ঔদাস্য ও অবহেলায়, অপচিকিৎসা কিংবা বিনা চিকিৎসায় কোনো শিল্প-সাহিত্যের অপমৃত্যু বা অকালমৃত্যু হলে দায়ী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে অভিযুক্ত করা যায় কিন্তু শাস্তির বিধান করা যায় না।
কথাটা অপূর্ণ অর্থবোধক হলেও প্রশ্নজনক। ব্যাকরণের বৈধতা খুঁজতে চেষ্টা না করে অর্থের দিকে ধাবিত হলে পেঁয়াজের খোসার মতো একের পর এক প্রশ্নের বাকল উঠতে থাকবে। হয়তো শেষ পর্যন্ত একটা প্রশ্নই থেকে যাবে। অথবা কিছুই থাকবে না। তবুও আমরা কৌতূহলী দর্শক দেখতে চাই সে সব প্রশ্নের উত্থান ও তার ধরন। সব প্রশ্নের উত্তর হয়তো এখানে পাওয়া যাবে না। কিন্তু খুঁজে দেখতে আপত্তি নেই বরং লাভ আছে।
রাজনীতিতে আমরা একবার স্বায়ত্তশাসনের জন্য সংগ্রাম করে সফল হয়েছি ব্যাপক। কারণ স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন শেষ পর্যন্ত স্বাধীনতার দিকে গিয়েছিল। ছয় দফা থেকে এক দফা। স্বাধীনতা লাভ করার পরে যে সব প্রশ্ন উঠেছে সে সব প্রশ্নের উত্তর খুবই জটিল এবং আপেক্ষিক। অনেকেই উত্তর দিতে চেষ্টা করেছেন কিন্তু ঠিক বলে গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। এখানেও তেমন প্রশ্নের উদ্ভব হতে পারে।
আমাদের প্রথমেই উচিত ছিল স্বায়ত্তশাসন বলতে কী বোঝাতে বা বুঝতে চাইছি তা স্পষ্ট করে নেওয়া। প্রবন্ধের নাম ও আলোচ্য বিষয় যেহেতু সাহিত্যের স্বায়ত্তশাসন। প্রথম এ প্রশ্নের উত্তরটাও বেশ জটিল। তাই এর উত্তর কথাগুলো বিন্যাসের অভাবে আপাতত সরিয়ে রেখে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে থাকি। পরে অনায়াসে সেটা পাওয়া যেতে পারে। অধীর না হয়ে বর্তমানের সঙ্গে তাল মিলিয়ে যেতে থাকি, দেখা যাক পেঁয়াজের বহিরাবরণের রঙিন প্রশ্নটা কী জিজ্ঞাসা করছে।
আমরা প্রথমেই অভিযোগ করেছি সাহিত্যের অকালমৃত্যু কিংবা অপমৃত্যুর কারণ চিহ্নিত করতে পারলেও অভিযুক্তের বিরুদ্ধে শাস্তির বিধান করতে পারি না। ঠিক এ মুহূর্তে তা করছিও না। কারণ অভিযোগ পেশ করার আগে জেনে নেওয়া জরুরি সাহিত্যের অপমৃত্যু বা অকালমৃত্যুর অর্থ কী! আমরা অনেকেই বিশ্বাস করি সাহিত্যের কখনো মৃত্যু হয় না। শুধু বস্তু ও শক্তির চরম পরিণতির মতো রূপান্তরিত ঘটে মাত্র। বিশ্বাস করি সাহিত্যের সাহিত্য সাহিত্য হয়ে ওঠার জন্য তার বস্তু— শিল্পবস্তু— হয়ে ওঠা প্রয়োজন। আর বস্তু হয়ে উঠলে তা আপনা থেকেই শক্তি হয়ে ওঠে। অবশ্য বস্তু না হলেও সাহিত্যের শক্তি থাকে, তবে তা ভিন্ন প্রসঙ্গ। (আমার লেখা সাহিত্যের সমালোচনা ও জীবনীশক্তি প্রবন্ধটিতে পাবেন) যদি তাই হয়, অর্থাৎ সাহিত্যের মৃত্যু না ঘটে তাহলে অপমৃত্যু বা অকালমৃত্যুর কথা আসছে কেন? আসলে বলা যায় সাহিত্যের সাহিত্য হয়ে ওঠার আগে যে মৃত্যু— যাকে আমরা সাহিত্যের ভ্রূণহত্যাও বলতে পারি।
ভ্রূণসাহিত্যের অকালমৃত্যু বা অপমৃত্যুর প্রধান কারণ হিসাবে আমরা দেখতে পাই বাইরের শাসনকে। অন্যভাবে বললে স্বায়ত্তশাসনের অভাবই এর মূল কারণ। স্বায়ত্তশাসন আমাদের প্রধান আলোচ্য বিষয় হলেও প্রথমে শাসন ও শাসকদের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ তা বিচার করব। এ প্রবন্ধে আলোচনার সুবিধার জন্য যে প্রকার শ্রেণীবিভাজন করা হয়েছে তা স্থায়ী শ্রেণীকরণ মনে করার কারণ নাই। ধরা যাক প্রথমেই সাহিত্যের শাসকশ্রেণীকে দুই ভাগে ভাগ করতে পারি।
প্রথমত, সাহিত্যের সৃজনকালে অদৃশ্য ও নেপথ্যের শাসক। এরা সাহিত্যের নিম্নতলে এবং সময়ের প্রস্থচ্ছেদে বিষয় অনুসারে শাসন করে। এরা লেখকের মস্তিষ্কের ভেতরে বসে থাকে।
দ্বিতীয়ত, সৃষ্ট সাহিত্যের সাহিত্য হয়ে ওঠার অর্থাৎ প্রকাশকালে এবং প্রকাশের পরে বস্তু ও পরিস্থিতি অনুসারে সময়ের দৈর্ঘচ্ছেদে সাহিত্যের উপরিতলে শাসন করে। সাহিত্যের ক্ষেত্রে এরাই মুখ্য।
