মে’র তরঙ্গ
থেমে যায় সেসব তরঙ্গ
তুষার ঝড়ে হারাবে বলে যে বেরিয়েছিল
অবয়বহীন ভবিষ্যতের মতো উষ্ণ এক মে মাসে;
আকাশবৃষ্টির মতো তুষারঝড়কে ভালোবেসে,
নিঃসঙ্গ দেয়ালের মতো শান্ত অদৃশ্য সে তরঙ্গ
চারুশিল্পের পোট্রেটে বন্দি
উজ্জ্বল সীসার মতো সংকেতের সোনালী সৌরভের উচ্ছ্বাসে
জ্বলজ্বলে চাঁদের চাঁদোয়ায় ভেসে যায়…
জলসাগরে ডুবে ডুবে শামুকের খোলের ভেতর
খুব সঙ্গোপনে–
ঢেউয়ের তোরে ভেসে যাওয়ার গোপন ইচ্ছেঘুড়ি ;
এখনো ঘুমিয়ে আছে নীল আকাশের গালিচায়,
নিজের ছায়ায় বন্দি
মুক্তি পেতে চায় ঘুমন্ত রঙগুলো
তাই, মুক্তোর ওপর খোদাই করে চলেছে নানা চিত্রকর্ম
আবারও ভালোবাসার উষ্ণ এক মে মাসে।
চৌচির দর্পণে মুখ দেখি
প্রত্যেক প্রেমিকই হৃদয় ঘটিত খুন হয়
এক কিংবা একাধিকবার,
আমিও খুন হয়েছি তোমার স্বপ্নের বারান্দায়।
যতবারই বদ্ধ ঘর ছেড়ে বের হতে চাই
খোলা হাওয়ায় একটু শ্বাস নেব বলে—
বারবারই ধাক্কা খাই তোমার মৃত স্বপ্নগুলোর সাথে;
কবে কখন কোথায় এক স্বপ্নালু নারী হৃদয় ঘটিত খুন হয়েছিল,
সে খবর এখন খুব বোরিং জানি।
ব্যাপারটা অনেকটা সে রকম–
যেভাবে ছাঁটাই হওয়া খালাসিরা উদাসীন চোখে
ভাসমান জাহাজের মাস্তুলের দিকে তাকিয়ে থাকে আর ভাবে
আহা! এরকম একজাহাজে আমিও তো একদিন ছিলাম;
অনেকটা সেরকম বোরিং।
তবু কখনো কখনো চৌচির দর্পণেও নিজের মুখ দেখতে ইচ্ছে হয়।
জীবন থাকলেই মৃত্যু হয়, আবার
কিছুটা আশার দেয়ালও ঝুলে থাকে নৈঃশব্দ্যের সোনালি আভার মাঝেই।
দেয়াল
প্রতিটি অনুভরের বিস্তীর্ণ অরণ্যে অন্তহীন ঝুলন্ত দেয়াল থাকে।
লেখার টেবিলে যেমন অসীম আকাঙ্ক্ষা নিয়ে বসে থাকি অথচ
কিছুই লিখতে পারি না দেয়াল ঝুলে থাকে সেখানেও দেয়াল গড়ে
ওঠে ট্রাফিকপুলিশ আর রাস্তার মাঝেও। প্রত্যেক সম্পর্কের
সুড়ঙ্গপথে দাঁড়িয়ে থাকে দেয়াল । শূন্যস্বপ্নের অসীমতায় স্বপ্নকল্পনার দেয়াল আড়াল করে স্বপ্নসুখ । ক্যানভাসে আঁকা প্রোট্রেট ল্যান্ডস্ক্যাপ বা অ্যাবস্ট্রাক্ট পেইন্টিংসের পেছনেও অদৃশ্য এক দেয়াল ঝুলে থাকতে দেখি আমি । যেভাবে হৃদয়ের সব পথ বন্দি হয় রঙিন সব জ্বালানির অন্তর্ঘাতে। শহরতলীর শেষ মাথার সমান্তরাল প্রাচীন এক দেয়ালের উপনিবেশ গড়া দেখতে পেয়েই তাতে চাবুক মারা শুরু করেছিলাম। তবু ঈশ্বরের মতো নির্ভীক দেয়ালগুলোর দুর্গ অভেদ্য রয়ে যায় ভোগবাদী মানুষের লালসায় অন্তরালে।
ক্যামোফ্লাজ
