আধুনিক বাংলা কবিতা যতটা না বিষয়ের, তার বেশি আঙ্গিকগত পরীক্ষা-নিরীক্ষার। ফলে রোম্যান্টিকদের সঙ্গে আধুনিকদের প্রাকরণিক পার্থক্যও স্পষ্ট। যেমন রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে জীবনানন্দ-সুধীন দত্তদের। এই ধারাবাহিকতা বর্তমান কালের বাংলা কবিতায়ও সমুপস্থিত। এই সময়ের প্রধান কবিদের অনেকেরই উন্মেষকাল মুক্তিযুদ্ধের অব্যবহিত পরবর্তী সময়ে। ওই সময়ের কবিতার বিষয়-আশয়ের বিপুল অংশজুড়ে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি, ক্ষোভ, দেশপ্রেম ও রাজনৈতিক অনুষঙ্গই বেশি। তবে কেউ কেউ সমকালের স্রোতের ভেতর থেকে নিজেকে আড়াল করতে পেরেছেন, নিস্পৃহ-নির্মোহ দৃষ্টিভঙ্গির জোরে। ফলে এ ধারার কবিরা সমকাল থেকে রসদ গ্রহণ করেও সমকালের প্রভাবে প্রভাবিত হননি, স্বকালকে প্রভাবিত করেছেন। সাধারণত স্বকালের ওপর তাঁদের প্রভাব এমন সর্ববিস্তারী হয় যে, কালের উত্তাপ তাঁদের পোড়াতে পারে না, স্পর্শ করে মাত্র। আবু হাসান শাহরিয়ার এই ধারারই একজন।
আধুনিক কালের কবি তাঁর উপস্থিতকালের প্রধান অসুখ শনাক্ত করেন এবং এ থেকে নিরাময়ের স্বপ্ন দেখান জাতিকে। এ কারণে তাঁদের কাজে নিজের কাল তেমন গুরুত্ব পায় না। অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যতের বিষয়-আশয় থেকে তাঁদের কবিতার রস ও রসদ সংগৃহীত হয়। অর্থাৎ অতীতের অভিজ্ঞতা, বর্তমানের রুচি এবং ভবিষ্যতের স্বপ্নচারণ— এই তিনের মিথস্ক্রিয়ায় সৃজিত হয় কবিতার অন্তরাত্মা ও অবয়ব। এ সঙ্গে শ্রেষ্ঠ কবিতার ভূমিকায় আবু হাসান শাহরিয়ার নিজেই বলেছেন, ‘বহুকালের বহু কবির ঋণভূমে নতুন শব্দের বীজ হাতে দাঁড়ায় কবিতার নতুন সমকাল। সেই সমকালকে নিয়ে কোনো দূর ভবিষ্যতের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করেন কবি। অস্থির সমকালে বাস করেও কবি এক ধ্যানী মহাকালের বাসিন্দা।’পাশাপাশি ইতিহাস সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণার প্রসঙ্গও উল্লেখ করেছেন।
চিন্তা ও কল্পনার সমন্বয়ে কবিতায় বুদ্ধি ও আবেগের সুষম সম্পর্ক রক্ষা করা কঠিন হলেও অসম্ভব নয়। আধুনিক কবি অভিজ্ঞতা, কল্পনা ও প্রজ্ঞার সমন্বয় ঘটান। নারী-পুরুষের প্রেম, প্রকৃতি, নদী, দেশপ্রেম, যুদ্ধ, ধর্ম, দর্শন ও রাজনীতি ছাড়াও মনোবিকার, ক্ষোভ, হতাশা, যৌনতা, বিশ্বায়ন, সর্বপ্রাণে প্রেম, যুদ্ধবিরোধী মনোভাব, সমকালের বিশেষ ঘটনার রেশ ইত্যাদি আধুনিক কবিতার গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হিসেবে বিবেচ্য হচ্ছে। তাঁর কবিতায় বিষয় বিচিত্র। কোনো নির্দিষ্ট ছকে সীমাবদ্ধ নয়। এ প্রসঙ্গে ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’র ভূমিকায় উল্লেখ করেছেন— ‘জীবনের ছবি থেকেই আমি তুলে আনি কবিতার চিত্রকল্প। জীবনের হাসি-কান্না হাহাকার থেকেই উঠে আসে আমার কবিতার ধ্বনিময়তা।’ কোনো বিশেষ নারী যেমন তাঁর আরাধ্য, তেমনি নির্বিশেষ নারীও। আবার কেবল নারীপ্রেমেই সীমাবদ্ধ নন কবি, চরাচরের অশরীরী প্রাণের সঙ্গে সম্পর্ক রচনার স্বপ্ন দেখেন। এ কারণে কাব্যচর্চার শুরুর দিকের কবিতা ‘তুমি’তে যেমন ‘তুমি’র পরিচয় স্পষ্ট করেন না, তেমনি পরিণতকালের কবিতা ‘বালিকাআশ্রম’-এও। প্রথম দিকের কাব্যগুলোয় তিনি মূলত প্রেমিক—যে প্রেম নারীর প্রতি, কিছুটা নিসর্গের প্রতিও। কিন্তু মধ্যপর্যায় থেকে শুরু করে সর্বশেষ কাব্যেও তাঁর প্রেম বিবর্তিত হয়েছে নারী থেকে নিসর্গে, দেহ থেকে দেহাতীতে। কবি যেন বস্তুবাদী ধারণা থেকে ভাববাদী চৈতন্যে পরিভ্রমণ করেছেন। কিন্তু কোথাও স্থির হতে পারেননি। মূলত কবি কোনো নির্দিষ্ট শ্রেণীর বিষয়ে কবিতা রচনা করেননি। তাঁর কবিতা হয়ে উঠেছে বহু বিষয়ের বহুরৈখিক প্রকাশ। শাহরিয়ার যেকোনো বিষয়কে কবিতা করে তুলতে জানেন। এ প্রসঙ্গে সমালোচক পবিত্র মুখোপাধ্যায় ‘চিরচলমান কবিতার এক কবি’ প্রবন্ধে লিখেছেন— ‘স্বাভাবিক কবিত্বশক্তি নিয়ে জন্মেছেন শাহরিয়ার। যেকোনো অনুভবকে সংযমশাসিত কবিতা তুলতে পারেন, তার অনুভব এত সৎ ও গভীর যে, তার প্রকাশও স্বচ্ছ-সাবলীল এবং ব্যঞ্জনাধর্মী হয়ে ওঠে।’ আবু হাসান শাহরিয়ারের কবিত্বশক্তির মৌলিক ও সাবলীল দিক সম্পর্কে বলতে গিয়ে পবিত্র মুখোপাধ্যায়‘স্বাভাবিক কবিত্ব শক্তি’ প্রসঙ্গের অবতারণা করেছেন। এই স্বাভাবিক কবিত্ব শক্তি স্বভাবকবির নয়, অভিজ্ঞতাঋদ্ধ, বহুলপাঠে আত্মপ্রস্তুতিসম্পন্ন প্রাজ্ঞের। ফলে নিজের অভিজ্ঞতা, পঠন-পাঠন, কল্পনা ও মনীষাযোগে যেকোনো বিষয়ে কবিতাসৃষ্টি তাঁর জন্য সহজ। এ প্রসঙ্গে শামসুর রাহমানের মূল্যায়ন প্রণিধানযোগ্য— ‘শাহরিয়ার প্রেরণার জন্য শুধু মেঘ কিংবা নক্ষত্রের দিকে দৃষ্টি রাখেন না, দেশ-বিদেশের বিভিন্ন লেখকের গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থমালার প্রতিও গভীর মনোনিবেশ করেন। নিজের অন্তর্দৃষ্টি, প্রচুর পাঠ, সর্বোপরি জীবন-নিঙ্ড়ানো অভিজ্ঞতা শাহরিয়ারের কবিতাকে সমৃদ্ধ এবং অগ্রসর করে তুলেছে।’ সমকাল ও সমাজকে অনুভবে ধরাই কবির মৌল কাজ। বস্তুসত্য সেখানে অর্থহীন। অনর্থক তার কার্যকারণ সম্পর্ক নির্ণয় করা। মরীচীকার নাগাল পাওয়া মানবজীবনের স্বপ্নের অসাধ্যও। বাস্তবের সঙ্গে তার সম্পর্ক মনোভূমিকেন্দ্রিক। বস্তুগত সত্যের সঙ্গে সম্পর্ক অসম্ভবের। জাতীয়তাবোধের প্রশ্নে, স্বজাতির আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটের প্রতিচ্ছবি আঁকা দেশপ্রেমিক কবির দায়। সে দায় পালনে তার কাব্যিক সততা তাৎপর্যময়।
কেবল স্বজাতি-স্বদেশ নয়, বৈশ্বিক চেতনাও তাঁর কবিতার একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কবি জানেন এবং মানেন—উগ্র জাতীয়তাবোধ কবিকে সংকীর্ণ ভৌগোলিক সীমায় আবদ্ধ রাখে। আবার দেশপ্রেমহীন বিশ্বনাগরিকবোধও কবিকে উন্মূল ও উদ্বাস্তু করে তোলে। শেকড়বিহীন বৃক্ষ যেমন মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না, তেমনি নির্দিষ্ট ভূখণ্ড ব্যতীত কবিরও অস্তিত্ব বিপন্ন। কারণ, ভূখণ্ড ব্যতীত যেমন স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের কল্পনা করা যায় না, তেমনি সার্বভৌম কবির অস্তিত্বও। প্রত্যেক সার্বভৌম কবিরই একটি নির্দিষ্ট ভূখণ্ড থাকে। সেটিই তাঁর শেকড়। শেকড় যে প্রাণসঞ্জিবীনী গ্রহণ করে, তা তাঁর নিজের ভূখণ্ড থেকেই।
তবে এ কথা অস্বীকার করা যায়ই না—বুদ্ধির চেয়ে হৃদয়বৃত্তির প্রাখর্যেই তাঁর সৃষ্টি উজ্জ্বল। কবিমনের অহংপ্রবণতা, কবিতাকে মানবজাতির চিৎপ্রকর্ষ ও চরিত্রের দার্র্ঢ্য প্রকাশের অনুষঙ্গে পরিণত করে। কলাকৈবল্যবাদীদের ‘শিল্পের জন্য শিল্প’ তত্ত্ব বর্তমান মানবসমাজে অন্তঃসার শূন্য প্রপঞ্চে পর্যবসিত। পাখি আপন মনে গান করে। এতে মানবজাতির কল্যাণ-অকল্যাণের কোনো সম্পর্ক নেই। তাই পাখির গান প্রকৃত গান নয়। মানব রচিত ও গাওয়া গানই গান। কারণ এতে মানুষের অংশগ্রহণকে মানুষ স্বাগত জানায়। শিল্পের যে প্রকরণ মানবতাকে শ্রদ্ধা জানাতে কার্পণ্য করে, সে প্রকরণের মৃত্যু জন্মের লগ্নেই নির্ধারিত হয়।
সাম্যের গান- মানবমন্ত্রে পরিণত হয়েছে অনেক আগে। তবু পরাধীন জাতিগুলো স্বাধীনতার জন্য প্রাণান্তকর চেষ্টা করেও সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর আগ্রাসন থেকে মুক্ত হতে পারে না। সাম্রাজ্যবাদী শক্তি স্বাধীনতাকামী জাতিকে পদানত করে রাখার জন্য দ্বিধাবিভক্ত করে। সবকালেই এর প্রমাণ রয়েছে। স্বাধীনতাকামী জাতিগুলোও বিভিন্ন ইস্যুভিত্তিক উপজাতিতে বিভক্ত হয়ে পড়ে। ফলে স্বাধীনতার দাবি ফিকে হয়ে আসে। আবার স্বাধীন জাতিগুলোর ভেতর বিভিন্ন রকম উপসর্গ ছড়িয়ে দিয়ে বিভিন্ন গৌণ বিষয়ে বিবদমান রাখে। তখন স্বাধীন জাতিগুলোও নিজেদের মধ্যে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গোষ্ঠী ও সংঘ তৈরির প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হয়। যে সে প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হওয়ায় ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মূল লক্ষ্য। মোদ্দা কথা, ছলে-বলে-কৌশলে এসব জাতির ঐক্য বিনষ্ট করে, জাতিগুলোর মতানৈক্যের সুযোগে পদানত করে রাখে। আবু হাসান শাহরিয়ার কবি হিসেবে অহিংসবাদী এবং প্রতিশোধবিমুখ। ‘সভ্যতার প্রতি’ কবিতায় স্পষ্ট উচ্চারণ করেছেন, ‘হত্যার বদলে যারা হত্যা চায় তারা/ সভ্যতার গ্লানি’। পাশাপাশি দোষীর মৃত্যুদণ্ডের পরিবর্তে সংশোধনের সুযোগ দেওয়ার প্রস্তাব করেছেন, অন্তত নির্বাসনে পাঠানোর অনুরোধ করেছেন। ঠিক এ কবিতাটির বিপরীতধর্মী কবিতা ‘একলব্যের পুনরুত্থান’। এই কবিতায় ব্যক্তির ‘সম্পন্ন মানুষ’ হয়ে ওঠার পেছনে বাধাগুলো শনাক্ত করে কবির দৃঢ়চিত্তের ঘোষণা সহসা সচকিত করে ‘সভ্যতার প্রতি’র পাঠককে। ‘সভ্যতার প্রতি’ কবিতার সমস্ত প্রস্তাবনাকে চূর্ণবিচূর্ণ করেই যেন শেষ দুই পঙ্ক্তি রচিত— ‘যদিও একলব্য তবু ভুলিনি অপমান/ পুনর্বার হব না তাই ক্ষমাঅন্তঃপ্রাণ’। স্বাভাবিকভাবে দুটি কবিতার মধ্যে বিরোধ লক্ষণীয় হলেও প্রকৃতপক্ষে আন্তঃমিলই বেশি। দুটোতে অহিংস এবং আত্মমর্যাদাকে গুরুত্ববহ করে তোলা হয়েছে। পরন্তু ‘একলব্যের পুনরুত্থান’ কবিতায় প্রকাশিত হয়েছে সমস্ত মেকি ও ন্যাকামির বিরুদ্ধে দ্রোহ। কারণ একপক্ষ কেবল ক্ষমাঅন্তঃপ্রাণ হলে অন্য পক্ষের স্বৈরাচারী হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা থাকে। এ কারণে সমাজের নানা স্তরের মানুষের স্বরূপ উন্মোচনও কবি করে দেন সহজে। ‘জন্ম যার নিসর্গতায় পদ্য তার পায়ে গড়ায়’ শীর্ষক এক বিশ্লেষণাত্মক গদ্যে মঞ্জুষ দাশগুপ্ত লিখেছেন, ‘হৃৎপিণ্ড ছিঁড়ে মনের অথই বোধের অতল যেমন দেখিয়েছেন, তেমনি মেধাবী ভাষায় সমকালের সমস্ত দীর্ণতাকেও ব্যঙ্গবিদ্রূপে শ্লেষে তীর্যকে অনেক রঙিন মুখোশধারীর আসল চেহারাও শনাক্ত করেছেন।’ প্রথম দিকে রচিত কবিতাগুলোয় কবি যতটা ভাববাদী, শেষদিকে ততটা নন। শেষ দিকের বিশেষত ‘ফিরে আসে হরপ্পার চাঁদ’, ‘হাটে গেছে জড়বস্তুবাদ’, ‘সে থাকে বিস্তর মনে বিশদ পরানে’, ‘বালিকাআশ্রম’বা ‘কিছু দৃশ্য অকারণে প্রিয়’ কাব্যে সমাজের প্রতি কবির দায় পালনের উজ্জ্বল প্রমাণ রয়েছে।
বিজ্ঞানের নব নব আবিষ্কার, প্রযুক্তির ব্যবহার, চার্লস ডারউইনের বিবর্তনবাদের প্রভাব, যান্ত্রিক সভ্যতার বিবমিষা, নগর জীবনের নিঃসঙ্গতা, নৈরাশ্য আর অবসাদগ্রস্ত এক ভীতিকর অভিজ্ঞতার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে আধুনিক কাল মানুষকে। যার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে নগরকেন্দ্রিক শিক্ষিত জন অলৌকিকতা এবং ঐশ্বরিক কার্যকারণ সম্পর্কের মধ্যে আপাতত অন্তঃসার শূন্যতা