তবে প্রথমে উল্লিখিত পরোক্ষ শাসকরা গৌন হলেও গুরুত্বহীন নয়। তারা সৃষ্টির আদিপর্বে শাসন করে সফল হলে পরে দ্বিতীয় পর্বে এসে সাহিত্য নির্বিঘ্নে সচল হতে পারে। আর এখানে ব্যর্থ হলে বা লেখক তাদের উপেক্ষা করে চললেই দ্বিতীয় পর্বে এসে নানারূপ বাধার সম্মুখীন হতে হয় সাহিত্যের।
সমাজবিদের কর্তাগিরি
সাহিত্য রচনার সময়ে সাহিত্যিকের মস্তিষ্কের ভেতরে বসে একজন সমাজবিদ সব সময়ই কর্তাগিরি করতে চেষ্টা করে। এর কোনো চরিত্রগত অস্তিত্ব নেই। সাহিত্যিকের চরিত্র, অবচেতন মনের অবদমিত আকাঙক্ষা আর সমকালীন সমাজ বাস্তবতার মিশ্রণে এর জন্ম। সমাজ থেকে সাহিত্যের উপাদান সংগ্রহ করতে তার অনুমতি লাগে। যে কোনো সামাজিক ঘটনা বা উদাহরণ কিংবা চরিত্র সাহিত্যে স্থান পেতে পারে না। কোনটা পাবে আর কোনটা পাবে না তা-ও সে নির্ধারণ করে থাকে। বাস্তববাদী সাহিত্যে সামাজিক বাস্তবতার নামে যে কোনো ছবির স্থান দেওয়াকে সে অনুমোদন করে না। পরাবাস্তবেও ঠিক বিরল ঘটনা ও চরিত্রের প্রতীকায়ন প্রভৃতি সে সমর্থন করে না। এর কাজ প্রধানত দেখা। সমাজের দৃশ্যমান ছবিগুলো তুলে ধরা ও নিয়ন্ত্রণ করা। কথাসাহিত্যের ক্ষেত্রে যেমন সমাজের কিছু ছবি গ্রহণ করা হয়, যা সাধারণত সাহিত্যের আওতার বাইরে এবং সাংবাদিকতার অধিভুক্ত। সমাজবিদের দক্ষ শাসনে এসব নির্বাচন ও নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
ভাষা ও ব্যাকরণবিদের পণ্ডিতি
সাহিত্য প্রকাশের ভাষা আর সামাজিক-বাস্তবতার ভাষা এক নয়। সাহিত্যের ভাষা সাহিত্যিকের নির্মিত ভাষা হলেও বাস্তবতার চিত্র তাতে প্রকাশ না পেলে পাঠকের কাছে গ্রহণযোগ্যতা হারায়। কমলকুমার মজুমদার যেমন বিষয়বস্তুর জন্য পাঠকসমাজে উপস্থিত আছেন কিন্তু ভাষার কারণে সীমিত গণ্ডির মধ্যে মাত্র। এক্ষেত্রে ধরে নেওয়া যায় সাহিত্যিক তাঁর সৃষ্টিশীল সময়ে ভাষা ও ব্যাকরণবিদদের পণ্ডিতিকে নির্বিচারে গ্রহণ করেছেন। কিন্তু সমাজবিদের সাথে তার ভাষাবিদের মধ্যে কোনো সমন্বয় ঘটেনি।
সাহিত্যে ভাষাগত পাণ্ডিত্য দেখানো যায় কিন্তু সমাজবিদের সাথে তার ঐক্যসূত্র স্থাপিত হতে হয়, না হলে তা বাস্তববোধের কাছে মার খায়। ঐ ভাষাবিদ পাঠকের কাছে নিম্নমানের অনুপযুক্ত ভাষা উপস্থাপন করাকে যেমন শাসন করে তেমনই অতিরিক্ত এবং অবাস্তব উঁচুমানের কিন্তু অনুপযুক্ত ভাষাকেও নিরুৎসাহিত করে।
নীতিবাগীশের নির্দেশ
সামাজিক বাস্তবতা আর নির্মাণের ভাষা দিয়ে শুধু মৃত ছবি আঁকা আর ভাস্কর্য তৈরি করা যায়, তাতে গতি, আদর্শ, মহত্ত্ব কিংবা প্রাণ কিছুই থাকে না। ধর্ম, মানবতা, দর্শন ও নীতিবোধের দ্বন্দ্ব-সংঘাতময় উপস্থিতিই সাহিত্যকে প্রকৃত শিল্পের মান দিয়ে থাকে।
মানুষ মাত্রেরই নিজের দর্শন আর নীতিবোধ থাকে। বাইরের ধর্ম ও নীতির বাণী এক হলেও একই সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষের ধর্ম ও নীতিগত পার্থক্য থাকে প্রতিটি চরিত্রের। মার্কসবাদী সাহিত্যিক ও সমালোচকদের সাথে তাদের প্রতিপক্ষের সংঘাত বাঁধে এ বিষয়টি নিয়ে। মার্কসবাদীদের অনেকে মনে করেন সমাজভুক্ত মানুষের নীতি ও ধর্মবোধ নিয়ন্ত্রণ করে থাকে শ্রেণীবিভক্ত সমাজ আর তার অর্থনৈতিক অবস্থার প্রতিফলন। এ বিষয়ের পক্ষে তর্ক করতে করতেই গোঁড়া মার্কসবাদীরা দিনে দিনে বিলুপ্তির পথে যাচ্ছেন। অবশ্য গভীর চিন্তাশীল ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন মার্কসবাদীরা স্বীকার করেন মানবচরিত্রের ভিন্নতা। মানুষকে আকারগত নীতির ছাঁচে ফেলা উৎপাদিত পণ্য বলে গণ্য করা তাদের অনেকেই মনে করেন না।
কাব্য, কথাসাহিত্য কিংবা কথাসাহিত্যের যে কোনো বিষয়ের জন্য সাহিত্যিকের মস্তিষ্কের এই নীতিবাগীশের নির্দেশ কার্যকর থাকে। সাহিত্যে তার নির্দিষ্ট নীতিবোধ ব্যবহৃত হওয়ার পরেও তা বদলাতে পারে। পরবর্তীকালে সাহিত্যিকের নিজেরই নীতিগত অবস্থানের পরিবর্তন ঘটতে পারে। একারণেই তলস্তয় শেষ জীবনে এসে তাঁর সমস্ত সাহিত্যকর্মকে মূল্যহীন বলে আখ্যায়িত করেছিলেন।
