আধুনিকতার অবক্ষয়ী চেতনার বিপরীতে নৈঃসঙ্গ ও আত্মমগ্নতাই আল মাহমুদের কবিতার উপজীব্য। নৈরাশ্য কিংবা অচরিতার্থ জীবনের হাহাকার নয়, স্বগৃহে প্রত্যাবর্তনের কাঙ্ক্ষা-ই তার মূল অনুষঙ্গ। ছন্দ-নির্বাচন, আঙ্গিক ও অলঙ্কারের পাশাপাশি বিষয় নির্বাচনে আল মাহমুদ ঐতিহ্যিক-মিথাশ্রয়ী। সে সঙ্গে স্বকালচেতনায়ও প্রোজ্জ্বল। আল মাহমুদ জীবন ও কবিতাকে দেখেছেন অভিন্ন দৃষ্টিতে। ফলে তার একাধিক কবিতায় এ দুটি বিষয় একীভূত হয়েছে।
স্বাদেশিকতা ও আন্তর্জাতিকতা বোধের যুগ্ম-স্বাক্ষর রয়েছে তাঁর কবিতায়। রাজনৈতিক চেতনা তাঁকে করে তুলেছে জনবান্ধব। ধর্মীয় চেতনায় আক্রান্ত হলেও তা মানবতাকে অস্বীকারের ভেতর দিয়ে নয়। রাজনৈতিক চৈতন্যের আগে অবশ্যই তার মর্মে ইতিহাসচেতনা ও জাতিগত অভিজ্ঞান গভীর রেখাপাত করে। ইতিহাস ও জাতিগত চেতনার সঙ্গে সমন্বয় করে লোকজ উপাদানকে করে তুলেছেন কবিতার অন্তর্গত। কেবল গ্রামীণ-জীবন যাত্রা-ই নয়, নাগরিক বোধ, প্রকৃতি, নারী, মানবপ্রেম, যৌনচেতনা, অধ্যাত্ম্য-সংকট ও মৃত্যুচেতনা কবিতার বিপুল অংশে প্রচ্ছন্ন। প্রাচীন কবিতা, বাউল-সম্প্রদায়, কৃষকসহ নিুবর্গের শ্রমিক সম্প্রদায়, লোকধর্ম ও ঐশীধর্ম, সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারের রূপান্তর ঘটিয়েছেন তিনি। এ প্রসঙ্গে ‘ভারত বর্ষ’, ‘বখতিয়ারের ঘোড়া’, ‘ইহুদীরা’ বিশেষভাবে উলে¬খযোগ্য। আত্মপরিচয় জানার স্পৃহার সঙ্গে-সঙ্গে আত্ম-উউন্মোচনেও কবি উন্মুখ। একদিকে সারল্য ও বিস্ময়, অন্যদিকে বর্বরতা—এই দুই বিপরীত স্বভাবের সমন্বয়ে গড়ে ওঠে আধুনিক মানুষের চারিত্র্য। এরই পরিপ্রেক্ষিতে সঙ্গত উচ্চারণ—‘সে অলীক মুহূর্তের ক্রোধ/ জয় করে দেখি আমি, কেবলই আমার মধ্যে যেন এক/ শিশু আর পশুর বিরোধ’ (বিষয়ী দর্পণে আমি)। কালজ্ঞান ও ইতিহাসচেতনা সময়ের প্রধান কবিকে করে তোলে কালের সাক্ষী, অতীতের ভাষ্যকার এবং ভবিষ্যৎদ্রষ্টা। তিনি সভ্যতার পর্যবেক্ষক, সংস্কৃতির বিশ্লেষক—এক কথায় নির্মোহ বিচারক।
আধুনিক বাংলা কবিতা গভীরতর অর্থে ঐতিহ্যের পরম্পরা এবং সংস্কৃতির রূপায়ণের ফল। বাংলা কবিতার আধুনিকতা কোনোভাবেই উল¬ম্ফনের বিপরীতে ঐতিহ্যিক পরম্পরাকে মান্য করে। এ দৃষ্টিকোণ থেকে আল মাহমুদের শুরুর দিকের কবিতায় কোথাও কোথাও জীবনানন্দীয় সুর লক্ষ করা যায়। ‘এভাবে সন্ধ্যা নামে, সব পাখি ফিরে যায় নীড়ে’ (প্রকৃতি) কিংবা ‘শঙ্খমাজা স্তন দুটি মনে হয় শ্বেতপদ্মকলি’ (সিম্ফনি) পঙ্ক্তিগুলোয় পূর্বসূরির স্বর লক্ষ করা যায় সত্য কিন্তু এই সুর তেমন উচ্চকিত কিংবা প্রকট নয়। এর চেয়ে তার নিজস্ব সুর ‘কোনো নারী কোনোদিন তার তরে মাখেনি কাজল’ (প্রকৃতি) প্রোজ্জ্বল ও হƒদয়গ্রাহী।
