বাংলা সাহিত্যের কম চর্চিত শাখা—গবেষণা ও প্রবন্ধ। সমালোচনামূলক প্রবন্ধ এবং গবেষণামূলক প্রবন্ধের তুলনামূলক বিচার করলে গবেষণামূলক প্রবন্ধ চোখে পড়ে বেশি, সমালোচনামূলক প্রবন্ধ কম। এর চেয়ে কম বিশ্লেষণাত্মক প্রবন্ধ। বাংলা সাহিত্যে গত ত্রিশ বছরে তেমন উল্লেখযোগ্য বিশ্লেষণাত্মক সমালোচনাসাহিত্য রচিত হয়নি। মোহিত লাল মজুমদার, বুদ্ধদেব বসু, দীপ্তি ত্রিপাঠী, আবু সয়ীদ আইয়ুব, হুমায়ুন কবীর, সৈয়দ আলী আহসান, অশ্রু কুমার শিকদার, হাসান হাফিজুর রহমানের পর উজ্জ্বল সমালোচক—সর্বোতভাবে নিরঙ্কুশ গবেষক-সমালোচক আব্দুল মান্নান সৈয়দ। তার পর তেমন সমালোচক আর কেউ নেই।
স্বাধীনতা-উত্তর বাংলা সাহিত্যে সুলুক সন্ধান করলে উপর্যুক্ত বক্তব্যের প্রমাণ মিলবে। কিন্তু এর বিপরীত চিত্রও কি নেই? কেউ কেউ ব্যক্তিগতভাবে কিংবা পেশাগত কারণেই কিছু গবেষণামূলক প্রবন্ধ লিখেছেন। ওইসব প্রবন্ধে কেবল তথ্য-উপাত্ত যে রয়েছে তা নয়, সঙ্গে মূল সাহিত্যের বিশ্লেষণ ও পাঠোদ্ধারও কমবেশি রয়েছে। এই ধারার একজন সাধক তপন বাগচী। লিখেছেন বেশকিছু প্রবন্ধের বই। তার উল্লেখযোগ্য প্রবন্ধের বইগুলো হলো—‘সাহিত্যের মধ্যমাঠ থেকে’, ‘রবীন্দ্র সাহিত্যে নতুন প্রেক্ষণ’, সাহিত্যের সঙ্গ অনুষঙ্গ’, ‘কিছু স্মৃতি কিছু ধৃতি’, ‘লোকসংস্কৃতির কতিপয় পাঠ,’ ‘বাংলাদেশের যাত্রা গান : জনমাধ্যম ও সামাজিক পরিপ্রেক্ষিত, ‘মুক্তিযুদ্ধে গোপালগঞ্জ’, ‘সাহিত্যের সাম্প্রতিক পাঠ’, ‘রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ’, ‘নজরুলের কবিতায় শব্দালঙ্কার’ ও ‘রবীন্দ্রনাথ : বৌদ্ধ আখ্যান।’
এর মধ্যে প্রায় সব প্রবন্ধই গবেষণামূলক। এসব প্রবন্ধে তার সাহিত্য মানস, সমাজ ভাবনা, রুচিবোধ যেমন প্রকাশ পেয়েছে, তেমনি তার নিজস্ব শৈলীও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। সাহিত্যবোধ সমাজ-সংস্কৃতির পটভূমিতে বিবেচনা করলে, তার সবচেয়ে মননশীল ও গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা ‘বাংলাদেশের যাত্রা গান : জনমাধ্যম ও সামাজিক পরিপেক্ষিত’ এ গবেষণাগ্রন্থে তপন বাগচী যাত্রা গানের উদ্ভব, ক্রমবিকাশ, বর্তমান অবস্থা এবং জনমাধ্যম হিসেবে যাত্রার সামাজিক প্রভাব বিশদ ব্যাখ্যা করেছেন। এ গ্রন্থের শুরুতে ‘গবেষণার রূপরেখা’ শীর্ষক অধ্যায়ে লিখেছেন, ‘যাত্রা বাঙালির প্রাচীন সংস্কৃতি। ধর্মীয় উত্সব উপলক্ষে আয়োজিত শোভাযাত্রায় পৌরাণিক কাহিনীর গীতবাদ্য—অভিনয়ের উপস্থাপনা এক সময় যাত্রাগান হিসেবে পরিণতি লাভ করে। সময়ের বিবর্তনে ‘‘যাত্রা’’র রূপ বদলে গেছে।’ যাত্রা গানের পটভূমিকা হিসেবে তপন বাগচী শুরুতেই উল্লেখ করেছেন, ‘এটি ধর্মীয় উত্সব উপলক্ষে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গীতবাদ্যের মাধ্যমে অভিনয় সহযোগে পরিবেশিত একটি শিল্প মাধ্যম। আর এ শিল্প মাধ্যমটি নানা আঙ্গিক ও বিষয়ের বিবর্তনের পর এখনো সামাজিক বিনোদন, জনজীবন, শিক্ষা ও প্রভাব বিস্তারের ফলে প্রায়োগিক জনমাধ্যম হিসেবে গ্রহণীয়।’ তপন বাগচীর মতে যাত্রা গান জনসচেতনতার ক্ষেত্রে ‘প্রায়োগিক মাধ্যম।’ যাত্রার আনুষ্ঠানিক সময় হিসেবে তপন বাগচী ১৮৬০ সালকেই বিবেচনা করেছেন। কারণ, ১৮৬০ সালেই ঢাকায় কৃষ্ণ কমল গোস্বামী ‘কৃষ্ণ বিষয়ক ঢপ কীর্তন পরিবেশনের পাশাপাশি পৌরাণিক পালা ও মঞ্চায়নের মাধ্যমে যাত্রার’ গতি সঞ্চার করেছিলেন। তার মতে বাঙালির অভিনয়ের কালও তিন ভাগে বিভক্ত। ওই তিন পর্ব হলো—‘আদিযুগ—দ্বাদশ শতাব্দী’, ‘মধ্যযুগ— ত্রয়োদশ থেকে অষ্টাদশ শতাব্দী পর্যন্ত’, ‘এরপর থেকে বর্তমান কাল পর্যন্ত আধুনিক যুগ।’
তবে তার এই যুগ বিভাজন নতুন নয়, সাহিত্যের অন্যান্য শাখার ক্ষেত্রেও এই বিভাজন গ্রহণযোগ্য। ফলে তার এই কাল বিভাজন যেমন প্রচলিত নিয়মকে মান্য করে, তেমনি নতুন কোনো বিতর্কেরও জন্ম দেয় না। তাহলে যাত্রার কাল বিভাজনে তার মৌলিকত্ব কোথায়? তার মৌলিকত্ব ও বিশেষত্ব এখানে যে, তিনি যাত্রার উদ্ভবকাল থেকে বর্তমান পর্যন্ত অভিনীত যাত্রা গানের ক্রম বিবর্তন পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ করেছেন। আর এ কাজটি করতে গিয়ে নগেন্দ্রনাথ বসুর সঙ্গে যেমন একমত পোষণ, তেমনি সহমত পোষণ করেছেন ড. আহমদ শরীফ, ড. অসিত কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, মনীন্দ্রলাল, ড. সুকুমার সেন, আসকার ইবনে শাইখ অমূল্যচরণ বিদ্যাভূষণ, ড. গৌরি শঙ্কর ভট্টাচার্যের সঙ্গে। এসব পণ্ডিত গবেষকের অভিমত বিশ্লেষণ শেষে তপন বাগচীর নিজের সিদ্ধান্তে উপনীত হন এভাবে—‘আমাদের নাট্য শিক্ষক কিংবা নাট্য গবেষকরা যাত্রার উত্পত্তি বিষয়েভীর কোনো গবেষণায় ব্রতী হননি।’ তার এ অভিমত গ্রহণযোগ্য। কারণ বাংলাদেশের তথাশিক্ষিত অধ্যাপক গবেষকরা যাত্রাকে লোক সংস্কৃতির একটি অনুষঙ্গ হিসেবেই কেবল বিবেচনা করেন। শিক্ষিতজনেরা যাত্রা যাত্রা বিষয়ে যত গবেষণা করেছেন, তার সবই পেশাগত প্রয়োজনে, অভিসন্দর্ভ রচনার তাগিদে, অন্তর্গত প্রেরণায় নয়। বিষয়টি তপন বাগচীর উপলব্ধিতে ধরা পড়েছে। তবে এ বিষয়ে তপন বাগচী সংযমী, ফলে কারও ওপর ব্যর্থতার দায় চাপিয়ে দেননি। এর কারণও স্পষ্ট—তিনি গবেষণা কর্ম হিসেবে বিষয়টি গ্রহণ করেছেন এবং অনেক পণ্ডিতের মতামতের ওপর ভিত্তি করে নিজের সিদ্ধান্ত প্রকাশ করেছেন। এক্ষেত্রে তার বিশেষত্ব—অন্য গবেষকদের মতামত খণ্ডনের ক্ষেত্রে তিনি যুক্তিতর্কের আশ্রয় নিয়েছেন এবং অধিকতর যুক্তিগ্রাহ্য অভিমতের পক্ষে সম্মতি দিয়েছেন।