প্রথা ও প্রতিষ্ঠানের ঐতিহ্য: সাহিত্যের স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্নে প্রথমেই পাঠকের চোখে পড়ে তা হল প্রকাশিত গ্রন্থের বাইরের শাসন। ধর্ম, রাষ্ট্র ও সমাজের মতো শক্তিশালী প্রথা ও প্রতিষ্ঠান আর নেই। লেখক-পাঠক তথা সব মানুষের সাথেই গভীর সম্পর্ক রয়েছে এর।
প্রতিভাবান মানুষের ভাব, চিন্তা ও কর্মের যে গতি তার তুলনায় এসব প্রতিষ্ঠান অনেক মন্থর। আর সৃষ্টিশীল ও প্রতিভাবান মানুষের গতি ব্যক্তিগত, অতিরিক্ত ও গণবিচ্ছিন্ন প্রায়। এমন গতিশীল মানুষের যা অতীত তা ঐসব প্রতিষ্ঠানের কাছে বর্তমান বা ভবিষ্যৎ মাত্র। এ কারণে প্রথা-প্রতিষ্ঠানের সক্রিয় দাপটকে ঐতিহ্য বলে গণ্য করা হয়।
প্রতিষ্ঠানগুলো অস্তিত্ব রক্ষা ও নিরাপত্তা রক্ষার স্বার্থে তাদের শৃঙ্খল ও শৃঙ্খলায় গণমানুষকে আবদ্ধ করে রাখে। যে কারণে ব্যক্তি অনুভূতিসম্পন্নরা তাতে বাধা মনে করে। প্রয়োজনে বিদ্রোহ করে। আর বিদ্রোহের ভয়ে প্রতিষ্ঠানগুলো সর্বদা আতঙ্কিত ও সতর্ক থাকে। শিল্পের সকল শাখার চেয়ে সুবোধ্য ও জনপ্রিয় সাহিত্যের ওপর শাসনব্যবস্থা জোরদার করে রাখে।
প্রাচীন, মধ্য ও আধুনিক যুগে, অর্থাৎ সব যুগে, সব দেশে ও সব ভাষার সাহিত্যের ওপর প্রথা ও প্রতিষ্ঠানের ঐতিহ্যের কঠোর শাসন ও দুঃশাসন দেখা গেছে। প্রকাশিত গ্রন্থের শাসনের এ ধারাকে আমরা গ্রন্থশাসনও বলতে পারি। যা সাহিত্যশাসনের উপবিভাগ মাত্র। তবে বেশিরভাগ সাহিত্যশাসন বা গ্রন্থশাসন শেষ পর্যন্ত সাহিত্যিক শাসন হয়ে দাঁড়িয়েছে। বলা হয়ে থাকে প্রাচীন ও মধ্যযুগে এমন সাহিত্যশাসন বা গ্রন্থশাসন হয়েছে খুব বেশি— কিন্তু সাহিত্যের ইতিহাসে আধুনিকযুগের ব্যাপ্তিকালেও কম ঘটেনি।* প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বের পুঁজিবাদী গণতান্ত্রিক, সমাজতন্ত্রী একনায়কতান্ত্রিক দেশসমূহে এবং তৃতীয়বিশ্বের সামন্ত, আধাসামন্ত, ধর্মকেন্দ্রিক মৌলবাদী, সামরিক ও আধাসামরিক নামেমাত্র গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে ব্যাপক হারে এ ধরনের অবিচার হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে। সকল শ্রেণীর রাষ্ট্রেই সাহিত্যশাসন ও সাহিত্যিকের ওপর নির্যাতন হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে। সমাজ ও ধর্মের প্রথা প্রথা আর রাষ্ট্রের আইন এসব শাসনব্যবস্থার প্রধান উপকরণ। সমাজের হয়ে মসজিদ-মন্দির-গির্জা এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ধর্মের যাজক-পুরোহিত ও মুফতি-মৌলানা সম্প্রদায়ের কিছুলোক, প্রাচীনপন্থী শিক্ষক, সালিশ-বিচারক, মাতব্বর, মেম্বর-চেয়ারম্যান, পুঁজিপতি-শিল্পপতি-ব্যবসায়ী, জমির দালাল, ভূস্বামী, রাজনৈতিক নেতা, বাড়িওয়ালা, আইন, শাসন ও বিচার বিভাগের ক্ষমতাবান দায়িত্বপ্রাপ্ত কিংবা অবসরপ্রাপ্ত গণ্যমান্য লোক আর রাষ্ট্রের সেন্সর বোর্ডসহ রাষ্ট্রীয় সব উপকরণ এসব দায়িত্ব পালন করে থাকে। পূর্ব ইউরোপের সামন্ত ও আধা সামন্ত দেশগুলোর সমাজতান্ত্রিক চেহারাধারণ এবং খোল-নলচে পাল্টে গণতান্ত্রিক রূপধারণ লক্ষ্য করা গেছে। কিন্তু সেখানে প্রথা ও প্রতিষ্ঠানের দাপট কমেনি। অবশ্য ইদানীং উৎকৃষ্ট গণতান্ত্রিক পরিবেশে আইন ও মানবাধিকারের পক্ষে কথা বলা বিভিন্ন সংগঠনের নিরপেক্ষ ভূমিকা অনেকটাই রাষ্ট্র ও সমাজের প্রতিপক্ষে অবস্থান গ্রহণ করে সাহিত্যের স্বায়ত্তশাসন অর্জনের পথ সুগম করেছে।
গ্রন্থশাসন বা সাহিত্যশাসন করে রাজনৈতিক মানবিচারীরা কিংবা সমাজ ও ধর্মের সংরক্ষণবাদীরা সাহিত্যকে হত্যা করতে পারে না। সাহিত্যিককে নির্যাতন বা হত্যা করতে পারে। আর একজন সাহিত্যিকের হত্যা ও নির্যাতনে অনেক আগামী বা সম্ভাব্য সাহিত্যের মৃত্যু ঘটতে পারে। আহত বা ভীত লেখক লেখালেখি ছেড়ে দিতে পারেন।