মেঘের বুকের ওপর জলোচ্ছ্বাস নামার মতো করে বারবার গা গুলিয়ে ওঠে আমার, পা থেকে মাথা পর্যন্ত বিবমিষার উৎসব যেন। কিছু আর ভালো লাগে না । গানের তরঙ্গের ভেতরেও তো স্তব্ধতা থাকে । অন্ধকার যেভাবে বিচ্ছেদ আনে নিজের সঙ্গে প্রতিবিম্বের।কী করে মেঘের প্রতিচ্ছবি নিঃশব্দে ঝুলে থাকে ভোরের জানালার শার্সিতে? মরা মাছের শীতল চোখের মতো ধ্যানের যে মগ্নতা ছিল একদিন তা ভেঙে গুঁড়িয়ে গেছে সঙ্গোপনে আর টেম্পার শেষ হওয়া গ্লাসের মতো অস্থির চুরমার করে গন্তব্য। আমি তো কোনো দৌড়বিদ নই। এত দীর্ঘ কেন এ ভ্রমণ? ম্যারাথন রেসে চড়া মেকআপ খোসে গোলে পড়ে, দামি পেন্সিল হিলের গোড়ালি ভেঙে যায়। ইতিহাস ভালোবাসি বলেই কি লাশের পচন দেখতে হবে আমায়? গলিত দুর্গন্ধ মিশে যাবে আমার রক্তের সাথে? স্বেচ্ছাচারী সময় আমাকে কাঁদায়। মানুষ কি সব পিশাচ হয়ে যাচ্ছে? হয়ে উঠছে ভীষণ ব্যবসায়ী? শিশুগুলো কেন মেঝের টাইলসে পড়ে আছে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে? কী লক্ষ্য আছে এই সোয়ালো জীবনের উড়ে চলার? আলোর জন্য আমার দীর্ঘশ্বাস আর তোমার জন্য ভালোবাসা, বিষণ্নতা ক্যামোফ্লাজ করে খুব ওতোপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে আমার হৃদয়ে…
জলাতঙ্ক
প্রেমের পাপিষ্ঠ কামড়ে
জলাতংকের আতঙ্ক থাকে,
নলিচেরা তৃষ্ণায় জ্বলে লি লি আগুন
শ্মশানের চিতায় নিশ্চিন্ত ঘুমায় লেলিহান;
শেষ বৃষ্টি হয়েছিল কবে?
বিষাদ সাহারার ক্যাকটাস হৃদয়ের গভীরে;
শেষ পাতাটি ঝরে গেছে
কোন বসন্তের বুকের নিবিড়ে?
পিচুটির মতো জমে জমে অন্ধ হয়েছে
অপেক্ষায় থাকা প্রসন্নতা,
নির্লিপ্ততা—
অল্প কিছুটা সাদা ছাই পেয়েছি
দুরন্ত ক্ষোভে মশাল জ্বেলে ;
কিছুটা দূরে একটি নিওলিথিক পাথর পড়ে থাকে ।
ইদানীং মিথ্যে নাটকগুলো ভালোই জমছে
এক কাপ ধূমায়িত কফি খাওয়ার পর
ফিল্ম উৎসবের শেষ সিনামাটা না দেখাই থাক ।।
পতঙ্গের গুঞ্জন
অন্ধ কি পায় আলোর দেখা? জেনে কী হবে? শঙ্খের নিনাদ যেখানে উচ্ছ্বসিত হয়, আমার নৈঃশব্দ্যের ব্যাঞ্জন গিয়ে মেশে সেখানেই। পতঙ্গের গুঞ্জনের মতো। ছুটে চলা দুর্বার ঝর্ণার মতো। কামিনীফুলের তীব্র আঘ্রাণ আমাকে ঘর ছাড়া করেছে। বুঝতে পেরেছি, বিষণ্ণহৃদয়ের মানুষ বড় বেশি বিপন্ন ও বিবর্ণ হয়। আমি এখন চেরির মিষ্টি সুবাস ভালোবাসি । পাতা ঝরার মৌসুমে যদিও বৈরাগ্য আসে মনে। ভ্রমণের নামে বাড়ি ছেড়েই দেখেছি পথঘাট সবই অচেনা। এদিকে জ্যামেতিক হারে অবক্ষয় বাড়ছে ক্রমশ। মহাকাশ ভ্রমণ নয়। আদিম পর্যটক হব না । তবে প্যাসিফিক ও আটলান্টিকের সঙ্গে যে গ্যালাপাগোস দীপপুঞ্জ আছে সেখানে যেতে পারি যদি তুমি সঙ্গী হও।