‘বাংলাদেশের যাত্রার ক্রম বিকাশ’ সম্পর্কে বলার আগে তিনি বিভিন্ন জেলায় যাত্রার পরিবেশনের ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন। শেষ পর্যন্ত তার পর্যবেক্ষণ—‘যাত্রানুষ্ঠানের খবর সংবাদপত্রের পাতায় নিয়মিত গুরুত্বের সঙ্গে ছাপা হয় না। এক সময় সাপ্তাহিক ‘‘চিত্রালী’’, সাপ্তাহিক সিনেমা সাপ্তাহিক ‘‘পূর্বানী’’ ও মাসিক ‘‘ঝিনুক’’ পত্রিকায় নিয়মিত ছাপা হতো। মাত্র দুই-তিনজন যাত্রার লোকই এ সব পত্রিকায় সংবাদ ও প্রতিবেদনের রচনা করত। তাই তাদের পছন্দের দলগুলোর কথাই বার বার এসেছে ওই সব পত্রিকায়। কোনো কোনো দলের খবর কখনই পত্রিকায় ছাপা হয়নি। দল মালিকরা তাদের কর্মকাণ্ডের দলিলপত্রও সংরক্ষণ করেন না। তাই যাত্রা দলের ক্রম বিকাশের ইতিহাস পুঙ্খানু ও পূর্ণাঙ্গ করা সম্ভবপর নয়।’ তপন বাগচীর এ পর্যবেক্ষণলব্ধ কার্যকারণ সম্পর্কগুলো যথার্থ। তার মতে যাত্রা পাঁচ ধরনের। এগুলো হলো—
১. পৌরাণিক বা ধর্মীয় বা ভক্তিমূলক পালা
২. ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক পালা
৩. কাল্পনিক ও লোক কাহিনীভিত্তিক পালা
৪. সামাজিক পালা
৫. জীবনী পালা।
ভাবতে অবাক লাগে, যে যাত্রা গান তথাশিক্ষিত পণ্ডিতদের কাছে নিছক বৈতরণী পার হওয়ার জন্য গবেষণা কর্ম মাত্র, তা-ই হয়ে উঠেছে তপন বাগচীর গভীর পর্যবেক্ষণের অনুষঙ্গ। যাত্রাকে তিনি কেবল শিল্প হিসেবেই গ্রহণ করেননি, সঙ্গে ‘জনমাধ্যম’ হিসেবেও বিবেচনা করেছেন। এ প্রসঙ্গে তার মূল্যায়ন ‘যাত্রার নিজস্ব শক্তিকে কাজে লাগানোর পাশাপাশি আধুনিক সম্প্রচার মাধ্যম তথা বেতার ও টেলিভিশনে যাত্রানুষ্ঠানের আয়োজন কিংবা জনপ্রিয় যাত্রা আঙ্গিকে বিভিন্ন অনুষ্ঠান নির্মাণ করে গণমাধ্যমে যাত্রার পরিপূরক ভূমিকাও গ্রহণ করা যায়। যাত্রার বিশেষায়িত ভঙ্গি যেহেতু সাধারণ মানুষের কাছে গ্রাহ্য, তাই এর মাধ্যমে শিক্ষা ও বার্তা প্রচারের উদযোগ ফলপ্রসূ হওয়া আদৌ অসম্ভবপর নয়।’