দেখেন। ফলে ক্রমাগত জগৎসংসার, যূথবদ্ধ জীবনপ্রণালি আর যৌথ পরিবার প্রথার বন্ধন নিয়ে সন্দেহ ও নৈরাশ্যবোধের উন্মেষ ঘটে। যা থেকে কেউ কেউ তাদের প্রাত্যহিক জীবন-যাপন থেকে ধর্মীয় অনুষঙ্গ ও অনুশাসনগুলোকে বিচ্ছিন্ন করে নিতে স্বতঃপ্রণোদিত ভূমিকা রাখার চেষ্টা করেন। যান্ত্রিক জীবনের প্রতি স্বপ্নবান মানুষের বিবমিষা জন্মে সহজে। যে যন্ত্র মানুষের আবেগ ও নিত্যপ্রয়োজনেরর দাবিকে অস্বীকার করে, তার প্রতি কবি বিতৃষ্ণ। ‘আড়াইঅক্ষর’ কাব্যে দার্ঢ্যরে সঙ্গে উচ্চারণ করেন—‘জীবনই না থাকে যদি কেন হাঁটি জীবিকার গলি?’ নাগরিক প্রতিবেশে বসে কবি নিসর্গকে স্মরণ করেন প্রেয়সীর মতো। এ কারণেই তাঁর সহজ উচ্চারণ ‘মাটির আমি পেটের ছেলে; আকাশ আমায় ডেকেছে ‘‘ভাই’’—/ একসঙ্গে বসে সবাই এক থালাতে নিসর্গ খাই।’ তবে শাহরিয়ার নিসর্গকে কাব্যের অনুষঙ্গ করে তুলতে গিয়ে গ্রাম্য করে তোলেন না, নিসর্গপ্রেমের সঙ্গে নগর চেতনার অন্বয় সাধনও করেন। নিজে হয়ে ওঠেন বিদগ্ধ এবং কবিতা তাঁর মন ও মননের স্মারক। তাই যৌনগন্ধী শব্দ এবং শারীরবৃত্তীয় শব্দের সমন্বিত পাঠ তাঁর কবিতায় অপেক্ষাকৃত বেশি। শেষ পর্যন্ত যৌনতাও শিল্প হয়ে উঠেছে।
তাঁর সামগ্রিক সৃষ্টিকর্মের বিবেচনা করলে দেখা যায়—‘অন্তহীন মায়াবী ভ্রমণ’ কাব্যে পূর্বসূসুরিদের ঋণ লক্ষণীয় হলেও তাঁরও প্রস্তুতির স্বাক্ষর রয়েছে। এ কাব্যের ‘বাংলাদেশ’ কবিতায় কবি দেশকে দেখেছেন কন্যারূপে। বলেছেন বাংলাদেশ লক্ষ্মীমন্ত মেয়ে, হাজারও সংকট ও সংগ্রামের পথ মাড়িয়ে সিজিল-মিছিল করে উঠেছে মাত্র এই কন্যা। তাকে যেন কেউ ভূত সেজে ভয় না দেখায়। ‘অব্যর্থ আঙুল’ মূলত আত্মজিজ্ঞাসাতাড়িতের দার্শনিক প্রজ্ঞাপূর্ণ। এ কাব্যের গুরুত্বপূর্ণ কবিতাগুলোর একটি ইতোপূর্বে উল্লিখিত ‘সভ্যতার পতি’। আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ কবিতা ‘মোহরপ্রার্থী।’ এই কবিতায় স্বরবৃত্তের দ্রুতলয়ের শব্দ সমবায়ের সমন্বয়ে সংবেদনশীল হৃদয়ের স্পষ্ট ও দৃঢ় মনোবাসনা প্রকাশিত হয়েছে। স্বরবৃত্তের পর্ববিন্যাস ও পঙ্ক্তিবিন্যাসে ভাঙচুর ও নিরীক্ষার প্রমাণ রয়েছে।
‘তোমার কাছে যাই না তবে যাব’ প্রস্তুতিকাল ছাড়িয়ে পরিণতকালের কাব্য। এ কাব্যের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কবিতা ‘যে -গোলাপ অনন্ত সুন্দর’। এ কবিতায় ব্যক্তির আত্মউদ্বোধন এবং উন্মোচনকে বিশেষভাবে মর্যাদাপূর্ণ করে তুলেছেন। গোলাপপ্রীতি সবার স্বতঃস্ফূর্ত নয়। অনেকটা লৌকিক আচরণ মাত্র। স্বার্থসিদ্ধির উপচারের পরিণত গোলাপ অনেক অসত্যেরও সহায়। তাই গোলাপপ্রীতি ফ্যাশন হয়ে ওঠে। যান্ত্রিক