নিরাশ্রয়ী ও হতোদ্যম মানুষ আশা-নিরাশার দোলাচলে দোলে। ‘প্রবোধ’ সেই সত্যের উজ্জ্বল স্বাক্ষর। এই কবিতায় ঘনিষ্ঠস্বরে অন্ধকার আহ্বান করে, ‘আসুন বাবজী’। এই আহ্বান প্রকৃতির নয়, ‘অন্তহীন যন্ত্রণায়’ কামাতুর রক্তের। চিন্তার সততা এবং কল্পনার স্বচ্ছতায় ঐক্য হলেই কেবল মানুষ যূথবদ্ধ ভাবনায় অন্তর্লীন হতে চায়। তখন ব্যক্তি ‘আমি’র উত্তরণ ঘটে নৈর্ব্যক্তিক সত্তায়; বিশেষ ‘আমি’ রূপান্তরিত হয় নির্বিশেষে। শুরু হয় যৌথ স্বপ্নের চাষাবাদ। মানুষ স্বপ্নচারী। স্বপ্নচারিতার সীমা অনির্দিষ্ট হলেও স্বপ্নের গন্তব্য সীমিত। মানুষ স্বপ্নের জগতেও মূলত তার পরিচিত পরিমণ্ডলে বিচরণ করে। অভিজ্ঞতার বাইরে মানুষ খুব বেশি সফল হতে পারে না, পারে জোরালো কোনো স্বপ্ন দেখতেও। শুরুতে পূর্বসূরি জীবনানন্দ যেখানে ‘রূপসী বাংলা’য় বলেন, ‘আবার আসিব ফিরে, এই বাংলায়’ উত্তরসাধক আল মাহমুদ তারই প্রমূর্তি হয়ে ‘প্রত্যাবর্তন’ কবিতায় বলেন, ‘দুঃখের রাজত্বে তবে পলাতক আমরা কজন/ আবার এসেছি ফিরে’। এর আগে আত্ম-জিজ্ঞাসাতাড়িত কবির প্রশ্ন—‘আমরা কোথায় যাব, কত দূর যেতে পারি আর’। একসময় অনুতপ্ত কবি স্বসমাজে ফিরে এসে দেখেন, ‘জয়নুলের ছবির মত ঘরবাড়ি’। যেখানে চিরায়ত বাংলার রূপ অকৃত্রিমভাবে ধরা দেয়, প্রকৃতির বরপুত্রের কাছে। ‘আদিম সাহসে বলে আমাদের হাতে হাতে দিন/ কর্পূর গন্ধের বিন্দু ফোঁটা ফোঁটা বাসনা রঙিন’ বলে তাঁকে অভ্যর্থনা জানায় তাঁর নিজের সমাজ।
উপভোগ ও সৌন্দর্য-উপলব্ধির যুগ্ম-স্বাক্ষর ‘সাহসে আঘাতে স্পর্শে’। অবদমনের বিপরীতে উপভোগ এবং অনুশোচনায় পরিবর্তে আহ্বান এবং তৃষ্ণা নিবারণই সম্পন্ন মানুষের মৌল চারিত্র্য। ব্যত্যয়ে সন্ন্যাস-জীবনের ছদ্মাবরণে অচরিতার্থ জীবনের হাহাকার এবং ভণ্ডামীরই দেখা মেলে। ‘কালের কলস’ কাব্যের ‘প্রত্যাবর্তন’ কবিতায় কবির সকুণ্ঠ প্রশ্ন—‘আমরা কোথায় যাবো, কতদূর যেতে পারি আর!’ ‘সোনালী কাবিন’ কাব্যের প্রথম কবিতা ‘প্রকৃতি’র শুরু ‘কত দূর এগোলো মানুষ!/ কিন্তু আমি ঘোর লাগা বর্ষণের মাঝে/ আজও উবু হয়ে আছি।’ আবার ‘লোকলোকান্তর’ কাব্যের ‘বিষয়ী দর্পণে আমি’ কবিতায় শেষ পর্যন্ত কবি যখন কোনো এক ‘অলিক মুহূর্তের ক্রোধ/ জয়’ করেন তখন নিজের মধ্যে অনুভব করেন শিশু আর পশুর বিরোধ। সেই শিশু ও পশু রূপান্তরিত হয়ে ফিরে আসে ‘সোনালি কাবিন’-এর ‘প্রকৃতি’ কবিতায়। যান্ত্রিক যুগে বিপুল উন্নতির পরেও কৃষিভিত্তিক আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থাপনা এবং সংস্কৃতির গুরুত্ব ম্লান হয়ে যায় না। এ রকম দৃশ্যের আড়ালে ভিন্ন রকম ব্যবস্থিতির অস্তিত্বও রয়েছে। নিয়মের রাজত্বে শক্তির অবিনশ্বরতার সূত্র অনস্বীকার্য; নিয়মানুবর্তিতা নীতিও। ফলে শেকড়-বিচ্ছিন্ন মানুষ যতই অনুকরণ করতে করতে স্বভাবে ও চিন্তায় নিজেদের বদল করে, শেকড়মুখী মানুষ কখনোই আপনমৃত্তিকার সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ করে না। বরং আত্মমগ্ন হলেই টের পায়—‘ক্রমাগত উঠে এসে মাছ পাখি পশু আর মানুষের ঝাঁক/ আমার চেতনাজুড়ে খুঁটে খায় পরস্পর বিরোধী আহার।’ আধুনিক কবিতার একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ অধ্যাÍ সংকট। আত্মচেতনা ও চরাচরের শব্দ, সুর ও রঙের মিথস্ক্রিয়ায় কবিমন উন্মনা হয়ে ওঠেন। প্রায়-সন্ন্যাস জীবন যাপন করেন কবি কিন্তু সে কেবল অনুভবে, আচরণে সংসারী মানুষ। পরস্পরবিরোধী সত্তা-ই আধুনিককালের কবিকে সময়ে কাছে কখনো-কখনো জটিল, অস্পষ্ট করে তোলে, সে সঙ্গে দুর্বোধ্যও।
মৌলিক শিল্পী বুদ্ধি নয় আবেগে সমর্পিত। চিন্তা ও কর্মের প্রতিমুহূর্তে আপন কর্মের পক্ষে পটভূমি ও ব্যাখ্যা রচনা করা তার স্বতঃসিদ্ধ অভিপ্রায় ও অভ্যাস। তারুণ্যের স্বভাব—যে বিষয়ে ব্যক্তি বিশেষের বিশেষ আসক্তি, ওই বিষয়শি¬ষ্ট চিন্তায় আচ্ছন্ন থাকা। এমনকি ওই বিষয়ে চিন্তার পৌনঃপুনিক প্রকাশেও সে অকুণ্ঠ। ফলে দেখা যায়, চিত্রশিল্পী কেবল ছবি আঁকার মধ্যেই নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখেন না, সঙ্গীতশিল্পী কেবল সঙ্গীত পরিবেশন করেই তৃপ্ত থাকেন না, চিত্রশিল্পী নিজের কর্মের ভাষ্য লিখতে এবং সঙ্গীতশিল্পী নিজেও গান রচনা ও সুরারোপে মনোনিবেশ করেন। কবিও তাঁর চিন্তারও অধিকাংশ অঞ্চল কবিতাত্মক। কবিতার পাশাপাশি কতিার মাহাত্ম্য রচনাও তাঁর আগ্রহের বিষয়। তাই ‘লোকলোকান্তর’ কবিতায় ‘কবিতার আসন্ন বিজয়’-এর স্বপ্ন দেখার পর কবিতাবিমুখদের প্রতি সংক্ষোভ প্রকাশ করে লেখেন, ‘অবুঝের সমীকরণ’। তাতেও কবিতাবিমুখ এবং কবিতা-বিদ্বেষীদের মতান্তর ঘটে না। শেষ পর্যন্ত কবিতার ভাষ্য এবং চারিত্র্য বর্ণনা করে রচিত হলো ‘কবিতা এমন’। আসন্ন বিজয়ের স্বপ্ন দেখার প্রস্তুতি যার রয়েছে, সে কবি কবিতার সামাজিক মূল্য নিশ্চিতির লক্ষ্যে ‘অবুঝের সমীকরণ’ লিখতেও প্রাণিত হন। এ ক্ষেত্রে সামাজিক বাস্তবতার চেয়ে শিল্পই তার কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। সমাজের কাছে