এমন ভয়ংকর ও বৈরী পরিবেশে সাহিত্যিকের পক্ষে জরুরি হয়ে ওঠে ছদ্মনাম ও ছদ্মবেশ গ্রহণ করা। সবকালেই এমন প্রবণতা ছিল। আরেকটি বিকল্প ব্যবস্থাও দেখা যায়। প্রতীক ও ইঙ্গিতধর্মী লেখায় মনের ইচ্ছা প্রকাশ করা। আমাদের সাহিত্যের অঙ্গনে পাকিস্তান আমলে এমন অনেক হয়েছে। এর মধ্যে সত্যেন সেনের পাপের সন্তান ও অভিশপ্ত নগরী এবং শওকত ওসমানের ক্রীতদাসের হাসি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। ব্রিটিশ আমলেও এমন লেখা প্রকাশিত হয়েছে। তারও অতীতে মধ্যযুগে বিশেষ করে মঙ্গলকাব্যগুলো আর রোমান্টিক প্রণয়োপাখ্যানমূলক কাব্যগুলো এ ধরনের সাহিত্যের প্রমাণ। আর মৌখিক সাহিত্য যা আছে, রূপকথা, উপকথা ও অপকথা বলে পরিচিত— সেসবের নির্মাতারাও প্রশাসনিক দৌরাত্ম্য থেকে আত্মরক্ষার জন্য এই বিকল্প পন্থা খুঁজে নিয়েছিলেন।
সেই যে উপকথার এক টুনি টুনটুনিয়ে সাত রানীর নাক কাটিয়েছিল। নারীবাদীরা বাবতে পারেন এক রাজার অন্যায়ে সাত রানীর কাটানো পুরুষতান্ত্রিক সমাজের বৈষম্য ও এক প্রকার নিগ্রহণ। কিন্তু আমরা ভিন্ন অবস্থানে দাঁড়িয়ে অন্য দৃষ্টিতে দেখলে বুঝি দক্ষ রূপকথার ও রূপদর্শী কাহিনিকার সমকালের পাঠক-শ্রোতাকে (এমনকী দূরবর্তীদেরও) বুঝিয়ে দিতে চেয়েছেন এ বুদ্ধিমান ও কথাবলা টুনটুনি আসলে তিনি নিজেই। অত্যাচারী শাসক তার কোনো ক্ষতিই করতে পারবে না। যেভাবে চেষ্টা করবে সেভাবেই আটকে যাবে। বরং তিনিই রাজার সাতজন সুন্দরী রানীরূপী সাতটি মহাপরিকল্পনাকে একে এক নস্যাৎ করে দেওয়ার বুদ্ধি রাখেন। রূপকথায় রাজাদের আটকুড়া বা নিঃসন্তান কিংবা অপুত্রক দেখানো হয়; এটাও সাহিত্যিকের সচেতন কিংবা অবচেতন মনের প্রতিরোধপন্থা। যে রাজার শাসনের অবসান কামনা করা হয় তার নিঃসন্তান বা ‘অপুত্রক’ ছবি আঁকাটাই বিদ্রোহের প্রকাশ। গণতান্ত্রিক যুগের আগে, সামন্ত কিংবা দাস যুগে যেসব কথা প্রকাশ করা সাহিত্যিকের পক্ষে ঝুঁকিপূর্ণ ছিল, সেসব কথাই কাহিনির চরিত্রে আরোপিত পশুপাখির মুখে অতি কৌশলে প্রকাশ করা হতো।
সমালোচকের পোদ্দারি: সাহিত্যের সমালোচনাও সাহিত্যশাসন। প্রকাশের পরেই সমালোচনা বা সমালোচকের কর্মকা- শুরু হয়— একারণে তার শাসন সাহিত্যের পক্ষে খুব একটা ক্ষতিকর হয়ে ওঠে না। পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত সাহিত্যের সমালোচনা করা হলে তা গ্রন্থাকারে প্রকাশের সময় প্রভাব পড়তে পারে। যেমন, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কৃষ্ণকান্তের উইল উপন্যাসটি ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হওয়ার সময়ই পাঠক-সমালোচকের কাছে বিধবা রোহিণীর উত্তরণ ও আচরণ ভালো লাগেনি। লেখকের বাড়িতে উগ্র সমাজ সংরক্ষকদের ঢিল পড়তে শুরু হলে লেখক রোহিণীকে থামিয়ে দেওয়ার জন্য গোবিন্দলালের হাতে পিস্তল তুলে দেন। গোবিন্দলাল রোহিণীকে চিরতরে থামিয়ে দেন।
প্রকাশিত গ্রন্থের সমালোচনা হলে পরবর্তী সংস্করণে তা কার্যকর হয়। অবশ্য সাহিত্যিক যদি তা গ্রহণ করেন অর্থাৎ শাসন মেনে নেন। সাধারণত সাহিত্যের স্বায়ত্তশাসন প্রত্যাশী সাহিত্যিকেরা অন্যের সমালোচনা খুবই কম পরোয়া করেন।
তবে পত্র-পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত সাহিত্যকর্মের সমালোচনা যথেষ্ট কার্যকরী হয়ে ওঠে। স্পর্শকাতর ও আপত্তিকর বিষয়ে তখন সমালোচনার ঝড় ওঠে। অনেক সময় তুমুল সমালোচনার মুখে সম্পাদক সে লেখা ছাপানো বন্ধ করে দেন। অথবা সে সাহিত্য আর গ্রন্থাকারে পাঠকের কাছে আসে না। বর্তমান বাজর অর্থনীতির যুগে তার ফল অনেক সময় বিপরীত হয়ে থাকে। সমালোচিত, বিতর্কিত এবং ঝড়তোলা লেখা ধারাবাহিকভাবে শেষ কিস্তি পর্যন্ত প্রকাশিত হওয়ার আগেই মলাটবদ্ধ হয়ে বাজারে চলে আসে। প্রকাশকরা এ ধরনের পাণ্ডুলিপিতে বিনিয়োগ করার ঝুঁকি নিতে ভরসা পান। সেসব বই দ্রুত কাটতে থাকে।
বেপরোয়া সাহিত্যিকরা পত্রিকায় প্রকাশিত সাহিত্যকর্মের কিংবা প্রথম প্রকাশপরবর্তী সমালোচনা বা শাসন তুমুল হলেও তার শাসিত রূপ পরবর্তী সংস্করণে আনেন না। এটা গণতান্ত্রিক পরিবেশেই সম্ভব হয়। পাঠকও মূলের অবিকৃত স্বাদ গ্রহণ করার জন্য দ্রুত সংগ্রহ করার চেষ্টা করেন।
