বাংলা ভাষার অন্যতম প্রধান কবি আল মাহমুদের জন্ম ১৯৩৬ সালের ১১ জুলাই, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। তিনি একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক, ছোটগল্প লেখক, শিশুসাহিত্যিক ও সাংবাদিক। তার উল্লেখযোগ্য গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে লোক লোকান্তর, কালের কলস, সোনালী কাবিন, মায়াবী পর্দা দুলে ওঠো, আরব্য রজনীর রাজহাঁস, বখতিয়ারের ঘোড়া, Al Mahmud In English, দিনযাপন, দ্বিতীয় ভাঙ্গন, একটি পাখি লেজ ঝোলা, পাখির কাছে ফুলের কাছে, আল মাহমুদের গল্প, গল্পসমগ্র, প্রেমের গল্প, যেভাবে বেড়ে উঠি, কিশোর সমগ্র, কবির আত্নবিশ্বাস, কবিতাসমগ্র, কবিতাসমগ্র-২, পানকৌড়ির রক্ত, সৌরভের কাছে পরাজিত, গন্ধ বণিক, নদীর ভেতরের নদী, উপমহাদেশ, উপন্যাস সমগ্র-১, উপন্যাস সমগ্র-২, উপন্যাস সমগ্র-৩। ২০১৩ সালের ২৬ অক্টোবর ছোটকাগজ অনুরণনের পক্ষ থেকে আল মাহমুদের মুখোমুখি হন কবি, প্রাবন্ধিক ও সংবাদকর্মী মোহাম্মদ নূরুল হক এবং শিশুসাহিত্যিক ও সংবাদকর্মী আবিদ আজম। কবির জন্মদিন উপলক্ষে চিন্তাসূত্রের বিশেষ আয়োজনের অংশ হিসেবে সাক্ষাৎকারটি এখানে হুবহু তুলে ধরা হলো।
আল মাহমুদ, বাংলা কবিতার এক অনিবার্য নাম। যিনি যৌবনে আবেগে উদ্বেল কবিতায়, বার্ধক্যে ধর্মে সমর্পিত। ১১ জুলাই তার জন্মদিন। তিনি লেখালেখির শুরু থেকে শেষপর্যন্ত মানবজীবনের নানাদিক তার কবিতায় ফুটিয়ে তুলেছেন। নারী-প্রকৃতি-ধর্ম-রাজনীতি, প্রেমের মতো বহুরৈখিক বিষয় তার কবিতার অনুষঙ্গ হয়ে উঠেছে। তার কবিতায় চিত্রকল্প-উপমা যেমন নতুন উদ্দীপনা সৃষ্টি করে কবিতাপ্রেমীদের মধ্যে, তেমনি তার ব্যক্তিগত জীবন-যাপনও অনেকের কৌতূহলের বিষয়। এ কবির ব্যক্তিগত রাজনৈতিক দর্শন যাদের অপছন্দের, তারাও তার কবিতার মুগ্ধ পাঠক, তার মঙ্গলাকাঙ্ক্ষী।
একটি সাহিত্যবিষয়ক ছোটকাগজের জন্য আল মাহমুদের একটা সাক্ষাৎকার নেওয়ার কথা ছিল। ২০১৩ সালের সেই মে কি জুনে। কিন্তু সময় আর হয়ে ওঠে না। আল মাহমুদের বাসায় যাব কিভাবে এসব নিয়ে যখন ভাবছিলাম, তখনই মনে পড়ল তরুণ কবি আবিদ আজমের নাম। সৌভাগ্যবশত আবিদ আজম আর আমি এখন একই বাড়ির বাসিন্দা। ও থাকে বাড়ির একতলায়, আমি তৃতীয় তলায়। ২৬ অক্টোবর সকালে আবিদ আজমকে ফোন করে আল মাহমুদের বাসায় যাওয়ার বিষয়টা জানাতেই বললেন, আজই চলুন।
দু’জন একসঙ্গেই হাজির হলাম আল মাহমুদের বাসায়। আবিদ আজম আমাকে গেস্টরুমে বসিয়ে রেখে ঢুকে গেল আল মাহমুদের বেডরুমে। কিছুক্ষণ পর ডাক পড়ল আমার। গিয়ে দেখি, আল মাহমুদ মুখে মুখে কবিতা রচনা করছেন, আর আবিদ আজম শ্রুতি লিখন করছেন। লেখা শেষে আবিদ কবিতাটা শোনালেন আল মাহমুদকে। বললেন, মাহমুদ ভাই, কেমন লিখলাম? আল মাহমুদ সবিস্ময়ে তাকালেন আবিদের দিকে—তুমি লিখলে? আবিদ বললেন, তো? কে লিখেছে? কবি যেন এবার আসল বিষয় ধরতে পারলেন, হো হো হো করে উঠলেন। বললেন, হ্যাঁ চমৎকার লিখেছ। তোমার লেখার তুলনা হয় না। এরপর হঠৎই যেন আমার দিকে দৃষ্টি পড়ল তার। বললেন, ‘তুমি কে?’
মোহাম্মদ নূরুল হক: আপনাকে দেখতে এলাম। কেমন আছেন মাহমুদ ভাই?
আল মাহমুদ: আজ সকালে গিয়াস কামাল চৌধুরী মারা গেছেন, জানো তো?
হক: হ্যাঁ। (আমার কথার মাঝখানে কবি থামিয়ে দিলেন। বললেন, সবাই একে একে চলে যাচ্ছেন। আমারও তো বয়স হয়েছে, আমিও চলে যাব যেকোনো দিন। এ সময় আবিদ কবিকে প্রবোধ দেওয়ার ছলে বললেন, আপনার আর তেমন বয়স কত?)
আল মাহমুদ: রবীন্দ্রনাথ বেঁচেছিলেন দীর্ঘ দিন। কিন্তু আমি দেখেছি এই বৃদ্ধবয়সে আমি খুব দুর্বল হয়েছি। বৃদ্ধবয়সে অনেকে হুঁশ হারিয়ে ফেলেন। হাঁটাচলা করতে পারেন না।
হক: সে হিসেবে আপনি অনেক ভালো আছেন। আমরাও আপনার সুস্থতা কামনা করি।
আল মাহমুদ: হ্যাঁ আমি অনেক ভালো। আল্লাহর রহমতে অনেক ভালো আছি। তবে দিন শেষ হয়ে আসতেছে। সত্তর আশি বছর বেঁচে থাকা আর…
আবিদ আজম: একশ বছর বেঁচে থাকা তেমন বেশি কিছু না…
আল মাহমুদ: অবশ্যই এত বেশি বছর বেঁচে থেকেই বা লাভ কী? (সমস্বরে হাঁসি)। যদি লিখতে না পারি?