তপন বাগচীর দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ বই—‘রুদ্র মুহাম্মদ শহিদুল্লাহ।’ এটি রুদ্রের জীবনীমূলক বই। এই বইতে তাপন বাগচী রুদ্রের পরিবার, শিক্ষা জীবন, সংসার, কর্মজীবন, সম্পাদনা, জীবন দর্শন ও সাহিত্য বৈশিষ্ট্য পুঙ্খানুপুঙ্খ আলোচনা করেছেন। এ গ্রন্থে লেখক বলেছেন কম, বেশি উপস্থিত করেছেন অন্য লেখকের সাক্ষ্য। ফলে বইটি হয়ে উঠেছে প্রামাণ্য গ্রন্থ। রুদ্র সম্পর্কে তার চূড়ান্ত মূল্যায়ন—‘রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর জীবন ও কবিতা ছিল অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত। কবিতাই তার জীবন, আর জীবনই তার কবিতা। জীবন দর্শন খুঁজলে তার সাহিত্যের বৈশিষ্ট্য ধরা পড়ে। পক্ষান্তরে সাহিত্য বৈশিষ্ট্যই ফুটে উঠেছে তার জীবন দর্শনে।’
অন্যদিকে ‘রবীন্দ্রনাথ : বৌদ্ধ আখ্যান’ গ্রন্থে তিনি দেখিয়েছেন রবীন্দ্রমানসে বৌদ্ধিক চেতনা কতখানি। রবীন্দ্রনাথের যেসব রচনায় গৌতম বুদ্ধের বিভিন্ন কাহিনী ও অভ্যাসের ছায়া পাওয়া যায় সেগুলো হলো—‘রাজা’, ‘অরূপ রতন’ ‘অচলায়তন’, ‘নেটীর পূজা’ ‘চণ্ডালিকা’, ‘শ্যামা’, ‘অভিসার’ ও ‘সামান্য ক্ষতি’। রবীন্দ্রমানসে গৌতম বুদ্ধের ছায়া সুদূর প্রসারী। ভারতবর্ষের মানুষ ও প্রকৃতির মধ্যে এক ধরনের আত্মিক সম্পর্ক রয়েছে। ওই সম্পর্ক ধর্মীয়-অনুভূতির সংস্পর্শে আসার পর ভিন্ন রূপ লাভ করেছে। ভারতবর্ষে প্রচলিত ধর্মগুলোর মধ্যে খ্রিস্ট, ইসলাম, সনাতন ও বৌদ্ধ ধর্মই প্রধান। তপন বাগচী ভারতবর্ষে এ চারটি ধর্মের প্রভাব ও প্রসার সম্পর্কে বলেছেন—‘এই উপমহাদেশে ব্যাপক প্রসার ঘটলেও খ্রিস্ট ও ইসলাম এই দুই ধর্মের উত্পত্তি ঘটেছে উপমহাদেশের বাইরের দেশে। এই এলাকার মৌলিক ও প্রাচীন ধর্ম বিশ্বাসের মূলে রয়েছে বেদ ও পুরান।’ এর কারণ হিসেবে তিনি উল্লেখ করেছেন—সনাতন ধর্ম বিশ্বাসের কথা। আবার গৌতম বুদ্ধের সর্বজনীন গ্রাহ্যতা নিয়ে তিনি যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন তাও প্রণিধানযোগ্য। এ প্রসঙ্গে তার মত হলো— ‘সাধারণত এক ধর্মের মানুষ অন্য ধর্মের প্রবক্তাকে ধর্মগুরু বলে স্বীকার করেন না। এক্ষেত্রে গৌতম বুদ্ধ ব্যতিক্রম। তাকে হিন্দু তথা সনাতন ধর্মীরা দেবতাজ্ঞানে মান্য করেন। এছাড়া আহমদিয়া মুসলিম সম্প্রদায়ের ও বাহাই ধর্মমতের বিশ্বাসীরা তাকে দেবতা বা মহামানব বলে মনে করেন।’ তপন বাগচীর এই বক্তব্যের সঙ্গে শতভাগ সহমত পোষণ করা যায় না। বিশেষত যখন তিনি বলেন—‘সাধারণত এক ধর্মের মানুষ অন্য ধর্মের প্রবক্তাকে ধর্মগুরু বলে স্বীকার করেন না, তখন তপন বাগচীর ধর্মীয় পরিচয় এবং সে সঙ্গে, প্রধান প্রধান ধর্মাবলম্বীদের বিশ্বাস সম্পর্কে তার গবেষণালব্ধ ধারণা কী— এসব প্রশ্ন সামনে আসে। এর কারণ খ্রিস্ট ধর্ম এবং ইসলাম ধর্মের অনুসারীরা পূর্ববতী ধর্মানুসারীদের প্রবক্তাকে ধর্মগুরু বলেই মান্য করেন। তপন বাগচী এক্ষেত্রে কেবল ভারতবর্ষীয় কয়েকটি ধর্মের অনুসারীদের স্বভাব-বিশ্বাস ও আচরণ থেকে লব্ধ ধারণার ওপর ভিত্তি করে ওই বিশেষ সিদ্ধান্তমূলক মন্তব্য করেছেন।