কবিতার প্রতি কবি যে পরিমাণ মনোযোগ আশা করেন, তার তিলার্ধও সামাজিক স্তরবিন্যাস এবং বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষের রুচি-স্বাতন্ত্র্য ও স্বাধীনতাকে মূল্য দেন না। এ দিকে থেকে বিচার করলে কবিকে সমাজের সবচেয়ে স্বার্থপর শ্রেণীর প্রতিনিধি বলে ভুল হতে পারে। কবি বলেই—চিন্তার বিপুল অংশজুড়ে কবিতাত্মক বিষয়ের প্রাধান্য।
আল মাহমুদ কয়েকটি প্রসঙ্গ বারবার উলে¬খ করেছেন। এর মধ্যে কবিতা প্রসঙ্গ একটি। কবিতা সম্পর্কিত কবিতাগুলোর মধ্যে ‘শোকের লোবান’, ‘কবিতা এমন’, ‘কবিরা বাঁচাও’, ‘কবির বিষয়’, ‘ত্যাগে দুঃখে’ কবিতাও আবেগ তাড়িত কবির চাঞ্চল্য, অবিরাম আকাঙ্ক্ষার প্রকাশ। তাঁর কবিতায়ই বারবার এসেছে কবিতা-প্রসঙ্গ। এদিকে, চোখের বিষয় চিত্রায়িত হয়েছে, ‘চোখ’, ‘উল্টানো চোখ’, ‘চোখ যখন অতীতাশ্রয়ী হয়’, ‘আমার চোখের তলদেশে’, ‘অতিরিক্ত চোখ দুটি’, ‘বিপাসার চোখ’ কবিতায়। মিথাশ্রয়ী কবিতাগুলোয় মিথের প্রচলিত ধারণা ভেঙে নতুন তাৎপর্যে ব্যঞ্জিত। ‘জুলেখার আগুন’, ‘ইউসুফের উত্তর’, ‘মিথ্যাবাদী রাখাল’ প্রভৃতি কবিতায় মিথিক প্রসঙ্গের মর্ম ও অভিজ্ঞান নতুনভাবে সৃষ্ট। প্রথাগত বিশ্বাসের বিপরীতে নতুন আস্থার অনুষঙ্গ সৃষ্টি করেছেন তিনি। ‘তরঙ্গিত প্রলোভন’, ‘চক্রবর্তী রাজার অট্টহাসি’, ‘মায়াবী পর্দা দুলে ওঠো’, ‘সবুজ ঈমান’, ‘হযরত মোহাম্মদ’, ‘বিশ্বাসের চর’, নীল মসজিদের ইমাম’, ‘কদর রাত্রির প্রার্থনা’, ‘আলো নিরাকার’, ‘অদৃষ্টে প্রবেশ’, ‘হে আমার আরম্ভ ও শেষ’ কবিতায় আল মাহমুদের অধ্যাত্ম চেতনার প্রমাণ মেলে।
আল মাহমুদ কেবল গ্রামীণ পটভূমিকে কবিতায় অঙ্গীভূত করেননি, নগরও চিত্রায়িত করেছেন। তাঁর কবিতায় নগর এসেছে, যান্ত্রিক সভ্যতার রূঢ় রূপ নিয়ে। গ্রামীণ বিষয়-আশয়কে তিনি যেভাবে ‘আন্তরিক রতির দরদ’সহ দেখেছেন, নগরকে সেভাবে দেখেননি। রফিক উল্লাহ খানের মতে—‘আল মাহমুদের কবিতায় নগর জীবনের নেতিবাচক প্রসঙ্গ এসেছে বারবার। কবি উৎকণ্ঠা ও সংশয়ে ব্যক্ত করেছেন শহুরে আবহাওয়ার বিষ-নিঃশ্বাসের কথা, যন্ত্রপিষ্ট মননের করুণ সংলাপ।’ এই কবি একদিকে যেমন ‘তিতাস’, ‘ফেরার সঙ্গী’, লোকালয়’, ‘নৌকায়’, ‘জল দেখলে ভয় লাগে’, ‘গ্রামে’, ‘পথের বর্ণনা’, ‘আসে না আর’, ‘তোমার হাতে’, ‘সোনালি কাবিন’ কবিতায় গ্রামীণ আবহ চিত্রায়িত হয়েছে, তেমনি নগরের যান্ত্রিকতা, দ্রুততা, শঠতা, ধূর্তামি ও বিমানবিকতাও এঁকেছেন ‘হে আচ্ছন্ন নগরী’, ‘বোধের উৎস কই, কোন দিকে’, ‘বুদ্ধদেব বসুর সঙ্গে সাক্ষাৎকার,’ ‘কবি ও কালো বিড়ালিনী’, ‘ফররুখের কবরে কালো শেয়াল’, ‘ক্ষমতা যখন কাঁদে’, ‘বন্দুক থেকে সরিয়ে হƒদয়’, ‘আমার সমস্ত গন্তব্যে,’ ‘গতির নিয়ম ভেঙ্গে’ কবিতায়।