সভ্যতায় সবকিছুই যেখানে উপযোগ দাবি করে করে, আর্থিক লাভালাভের ভিত্তিতে সেখানে প্রেমিকের দাবি কী? নৈরাশ্য তাকে আচ্ছন্ন করে কখনো কখনো। এই সত্য উপলব্ধিজাত নয় কেবল, অভিজ্ঞতারও অংশ। যে অভিজ্ঞানে কবি সাধারণ মানুষ থেকে কবি হয়ে ওঠেন, কবি থেকে হয়ে ওঠেন সম্পন্ন মানুষও। এ গোলাপ কার্যসিদ্ধিরও উপায়। সম্প্রীতি স্থাপনে গোলাপ যেমন সেতু বন্ধন হতে পারে, তেমনি দীর্ঘমেয়াদি কোনোও কর্মযজ্ঞেরও স্মারক গোলাপ হতে পারে। উভয় ক্ষেত্রেই গোলাপের গুরুত্ব অপরিমেয়।
ঐতিহ্য ও লোকপুরাণের নবায়নে সৃষ্ট ‘একলব্যের পুনরুত্থান’। ‘নিরন্তরের ষষ্ঠীপদী’ প্রকৃতপক্ষে নিসর্গ প্রশস্তি ও সর্বপ্রাণের প্রতি প্রেমের বর্ণনা। আরোপিত সভ্যতার যন্ত্রণাক্লিষ্ট জীবনের প্রতি তীব্র কটাক্ষের কাব্য, ‘এ বছর পাখিবন্যা হবে’। ‘ফিরে আসে হরপ্পার চাঁদ’, ‘হাটে গেছে জড়বস্তুবাদ’, ‘সে থাকে বিস্তর মনে বিশদ পরানে’, কাব্যত্রয়ী উত্তরাধুনিক চেতনায় ঋদ্ধ। এ উত্তরাধুনিকতা পশ্চিমের আরোপিত নয়, বাংলার ঐতিহহত্য, পুরাণকে চিন্তার ভরকেন্দ্রে রেখে কল্পনার সংহত ভাবের সমন্বয়ে সৃষ্ট। সমকাল ও স্বসমাজের নানা দিক কেন্দ্রে রেখে আপনসৃষ্টির মিথস্ক্রিয়ায় লিখিত কাব্য ‘তোমাদের কাচের শহর’। ‘নিরন্তরের ষষ্ঠীপদী’, ‘আড়াইঅক্ষর’ ও ‘বালিকাআশ্রম’ মূলত আখ্যানকাব্য। ‘নিরন্তরের ষষ্ঠীপদী’ ও ‘আড়াইঅক্ষর’এর কবিতাগুলো লিরিকধর্মী, বিষয় নির্বাচনে প্রেম, শরীর, প্রযুক্তির নানা দিক প্রাধান্য পেয়েছে। ইতিহাস, ঐতিহ্য, লোকজ-বিষয়, যুদ্ধ, প্রেম, সংবিধান প্রভৃতি বিষয়ের বহুরৈখিক প্রকাশ ঘটেছে ‘বালিকাআশ্রম’ কাব্যে।
আবু হাসান শাহরিয়ার কালসচেতন বলেই সমকালকে শব্দে-বাক্যে-পঙক্তিতে ধারণ করেন সচেতনভাবেই। তাতে কবিতা সমকালের ফসল হয়েও চিরকালীন হয়ে ওঠে। সমকালীন রাজনীতি, রাজনৈতিক সংকট, অর্থনৈতিক মন্দা ভাব, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, কুসংস্কার, সাংস্কৃতিক বন্ধ্যাত্ব কবির মনোবিশ্বকে আলোড়িত করে, ব্যথিত করে; করে ক্ষত-বিক্ষতও। আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদ, সাংস্কৃতিক আগ্রাসন ও ধর্মীয় উন্মাদনার সংক্রমণে কবি ব্যথিত। ছন্দ মানা ও ছন্দভাঙার প্রতি তাঁর সমান আগ্রহ, চিত্রকল্পে রয়েছে নিজস্ব রুচির পরিচয়। সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব, যন্ত্রনির্ভর সভ্যতার শিক্ষাকে কবিতার অনুষঙ্গে পরিণত করতে গিয়ে শিক্ষিত মানুষের ভদ্রোজনোচিত ভাষাকে কবিতার ভাষা হিসেবে গ্রহণ করেছেন তিনি। কবিতার স্বর ও সুর এবং চিত্রকল্পে তাঁর স্বাতন্ত্র্য উজ্জ্বল।
- সাহিত্যের রাজনীতি থেকে