হক-আবিদ (একসঙ্গে): না আপনি তো লিখতে পারেন…
আল মাহমুদ: যাই হোক, খুব খুশি হলাম আপনার সঙ্গে দেখা হওয়ায়। কী নাম আপনার?
হক: মোহাম্মদ নূরুল হক।
আল মাহমুদ: বাড়ি হইল…
হক: নোয়াখালী।
আল মাহমুদ: নোয়াখালীর কোথায়?
হক: মাইজদী।
আল মাহমুদ: মাইজদীতে, ও…। ওখানে তো আমি গেছিলাম।
হক: হ্যাঁ, আপনার সঙ্গে আমি দেখা করেছিলাম সেবার। আপনার ছোট একটা সাক্ষাৎকারও নিয়েছিলাম। একসঙ্গে ঘুরেছি, আপনার সঙ্গে ছবি-টবিও তুলেছি…
আবিদ: হ্যাঁ মাহমুদ ভাই, হক ভাই আপনাকে নিয়ে অনেক প্রবন্ধ লিখেছেন, জনকণ্ঠে, ডেসটিনিতে, আরও কোথায়-কোথায় যেন… হক ভাই যখন ইত্তেফাকে ছিলেন, তখন আপনার কবিতা নিয়ে ছাপিয়েছেন সেখানে। বিলও অগ্রিম পাঠিয়ে দিয়েছিলেন নাইস নূরের কাছে।
আল মাহমুদ: কবিতা ছাপালে তো আমাকে খালি হাতে ফেরানোটা যায় না। কবিকে তো সম্মান দিতে হয়।
হক: মাহমুদ ভাই আমি লেখকের সম্মান ও সম্মানি একসঙ্গেই দেই।
আবিদ: হ্যাঁ, সেটাই। এই আরকি! হকভাই আপনাকে নিয়ে লিখেছেন, তার বইয়েও আপনাকে নিয়ে একাধিক প্রবন্ধ আছে। লোকে বলে, আপনাকে গালি দিয়েও নাকি প্রবন্ধ লিখেছেন এই লোক। উনি এখন দৈনিকে আছেন।
আল মাহমুদ: এটা কোন দৈনিক?
আবিদ: আমাদের সময়।
আল মাহমুদ: খুবই ভালো। খুবই ভালো। সারাজীবন তো আমি এই-ই করেছি। করে যাচ্ছি। আমি সম্পাদক ছিলাম গণকণ্ঠের। লেখালেখির কারণে প্রচুর জুলুম আমার ওপর দিয়ে গেছে। সংসার তছনছ হয়ে গেছে। ছেলে-মেয়ের লেখাপড়া বাধাগ্রস্ত হয়েছে। এখন সময় শেষ হয়ে এসেছে। মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করছি আর কি!
আবিদ: না, মৃত্যুর সময় না। আপনি বয়োজ্যেষ্ঠ, আমার বয়স অনেক কম। কিন্তু আমি আপনার আগেও মারা যেতে পারি। এটা বলা যেতে পারে…
আল মাহমুদ: আমি এখন খাওয়া কন্ট্রোল করে চলি। মুসলমানদের ওই কথা মানি। পেট ভরে খাইতে হয় না। একটু খালি রাখতে হয়।
আবিদ: একবার আমরা কবি আবু হাসান শাহরিয়ারের নিমন্ত্রণে যুগান্তরের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে গেলাম না? সেখানে তো খাওয়ার টেবিলে শাহরিয়ার ভাই খাবার তুলে দিচ্ছেন আপনার প্লেটে। আপনি বললেন, না, না শাহরিয়ার আমি খেতে পারি না। তুমি মরা ঘোড়ার ওপরে বাজি ধরো না। আমি বেশি খেতে পারি না। (সমস্বরে হাসি) অনেক দিন আগে।
আল মাহমুদ: আবিদ কোত্থেকে এসেছ?
আবিদ: বাসা থেকে। আব্বা অসুস্থ। তার পাশে বসেছিলাম। এ সময় হক ভাইয়ের ফোন। বললেন, মাহমুদ ভাইয়ের সঙ্গে একটু দেখা করতে যাব। তিনি অবশ্যই অনেক দিন থেকে বলে আসছিলেন। তো ফোন পেয়ে বললাম, চলেন আজই যাই। গত তিন মাস ধরে হক ভাই বলতেছেন। তো আজ নিয়ে এলাম তাকে।
আল মাহমুদ: আমি তো ভাই বুড়ো মানুষ। আমার তো কিছু করার থাকে না। মাঝেমাঝে লেখি। (আবিদ আজমের দিকে তাকিয়ে, আমাকে ইঙ্গিত করে ও কী করে?)
আবিদ: উনি প্রবন্ধ লেখেন। কবিতাও লেখেন। এখন যদিও উনি নিউজের মানুষ হয়ে গেছেন। এখন কবিতার কথা ভুলে গেছেন কি না।
হক: না, না, এখনও লিখি। প্রতি সপ্তাতে অন্তত একটা গদ্য লিখি।
আল মাহমুদ: আমিও তো এডিটরগিরি করেছি। এরপরও তো কবিতা ভুলিনি। প্রতি বছর ফেব্রুয়ারি মাসে বইমেলা হয়, সেখানে তো আমার একটা না একটা কবিতার বই বের হয়। আচ্ছা তুমি কেন এসেছ, তা তো বললে না।
আমি লিখলে কেউ একজন হয়তো ঘরে বসে, রান্নাঘরে চোখ টিপেটিপে কাঁদতো
হক: আপনাকে দেখতে এলাম। আপনাকে দেখাও হলো, আপনার কিছু কথাও শোনা হলো। এই জন্যই আসা।
আল মাহমুদ: বলো…কী জানতে চাও…
হক: আপনি অনেক কথাই বলেছেন। অনেক সময় একই কথা বারবারও বলেছেন। আমি শুনতে এসেছি এমন কিছু কথা, যা আগে কখনো বলেননি। এমন কিছু কথা, যা বলতে ইচ্ছা করে, অথচ বলতে পারছেন না।
আল মাহমুদ: আছে কিন্তু তোমাকে বলব না। কারণ বিষয়টা খুব ব্যক্তিগত। তবে আমি কোথাও-কোথাও লেখার চেষ্টা করেও লিখিনি।
হক: কেন লিখলেন না? লেখা যেত না?