সমালোচকের সাহিত্যশাসন সাহিত্যের প্রত্যক্ষ কোনো ক্ষতি করতে পারে না, তবে লাভের দিগন্ত কুলে দিতে পারে। কিন্তু পরোক্ষে যে ক্ষতিটা করতে পারে তা প্রত্যক্ষ লাভের তুলনায় অনেক বেশি গুরুতর। সমালোচনা শুরু হলে অনেক দিনকানা শাসকের চোখ খুলে যায়। বিশেষ করে ঐতিহ্যবাহী প্রথা ও প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা ও কর্ণধারের। এর পরে তারা দুর্বলতা খুঁজতে শুরু করেন। নিজেরা যাচাই-বাছাই না করে সমালোচকের কথার রেশ ধরে সুযোগ পেলেই সাহিত্য ও সাহিত্যিকের ওপর শাসনের রাজদ- নামিয়ে আনেন। এভাবে সমালোচকরা হুমকি, হামলা ও মামলার সুযোগ সৃষ্টি করেন।
প্রকাশকের স্বার্থরক্ষা
যার হাতে সাহিত্যের প্রকাশ ঘটে তার শাসনব্যবস্থা প্রথা-প্রতিষ্ঠান ও সমালোচকের শাসনেরও আগে কার্যকর হয়। প্রকাশক নিজে মানুষ, যাবতীয় মানবিক গুণাবলী কিংবা সীমাবদ্ধতা তার মধ্যে অনিবার্যভাবেই উপস্থিত থাকে। প্রকাশনা তার পেশা। এটা সব সময় শখের বিষয় না। প্রাচীন এবং মধ্যযুগের লিপিকারগণও এটাকে পেশা হিসাবেই নিতেন। আর বর্তমান যুগে তো প্রকাশনা শিল্প অর্থেই ইন্ডাস্ট্রি বা ইন্ডাস্ট্রি অর্থেই শিল্প। এখানে রয়েছে বহু প্রকার লাভ-ক্ষতির শ্রেণীবিভাগ ও অনেক প্রকার পেশাদার কর্মচারী। এ ব্যবসায় পুঁজি খাটানো হয় অবশ্যই লাভের আশায়। কেবল সাহিত্যসেবা আর সাহিত্যিকের আহার যোগানোর জন্য নয়। এ কারণে লেখকের পাণ্ডুলিপিকে প্রকাশক তার শিল্পের কাঁচামাল বিবেচনা করেন। এ ব্যাপারে কারো কিছুর বলার থাকে না। এটাকে নতুনভাবে উৎপাদন করে বাজারজাত করে লাভের টাকা তুলে আনার জন্যই তার অর্থলগ্নি করা।
যে পাণ্ডুলিপি প্রকাশ করলে প্রকাশকের লাভ কম হবে বা ঝুঁকিপূর্ণ তা বর্জন করা তার বাণিজ্যিক কর্তব্য। এ ক্ষেত্রেপ্রকাশকের শৈল্পিক আবদার রক্ষা করতে পারে না সাহিত্যিকের শৈল্পিক । এসময় উভয়কেই একটা সমঝোতায় আসতে হয়। তখনই সাহিত্যের ওপর প্রকাশকের খবরদারি শুরু হয়। প্রকাশক স্বয়ং গল্প-উপন্যাস কিংবা প্রবন্ধের যেখানে সেখানে সংশোধন, পরিবর্তন কিংবা সংযোজন ও বর্জনের নির্দেশ দেন।
প্রকাশকদের এ ধরনের নির্দেশ অনেক সময় অতি কঠিন হয়ে ওঠে। যা রক্ষা করা লেখকের পক্ষে খুব কষ্টকর। অগ্রিম টাকা নিয়ে সময়মতো পাণ্ডুলিপি দিতে না পারলে প্রকাশকের ক্ষতি হয়। প্রকাশক তখন চাপ দিয়ে মর্জি মতো লেখা আদায় করতে চেষ্টা করেন। আইনের ভয়ও দেখান। ফিওদর দস্তয়েভস্কির জীবনে প্রকাশকের বিভিন্ন প্রকার জুয়ার দানে পরাজিত হয়ে ফরমায়েশি লেখা লিখে দিতে হয়েছে। এ কথা বিশ্ববিদিত।
এমনই অনেক সূক্ষ্ম ও স্থূল স্বার্থবুদ্ধিতে সাহিত্যের ছোট ও বড় নানা প্রকার ক্ষতি হয়ে থাকে। অথচ প্রকাশকই এ যুগে প্রধান ব্যক্তি, যার সাহায্য ছাড়া লেখা পাঠকের হাতে পৌঁছতে পারে না। লেখক-পাঠকের মাঝখানে সম্বন্ধ রচনা করাই তার কাজ। এমনও ঘটে থাকে, বড় লেখকের গুরুত্বহীন কিংবা ঝুঁকিপূর্ণ গ্রন্থ প্রকাশ করে অথবা অখ্যাত লেখকের বড় আবদার রক্ষা করে প্রকাশক বিপদের মুখে পড়েন। অনেক প্রতিষ্ঠান এভাবে দেউলিয়া হয়ে যায়। মালিক ব্যবসা গুটিয়ে নিতে বাধ্য হন।
কিন্তু এ কথা সত্য, প্রকাশকের অনাগ্রহে অনেক ভালো লেখা অপ্রকাশিত থেকে যায়। কিংবা বিকৃত চেহারা নিয়ে প্রকাশিত হয়। দু’দিক সামলে নিয়ে তার চলতে হয়, বাণিজ্য রক্ষা করা এবং উৎকৃষ্ট সাহিত্যের প্রতি অবহেলা ও উদাসীনতার দৃষ্টি পরিবর্তন করা।
সম্পাদকের উপনিবেশ
এ যুগে বিভিন্ন প্রকার সাময়িক বা অনিয়মিত পত্র-পত্রিকায় কমবেশি সাহিত্য প্রকাশিত হতে দেখা যায়। তা দৈনিক, সাপ্তাহিক, পাক্ষিক, মাসিক, ত্রৈমাসিক কিংবা অনিয়মিত যাই হোক। জাতীয়, আন্তর্জাতিক অথবা আঞ্চলিক হোক। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, অপরাধ জগতের, শিল্প-সংস্কৃতি যে কোনো বিষয়েরই হোক। নারী, শিশু অথবা পরিবারের সকল শ্রেণীর পাঠকের জন্যই ছাপা হোক, সাহিত্য ছাপানো একটি জরুরি বিষয়। এর মধ্যে সাহিত্যপত্রিকার সাহিত্যিক সম্পাদক ছাড়া বাকি সব পত্রিকার সম্পাদকের সাহিত্য-সম্পাদনা ঔপনিবেশিক শাসনের নামান্তর।