এই সামান্য ত্রুটি বাদ দিলে রবীন্দ্রসাহিত্যে গৌতম বুদ্ধের প্রভাব সম্পর্কে তার মূল্যায়ন যৌক্তিক। এক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের সাফল্য সম্পর্কে তার মূল্যায়ন ‘রবীন্দ্রনাথ বৌদ্ধ ধর্মীয় মূল তত্ত্বের চেয়ে আদর্শকে গ্রহণ করেছেন তীব্রভাবে। রবীন্দ্রনাথ বুদ্ধের অহিংসনীতি গ্রহণ করেছেন। বুদ্ধের প্রভাবে রচিত রবীন্দ্র সাহিত্য সম্পর্কে তপন বাগচীর অভিমত—‘বৌদ্ধ আখ্যানের ভিত্তিতে রচিত রবীন্দ্র রচনা বাংলা সাহিত্যই নয়, বিশ্ব সাহিত্যের প্রেক্ষাপটেই অমূল্য সম্পদ। তপন বাগচী রবীন্দ্রনাথকে দেখেছেন আবেগ অনুভূতি আধ্যাত্ম সঙ্কট ও সমাজচিন্তকের প্রমূর্তিতে। রবীন্দ্র সাহিত্যে গৌতম বুদ্ধের প্রভাবকে দেখেছেন যতটা আধ্যাত্মচেতনা বা ধর্মীয় বিশ্বাসের পটভূমিতে তারও বেশি লক্ষ্য করেছেন আত্মিক-সাংস্কৃতিক সম্পর্ক, সে সঙ্গে শৈল্পিক অনুষঙ্গ ও মানবিক বিষয়-আশয়। নতুন তথ্য-তত্ত্ব আবিষ্কারে তিনি সফল গবেষক।
সাহিত্যের বিভিন্ন অনুষঙ্গ নিয়ে লিখেছেন—‘সাহিত্যের সঙ্গ অনুষঙ্গ।’ এই বইতে বাংলা কবিতা-কথাসাহিত্য-প্রবন্ধের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান যারা রেখেছেন, তাদের কয়েকজনকে নিয়ে লিখেছেন স্মৃতিচারণ নির্ভর বিশ্লেষণাত্মক প্রবন্ধ। ওই বইয়ের গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধগুলো হলো—‘শামসুর রাহমান : স্মৃতি অনুভবে’, ‘বিনয় মজুমদার : উত্সর্গ করা আশ্চর্য মানুষ’, ‘আব্দুল মান্নান সৈয়দ : সাময়িকপত্র সম্পাদনা, ‘ সেলিম আলদীন : তার যাত্রা ভাবনা’ ‘অসীম সাহার কবিতা : শুদ্ধ স্বরে শিল্পস্তূতি’, ‘গুরুত্বপূর্ণ কবির নাম মহাদেব সাহা’ এবং ‘আবুল আহসান চৌধুরী : বহুমাত্রিক সৃজন-অন্বেষা।’ প্রবন্ধগুলোর নামকরণই সাক্ষ্য দেয়—প্রাবন্ধিক সাহিত্যের সপ্রশংস আলোচক এবং মুগ্ধ পাঠক। এ কারণে যা কিছু নান্দনিক যা কিছু মাঙ্গলিক তারই সপ্রশংস বিশ্লেষণে ব্রতী হয়েছেন। এসব প্রবন্ধে তপন বাগচী সাহিত্য আলোচনার পাশাপাশি ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণও করেছেন। ফলে তার প্রবন্ধগুলো নিছক প্রবন্ধ না হয়ে, হয়ে উঠেছে ননফিকশন। এ কারণে সাহিত্যের বিশ্লেষণের পাশাপাশি সাহিত্যিকের আচরণ এবং জীবনযাপনের সংবাদও মেলে এসব প্রবন্ধে। যেমন—
১.