আল মাহমুদ: লেখা যেত, কিন্তু ঠিক হতো না।
হক: সামাজিক কারণ?
আল মাহমুদ: আমাদের এই সামাজিক পরিবেশে কেউ ওই লেখা পড়ে দুঃখ পাবে। এই কারণে আমি লিখিনি। এই রকম বিষয় আছে আমার। আমি লিখলে কেউ একজন হয়তো ঘরে বসে, রান্নাঘরে চোখ টিপেটিপে কাঁদতো। এটা তো আমি চাই না। এ জন্য লিখি না।
আবিদ: হ্যাঁ, সেটাই। মাহমুদ ভাইতো তো একটা কথা প্রায়ই বলেন যে, তার চরিত্রগুলো মানে তার গল্প-উপন্যাস-কবিতার চরিত্রগুলো ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার পূর্ণাঙ্গ নির্যাস।
হক: মানুষের কল্পনা তার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার বাইরের কিছু নয়। মানুষ তার অভিজ্ঞতার বাইরে কল্পনাও করতে পারে না।
আল মাহমুদ: হুম, মানুষের অভিজ্ঞতায় যা নেই তা সে লিখতে পারে না।
আবিদ: সে যাই হোক,
আল মাহমুদ: যাই হোক, (আবিদের দিকে তাকিয়ে) তুমি কেমন আছ?
আবিদ: ভালো। কিন্তু আব্বা অসুস্থ। আপনি একটু দোয়া করবেন।
আল মাহমুদ: অবশ্যই।
আবিদ: দেশের পরিস্থিতি তো খুবই খারাপ।
আল মাহমুদ: খুবই খারাপ। দেশের পরিস্থিতি খুবই খারাপ।
আবিদ: কী করা যায় এই মুহূর্তে?
হক: আপনার কী মনে হয়, দেশের পরিস্থিতি কোন দিকে যাচ্ছে?
আল মাহমুদ: আমার মনে হয়, শেষ পর্যন্ত সংঘাত হবে না। তবে খুব খারাপ। বাংলাদেশের মানুষের প্রতি আল্লাহর রহমত আছে। আল্লাহ কিভাবে যেন এদেশের মানুষকে রক্ষা করেন।
আবিদ: আপনি খুব আশাবাদী মাহমুদ ভাই।
আল মাহমুদ: হ্যাঁ, আমি আশাবাদী। আমাদের দেশের মানুষের সব আছে। কী নেই? আমরা কোনও কাজ করি না। বসে থাকি। গরিব মানুষরা সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কাজ করেন।
আবিদ: একটা কবিতা আমরা পড়েছি— সব সাধকের বড় সাধক আমার দেশের চাষা। চাষা তো সকাল থেকে রাত পর্যন্ত খাটে।
আল মাহমুদ: দাও পয়সা দাও।
আবিদ: দেব। হক ভাই দেবেন। উনি তো বলেছেন, কবিকে উনি সম্মান ও সম্মানি দুই-ই দেন। আপনার কি খেটে খাওয়া মানুষদের নিয়ে কোনও লেখা আছে?
হক: শুরুর দিকের লেখাগুলোয় তো আছে।
আল মাহমুদ: আমি এডিটর ছিলাম না? তখন তো প্রচুর লিখেছি। লিখে জেল খেটেছি না?
আবিদ: আপনাকে জেল থেকে যে লোকটা ছাড়িয়ে নিয়ে আসলেন, সে গিয়াস কামাল চৌধুরী তো আজ মারা গেছেন।
আল মাহমুদ: মারা গেছেন, আজ। গিয়াস কামাল চৌধুরীর বড় ভাই হলেন, বেলাল চৌধুরী। তারা তো আমাদের আত্মীয়। তাদের বাড়ি তো নোয়াখালীর দিকে।
হক: গিয়াস কামাল চৌধুরী আপনাকে কিভাবে জেল থেকে বের করে আনলেন…
আল মাহমুদ: তুমি তো আমার অনেক খবর জানো…
আবিদ: হ্যাঁ, উনি আপনার সব খবর রাখেন…
আল মাহমুদ: গিয়াস কামাল আমার জন্য এত করেছেন। এটা বলে শেষ করা যাবে না। সে শেখ সাহেবের সঙ্গে তর্ক করেছেন। উনাকে উত্যক্ত করেছেন। আমি যখন জেলে, আমাকে ছাড়ানোর জন্য খুব চেষ্টা করেছে। তখন তিনি সাংবাদিক ইউনিয়নের বোধ হয় সভাপতি ছিলেন, বা সেক্রেটারি ছিলেন; যাই হোক। তিনি আমাকে জেল থেকে বের করেছেন।
হক: তিনি চেষ্টা করেছেন, আর বঙ্গবন্ধু তো আপনাকে খুব পছন্দ করতেন…
আল মাহমুদ: হ্যাঁ, আমাকে খুব পছন্দ করতেন। আমার সঙ্গে তার একটা ব্যক্তিগত…। হ্যাঁ কিভাবে যেন একটা সম্পর্ক ছিল। আমাকে খুব স্নেহ করতেন। উনি তো সাংবাদিক সম্মেলন ডাকতেন, মাঝে-মধ্যে বাসায়। সেখানে বক্তৃতা করতেন। বক্তৃতার পরে আমাকে চোখ ইশারা দিতেন ওনার কাছে আসার জন্য। সবাই চলে গেলে আমি থেকে যেতাম। তখন আমাকে ভেতরে ডেকে নিয়ে যেতেন। আমাকে সিঙ্গাড়া খাওয়াতেন। বলতেন, নে খা।
হক: বঙ্গবন্ধু তো ছোটদের তুই করেই সম্বোধন করতেন… আপনাকেও তাই।
আবিদ: নানা বিষয়ে বোধ হয় পরামর্শও করতেন আপনার সঙ্গে?
