নাম দেয় গোয়ার্তুমি, তাকে করে অবজ্ঞা। মনীষার প্রতি সমাজের অবজ্ঞা বাড়ে। মনীষার তথা-গোয়ার্তুমিকে দেখে নেতিবাচকভাবে। কিন্তু সত্যসন্ধানীর কাছে তা-ই হয়ে ওঠে নমস্য। এই নমস্যদের একজন আরজ আলী মাতুব্বর।
আরজ আলী মাতুব্বর যতটা প্রশ্নশীল ততটা বিশ্লেষক নন। তবে তার প্রশ্নেই উত্তর প্রচ্ছন্ন। সহজে বক্তব্যের মর্ম উপলব্ধি করা যায়। দারিদ্র্য আর বিরূপ পরিবেশ-সময়ে বসে তার জ্ঞানসাধনা ও লেখালেখি। ওই পরিস্থিতিতেও তার মনে এত বেশি মৌলিক প্রশ্নের উদয় হয়েছে যে, সব প্রশ্নের বিশ্লেষণাত্মক উত্তর লিখতে গেলে অনেক প্রশ্নই হয়তো অপ্রকাশিত থেকে যেত। মানবমনে সৃষ্ট প্রশ্ন তাৎক্ষণিক প্রকাশ করতে না পারলে সময়ের ব্যবধানে পরিস্থিতির হেরফেরে অনেক প্রশ্ন মন থেকে মুছে যায়। তখন শত চেষ্টা সত্ত্বেও স্মরণ করা সম্ভব হয় না। আরজ আরী মাতুব্বরের ক্ষেত্রে তাই ঘটেছে। ফলে তিনি অনবরত প্রশ্ন করে গেছেন, উত্তরের অপেক্ষা করেননি। এসব প্রশ্ন সমাজ-রাষ্ট্র-ধর্মের নানা দিক বিশ্লেষণ করে উদয় হয়েছে। চিন্তার প্রশ্নে, সমাজ বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে পর্যবেক্ষণ ও সততার সম্মিলন যিনি ঘটাতে পারেন, তার চিন্তার প্রকাশ স্বতন্ত্র হতে বাধ্য। আরজ আলী মাতুব্বরও এর ব্যতিক্রম নন।
এই মনীষী সমাজের বিশৃঙ্খলা ও রাজনৈতিক অস্থিরতার ভেতর লক্ষ করেছেন ধর্মের অপকৌশল ও বিকৃত ব্যাখ্যা। যেসব ব্যাখ্যা সমাজের কোনো কল্যাণ তো সাধন করেইনি, উল্টো কল্যাণের পথে বার বার বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ প্রসঙ্গে আরজ তার বক্তব্য ‘…আমার মা মারা গেলে আমি আমার মৃত মায়ের ফটো তুলেছিলাম। আমার মাকে দাফন করার উদ্দেশ্যে যে সমস্ত মুন্সী, মৌলভী ও মুছল্লি এসেছিলেন, ‘ফটো তোলা হারাম’ বলে তারা আমার মা’র নামাজে জানাজা ও দাফন করা ত্যাগ করে লাশ ফেলে চলে যান। অগত্যা কতিপয় অমুছল্লি নিয়ে জানাজা ছাড়াই আমার মাকে সৃষ্টিকর্তার হাতে সোপর্দ করতে হয় কবরে। ধর্মীয় দৃষ্টিতে ছবি তোলা দূষণীয় হলেও সে দোষে দোষী স্বয়ং আমিই, আমার মা নন।’ ধর্মের অপব্যাখ্যাকারীদের ক্রোধের সামনে কষ্ট পেলেন আরজ আলী মাতুব্বর, শাস্তি পেলেন তার মা। ফলে অল্প বয়সে ধর্মের প্রতি তার বিরাগ জন্মানোর কথা, হয়ে ওঠার কথা ধর্মবিদ্বেষী। কিন্তু বিদ্বেষী হওয়ার পরিবর্তে হয়ে উঠলেন জিজ্ঞাসু। শুরু হলো তার জ্ঞান অন্বেষণ। বিপুল পঠন-পাঠন ও গবেষণায় জানার চেষ্টা করলেন প্রতিটি প্রধান ধর্মের উৎপত্তির কারণ ও বিকাশের সামাজিক পরিপ্রেক্ষিত। ধর্ম-তাত্ত্বিক বিষয়ে তার আলোচনার মূল বিষয় জীবসৃষ্টির উদ্দেশ্য, পাপ-পুণ্য, ইহকাল-পরকাল, স্বর্গ-নরক, স্রষ্টা-সৃষ্টি। ধর্মের এসব বিষয়ে কিছু মৌলিক প্রশ্ন তুলেছেন। যার উত্তর বিজ্ঞানবিমুখ ধার্মিকদের পক্ষে দেয়া সম্ভব নয়। যারা কোনো বিষয়ের যৌক্তিক ও বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দিতে অপারগ তারা নানা রকম বিধিনিষেধ আরোপ করে প্রশ্নকারীকে থামিয়ে দিতে চায়। বিজ্ঞানবিমুখ ধার্মিকদের প্রচারিত স্বতঃসিদ্ধ সত্য হলো মানব সৃষ্টির উদ্দেশ্য হলো, স্রষ্টার গুণকীর্তন করা। ধার্মিকদের প্রতি আরজ আলীর প্রশ্ন এখানে তাদের প্রচারিত ধর্মমতানুসারে স্রষ্টাই সব কিছু সৃষ্টি করেছেন, সব শক্তির অধিকারী স্রষ্টা, যার অগোচরে ও ইচ্ছার বিরুদ্ধে বিশ্বচরাচরের কোথাও কিছু ঘটে না; তাহলে মানুষের পাপপুণ্য কী? কেন মানুষের জন্য শাস্তি-পুরস্কারের বিধান? মানুষেরই বা কেবল বিচার কেন, কেন অন্যান্য প্রাণীর বিচার হবে না? ধর্মান্ধরা যেহেতু মৌলিক বিষয়ে প্রশ্ন তোলাকে গর্হিত মনে করে, সেহেতু নিজেরাও কখনও প্রশ্ন তোলে না। অন্যে তুললে তাকেও দেখে সংশয়ের চোখে।
অমল দাশগুপ্তের ‘পৃথিবীর ঠিকানা’ থেকে ঋণস্বীকার করে ধর্মের মৌলিক বিষয়ে তার যৌক্তিক প্রশ্ন ‘বিজ্ঞানীগণ বলেন যে, ভূপৃষ্ঠের গড় উত্তাপ ২০০ সেন্টিগ্রেড বা ৬৮০ ফারেনহাইট এবং ৩০ মাইল নিচের তাপমাত্রা ১২০০০ সে. বা ২২০০০ ফা.। এই উত্তাপে অনায়াসে পাথর গলে যেতে পারে। আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত ও লাভাক্ষরণ সেখান হইতেই হইয়া থাকে। নিচের দিকে ক্রমশ উত্তাপ বৃদ্ধি পাইয়া কেন্দ্রের দিকে তাপমাত্রা দাঁড়ায় ৬০০০০ সে.।’ এই বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব উপস্থাপনের পর যৌক্তিক প্রশ্ন ‘ইহা সূর্যের বহিরাবরণের তাপের সমান। ইহাতে বুঝা যায় যে, ভূগর্ভে নরকাগ্নি থাকা অসম্ভব নহে। কিন্তু স্বর্গীয় উদ্যানসমূহ কোন্ জায়গায়?’ এখানে আরজ আলী মাতুব্বরের বিরুদ্ধবাদীদের পাল্টা প্রশ্ন থাকতে পারে মাতুব্বর যদি বিজ্ঞানভিত্তিক প্রশ্নই করবেন, তাহলে নরক সম্পর্কে তার ধারণা ভূগর্ভস্থকেন্দ্রিক কেন? উত্তর আরজ আলীর কাছেই ‘শোনা যায় যে, মৃত্যুর পরে শবদেহকে কবরের ভিতরে পুনর্জীবিত করা হয় এবং ‘মনকির’ ও ‘নকির’ নামক দুইজন ফেরেশতা আসিয়া প্রত্যেক মৃতকে তাহার ধর্ম সম্পর্কে প্রশ্ন করে। যাহারা পাপী, তাহারা প্রশ্নের জবাব দিতে পারে না বলিয়া তাহাদের উপর ঐ ফেরেশতাদ্বয় অমানুষিক অত্যাচার চালায়। গুর্জের (গদার?) আঘাতে দেহ ৭০ গজ নিচে প্রোথিত হইয়া যায়। আবার তাহারা উহাকে পুনরোত্তলন করিয়া লয়। দোজখ হইতে সুড়ঙ্গপথে আগুনের উত্তাপ আসিয়া বেহেশতের মলয় উপভোগ করিতে থাকেন।’ এই বর্ণনা আরজ আলীর নিজস্ব নয়, ধর্মের। ফলে স্বর্গ-নরকের অবস্থান ভূগর্ভকেন্দ্রিক, এটা ধারণা বা অনুমান মাত্র নয়, ধর্মপাঠলব্ধ জ্ঞান। স্বর্গ-নরক সম্পর্কে তার চূড়ান্ত প্রশ্ন ‘কোনরূপ ভৌগোলিক সত্তা আছে কি?’ কিন্তু এ প্রশ্নের উত্তর দিতে হলে, উত্তরদাতার একাধারে ধর্মীয়, বৈজ্ঞানিক, চিকিৎসাশাস্ত্র, যুক্তিবিদ্যা, ইতিহাস, নৃতত্ত্ব, পুরাতত্ত্ব ইত্যাদি বিষয়ে বিশদ জ্ঞান থাকা আবশ্যিক। এর কোনো একটিরও কমে স্বর্গ-নরক সম্পর্কিত বাস্তবানুগ, যুক্তিসঙ্গত বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দেওয়া সম্ভব নয়।
এখন কথা হলো যেখানে মহাবিশ্বের গ্রহ-নক্ষত্র থেকে শুরু করে কীটপ্রতঙ্গের গতি ও জীবচক্র গবেষণা ও পরীক্ষায় প্রমাণ সম্ভব সেখানে ধর্মের মৌলিক বিষয়ে প্রশ্ন উত্থাপিত হলে তার সমাধান সম্ভব নয় কেন? এ ধরনের প্রশ্ন করার জন্য যে পরিমাণ ও ধরনের শিক্ষা ও অনুসন্ধিৎসু মন থাকা দরকার তা সবার থাকে না। হাজারে একজনের থাকে আরজ আলী সেই একজন। তার অনুসিন্ধৎসা ও আত্মজিজ্ঞাসার ধরন স্বাভাবিকভাবেই স্বতন্ত্র হতে বাধ্য। এ প্রসঙ্গে রণদীপম বসু ‘আপ্তবাক্য বনাম আরজ আলী’ প্রবন্ধে বলেছেন ‘জানার অদম্য কৌতূহলে শিক্ষা-দীক্ষা, জীবন-যাপনে জাগতিক সমস্ত প্রতিকূলতায় আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থেকেও অজ্ঞানতার বিরুদ্ধে শুধুমাত্র স্বীয় পরিচর্যায় কীভাবে জ্ঞানচেতনায় দার্শনিক বিভার উদ্ভাস ঘটাতে হয়, তাই দেখিয়েছেন আমাদের আরজ আলী মাতুব্বর।’ আরজ আলী দৃঢ়প্রত্যয়ী। যা বলতে চেয়েছেন বলেছেন, ধর্মের ভয়, সমাজের ভয় কিংবা রাষ্ট্রের রোষানল কোনো কিছুই তাকে আটকাতে পারেনি। আরজ আলী সাহসী ছিলেন, দুঃসাহসী নন। তার অদম্য সাহসিকতা প্রসঙ্গে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী ‘বিরূপ বিশ্বে সাহসী মানুষ’ প্রবন্ধে লিখেছেন ‘সাহস দু’রকমের হয়। এক রকমের সাহস নাটকীয়, আরেক সাহস শান্ত। নাটকীয় সাহস ঢাকঢোল বাজায় এবং সেই বাজনার উত্তেজনা থেকে রসদ নিয়ে নেয়। শান্ত সাহস ধীর-স্থির এবং অনমনীয়। আরজ আলী মাতুব্বরের সাহস এই দ্বিতীয় ধরনের। তিনি সর্বদাই শান্ত এবং সর্বক্ষণ অনমনীয়। যুদ্ধ করেছেন, কিন্তু যুদ্ধের সাজ নেই। জয়ী হয়েছেন কিন্তু বিজয়ীর দম্ভ নেই।’ আরজ আলীর মূল শক্তি এবং চারিত্র্য সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী যথার্থই শনাক্ত করেছেন। সুবিধাবাদী সমাজ সেবক থেকে শুরু করে রাজনীতিবিদ, চিন্তক সবাই নিজেদের কর্মযজ্ঞের সংবাদ সরবে প্রচার করেন, আরজ আলী ব্যতিক্রম।
মানবমঙ্গলের প্রশ্নে, সমাজ-উন্নয়নের প্রশ্নে, মানুষকে সংস্কৃতিবান করে তোলার লক্ষ্যে একজন জ্ঞানতাপস-দ্রোহীর যা করা কর্তব্য তিনি তা-ই করেছেন। লিখে গেছেন দৃঢ়তার সঙ্গে চিৎকার করে নয়, নীরবে। জ্ঞান সাধনা ও তা প্রকাশের ধরনে আরজ আলী প্রশ্নশীল। কোনো সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয়া কিংবা মন্তব্যসর্বস্ব বক্তব্যের দেখা মেলে না তার রচনায়। প্রশ্নের বিষয়ও কিছু মৌলিক অথচ স্বাভাবিক প্রসঙ্গে। মানুষ ও পশুর সাদৃশ্য, আকাশ-পৃথিবী, দিন-রাত, পৃথিবীর অবস্থান, ভূমিকম্প, বজ্রপাত, ঋতুপরিবর্তন, জোয়ার-ভাটার সময়, আগুনের ধর্ম, লৌকিক-ইহলৌকিক ধর্ম এমন অনেক বৈজ্ঞানিক সমাধানসম্মত বিষয়। প্রশ্নের সঙ্গে বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যার প্রতিও সমর্থন ব্যক্ত করেছেন। বিষয়গুলোর এত সহজ সমাধান বিজ্ঞান করেছে যে, তার প্রমাণও সহজে মেলে। কিন্তু বিজ্ঞানবিমুখ ধর্মান্ধরা এসব বিষয়ে যেসব তথ্য ও কারণ প্রচার করে তার সঙ্গে বাস্তবতার কোনো মিলই খুঁজে পাওয়া যায় না। ধর্মান্ধদের প্রচারিত তথ্যগুলো হাস্যকর হয়ে উঠলেও তারা নিজেদের মতামত নিয়ে পুনশ্চিন্তায় মগ্ন হয় না। ভাবতে অবাক লাগে এসব বিষয়ে বিজ্ঞানের প্রমাণ উপস্থিত দেখেও বিজ্ঞানের সুফল ভোগ করেও ধর্মান্ধরা উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত ধারণা থেকে একচুলও নড়ে না। আরজ আলীর কৃতিত্ব এখানে যে কুসংস্কারচ্ছন্ন, ধর্মান্ধ সমাজে বসেই বিজ্ঞানভিত্তিক প্রশ্ন তুলেছেন সমাজের কাছে। বিরূপ সমাজে মনীষার কাজ দ্রোহ করা, সে দ্রোহ শান্ত-স্থির ও নিরুত্তেজ। আরজ আলী মাতুব্বর সে-ই দ্রোহী মনীষী, যিনি কোনো খ্যাতি-মোহের প্রতি আকৃষ্ট নন, শান্ত অথচ নির্ভীক নিজের অভিমত প্রকাশে।
•প্রথম প্রকাশ: শুক্রবার, ৭ ডিসেম্বর ২০১২, দৈনিক জনকণ্ঠ