আল মাহমুদ জীবনকে দেখেছেন কবিতার ভেতর, কবিতাকে করে তুলেছেন জীবনের ভাষ্য। প্রতিদিনের উচ্চারিত শব্দসমবায় থেকে সংগ্রহ করেছেন শব্দ। ফলে তার জটিল চিন্তাও হয়ে উঠেছে সহজবোধ্য। তার পক্ষপাত শেকড়ের প্রতি, যে শেকড় গ্রামের কৃষিভিত্তিক সমাজব্যবস্থায় গ্রথিত। তার এ গ্রামমুগ্ধতার প্রকাশ ঘটেছে ‘ফেরার পিপাসা’, ‘প্রত্যাবর্তন’, ‘প্রকৃতি’, ‘প্রত্যাবর্তনের লজ্জা’, ‘খড়ের গম্ভুজ’, ‘তোমার হাতে’ প্রভৃতি কবিতায়। কবি গ্রাম বলতে জানেন, ‘ওই তো সামনে নদী, ধানক্ষেত, পেছনে পাহারা’ (প্রত্যাবর্তন), বিপরীতে নগরের দৃশ্য তাঁর কাছে ‘নোংরা পালক ফেলে পৌরভাগাড়ে ওড়ে নগর-শকুন’। কেবল মন ও মননের পরিচর্চাই কবির লক্ষ্য নয়। সৎ কবির লক্ষ্য অনেক; দায়ও। তার মধ্যে সামাজিক দায় প্রত্যক্ষ। সমাজস্থ মানুষের আনন্দ-বেদনা, হাসি-কান্না, সুখ-দুঃখ, জ্বরা-মরার শৈল্পিক রূপায়ণ তাঁর প্রধান দায় ও প্রেরণা। ব্যতিক্রমে প্রতিভার বিকাশ শতভাগ সম্ভব হয়তো; কিন্তু সে প্রতিভার সপ্রকাশে মানবজাতির কোনো স্বার্থ নিহিত না থাকায় তা ফানুসের মতো উবে যায়। সমকালের কোনো কোনো আত্মতৃপ্তির মুহূর্ত ও অনুষঙ্গও কালের বিবর্তনে, রুচিবোধের পরিবর্তনে গ¬ানিতে অবসিত হয়। আল মাহমুদ কাল সচেতন। সৈয়দ আলী আহসানের মতে—‘পুরাতন এবং অতীতকে নববিগ্রহ দান করবার চেষ্টায় এবং উপস্থিত সত্তায় তাকে অবিরত সচল রাখবার প্রয়াসে আল মাহমুদের একটি নতুন কবি-স্বভাব জন্মলাভ করেছে, যার অভিধারণ এক মুহূর্তে অতীতে পরক্ষণেই বর্তমানে।’ আল মাহমুদ সামাজিক অনুষঙ্গগুলোকে কবিতায় অঙ্গীভূত করেছেন সমাজকর্মী ও সমাজচিন্তকের যুগ্ম-অভিজ্ঞানে। কবি সমাজকে আলোর সন্ধান দেন, দেন লক্ষ্যে পৌঁছানোর মন্ত্রও। কবির প্রদর্শিত পথে সমাজ তাৎক্ষণিক পরিচালিত না হলেও কবির কোনো ক্ষোভ থাকে না। কারণ, কবিকে সমাজ তাৎক্ষণিক বুঝে উঠতে পারে না সব সময়। সামাজিক বিকারকে আল মাহমুদ কবিতার বিষয় করে তুলেছেন সহজে। কবির সামাজিক দায়িত্ব পালনে সবার সঙ্গে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণের যুক্তি অবান্তর। কবি দায় পালন করেন সাধারণ মানুষের অলক্ষ্যে ও দৃশ্যের অন্তরালে। তবু কবিকে দেখা যায়, নৈতিক অবক্ষয়, সামাজিক বিচ্যুতি, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, সন্ত্রাসবাদ, সাম্রাজ্যবাদ ও পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে। এসব