কারণ একে তো সাহিত্য তাঁর অধিগম্য বিষয় নিজস্ব অঞ্চলের বাইরে। দ্বিতীয়ত, সাহিত্যিকের রুচি অপেক্ষা নিজস্ব রুচির প্রাধান্যেই শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। সম্পাদক তার পাঠক ও গ্রাহকের রুচির কথা চিন্তা করে সাহিত্যকে ‘সাইজ’ করেন। এ ব্যাপারে আজও কোনো প্রকার মীমাংসা হয়নি—সাহিত্যকে সাইজ করার ঠিক কতটুকু অধিকার তার আছে। যে সম্পাদক নিজে সাহিত্যিক তার সম্পাদনায় অসাহিত্যও সাহিত্য হয়ে উঠতে পারে। অন্যদের ক্ষেত্রে এর বিপরীত ঘটনা ঘটাই স্বাভাবিক। সম্পাদকের দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধ আর অধিকার নিয়ে লেখকের সাথে অপ্রীতিকর ঘটনাও ঘটে একারণে।
সাহিত্যিক সম্পাদক যাঁরা তাদের বিচার-বিবেচনা ও অযোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন উঠতে পারে। সম্পাদক যদি শুধুই কবি হন তার হাত গলে দুর্বল ছোটগল্প কিংবা প্রবন্ধ বেরিয়ে যেতে পারে। কবিতা ও গদ্য— এ দু’টি ভিন্ন ধারা। পৃথক চর্চায় দক্ষতা আসে। আবার একজন প্রাবন্ধিক যদি সম্পাদক হন, তিনি ছোটগল্পের ঘটনা ও চরিত্র নিয়ে জ্ঞান রাখলেও কবিতার শরীর ও মন পৃথকভাবে বুঝতে পারবেন তার নিশ্চয়তা নেই। আর অনুবাদ সাহিত্য প্রকাশের ব্যাপারে সম্পাদকের দু’টি ভাষা সম্পর্কেই বিশেষ ধারণা থাকা প্রয়োজন। সে গল্প, কবিতা, উপন্যাস, প্রবন্ধ যে কোনো সাহিত্যের অনুবাদই হোক।
পৃথিবীর ও সভ্যতার আদি সম্পাদক দুই শ্রেণীর— কৃষক আর শ্রমিক শ্রেণীর। কৃষক বীজ বাছাই করে জমিতে ফেলে অপেক্ষা করেন চারা জন্মানোর। চারা পরিমাণ মতো বড় হলে সম্পূর্ণ নির্মোহ দৃষ্টিতে বিচার-বিচার করে অপ্রয়োজনীয় চারা তুলে নেন নিড়ানি দিয়ে। বাকি সব চারা সযতেœ লালন করেন ফসলের প্রত্যাশায়। এর সবই তার সম্পাদকীয় দায়িত্ব। কোন চারাগুলো রাখতে হবে আর কোনগুলো ফেলে দিতে হবে তা তিনিই ভালো বোঝেন— যা অন্যেরা সহজে বুঝতে পারেন না। একজন নবীন কৃষক যদি সবুজ চারার সজীবতা, সৌন্দর্য ও প্রাচুর্যে মুগ্ধ হয়ে পড়েন তবেই ফসলের সমূহ ক্ষতির সম্ভাবনা। এ ক্ষেত্রে প্রবীণ কৃষকের এমন মোহগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। তার সম্পাদকীয় দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধ এবং অধিকার বিষয়ে সম্পূর্ণ সচেতন তিনি।
অন্যদিকে শ্রমিক তার পণ্যের কাঁচামাল থেকে অতিসূক্ষ্ম বিবেচনায় প্রয়োজনীয় অংশ রেখে বাকিগুলো বর্জ্য ঘোষণা করেন। এটাও সাধারণ লোকের পক্ষে বুঝে ওঠা কঠিন। গুণাগুণ বিচার-বিশ্লেষণ ও গ্রহণ-বর্জন সম্পূর্ণ নির্মোহ ও দায়িত্বশীল সম্পাদকের কাজ। কৃষক ও শ্রমিক সেই আদি যুগ থেকেই সম্পাদকীয় দায়িত্ব পালন করে আসছেন।
দু’জনেই সম্পাদনা করে আসছেন একই মনে কিন্তু কাজের ক্ষেত্রে ও ফলাফল সম্পূর্ণ ভিন্ন। কারণ কৃষক বীজ বাছাইয়ে ও চারাগাছের সম্পাদনা করলেও তিনি ফসল সৃষ্টি করতে পারেন না। প্রকৃতির হাতে দায়িত্ব অর্পণ করে অপেক্ষায় থাকতে হয়। অন্যদিকে শ্রমিক তার কাঁচামাল সম্পাদনা করার পরে নিজ হাতে প্রয়োজনে পেশিশক্তি খরচ করে উৎপাদন করে নতুন পণ্য।
সাহিত্যের সম্পাদকের মধ্যেও এমন দু’টি শ্রেণী আছে। একজন যিনি নিজে সম্পাদনা করে সাহিত্য তৈরি করতে পারেন। অন্যজন শুধু ভালো লেখা বাছাই করতে আর সাজাতে পারেন পত্রিকার জন্য। অপুষ্ট ও অপূর্ণ ভ্রূণ সাহিত্যের সুচিকিৎসা করে তাকে বাঁচিয়ে তোলা শ্রমিক শ্রেণীর সম্পাদকের কাজ। আর ঔদাস্য ও অবহেলা ত্যাগ করে পূর্ণাঙ্গ সাহিত্যের সুস্থ প্রজনন ও সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা কৃষক শ্রেণীর সম্পাদকের কাজ।
এ দু’শ্রেণীর সম্পাদক ভালো রচনা ও সাহিত্য অন্তত চেনেন। এদের বাইরে যারা আছেন, বাইরের জগৎ থেকে এসে সাহিত্যের জগতে উপনিবেশ স্থাপন করে সাহিত্যশাসন করেন শুধু নিজস্ব অভিরুচি বা আর্থিক লাভের বিবেচনায়, তাদের শাসনে যে অনেক সাহিত্যের অপমৃত্যু কিংবা অকালমৃত্যু ঘটতে পারে এ দায় কি তাঁরা সহজে এড়াতে পারবেন?