আল মাহমুদ: পরামর্শ মানে, আলাপ করতেন আর কি, নানা বিষয়ে আলাপ। নিজেও সাংবাদিক ছিলাম তো।
হক: জেল থেকে আসার পর তো আর গণকণ্ঠে গেলেন না…
আল মাহমুদ: না।
হক: তখন কি শিল্পকলায় জয়েন করলেন?
আল মাহমুদ: হ্যাঁ, শিল্পকলায় গেলাম। আমি জেলখানায় থাকতেই শুনেছি, গণকণ্ঠের কিছু লোক আমাকে সরাতে চাইছিল। আমি বিশ্বাস করি নাই। সেটা হলো যে, আমি ফিরে আসলে আমাকে আর গণকণ্ঠে যেতে দেবে না। আমাকে একটা সাপ্তাহিক করতে বলবে। আর তারা গণকণ্ঠ করবে। এর মধ্যে একজন ছিলেন আফতাব আহমেদ। আমার বন্ধু মানুষ ছিলেন। কিন্তু তিনি এই পরিকল্পনাটা করেছিলেন।
হক: এই আফতাব আহমদ কি প্রফেসর আফতাব আহমদ?
আল মাহমুদ: হ্যাঁ। কিন্তু আমি যখন বেরিয়ে আসলাম, তখন আফতাব আহমদ আমার বাসায় আসল। এসে বলল, গণকণ্ঠ তো সরকার বন্ধ করে দিয়েছে। তুমি আর গণকণ্ঠ বের করার চেষ্টা করবা না। তখন আমি আর কী করব? তখন তো আমার অবস্থা খুবই কাহিল। পরিবার নষ্ট হয়ে গেছে। ছেলেরা কে কোথায় কিছুই জানি না। এ রকম একটা পরিস্থিতি। এমন একটা লণ্ডভণ্ড অবস্থায় আমি। এটা আবার শেখ সাহেবও জানতেন। আমার পরিবার নষ্ট হয়েছে, ধ্বংস হয়ে গেছে। তিনি আমাকে বলেছিলেনও যে, তোর জন্য আমার হৃদয়ে খুব ব্যথা আছে। বিশ্বাস কর, তোর জন্য আমার হৃদয়ে খুব ব্যথা আছে। এসব বলেছেন আমাকে। তো আমি তো আর কিছু বলতাম না। আমি তো এই অবস্থার মধ্যেই ছিলাম। জীবন বড় কঠিন।
আবিদ: বঙ্গবন্ধু তো আপনাকে জেল থেকে বের করে এনে আবার চাকরিও দিলেন…
আল মাহমুদ: চাকরি তো আমি চাইনি। আমাকে জোর করে চাকরি দিয়েছেন।
হক: শিল্পকলায়?
আল মাহমুদ: শিল্পকলায়। আমার জন্য তিনি গাড়ি পাঠিয়েদিয়েছেন। তখন আমার স্ত্রী আমাকে বললেন, দেখো, শেখ মুজিবের বিরোধিতা করেছে এমন সবাইকে তো তিনি জেলে ভরেছেন। আর তোমাকে চাকরি দিয়ে দিচ্ছেন। তুমি তো জীবনে আমার কথা শুনো নাই, এবার আমার কথা শোনো। তুমি চাকরিতে জয়েন করো। তো, আমি আমার স্ত্রীর কথায় জয়েন করলাম। এই আর কি।
না রে ভাই। এটা কিন্তু সত্য না। মানুষ সব সময় কবি থাকতে পারে না
হক: ছিলেন তো ওখানে, বেশ অনেক দিন।
আল মাহমুদ: হ্যাঁ, ওখানে দুই বছর ছিলাম। প্রকাশনা বিভাগের ডিরেক্টর ছিলাম। যা হোক, এখন সিগারেট খাব। আমি তো সিগারেট খাই না, কেউ আসলে তখন…। (এই সময় কবিকে বেশ অন্যমনস্ক দেখাচ্ছিল। আবিদ আজম এই ফাঁকে খাদিজা বলে ডাকতেই, একটা ছোট মেয়ে এসে সিগারেট দিয়ে গেল। আবিদ তখন ওই সিগারেটে অগ্নিসংযোগ করে কবিকে দিলেন। কবি খুব ধীরে, অনেক ধ্যানস্থ হওয়ার মতো করে সিগারেটে টান দিলেন। আমার দিকে অর্থপূর্ণ দৃষ্টি তার— কী তুমি সিগারেট-টিগারেট খাও না কি? আমি হাসতে হাসতে বললাম, না ভাই, আমি খাই না। কবি চুপ করে থাকলেন কিছুক্ষণ। আমরা তিনজনই এসময় চুপচাপ। আমি আবার শুরু করি।)
হক: আপনি কি বঙ্গবন্ধুর বিরোধিতা করেছিলেন?
আল মাহমুদ: না, আমি করি নাই। আমাকে গণকণ্ঠের কারণে জেলে দিয়েছেন। আমাকে তিনি খুব ভালোবাসতেন ব্যক্তিগতভাবে। আমাদের সবাইকে চিনতেন। আমার বাবা-মা চাচাদের চিনতেন। উনি আমাকে বলতেন যে, উনি যখন ছাত্র ছিলেন, কোলকাতায়। আমার চাচাতো ভাই, চাচা তাদের সঙ্গে তার পরিচয় ছিল ভালো। আমি অবশ্যই জানতাম না অত কিছু। আমি একটু উদাসীন ধরনের মানুষও ছিলাম। কবি ছিলাম তো।
হক: কবি তো সব সময়ই কবি…
আল মাহমুদ: না রে ভাই। এটা কিন্তু সত্য না। মানুষ সব সময় কবি থাকতে পারে না। মাঝেমাঝে কবিত্বশক্তি একটু শিথিল হয়ে যায়। তখন চেষ্টা করেও কবিতা লেখা যায় না। আবার হঠাৎ করে লিখতে পারে। কবিসত্তা ফিরে আসে।
হক: কবিতা আসলে চেষ্টা করে লেখা যায় না।
আল মাহমুদ: না, হয় না। তবে চেষ্টা করে হয় না মানে কী? আসলে লেখার সাধনা করতে হবে। লেখার চেষ্টা তো তোমার থাকতে হবে।
হক: আমি তো আপনার সম্পর্কে এমন জানি যে, আপনি চেষ্টা করেও অনেক কবিতা লিখেছেন। এর মধ্যে একটা কবিতা হলো…কবি আবু হাসান শাহরিয়ার আমন্ত্রণে যুগান্তরের জন্য লিখেছিলেন।
আবিদ: ‘কতদূর এগোলো মানুষ’?
হক: না, এটা তো সোনালি কাবিনের প্রথম কবিতা ‘প্রকৃতি’র শুরুর পঙ্ক্তি।
আল মাহমুদ: হ্যাঁ।
হক: আমি যেটার কথা বলছিলাম সেটা ‘দ্বিতীয় ভাঙন’ কাব্যের প্রথম কবিতা…
আবিদ: হক ভাই আপনার কি কনসেপ্টটা মনে আছে।
হক: আছে। ওই যে পাখি…খাঁচা
আবিদ: মাহমুদ আপনার একটা কবিতায় আছে না, আপনার মেয়ে কবিতা কবিতা করে…
হক: ওই কবিতার নাম ‘কবিতার কথা’ই তো…
আল মাহমুদ: হ্যাঁ।
হক: আবেগ রহমান নামের একজন লেখক আছেন। তিনিই গিয়েছিলেন আপনার কাছ থেকে কবিতাটা লিখিয়ে আনতে। ওটা যুগান্তরে প্রকাশিত হয়েছিল। কবিতাটা আনার জন্য কবি আবু হাসান শাহরিয়ার পাঠিয়েছিলেন তাকে। আপনি তাকে তেরো দিন ঘুরিয়ে চৌদ্দ দিনের দিন দিয়েছিলেন।
আবিদ: আবেগ রহমান ওই ঘটনা নিয়ে একটা লেখাও লিখেছেন।
হক: পায়ে হেঁটে যে চতুর্দদশপদী রচিত।
আবিদ: ওই লেখাটা লিখেই তিনি বেশ পরিচিতিও পেয়েছেন। (এই সময় কবি খুব উচ্চস্বরে হাসতে থাকেন।) মাহমুদ ভাই তো আবু হাসান শাহরিয়ারকে নিয়েও একটা গদ্য লিখেছেন। যেখানে এক অভিমানী ছোট ভাইকে বোঝাতে চেয়েছেন নিজের আদর্শগত পরিবর্তন।
আল মাহমুদ: কী রকম? আমার তো মনে নাই।
হক: লেখাটার নাম বোধ হয়, প্রিয় শাহরিয়ার, ওই গদ্যে আপনি আপনার লোকলোকান্তর, কালের কলস, সোনালি কাবিন পর্ব থেকে কিভাবে মায়াবিপর্দা দুলে ওঠো পর্বে বাঁক নিলেন, এসব কারণ ব্যাখ্যা করেছেন। সেই, জেলখানায় স্বপ্ন দেখা, বুকের ওপর কোরান রাখা…
আল মাহমুদ: মনে পড়ে না, কিছুই। ভুলে গেছি।
আবিদ: আবু হাসান শাহরিয়ার তো তার প্রথম বই শামসুর রাহমান আর আপনাকে উৎসর্গ করেছেন। তিনি তো আপনাকে খুব পছন্দ করেন। তিনি খুব মেধাবী মানুষ। আপনি তার লেখার খুব প্রশংসা করতেন একসময়।
(এ সময় আল মাহমুদকে খুব চিন্তিত দেখাচ্ছিল। যেন কিছু মনে করার চেষ্টা করতেছেন, অথচ মনে পড়ছে না। বার বার মাথা দোলাচ্ছিলেন। একসময় হাসিহাসি মুখে আমার দিকে তাকালেন।)
হক: আপনার পরে যারা লেখালেখিতে এসেছেন, বিশেষ করে কবিতায় তাদের মধ্যে কার কার কবিতা আপনার ভালো লাগে?
আল মাহমুদ: আমি তো পড়তে পারি না।
হক: যখন পড়তে পারতেন, তখন কার কার কবিতা ভালো লাগত?
আল মাহমুদ: এখন তো আর নামটাম মনে নাই আমার। বয়স হয়ে গেছে অনেক।
আবিদ: আপনি বলেছিলেন, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে একটা বড় লেখা লিখবেন, মানে মুক্তযুদ্ধ আর আপনার আত্মজীবনী মিলিয়ে আর কি।
আল মাহমুদ: এখন আর পারব না। আমি কিন্তু খুবই অসুস্থ। ডাক্তার আমাকে একদম বারণ করেছেন কথা বলতে। একদম ভয়েসরেস্ট থাকতে বলেছেন।
আবিদ: কিন্তু আপনার অনেক দিনের স্বপ্ন আপনি মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আপনি একটা বড় লেখা লিখবেন।
আল মাহমুদ: লিখব তো, বেঁচে থাকলে লিখব ইনশাল্লাহ।
হক: ‘যেভাবে বেড়ে উঠি’ যেখানে শেষ হলো, তার পর থেকে আর কিন্তু লিখলেন না। এরপরের পর্বটা তো লেখা যায়…
আল মাহমুদ: যেভাবে বেড়ে উঠি— এটার ৪টা সংস্করণ বের হয়েছে।
হক: আমার কাছে প্রথম সংস্করণটা আছে।
আবিদ: প্রথমা থেকেও তো বইটার একটা সংস্করণ বের হলো, ওই যে গিয়াস কামাল চৌধুরীকে উৎসর্গ করলেন…তাকে আর দিতে যাইতে পারলাম না। তাকে একটা বই উৎসর্গ করলেন।
আল মাহমুদ: গিয়াস কামাল চৌধুরী তো আজ মারা গেলেন, জানো তো? এত দুঃখ পেয়েছি। আমার জন্য এত করেছেন, আমি সেটা ভুলতে পারব না। আমি যখন জেলে ছিলাম, তখন তিনি আমার জন্য অনেক করেছেন। তার চেষ্টায়-ই আমি জেল থেকে মুক্তি পেয়েছি।
হিটলার কিন্তু নিজেকে জারজ মনে করত। তার ধারণা ছিল, কোনো জার্মান ইহুদি তার বাবা
আবিদ: এবার তো নোবেল পেলেন…
হক: কানাডিয়ান লেখিকা অ্যালিস মনরো
আবিদ: ছোটগল্প লিখেছেন।
আল মাহমুদ: বিশ্বসাহিত্যের সঙ্গে এখন আর তেমন যোগাযোগ নাই আমার। আসলে আমি তো এখন আর চোখেও দেখি না।
আবিদ: হিটলারের দ্য মাইন্ডক্যাম্প পড়লেন কদিন আগে।
আল মাহমুদ: হ্যাঁ, পড়লাম। বইটা কিন্তু খুবই ভালো। একটা মানুষকে বোঝা যায়। হিটলার কিন্তু নিজেকে জারজ মনে করত। তার ধারণা ছিল, কোনো জার্মান ইহুদি তার বাবা। এই জন্যই নাকি ইহুদিদের প্রতি তার একটা বিদ্বেষ ছিল। এটাই কারণ কি না, তা জানি না। তবে তার মায়ের কবরে গিয়ে হিটলার ছেলে মানুষের মতো কেঁদেছিলেন। শিশুদের মতো কেঁদেছিলেন। এই বর্ণনাটা আমি ওই বইয়ে পড়ে জেনেছি। হিটলার তো এককভাবে পৃথিবীকে শাসন করতে চেয়েছিলেন।
আবিদ: স্বৈরাচার…
আল মাহমুদ: স্বৈরচার না, তাকে তো ফ্যাসিস্ট বলা হতো। অনেক হিস্ট্রি আছে, না পড়লে তো এগুলো জানা যাবে না। হিটলার নিজেকে জারজ সন্তান মনে করত এবং একজন ইহুদিকে তার বাবা মনে করত।
আবিদ: মাহমুদ ভাই, অন্য একটা কথা। আপনারা পঞ্চাশের কবিরা, বুদ্ধদেব বসুর ছত্রছায়ায় ছিলেন, এটা খুব মনে করা হয় আর কি…
আল মাহমুদ: ছত্রছায়ায় না, বুদ্ধদেবের লেখা আমাকে অনুপ্রাণিত করত। তার লেখায় একটু আন্তর্জাতিক রস পাওয়া যেত। তার চিন্তাচেতনা প্রসারিত ছিল।
হক: কবিতায় না গদ্যে?
আল মাহমুদ: গদ্যে।
হক: কবিতায় তো মূল কাজ অনুবাদে…
আল মাহমুদ: তিনি তো মূলত বোদলেয়ার অনুবাদ করেছেন। তার অনুবাদ অসাধারণ। এরকম অনুবাদ বাংলাভাষায় আর নেই। ক্লেদজ কুসুম তিনি অনুবাদ করেছিলেন।
আবিদ: বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিত কবিতা পত্রিকায় আপনি কবিতা পাঠিয়েছিলেন। ছাপানোর পর আপনি বলেছিলেন, ওই মুহূর্তটা আপনার জীবনের সবচেয়ে বেশি পুলক-মুহূর্ত।
আল মাহমুদ: আমি তিনটা কবিতা পাঠিয়েছিলাম। বুদ্ধদেব বসু আমার কবিতাগুলো পেয়ে সাদা পোস্টকার্ডে একটা চিঠি লিখেছেন— প্রিয় বরেষু, তোমার একটি বা দুটি কবিতা ছাপা যাবে মনে হচ্ছে। নিচে সই ছিল বুদ্ধদেব বসুর। কার্ডটা বহুদিন আমার কাছে ছিল। এখন আর নাই। তবে ওটার ছবি ছাপা আছে।
হক: পরে কয়টি কবিতা ছাপা হয়েছিল?
আল মাহমুদ: তিনটি। পরে দেখলাম, যখন কবিতাপত্রিকা বের হলো, তিনটিই প্রকাশিত হলো। এটা প্রথম এসে বললেন যিনি এবং পত্রিকাটা আমাকে যিনি দিলেন, তিনি শহীদ কাদরী। তিনি তখন বিউটি রেস্টুরেন্টে বসে মুখ গোমরা করে বসে আছেন। আমি সেখানে গেলে আমার দিকে কবিতাপত্রিকা বাড়িয়ে ধরে বললেন, দোস্তা এটা নিয়ে যাও। আমি খুব অবাক হলাম তার এমন আচরণ দেখে। পরে জেনেছিলাম, ওই দিন তার মা মারা গেছেন। তিনি শুধু আমাকে কবিতাপত্রিকা দেওয়ার জন্য ওখানে অপেক্ষা করছিলেন।
আবিদ: মাহমুদ ভাই রবীন্দ্রনাথের প্রতি আপনার তো খুব মুগ্ধতা
আল মাহমুদ: আমার প্রিয় কবি। রবীন্দ্রনাথকে সম্পূর্ণ না পড়লে কেউ বুঝতে পারবে না।
হক: রবীন্দ্রনাথ প্রিয় কবি হয়ে ওঠার কারণ কী?
আল মাহমুদ: সত্যি কথা বলতে কী, ছন্দের যে মিল, মিল যে কত রকমের হতে পারে এটা তিনি দেখিয়ে দিয়েছেন। আর রবীন্দ্রনাথকে সমালোচনা করার মতো খুব একটা দোষ কিন্তু পাওয়া যাবে না। আমি বলছি না যে, রবীন্দ্রনাথের সমালোচনা হয় না, নিশ্চয় হয়। আপনি যদি রবীন্দ্রনাথকে পড়েন, তাহলে আপনি, আমার তো মনে হয় যে, মুগ্ধ না হয়ে পারবেন না।
আবিদ: নজরুলকে দেখেছেন?
আল মাহমুদ: হ্যাঁ দেখেছি। শেষ সময়। আমি আর শামসুর রাহমান একসঙ্গে গিয়েছিলাম। আমার মনে আছে, আমার চোখে কোনো চশমা ছিল না, শামসুর রাহমানের চোখে ছিল। এটা দেখে কবি খুব ক্রুদ্ধ হয়েছিলেন। তখন নজরুলের ছেলে এসে বললেন, চশমা খুলে ফেলেন, বাবা চশমা পরা দেখলে অসন্তুষ্ট হন। এর কারণ কী ছিল, তা আমি জানি না। কী কারণে তিনি চশমাধারী লোকদের দেখতে পারতেন না, তা আমি জানি না।
(এ সময় আল মাহমুদ নিজের মুখমণ্ডলে বার বার হাত বোলাতে থাকেন। একই কথা বার বার বলতে থাকেন। নজরুল প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে তার কথাগুলো জড়িয়ে জড়িয়ে যাচ্ছিল।)
হক: জসীমউদ্দীনের সঙ্গে আপনার যোগাযোগটা কেমন ছিল?
আল মাহমুদ: ভালো।
হক: তাকে নিয়ে তো আপনার একাধিক লেখা আছে।
আল মাহমুদ: না, একটি।
হক: আমার জানা মতে দুটি। কবির আত্মবিশ্বাস বইতে একটি আছে। যেখানে কবির আত্মবিশ্বাস ও অহঙ্কারের বিষয়টা বলেছেন। ওই যে কেউ তাকে দাওয়াত দিতে এলে তিনি নিজের সঙ্গে তার পরিবারের জন্যও যাতায়াত টিকিট চাইতেন…
আল মাহমুদ: হ্যাঁ। একবার আমিও ছিলাম। কোলকাতা থেকে ওরা এসেছে দাওয়াত দিতে। উনি সব শর্ত দিচ্ছেন, ওরা সব বিষয়ে কেবল জে, আজ্ঞে বলছে। কবি বলছেন, আমি প্লেনে যাব। ওরা বলছে, জে আজ্ঞে। কবি বলছেন, আমাকে বিমানবন্দর থেকে প্রেমেন্দ্র মিত্র রিসিভ করতে হবে। ওরা বলছে জে আজ্ঞে।
আবিদ: যে লোক দাওয়াত দিতে এসেছিলেন, তিনি কি কবিকে ষষ্ঠাঙ্গে প্রণাম করে গেলেন?
আল মাহমুদ: এখন আর মনে নাই।
হক: শক্তি চট্টপাধ্যায়ের সঙ্গে তো বেশ ভালো সম্পর্ক ছিল আপনার।
আল মাহমুদ: তিনি আমার বন্ধু ছিলেন। শক্তি মানুষ তেমন ভালো না হলেও তার বউ খুব ভালো ছিলেন, এটা আমাকে স্বীকার করতেই হবে।
হক: বুদ্ধদেবের সঙ্গে আপানার কখন দেখা হলো?
আল মাহমুদ: আমি তখন কলকাতায়। একবার শুনলাম তিনি আসবেন। আমরা যেখানে থাকি তার পাশে। বুদ্ধেদেবের জামাই আমাকে জানালেন। অবশ্যই যে বাসায় তিনি এসেছিলেন, সেখানে আমি নিমন্ত্রিত ছিলাম না। সে যাই হোক, কবির জামার সঙ্গে গিয়ে কবিকে পা ছুঁয়ে সালাম-টালাম করলাম। তিনি আমার নাম শুনে বললেন, ও তুমি আল মাহমুদ! তোমার লেখা তো আমি ছেপেছি। আমি বললাম, জি। আমি ওখানে থাকলাম না। চলে এলাম।
হক: ওই ঘটনাকে মনে রেখে একটা কবিতা লিখেছেন, বুদ্ধদেব বসুর সাক্ষাৎকার নামে।
আবিদ: আমাদের সাহিত্য আলোচনায় ফররুখ আহমদের নাম কেউ নেন না। এর কারণ কী মাহমুদ ভাই?
আল মাহমুদ: ওই আর কি, উনার কবিতায় ইসলাম ভাবসাব বেশি এজন্য। তিনি পুঁথিসাহিত্য থেকে তার কবিতার বিষয় নিয়েছেন। এটা এখানে গ্রহণ করছে না আর। তিনি সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ধারার একজন কবি।
হক: আমার মনে হয় ফররুখ আহমেদকে নিয়ে আলোচনা করতে না চাওয়ার কারণ, তার কবিতায় বাংলাদেশের পরিবেশ বেশি পাওয়া যায় না। মধ্যপ্রাচ্য, মশলার দ্বিপ পাওয়া যায়…
আল মাহমুদ: এই অভিযোগ সত্য না। তিনি তো পুঁথির জগতে থাকছেন। পুঁথি তো বাংলাদেশের সৃষ্টি।
হক: আপনি একবার বলেছিলেন, কবির একটা নির্দিষ্ট ভূখণ্ড থাকা দরকার।
আল মাহমুদ: কবির একটা দেশ থাকা দরকার। একবার লিখেছিলাম, আমি এখনো সেটা বিশ্বাস করি।
সব কবিই ভালো গদ্য লিখেছেন
হক: আপনার লোকলোকান্তর, কালের কলস, সোনালি কাবিন এর পর বিরাট পরিবর্তন আসে মায়াবি পর্দা দুলে ওঠো পর্বে। এরপর দ্বিতীয় ভাঙন পর্বে। কিন্তু আপনি যতই বিষয় আর আঙ্গিকের পরিবর্তন ঘটান না কেন, সব পর্বের কবিতায়ই ছন্দযুক্ত। কোথাও আপনি ছন্দ বর্জন করেননি। ছন্দের নিয়মকানুন মেনে চলেছেন।
আল মাহমুদ : ছন্দ ছাড়া তো কবিতা হয় না।
হক: এখন যারা লিখতে আসছে, তারা তো ছন্দ না মানার স্লোগান দিচ্ছে…
আল মাহমুদ: সেটা হয়, ছন্দ ছাড়া কবিতা? হাহাহহাহাহা। ওরা কী বলতে চায়?
হক: ওরা বলতে চায়, ওরা ছন্দ মানছে না, ছন্দ ভাঙছে…
আল মাহমুদ : কী ভাঙছে, ‘সবাই বলে ভাঙো ভাঙো, কেউ কি কিছু ভাঙে/ ষাটের দশক বগল বাজায় বউ নিয়ে যায় লাঙে।’ আমিই তো লিখেছি। সবাই বলে ভাঙো ভাঙো, কী ভাঙে তারা? ভাঙতে পারছে কই?
হক: আপনি একবার বলেছিলেন, কবিদের এখন গদ্য লেখার যুগ
আল মাহমুদ : হ্যাঁ, দেখেন সব কবিই ভালো গদ্য লিখেছেন। জসীমউদ্দীনের গদ্য পড়েছেন? অসাধারণ গদ্য।
হক: বুদ্ধদেব বসুর গদ্যও।
আল মাহমুদ: আমাদেরও।
কবিতা লেখার একটা উত্তেজনা আছে কিন্তু। গদ্যে সেটা নাই
হক: আপনার পরে জেনারেশনের আবদুল মান্নান সৈয়দ…
আল মাহমুদ: মান্নানও গদ্য লিখেছেন। আমি তো প্রবন্ধ ছাড়া, উপন্যাস-ছোটগল্পও লিখেছি। আমার গল্পের বই দুই খণ্ড বেরিয়েছে। আমি নিজেই অবাক যে, এত লেখা আমি লিখলাম কখন?
আবিদ: মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে এসে আপনি গল্পে লিখতে শুরু করলেন…
আল মাহমুদ: আমি তো সময় এখন ভাগ করতে পারি না। কবিতা লেখার একটা উত্তেজনা আছে কিন্তু। গদ্যে সেটা নাই। গদ্যে তো স্থির মস্তিষ্ক লাগে, গদ্যে যুক্তি দেখাতে হয়। কিন্তু কবিতা তো যুক্তি মানে না। কবিতা আবেগের তৈরি। মানুষের অন্তরের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে কবিতা। কবিতা যুক্তি মানে না।
আবিদ: একটা মজার ব্যাপার হলো, আপনার কবিতার মতো, আপনার গদ্যভাষাও আপনার নিজস্ব।
আল মাহমুদ : প্রকৃত লেখক সবসময় নতুন ভাষা সৃষ্টি করে।
হক: প্রকৃত লেখক স্বসৃষ্টভাষায় লেখেন, অন্যের ভাষায় নয়।
আল মাহমুদ : যাই হোক, আপনার নাম কী যেন বললেন?
হক: মোহাম্মদ নূরুল হক।
আল মাহমুদ: আপনি এখন কোথায় আছেন?
হক: আমাদের সময়ে।
আল মাহমুদ : নিউজ এডিটর?
হক: হ্যাঁ।
আল মাহমুদ : ভালো। খুব ভালো।
আবিদ: মাহমুদ ভাই, পত্রিকাটির সম্পাদক কবি আবু হাসান শাহরিয়ার।
আল মাহমুদ: ও তো খুব মেধাবী।
আবিদ : আপনি হক ভাইকে চেনেন না, কিন্তু তিনি আপনাকে নিয়ে অনেক লিখেছেন।
আল মাহমুদ: সমকালের কালের খেয়ায় দেখলাম, ওরা জীবনানন্দ, সুনীল, শামসুর রাহমানকে নিয়ে সংখ্যা করেছে। ওই তিনজনকে আলাদা সংখ্যা করার মানে বুঝলাম না। হাহাহাহা।
হক: মাহমুদ ভাই, ওটা কবিত্ব শক্তির বিচারে নয়, ওই কবিদের জন্মমৃত্যু তারিখ অক্টোরের ১৫, ২৩, এই দুদিনে। তাই ওরা হয়তো একসঙ্গে তিন জনকে স্মরণ করেছে।
আল মাহমুদ: ও, আচ্ছা, আচ্ছা। একটা রেডিও থেকে আমার কাছে এসেছিল, শামসুর রাহমান সম্পর্কে আমার কমেন্ট নিতে। আমি বলেছি তার সম্পর্কে।
হক: আপনি তো শামসুর রাহমানকে নিয়ে একটা প্রশ্বস্তিমূলক গদ্যও লিখেছেন আপনার যৌবনে।
আল মাহমুদ: ঠিক বলেছ। ওই প্রবন্ধের কথা আমি ভুলেই গেছিলাম। বাইরের লোক মনে করত আমার প্রতিদ্বন্দ্বী। কিন্তু আমাদের ব্যক্তিগত সম্পর্ক খুব ভালো ছিল। খুব মধুর ছিল। আপনি দেখছি, অনেক জানেন।
আবিদ: তরুণদের মধ্যে হক ভাই কিন্তু অনেক পরিশ্রমী। পরিশ্রম করে প্রবন্ধ লেখেন। আবদুল মান্নান সৈয়দের পরে তো তেমন প্রবন্ধে কেউ নাই। এখন দেখা যাক, হক ভাই যদি একটু পরিশ্রম করে, যত্ন করে কাজ করেন, তাহলে…
হক: আমার দুটা কবিতার আছে। গদ্য লেখার কারণে কেউ আর আমাকে কবি বলে না।
আল মাহমুদ: হাহাহাহাহাহাহাহ
আবিদ: মান্নান সৈয়দেরও একই সমস্যা ছিল। গদ্য লেখার কারণে শেষ দিকে লোকজন তাকে আর কবি বলত না।
আল মাহমুদ: আমি আপনাকে কবি বলব। যার দুটা কবিতার বই আছে, সে কবি না হয়ে যায় না। হাহাহা।
(এ সময় কবি ও আমার একটা ছবি তুললেন আবিদ আজম। কবি আমার কাঁদের ওপর হাত রেখে বললেন, দাও আমাদের ছবি তুলে দাও। আল মাহমুদ একই কথা বার বার বলতে থাকেন। দশ মিনিট আগে কী বলেছেন, দশমিনিট পরে মনে রাখতে পারেন না। একারণে কিছুক্ষণ পরপরই একই কথা বলতে থাকেন। এক ঘণ্টার আড্ডায় আল মাহমুদ আমার জিজ্ঞাসা করেছেন তিন/চার বার। কখনো আপনি, কখনো তুমি করে সম্বোধন করেছেন। স্বাভাবিক কথায়, আচরণে কবি খেই হারিয়ে ফেলেন বারবার। কিন্তু মুখে মুখে কবিতাসৃষ্টির সময় তাঁর পঙ্ক্তিবিন্যাসের ধারাবাহিকতা সাধারণত কোনও ব্যঘাত ঘটে না। দীর্ঘক্ষণ কথা বলার কারণে হয়তো, কবিকে খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছিল। এদিকে আবিদ আজমও আমাকে ইশারা দিচ্ছেন, আমাদের দুজনেরও অফিসে যাওয়ার সময় প্রায় ঘনিয়ে এলো। আবিদ বলল, মাহমুদ ভাই, আপনার সঙ্গে অনেক কথা হলো, আজ তাহলে আসি? কবি আবারও আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমাকে আমার খুব ভালো লেগেছে, তুমি আবারও আসবে। আমি মাথা নেড়ে সায় দিলাম আর আবিদ জানালো আমার মনের কথা, হক ভাই তো প্রায় আসতে চান, কিন্তু সময় হয় না তার। আমি বললাম, আবার আসব, আজ আসি। আমাদের সময়ে দেওয়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। )