দ্রোহ তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়াজাত হলেও, তার ফলাফল সুদূরপ্রসারী ও সংক্রামক সমাজ থেকে সমাজে। তরুণ-চিত্তের অস্থিরতা এবং অপেক্ষার কষ্ট তাকে করে তোলে অসহিষ্ণু। মানুষের প্রত্যাশা ও অপ্রাপ্তির মিথস্ক্রিয়ায় লিখিত ‘কালের কলস’ কাব্যের ‘ধৈর্য’; প্রত্যাশা-প্রাপ্তি ও আশাভঙ্গের যুগ্ম প্রকাশ ঘটেছে, ‘আমার সমস্ত গন্তব্যে’ কবিতায়। মানবজাতির স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্য—মাঝে-মধ্যে সব অর্গল খুলে নিজেকে অন্যের সামনে মেলে ধরতে চাওয়া। সৃজনশীল মানুষের আকাঙ্ক্ষা প্রকাশের ধরনে সলাজ ভাব স্পষ্ট। নিসর্গ চেতনা ও মানব প্রজাপতির হার্দিক টানাপড়েন, যৌন চেতনা, ক্ষুধা ও ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবোধ আল মাহমুদের কবিতার অবিচ্ছেদ্য অনুষঙ্গ। আবহমান বাংলার কৃষিভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থা, প্রথাগত ধারণাকে গভীরভাবে আত্মস্থ করে আধুনিক জীবনের, যুগযন্ত্রণার অভিজ্ঞতাকে নির্মম বাস্তবতার আলোকে স্বীকার করেছেন।
ইংরেজ কবি ও নাট্যকার ডব্লিউ এইচ অডেনের মতে কবিতার প্রধান গুণ, Memorable speech. আল মাহমুদের কবিতার প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলো পর্যালোচনা করলে এ উক্তির তাৎপর্য উপলব্ধি করা যায়। যেমন—
১. আমার চেতনা যেন শাদা এক সত্যিকারের পাখি/ বসে আছি সবুজ অরণ্যে এক চন্দনের পাখি। (লোক-লোকান্তর)
২. ও পাড়ার সুন্দরী রোজে না/ সারা অঙ্গে ঢেউ তার, তবু মেয়ে/ কবিতা বোঝে না! ( অবুঝের সমীকরণ)
৩. আমার সমস্ত গন্তব্যে একটি একটি তালা ঝুলছে। (আমার সমস্ত গন্তব্যে)
৪. দ্যাখো, জয়নুলের ছবির মত ঘরবাড়ি, নারী/ উঠোনে ঝাড়ছে ধান, ধানের ধুলোয় ম্লান শাড়ি। (প্রত্যাবর্তন)
৫. কবিতা তো মক্তবের মেয়ে চুল খোলা আয়েশা আক্তার। (কবিতা এমন)
৬. নোংরা পালক ফেলে পৌর ভাগাড়ে ওড়ে নগর শকুন। (খড়ের গম্ভুজ)
৭. আমাদের ধর্ম হোক ফসলের সুষম বণ্টন। (সোনালি কাবিন-১০)
৮. আমাদের কলাকেন্দ্র, আমাদের সর্ব কারুকাজে/ অস্তিবাদী জিরাফেরা বাড়িয়েছে ব্যক্তিগত গলা। (সোনালি কাবিন-১১)
৯. হৃদয়ের ধর্ম নিয়ে কোনো কবি করে না কসুর। (সোনালি কাবিন -১৪)
১০. আমার কবিতা শুধু অই চোখের কসম। (কালো চোখের কাসিদা)