কয়েক বছর আগে তিনি নিজের নামেই প্রতিষ্ঠা করেন ‘মান্নান সৈয়দ শিল্পকেন্দ্র।’ আর সেখান থেকে সম্পাদনা ও প্রকাশ করেন ৯টি বুলেটিন। শেষ বয়সে অন্যের লেখা জোগাড় করে মুদ্রণ ও প্রকাশনার ঝক্কি পোহাতে পারেন কেবল জাত-সম্পাদকরাই। আব্দুল মান্নান সৈয়দ সেই জাত-সম্পাদকদেরই একজন। সম্পাদনার মধ্যদিয়ে তিনি নিজে পরিশীলিত হয়েছেন, সৃষ্টি করেছেন নতুন লেখা, আবিষ্কার করেছেন নতুন লেখা।
(আব্দুল মান্নান সৈয়দ : সাময়িকপত্র সম্পাদনা)
২.
বাংলা কবিতা তো বটেই বাংলা সাহিত্যের প্রেক্ষাপটেই একজন অসীম সাহা গুরুত্বপূর্ণ লেখক। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য যে, আমাদের সমালোচকেরা কোনো এক দুর্বোধ্য কারণে তার কবি সত্তা অনুসন্ধানে নিস্পৃহতা প্রদর্শন করে।
(অসীম সাহা : শুদ্ধ স্বরে শিল্পস্তুতি)
৩.
ভাবলে অবাক হই, যে লোক মানসিক বিকারগ্রস্ত হিসেবে বিবেচিত, একাধিকবার কারাগারে ও হাসপাতালে নিক্ষিপ্ত, তিনি কী করে এত সুন্দর কবিতা লেখেন। তার মনোবিকারকে নিছক ‘পাগলামি’ বলে অভিহিত ও প্রচার করে করে আমরা কেউই নিজেদের দায় এড়াতে পারি না।
(বিনয় মজুমদার: উৎসর্গ করা আশ্চর্য মানুষ)
উদ্ধৃত অংশগুলো বিশ্লেষণ করলে, একটা বিষয় স্পষ্ট হয়—তপন বাগচী বর্ণনার ভঙ্গিতে আলোচ্য বিষয়ের মর্মমূল বিশ্লেষণ করেন। ওই বিশ্লেষণের মাধ্যমে আবিষ্কার করেন আলোচ্য বিষয়ের সারবত্তা এবং তার প্রকাশও।
বাংলা সমালোচনা সাহিত্য ও গবেষণার পটভূমিতে তপন বাগচীর গবেষণাকর্ম ও সমালোচনার বিশিষ্টতা এইখানে যে—তিনি সমালোচনা-গবেষণামূলক প্রবন্ধগুলোকে নিছক তথ্য-উপাত্তের বৃত্তে বন্দি রাখেননি। নানা ভঙ্গি ও শৈলীতে পাঠকের মর্মমূলে পৌঁছে দেওয়ার সাধনা করেছেন। আর এ কারণে প্রাবন্ধিক-সমালোচক-গবেষক তপন বাগচীর গবেষণা-সমালোচনামূলক রচনাগুলো হয়ে উঠেছে মননশীল ও সুখপাঠ্য।