স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্নে
এখানে এসে আমাদের মনে কিছু প্রশ্নের উদয় হতে পারে। এতক্ষণের কথা থেকেই উঠতে পারে এ কথা আগেই বলা হয়েছে। যেমন, সাহিত্যের দুই শ্রেণীর শাসকদের মধ্যে যারা প্রথমোক্ত শ্রেণীর অর্থাৎ সাহিত্যের বিষয় অনুসারে প্রস্থচ্ছেদে নেপথ্যে শাসন করে থাকে তাদের শাসনমুক্ত হওয়াকে সাহিত্যের স্বায়ত্তশাসন অর্জন বলা যাবে কি না। এ ক্ষেত্রে প্রথমে বিবেচনায় রাখতে হবে ঐসব নেপথ্য শাসকের শাসন প্রকৃত অর্থে শাসন কি না। মুক্ত বিবেক ও মুক্তচিন্তার প্রবক্তাদের মতানুসারে তো মনে হয় তাদের যোগ্য শাসক এমনকি প্রশাসকও বলা যায়। অর্থাৎ তাদের প্রশাসন<প্রকৃষ্টরূপ শাসন।
মুক্তচিন্তাশীলরা তো মুক্তচিন্তাশীলই। চিন্তায় তাঁরা কোনো প্রকার প্রতিবন্ধকতা পছন্দ করেন না। কিন্তু দ্বন্দ্বের ব্যাপারে তাদের কী মত? এ ক্ষেত্রে তাদের মধ্যে দেখা যায় নির্দ্বন্দ্ব চিন্তাশীলের সংখ্যাই বেশি। আর যারা নির্দ্বন্দ্ব তাদের কাছে এ শ্রেণীর শাসকের বা প্রশাসকের কোনো গুরুত্বই থাকে না। মজার ব্যাপার হচ্ছে মার্কসবাদ মূলত দ্বান্দ্বিক মতবাদ কিন্তু এর আঞ্চলিক প্রবক্তাদের বেশিরভাগই একরোখা ও নির্দ্বন্দ্ব। আবার তাঁরা নিজেদের মুক্তচিন্তার লোক বলেই মনে করেন।
দ্বিতীয় পর্যায়ের শাসক— যাঁরা সৃষ্ট সাহিত্যের প্রকাশকালে ও পরে বাইরে থেকে এসে প্রত্যক্ষ শাসন করে সময়ের দৈর্ঘ্যচ্ছেদে, তাদের গুরুত্ব নিয়েও প্রশ্ন উঠতে পারে। আগেই দেখেছি প্রথমোক্ত শ্রেণীর শাসনে শাসিত হলে সাহিত্যের প্রকাশে ও প্রচারে ঝুঁকি কম থাকে। তখন প্রত্যক্ষ বা বাইরের শাসকের শাসন করার খুব একটা সুযোগ থাকে না।
তাহলে আবার প্রশ্ন উঠবে সাহিত্যের শাসনের পরিধি আসলে কতটুকু? শাসনের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য স্বশাসন প্রতিষ্ঠা করাই কি সাহিত্যের স্বায়ত্তশাসন? তাই যদি হয় তাহলে কি সাহিত্যের স্বায়ত্তশাসনের প্রয়োজনে সাহিত্যিকের বাড়তি কিছু অর্জন করা প্রয়োজন? এ প্রশ্নের উত্তর এ মুহূর্তে উদাহরণ ছাড়া দেওয়া অসম্ভব।
রবীন্দ্রনাথ, তলস্তয়, দস্তয়েভস্কি কিংবা গ্যেটের সাহিত্যে বাইরের শাসন ঠিক কতখানি এসেছিল? তলস্তয় আর দস্তয়েভস্কির ওপরে প্রথা ও প্রতিষ্ঠানের প্রচ-রূপ শাসন চলেছিল। একজনকে খ্রিস্টধর্মের বাইরে অন্যজনকে সভ্যতা ও লোকালয়ের বাইরে সাইবেরিয়াতে নির্বাসনে পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ আর গ্যেটের ক্ষেত্রে বাইরের শাসকেরা খুব একটা সুবিধা করতে পারেননি। এর কারণ কি এই— মস্তিষ্কের ভেতরের প্রাথমিক ও পরোক্ষ শাসক তাঁদের প্রবল ছিল আর রুশ দু’জনের ক্ষেত্রে দুর্বল ছিল? তাঁদের সাহিত্যকর্মে তো এর প্রমাণ পাওয়া যায় না। তাহলে কেন? রবীন্দ্রনাথ ও গ্যেটে নিজেরাই বিশাল প্রতিষ্ঠান ছিলেন বলে? তবে কি তলস্তয় বিশাল প্রতিষ্ঠান ছিলেন না? তিনি তো রবীন্দ্রনাথের চেয়েও বড় জমিদার বা কাউন্ট ছিলেন।
আগেই বলা হয়েছে সব প্রশ্নের উত্তর এ রচনায় পাওয়া যাবে না। আমরা যারা চিন্তাশীল পাঠক যতারা ভবিষ্যতে কোথাও পেতে পারি। দ্বিতীয়োক্ত শ্রেণীর প্রত্যক্ষ শাসকদের মধ্যে দুর্বল কিছু শাসকও আছেন। মুদ্রাকর, প্রচ্ছদশিল্পী, প্রুফরিডার, বিজ্ঞাপনদাতা, পরিবেশক ও অনুবাদক। তাঁরাও সাহিত্যে এক-আধটু শাসন করার ক্ষমতা রাখেন। তাহলে সাহিত্যের স্বায়ত্তশাসন অর্জন বলতে কি এসব কাজকে সাহিত্যিকের আয়ত্তে থাকা বুঝব? তবে সর্বাধুনিক ইলেকট্রনিক মিডিয়া বা ইন্টারনেটে লেখকদের স্বয়ম্প্রকাশিত সাহিত্যকে একমাত্র স্বায়ত্তশাসিত সাহিত্য বলে বুঝতে হবে? অন্য প্রকারে কি সম্ভব?
আবার রবীন্দ্রনাথকে দৃষ্টান্ত হিসাবে টানতে হচ্ছে। কারণ তাঁর সাহিত্যকে এখানে অতি সংক্ষেপে বিচার করতে পারি। সাহিত্যের উপরিতলের প্রত্যক্ষ শাসনকে বিভাগের সবক’টি তিনি পালন করেছেন। প্রথমত, তিনি ভূস্বামী ও সামন্ত শাসক ছিলেন। পিতার বন্ধু কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত ব্রাহ্মধর্মের প্রচারক ছিলেন। দ্বিতীয়ত, তিনি সাহিত্যের সমালোচক ছিলেন। দেশ-বিদেশের অনেক সাহিত্যের সমালোচনা করেছেন। তৃতীয়ত, তিনি নিজের বইয়ের নিজেই প্রকাশক ছিলেন। চতুর্থত, তিনি বিভিন্ন বয়সে অনেকগুলো সাহিত্যপত্রিকা সম্পাদনাও করেছেন।
আর নিম্নতলের পরোক্ষ শাসন বিভাগের দায়িত্বও তাকে পালন করতে হয়েছে। সমাজকল্যাণ ও সমাজভাবনার সাথে জড়িত ছিলেন আজীবন। এ কথাও সত্য যে, তিনি সমাজের জন্য সাহিত্যের অনেক ছাড় দিয়েছেন। ভাষা ও ব্যাকরণবিদের হস্তক্ষেপের কোনো অবকাশ দেননি; তিনি নিজেই ভাষাবিদ ও ব্যাকরণবিদ ছিলেন বলে। ভাষাতত্ত্বে তাঁর বিরাট অবদান ছিল এবং আছে। একারণে তাঁকে বাঙলা ভাষার প্রথম দিকের একজন শ্রেষ্ঠ ভাষাবিজ্ঞানী বলে অভিহিত করেছেন হুমায়ুন আজাদ। আর নীতিবাদের তুমুল দ্বন্দ্বে তিনি সারাক্ষণ জর্জরিত ছিলেন। প্রচ- দ্বান্দ্বিক ছিল তাঁর ভেতরটা।
মোট কথা শাসনবিভাগের উভয় কক্ষে তাঁর উপস্থিতি ছিল প্রভাবশালী। এসব কারণে তিনি পেশাদার সমালোচকদের গুরুত্ব দিতেন কম। সম্পাদকের ফরমায়েশে উপন্যাসের জগতে এলেও তাদের শাসন মানতে বাধ্য ছিলেন না। সমাজভাবনার কারণেই পেশাদার সমালোচকদের চাইতে পাঠকের সমালোচনাকে বেশি গুরুত্ব দিতেন। পাঠকেরাই সাহিত্যের ভোক্তা এবং ভুক্তভোগী। এসব দিক থেকে বিচার করলে রবীন্দ্রসাহিত্যকে স্বায়ত্তশাসিত সাহিত্যের উদাহরণ হিসেবে নেওয়া যায় কি না এ রায় প্রদানের দায়িত্ব পাঠকের হাতে ছেড়ে দেওয়া হল।
সাহিত্যের স্বায়ত্তশাসন
শুরুতেই যে প্রশ্নটি হাতে রেখে দেওয়া হয়েছিল বিন্যাসের অভাব আর জটিলতার অজুহাতে এখন বিদায়ের কালে তার উত্তর খুঁজে দেখা যাবে আরেকবার। ঠিক উত্তর যে পাওয়া যাবে এমন নিশ্চয়তা কখনোই দেওয়া হয়নি। বলা হয়েছে একটা মামুলি প্রশ্নই শেষ পর্যন্ত থেকে যাবে অথবা কিছুই থাকবে না।
প্রশ্ন ছিল সাহিত্যের স্বাত্তশাসন বলতে কী বুঝি? যাকে নিয়ে এতক্ষণ এত কথা হল সে জিনিসিটা কী তাই বোঝা গেল না। ্্র প্রশ্নের উত্তরটা অনায়াসে পাওয়া যেতে পারে বলে ধারণা দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু পাওয়া গেছে কি? হয়তো আবছা ও অস্পষ্ট ধারণা পাওয়া গেছে শাসনের নানা আলোচনায়। পরিষ্কার হয়নি, আসলে বিষয়টাই অস্পষ্ট। এর রূপরেখা খুবই সূক্ষ্ম।
সাহিত্য মূলত শিল্পসাম্রাজ্যের একটি করদরাজ্য। তাই এর স্বাধীনতা সম্পূর্ণ অসম্ভব। যদিও শিল্পীর স্বাধীনতা নিয়ে দেশে দেশে অনেক আলোচনা-সমালোচনা, তর্ক-বিতর্ক, হামলা-মামলা অনেক হয়েছে। তবুও বিষয়টা স্পষ্ট হয়নি আজও। হওয়ার কথাও না। শিল্প ও শিল্পীর স্বাধীনতা বা সাহিত্য ও সাহিত্যিকের স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্নে আজও অজানা রয়ে গেছে এ দু’টি বিষয় আসলে এক কি না। এর পার্থক্যই বা কী? দেখা গেছে যুগে যুগে, দেশে দেশে, ভাষায় ভাষায় প্রত্যক্ষ শাসকের শাসন সাহিত্য ও সাহিত্যিক উভয়ের ওপর পড়েছে। সাহিত্যশাসন হয়েছে সাহিত্যিকশাসন বা গ্রন্থশাসন। সাহিত্যকে বস্তুগত রূপ দিয়ে গ্রন্থশাসনের সাথে এক করে নিয়েছি কিন্তু এক করতে পারিনি বস্তুর সাথে ব্যক্তির ওপর আরোপিত শাসনকে।
মানুষ কখনোই অন্যের দ্বারা শাসিত হতে চায় না। শাসনক্ষমতা চায় নিজ হাতে। ঈশ্বরদ্বারাও শাসিত হতে চায় না; যদিও ঈশ্বরের করুণা চায়, ক্ষমা চায়, কৃপা চায়। অন্যের বিরুদ্ধে নালিশ করে তাদের শাসনে রাখতে চায় কিন্তু নিজের জন্য চায় ক্ষমা। রাজনীতিতে আমরা আত্মনিয়াধিকারকে স্বায়ত্তশাসনরূপে ব্যাখ্যা করে আন্দোলন করে পেয়েছি স্বাধীনতা। শাসনক্ষমতা নিজ হাতে চাওয়ার আগে পাওয়ার যোগ্যতা অর্জন করতে হয়। নয়তো স্বশাসন শেষ পর্যন্ত স্বেচ্ছাচারিতায় পৌঁছে যায়। তাহলে এখানে যদি একটা সরল ও আপাতকালীন সংজ্ঞায় পৌঁছি — যে শাসকের কাছে স্বেচ্ছায় শাসিত হওয়ার ইচ্ছা জাগে তাই স্বায়ত্তশাসন। তাহলে কি সমস্যা মিটল? এই মামুলি উত্তরটা সাহিত্যের পেছনে জুড়ে দিলে কী দাঁড়ায়? যে সাহিত্য নিজেকে নিজে শাসন করার যোগ্যতা রাখে, নিজের দ্বারা শাসিত হতে চায় তাই কি সাহিত্যের স্বায়ত্তশাসন?
আমাদের প্রতিশ্রুতি অনুসারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছা না গেলেও প্রশ্ন রেখেই আলোচনার ইতি টানব। আর দূরে নয় বরং এখানেই।