কাব্য নিরীক্ষার ক্ষেত্রে কবির দীর্ঘদিনের অভ্যাস, অর্জিত জ্ঞান, অধীত মনীষা, আত্মোপলব্ধিজাত অন্তর্নিহিত তাৎপর্যময় চিত্রকল্প, উপমা, উৎপ্রেক্ষা ইতিবাচক ভূমিকা রাখে। কালই শেষ পর্যন্ত কবিতার শ্রেষ্ঠ পাঠক ও বিচারক। বাংলা কবিতার ইতিহাসে ‘সোনালী কাবিন’ একাধারে বুর্জোয়া, ধনতন্ত্র ও পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। ‘সোনালী কাবিন’ নিখিল নাস্তির দলিল নয়; নয় প্রবল বিশ্বাসের খতিয়ানও। আল মাহমুদ কবি—সমাজ ও শিল্পে সমন্বয়বাদী; বলার ভঙ্গি এবং অন্তর্জগত চেতনায় ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যে প্রোজ্জ্বল। নিজের কণ্ঠস্বাতন্ত্র্য স্পষ্ট করার লক্ষ্যে একই বিষয়ে যেমন বারবার ভিন্ন ভিন্ন কবিতায় উচ্চারণ করেছেন, তেমনি পরম্পরা রক্ষা করে রচনা করেছেন একের পর এক কবিতা। ‘বৃষ্টির অভাবে’ কবিতার ‘দুঃখের চৌকাঠ ভেঙে যদি আসো, দাঁড়াবে কীভাবে’ কিংবা একই কবিতার শেষের দু চরণ ‘তুমি এসো, কোমরে পেঁচিয়ে নীল শাড়ি/ দুঃখের ঘরকে করো শোকোত্তীর্ণ প্রাণের বাগান’, কিংবা ‘শোকের লোবান’ কবিতার ‘অক্ষরে বিম্বিত হতে চাও যদি, খুলে ধরো সমস্ত গোপন’ পঙ্ক্তিগুলোর চরম পরিণতির সাক্ষাৎ পাই ‘সোনালী কাবিন’ সনেটগুচ্ছের ‘বধূ বরণের নামে দাঁড়িয়েছে মহামাতৃকুল/ গাঙের ঢেউয়ের মত বল কন্যা কবুল কবুল’ কিংবা ‘হাত বেয়ে উঠে এসো হে পানোখী, পাটিতে আমার/ এবার গুটাও ফণা কালো লেখা লিখো না হƒদয়ে,/ প্রবল ছোবলে তুমি যতটুকু ঢালো অন্ধকার/ তারও চেয়ে নীল আমি অহরহ দংশনের ভয়ে।’ কিংবা ‘চরের মাটির মতো খুলে দাও শরীরের ভাঁজ/ উগোল মাছের মাংস তৃপ্ত হোক তোমার কাদায়’-এর মতো পঙ্ক্তিগুচ্ছে।
মিথ এবং উপকথার প্রতি কবির অমোঘ আকর্ষণ লক্ষণীয়। পুরাণের বিভিন্ন চরিত্র এবং ঘটনা, ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ কালখ- তাঁর মন ও মননে গভীর রেখাপাত করেছে; নয়তো পুরুষ তার নারীকে প্রলুব্ধ করার জন্য বিভিন্ন চরিত্রের উদাহরণ টেনে আনবেন কেন! তার কাছে শাস্ত্রীয় ধর্মের চেয়ে মানবধর্ম বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। মানুষের ধর্ম মানেই ফসলের সুষম বণ্টন হবে—এই প্রত্যয় নিয়ে কবি তাঁর দয়িতাকে আলিঙ্গনের আহ্বান করেন। ‘সোনালী কাবিন’ সনেটগুচ্ছে শব্দের যুক্তিগ্রাহ্য ও নান্দনিক চিত্ররূপ আঁকতে গিয়ে পুরাণ ও মিথকে আশ্রয় করেছেন। এই প্রবণতা তাঁকে বিশিষ্ট এবং বিশ্লিষ্ট করেছে তাঁর পূর্ববর্তী এবং সমসাময়িক অন্য কবিদের কাব্যভাষা থেকে। তাঁর কবিতায় কেবল গ্রাম নয়, নগরও সমান গুরুত্বে অঙ্গীভূত। এ ক্ষেত্রে নাগরিক জীবনের গ্লানি এবং শেকড়ের প্রতি আকর্ষণ—এ দুয়ের টানাপড়েনে আল মাহমুদ সমন্বয়বাদী নন; ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী।