একবিংশ শতাব্দীর খসে পড়া চাকা তবু গড়াচ্ছে, যেনো হাওয়ার চাপে, কারো কারো দৃষ্টি তবু রায় দেয় গড়াচ্ছে কোথায়, মুখ থুবড়ে পড়েছে পুরাধুনিক ভাগাড়ে।
সুদূর য়ূরোপ থেকে উড়ে এসে মিস্টার এ্যাসেল হ্যারিস তার অবসর যাপনকালের দীর্ঘ সময় বাংলাদেশের উত্তরে গ্রামীণ জনপদগুলোতে দুটি চোখ আর একটি দৃষ্টি নিয়ে ঘোরে। বাংলার দক্ষিণের সন্তান মিস্টার আব্দুল্লা কালাম তার পথ নির্দেশ করে চলে। তখন তাপ ছড়ানো দুপুরের রোদে সুতোয় বোনা ছাতা মাথায় জনমানব আর ছায়াহীন মেঠো পথ হেঁটে তারা লোকালয়ের কাছে ছায়া দেখে বসে। মিস্টার হ্যারিস তার গাইডের কাছ থেকে নোট খাতা আর কলম চেয়ে নিয়ে মগ্ন হতেই লোকালয় থেকে বিলাপের শব্দ কানে এলে মিস্টার হ্যারিস সজাগ করে কান পেতে রাখে। গাইড একটু হেঁটে এসে খোঁজ এনে দেয় অসুস্থ এক রোগির মৃত্যু ঘটেছে। মিস্টার হ্যারিস পুনরায় কলম হাতে নোট খাতায় মগ্ন হয়।
ফুলপরি তখন মধুর স্বপ্নে বাতাসে পাখা ঝাপটায় আর ঠোঁটের কোনায় শুকনো কটকটে লালা চাটতে চাটতে এপাশ ওপাশ গড়াগড়ি যায়। সূর্য উঠে আসমানের দ্বিতীয় তলায় চড়লে মিসেস সফুরা বাসি কাম কাজ শেষে ভাতের পানি চড়িয়ে ধোঁয়ায় চোখে আঁচল চাপা দিয়ে খোকারে ডাক পাড়ে, ফুলি কি এ্যাকনো নিন পারোচে? বেলা উঠি কোন আসমানত গিয়া ঠ্যাকোচে আর ওটি কামলারা মাঠোত ধান কাটবার লাগিচে। কলি আর মলিরে সাত সকালে দেখনু ব্যাগ হাতোত কর্যা লিয়্যা শীষ কুড়াবার গ্যাচে, হারামজাদী ছুঁড়ির নিন ভাঙ্গোচে না, আজগ্যা ওরে ভাত খিলামুনে পিষ্যা পিষ্যা। খোকা সূর্যের সাথে সাথে জেগে জানালার কবাট তুলে ভূগোল বইয়ের ছেঁড়া পাতা দেখে দেখে বাংলাদেশের মানচিত্র আঁকার প্র্যাকটিস করে। তখন মধুর স্বপ্নে হঠাৎ মহামারি অধ্যায় যোগ হলে ফুলপরি হুড়মুড় করে ঘুম থেকে জেগে এক হাতে ঠোঁটের কোনায় কটকটে লালা ঘষতে ঘষতে অন্য হাতে কচি বুকের ওপরে ওড়না তোলে। খোকা কয় এ্যাকুন উটলু ওটি মায়ে মহা ক্ষেপা ক্ষ্যাপোচে তুই শিগগিরি শীষ কুড়াবার যা, হামি কচ্চি ইশকুলত যামো, এ্যাকন এটি বস্যা বস্যা বাংলাদেশ বানাচ্চি মাস্টার মশাই কচে। ফুলপরি ধুকপুকানো হার্টবিট নিয়ে উঠে চোরা পথে মিস্টার আবুলের বাপের কলপাড়ে যায় কিন্তু সেখানেই মিসেস সফুরার চোখের সাথে ঠোকাঠুকি লেগে গেলে ফুলপরির হার্টবিট খাঁচায় পোরা আনকোরা পাখির লাহান আছড়ায় বিছড়ায়। মিসেস সফুরার দুহাত বেজায় নিশপিশ করে কিন্তু হাত না তুলে চোখে আগুন ঝরায়, কয় তোক আজগ্যা ভাত খিলামুনে মাগী, জমিদারের বউকেরে লাকান দশটা পয্যন্ত নিন পাড়িস, এতো ডাকা ডাকোচি ওরি কোনো হুশ নাই, কলি আর মলির পুঁটকি ধুইয়্যা পানি খিলামুনে আজগ্যা হারামজাদী ছুঁড়ি। তবু পুষ্টিহীন চিটচিটে চামড়ায় চড় থাপ্পরের জ্বলুনি সইতে হয় নাই শুধু রোজকার মতো থুথু ছিটিয়ে খিস্তি ছেড়েছে মাত্র। কলপাড় ফাঁকা হলে ফুলপরি কচলে কচলে হাত মুখ ধুয়ে ঘরে এসে মাচানের উপরে বাসন কোসন হাতড়ে দু’মুঠো মুড়ি কোচে ভরে ব্যাগ হাতে মাঠের দিকে হাঁটা দেয় তখন রোদ চড়েছে বটে, হুট করে ছায়া থেকে বের হয়ে এলে চোখের ঘিলু টাটায়। মাঠে যেনো রোদ নয় কুয়াশার মতো আগুনের বিন্দু ঝরে। ছোটো মাঠ পেরিয়ে সুপারি বাগানের সার ধরে সরু সাদা পথের ধারেই ছোটো একটা জঙ্গলা আর জঙ্গলা পেরিয়ে বড়ো মাঠের আগে মিস্টার মতলব বুড়োর খুপড়ি থেকে কাৎরানি শোনা যায়। ফুলপরি মুড়ি চিবুতে চিবুতে খোলা দরজায় উঁকি দিলে বুড়ো কাৎরানি থামিয়ে ধরা গলায় কয় আদুরি ক্যাবল আলু, ও আদুরি, হামার পরান ড্যাকা কয় তুই আসপু। তর দামন কি এ্যালো, হামার জান্ডা এ্যাকুন যানি যায়। ফুলপরি ঘরে উঠে বুড়োর সিথানে দাঁড়িয়ে কয় হামি আদুরি লয় মতি দাদা, হামি গফুরের বেটি ফুলি। মিস্টার মতলব বুড়ো ফ্যালফ্যাল করে লাল চোখে ফুলপরির দিকে চেয়ে থাকলে বাইরে মিসেস মতলবের গলা শোনা যায়। ফুলপরি বাইরে এসে জিগায় দাদাক না হসপিটালত লিয়া গেছলু কি হচে কও না দাদি। মিসেস মতলব মাটির ওপরে পাছা গেড়ে বসে কয় ট্যাকা দিয়া পাননু না বুন খ্যাদা দিলো, তোর দাদা হাসপাতালের মেঝেত শুয়্যা শুয়্যা এই যে কাৎরায় নার্সরা খালি শরীলের চামড়া ফুটা কর্যা সেলাইন ঢুকায়, ফিরি ওসুদ পত্তর আর ভিটামিন দ্যায়। ডাক্তর আস্যা আস্যা দামি দামি ওসুদ লেক্যা দ্যায় কিন্তুক হামাকেরে ট্যাকা নাই। তোর দাদার এই যে কাতরানি ডাক্তারেকেরে একটু যদি দয়া হয়। শ্যাষে কয় মরবার আসপু তে হাসপাতালত ক্যা, বাড়িত বস্যা মর।
ফুলপরি বড়ো মাঠে নেমে দেখে উত্তরের মাঠে অনেক কামলারা মাথায় গামছা বেঁধে ধান কাটে আটি বাঁধে আর কয়েকজন বালক বালিকারা খসে পড়া শীষ কুড়ায়। ওদের ব্যাগ কেমন ডিমভরা ট্যাঙরা মাছের পেটের মতোন ফোলানো ফাঁপানো দেখায়। তখন ফুলপরি হাঁটে না যেনো দৌঁড়ায় আর ওদের কাছে গিয়ে দেখে কলি আর মলির ব্যাগে জায়গা নাই। ওরা কয় তুই ক্যাবল আলু ফুলি আর হামরা বাড়িত যাচ্চি, এ্যাকন ওইদ মাতাত যানি আগুন ঢালিচ্চে। ফুলপরি কয় তোরা যা হামি কয়ডা শীষ কুড়া লিয়া যাই বলে সে শীষ কুড়াতে লাগে।
দক্ষিণের মাঠের মতো উত্তরের মাঠেও ধান কাটা শেষ হয়ে আসতে শুরু করেছে। মাঠের পরে মাঠ কেমন একা হয়ে যেতে লেগেছে। ফসল নাই আর তাই এই উত্তরের মাঠ ছাড়া কোথাও কোনো মানুষজন নাই। একা মাঠ রোদে পুড়ে খাঁক হয়। ওদিকে উত্তরের মাঠে কামলারা শেষ ফসল ঘরে তোলার জোর তাড়া লাগায়। কে জানে জ্যৈষ্ঠ মাসের মেঘ কখন কোন আকাশের ফাটল দিয়ে দুনিয়ার ওপরে এসে তোলপাড় জুড়ে দেয় যেনো মৌসুমি দানবের তা-ব, ঘর বাড়ি ভেঙ্গে মাঠের পরে মাঠ সোনার ফসল জল-কাদায় লুটিয়ে কইলজার ভেতরে সান্দায়। কিন্তু এ যেনো ঝড়-বৃষ্টির আকালের বছর। বোশেখ গেছে গৃহপালিত বাঘের মতোন, সকাল বিকাল হালুম আছে বটে তবু সে হুংকারে কোনো শিকারের স্বর নাই কিন্তু তাতে বিশ্বাস কি, সে হুংকারেই মানুষ কাঁপতে কাঁপতে গর্তে সেঁধোয়।
ফুলপরি শীষ কুড়াতে কুড়াতে আর কামলারা ধান কাটতে কাটতে দেখে একটু একটু ছায়া ঘনায়। দ্যাখ বারে আসিচ্চে আসিচ্চে, আজগ্যার ম্যাঘের ভাবগতিক ক্যাঙ্কা ক্যাঙ্ক্যা মন কয়। ফুলপরির ব্যাগ তখন আধেক ভরেছে আর মিসেস সফুরার চামড়া ওঠা কালো লিকলিকে হাতে থাপ্পরের কথা মনে হলে বাকি আধেক পূর্ণতার দাবি করে কিন্তু মেঘ দেখে মনের ভেতরে কেমন ডর লাগে। হাজী বাড়ির বাঁধা কামলা মিস্টার গয়সা কয় যা ছুড়ি ফাঁকা মাঠোত ডাক পর্যা মরবু যা দৌড়া বাড়িত যা। ফুলপরি ভয়ে ভয়ে দু’পা আগায় তারপর দেখে মাঠের ওপারে চান্দট গ্রামের মাথার ওপরে ধুলার কু-লী পাকাচ্ছে। আসিচ্চে আসিচ্চে, বলে এবার লম্বা পায়ে দৌড় লাগায়। দক্ষিণের মাঠের শেষে, পাক খেয়ে খেয়ে বেগে বয়ে আসা বাতাস গতিপথ থেকে ছিটকে দেয়। হঠাৎ তখন বাতাসে শত খন্ড একটি চিৎকার ফুলপরির কানে এসে পিছলে গেলে তারপর মুহূর্ত কয়েক দাঁড়িয়ে দেখে স্যালো মেশিনের দোচালা খড়ের ঘর থরথর কাঁপে। কে ওটি চিল্লায় বারে? তখন আলো আন্ধারে দেখা যায় পাড়াতো ভাই মিস্টার মকবুল হোসেন তারে ডাকে। এটি আয় ফুলি ঝড়ের মইদ্যে বাড়ি যাবার পারবু না পথত পর্যা মরবু। ফুলি লম্বা পায়ে দৌড় লাগিয়ে স্যালো মেশিনের থরথরানো ঘরে মিস্টার মকবুল হোসেনের গায়ের ওপরে আছাড় খায়। মিস্টার মকবুল হোসেন কয় ক্যাঙ্কা ঝড় উটলো বারে ফুলি, আল্লাক ক য্যান থাম্যা যায়। ফুলপরি মিস্টার মকবুল হোসেনের হাত ধরে গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থরথর কাঁপলে মিস্টার মকবুল হোসেন টের পায় ভয়ে কাজি পেয়ারার মতো ফুলপরির কচি দুটো স্তন তার বুকের তলে কেমন আকুলি বিকুলি আশ্রয় চায়। হামার ক্যাঙ্কা ডর করে মকু ভাই ঘর বান কখুন উড়্যা যায়। মিস্টার মকবুল হোসেন এবার বুক বরাবর ফুলপরিকে জাপটে ধরে, ভয় পাচ্চু ক্যা হামি তো আচি দেখবু কিচ্চু হবে না কিন্তুক ক তো তুই, তোর বুক দুইডা ক্যাঙ্কা ঝটপটায় রে ফুলি জবো করা কইতরের বাচ্চার লাকান। কিন্তুক ক তো ফুলি, এ্যাকন হামার বুকের মদ্যেও ক্যাঙ্কা করে বান হামি য্যানো তোক লিয়্যা এটি মরমো, হামার মুখোত চাইয়া দ্যাখ। কিন্তু ফুলপরি তখন চোখ বুজে দ্বিগুন থরথর করে কাঁপে। মকবুল হোসেন ফুলপরির চিবুক উঁচিয়ে দুঠোঁট মুখের ভেতরে পুরে পাইনাপল লজেন্সের মতো চুষতে লাগে। বাহিরে ঝড়ের গতিবেগ বাড়ে আর আকাশ ভেঙ্গে বৃষ্টি নামে।
এদিকে কোনো পথ নাই সামনে যাবার, কেঁপে চলেছে বিভ্রান্ত পে-ুলাম, বৃত্তের ভেতরে আটকা পড়ে তড়পাচ্ছে বোঁটা ছেঁড়া কলিজার টুকরা।
নোট লেখা শেষ করে মিস্টার হ্যারিস ব্যাগে উপস্থিত শুকনা খাবার তয়ের করতে বলে ক্যামেরার বাটন টিপে তোলা ছবি দেখতে থাকলে ডিসপ্লেতে শাপলা ফোটা একটি ডোবার ছবি ভাসে, যেখানে কয়েকটি নেংটা বালক গায়ে মুখে আর বাড়ন্ত শিশ্নে কাদা মেখে তুমুল উৎসব করে। তার ঠোঁটের কোনায় হাসির বাঁকা রেখা ফুটে উঠতেই ডিসপ্লেতে এক বৃদ্ধের ক্ষুধার্ত রোদে পোড়া কংকালসার মুখ ভাসে। হঠাৎ ক্যামেরাটি মাটির ওপরে রেখে দিয়ে শূণ্য চোখে রোদ ধাঁধানো মাঠের দিকে চেয়ে থাকে।
ছোটো একটা হাটের পরেই দীর্ঘ জনপদ যেখানে সারি সারি একচালা দোচালা টিনের ঘর। বাইরের আঙ্গীনায় বয়সিদের তেমন চোখে না পড়লেও দেখা যায় বালক বালিকা আর কিশোর কিশোরীদের ভীড়, যেখানে খেলা ধুলা আর গালগল্পের যেনো হাট বসেছে। মিস্টার হ্যারিস অভ্যস্ত চোখেও চমকায়। তারপর ক্যামেরাটা বের করে হাঁটতে হাঁটতে ছবি তুলতে লাগলে বালক বালিকারা প্রথমে পথ করে দাঁড়ায় তারপর আজিব চিড়িয়া দেখার মতো দীর্ঘ পথ পিছু নেয়। সামনে গিয়ে বসতি একটু একটু ফাঁকা হয়ে আসে আর পথও কেমন জটিল হয়ে এলে দেখে একটি বাড়ির আঙ্গিনায় তারা জোড়া নারিকেল গাছের তলায় দাঁড়িয়ে আছে। পাশেই সে বাড়ির রান্না ঘরে অল্প বয়সী বউটা চুলায় ফুঁক দিতে দিতে চোখের পানি নাকের পানি মুছতে থাকলে মিস্টার হ্যারিস ক্যামেরা তাক করে দুটো ক্লিক করে তখন বউটা ভূত দেখার মতোন চমকে উঠে সামনে তাকায়। মিস্টার আব্দুল্লা কালাম সামনে এসে কয় উনি বিদেশ থেকে এসেছেন এই জনপদ দেখতে, আচ্ছা বলুন তো এদিকে যাবার পথ কোন দিকে? বউটা অদ্ভুত রকমের একটা দিক নির্দেশ করলে তারা বিভ্রান্ত বোধ করে চারিদিকে তাকাতে থাকলে ওদিকের ঘর থেকে ভদ্র মতোন একজন বয়সি নেমে এসে শান্ত তবু কেমন বিষণœ গলায় কয় এদিকে কোনো পথ নাই।
ঝড় থেমে গেলে মনে হয় পৃথিবীটা হঠাৎ হোঁচট খেয়ে থেমে গেছে। এতো শান্ত যেনো পৃথিবীটা এক বিজন গোরস্থান, আত্মারা পরমাত্মার সাথে সংলাপ ভুলে গেছে। গ্রামের ওদিক থেকে কোনো কোলাহল কানে পশে না আর উত্তর কিংবা দক্ষিনের মাঠে কোনো প্রাণের ছায়া পড়ে না। উত্তরের মাঠে শুধু আটি আটি ধান জল কাদায় লুটোপুটি খায়। স্যালো মেশিনের খড়ের ঘরটা এক দিকে কাত হয়ে পড়ে, তার তলায় ফুলপরি আর মকবুল হোসেন ঝিম মেরে বসে থাকে। তাদের মনে তখনো শন শন ঝড়ো বাতাস পাক দিয়ে চলে। প্রথমে উঠে আসে ফুলপরি, সে দুহাতে হাঁটুমুড়ে বসে তার ভেতরে ডোবানো মুখ একটু তুলে কাঁপা গলায় কয় মকু ভাই হামার তো ভয় লাগোচে। ঝড়ের ভেতরে তাদের দৈহিক ঘটনার পরে দুজনেই নির্বাক হয়ে বসে থাকে আকস্মিক বিষণœতায়। সেখান থেকে উঠে আসার অবলম্বন খুঁজতে গিয়ে ফুলপরি কথা কয় আর মিস্টার মকবুল হোসেনও যেনো ভেতরের শাঁ শাঁ ঝড়ো বাতাস থেকে উদ্ধার পায়। তারপর ফুলপরির আরো কাছে ঘেঁষে এসে পিঠের ওপরে আদুরে হাত রেখে কয় হামি তো আচি ফুলি ভয় পাচ্চু ক্যা? ফুলপরি তখন ফুঁপিয়ে কেন্দে উঠে মকবুল হোসনকে জাপটে ধরে কয় মকু ভাই তুই হামার পুরুষ হবু মাথাত হাত দিয়া ক? মকবুল হোসেন ফুলপরির মাথায় হাত রেখে কয় হামিই তোর পুরুষ রে ফুলি হামিই তোর পুরুষ হমো এ্যাকন বাচ্চাকেরে লাকান এ্যাঙ্কা কান্দিস নে কচ্চি, এটি দ্যাখ হামার দুই ব্যাগ শীষ তোক এ্যাক ব্যাগ দিচ্চি। শুনবু হামি এ্যাক ব্যাগ কুড়াচি আর এ্যাক ব্যাগ আতরের ভুয়েত থ্যাকা ছিঁড়্যা ব্যাগত ভর্যাচি। শালা আতর হামাক এ্যাকদিন চোর কয়্যা গাল পাড়িচে হামিও তার বদলা লিনু।
ঝড় পরবর্তী শান্ত পৃথিবী নড়তে চড়তে লেগেছে তখন। দেখা যায় একটা দুটো পাখি এদিক ওদিক চঞ্চল ওড়াউড়ি করে। উত্তরের মাঠে কামলারা ধান উদ্ধারের কাজে ফিরে আসতে লাগে তখন ফুলপরি আর মকবুল দুজন দুপথে বাড়ির পথ ধরে।
খোকার কি এক বাতিক রোগে ধরেছে সারাদিন বই নিয়ে বসা নাই ওদিকে পাড়ার ছেলেদের সাথেও মেশে না খেলে না। সময় অসময় নাই ষোলো টাকায় কেনা সাধের রঙপেন্সিলের বক্স নিয়ে বসে বসে ফুল ফল ঘর দোর আর মানুষ কুকুরের ছবি আঁকে। আজকাল পড়েছে বাংলাদেশ নিয়ে, রাত দিন নাই ভূগোল বই দেখে দেখে কর্ণফুলির সাদা পেপারে বাংলাদেশের শরীর আঁকে। তখন আলোহীন ঘরে সন্ধ্যার আবছায়ায় জানালার মুখোমুখি বসে বাংলাদেশের শরীরে কলম দিয়ে মার্ক করে খোকা জেলা ভিত্তিক জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার নির্ণয় করে। ঘরে আলো দিতে এসে ফুলপরি দেখে কয় বাংলাদ্যাশের মদ্দে অঙ্কা কালো কালো অং ক্যাঙ্কা ভালো দেখায় না তুই লীল আর গোলাপের লাকান অং কর খোকা। শুনে খোকা জ্ঞানির মতো হাসে আর কয় হামি অং করিচ্চি লয় বুবু কালো কালো এগুলান মানুষ, তখন হতবাক ফুলপরির বুদ্ধি মাথার কোটরের ভেতরে বেকায়দায় পড়ে যায়। খোকার চোখ মুখ তখন হঠাৎ আলো পায় আর ফুলপরিকে ডেকে কয় বুবু শুনবু এ্যাকটা গপ্প। আজগ্যা হামাকেরে ইস্কুলত ভুগোল স্যারের ক্লাসত বাংলাদ্যাশের মানচিত্র অ্যাঁক্যা জনসংখ্যার ঘনত্ব দাগাচ্চিলাম, তখন এ্যাকজন বিলাতি মানুষ ফটো তোলার যন্ত্রর লিয়্যা আস্যা হামাকেরে সাতে অনেকগুলান ফটো তুলিচে। সেগুলান ওরকেরে দ্যাশোত লিয়্যা বান কি করবে। বিলাতিডা ক্যাঙ্কা বুড়া হয়্যা গেচে তাই নরম সাদা চামড়া বাসি গমের উটির লাকান মনে হয়। জানিস বুবু, হামাকেরে স্যার কলো বিলাতিরা তামান নাকি বড়োলোক, বাকসো বাকসো ট্যাকা, বালাখানা। ফুলপরি তখন আলস্যে হাই তোলে আর কয় আজগ্যা হামি দুই ব্যাগ শীষ কুড়্যাচি কিন্তুক কালক্যা কোন মাটোত যামো খোকা, উত্তরের মাটোত এ্যাকন আর ধান নাই। খোকার কানে সেসব পশে না, কর্ণফুলির সাদা কাগজে সে বাংলাদেশের মানচিত্র আঁকে আর স্যারের নতুন নির্দেশে তাতে কলম দিয়ে মার্ক করে জেলা ভিত্তিক দারিদ্রতার হার নির্ণয় করে।
স্বপ্নের ভেতরে হানা দেয় মৃত্যু অথচ তুমুল জাগিয়ে তোলে, বলো না ঈশ্বরের মগজ অধিকারে নিয়েছে মহাকালের ঘুণ, হরদম কাটাকুটি চলছে আর তিরতিরিয়ে কেঁপে চলেছে বোধ।
মিস্টার এ্যাসেল হ্যারিস তার অবসর যাপনের শেষ দিনগুলোর একদিন উত্তরের এক শহুরে আবাসে তখন সন্ধ্যায় তার ভ্রমণে তোলা ছবিগুলো নিয়ে বসে। ততোদিনে তার রক্তে বিষাদ জমেছে সুগারের মতো। এখন বিকেলের কোমল রোদে কিশোরীর হাসিমুখ প্রাণের মতো জেগে উঠলেও সে অবিশ্বাস করে। যেনো দীর্ঘ এ ভ্রমণে কোনো প্রাপ্তি নাই বিষাদ ছাড়া। ওদিকে ডিসপ্লেতে একের পর এক ছবি আসে। নতুন জন্মানো শিশুর শব যাত্রা। বৃদ্ধার আকাশ মুখো অপাঠ্য চোখ। একের পর এক ছবি আসে।
সেদিন রাত গভীর হলে যখন শহুরে ব্যস্ততায় নির্জনতা নামে তখন মিস্টার হ্যারিস জাগরণের ভেতরেই জেগে উঠে যেনো চিতার আয়োজন করে। প্রথমে ক্যামেরাটা আছড়ে ভাঙ্গে তারপর দীর্ঘ ভ্রমণকালে লেখা সমৃদ্ধ নোটখানায় আগুন ধরিয়ে যেনো মন্ত্রপাঠ করে, প্রাপ্তি নাই প্রাপ্তি নাই।
খোকার মাথায় হঠাৎ ভূত চাপে। ছুটির দিনে সারা সকাল সে ডোবার ধার থেকে নরম মাটি তুলে এনে ছেনে ছেনে কাদা বানায়। ঘরের পেছনে নিরালায় ইঞ্চি ইঞ্চি কাদা বসিয়ে বাংলাদেশের দেহ বানায়। পানি ফুরিয়ে গেলে ভাঙ্গা বদনাখানা নিয়ে আবারো সে ডোবার ধারে যায় আর এসে দেখে বাংলাদেশের উপরে ঠ্যাং তুলে কুকুর একটা ছিরছিরিয়ে মুততে লেগেছে। খোকা কুকুর তাড়িয়ে এবার পানি ঢেলে বাংলাদেশ পবিত্র করার কাজে লাগে। মিসেস সফুরা ডাক পাড়ে আর কয় খোকা ওটি কি করিচ্চু ঘরোত আয়। খোকা বিড়বিড় করে কয় বাংলাদেশ ছাফ করোচি মা কুত্তায় মুতিচে।
প্রথম মাসের পরে যখন দ্বিতীয় মাসেও মাসিকের নির্ধারিত তারিখটি পার হয়ে যায় তখন ফুলপরি ঘন ঘন লেট্রিনে গিয়ে রক্তের দেখা না পেয়ে ব্যাপারটা নিশ্চিত হয়, তখন গলার কাছে মরণ এসে আটকে যায়। মিসেস সফুরা কয় তোর মুক ক্যাঙ্কা য্যানো শুকন্যা শুকন্যা মনে হয় কি হচে হামাক ক ফুলি। কিন্তু ফুলি কোনো কথা কয় না শুধু আড়াল পেলেই কেন্দে জারেজার হয়। সুযোগ পেলেই সকাল বিকাল মিস্টার মকবুল হোসেনের খোঁজে বের হয় কিন্তু লগ্ন মেলে না। একদিন সেদিনের মতো এক সময় এসে যায় যখন আকাশ ভরে মেঘ জমে ওঠে আর হাজি বাড়ির আমবাগানে কচি বুড়োরা আমের ধান্ধায় বাতাসের অপেক্ষায় ঘোরে ফেরে। ফুলপরি ঘোরে মিস্টার মকবুল হোসেনের ধান্ধায়, লগ্ন মিলে যায়। তখন হঠাৎ ফুলপরির মাথার ভেতরে চক্কর খেলে গিয়ে বমির ভাব হলে মিস্টার মকবুল হোসেন চারপাশ দেখে নিয়ে কাঁধে হাত রেখে ভরসা হয়ে দাঁড়ায়। ফুলপরি কয় হামাক বাঁচাও সিগ্গিরি প্যাটোত তোমার বাচ্চা, চিন্তায় হামি য্যানো মর্যা যাই। শুনে মিস্টার মকবুল হোসেনের মাথার ভেতরেও চক্কর খেলে যায় তখন দূর থেকে শাঁ শাঁ ঝড়ো বাতাসের শব্দ শোনা গেলে সবার ভেতরে চাঞ্চল্য ঝাপটা দেয়। মিস্টার মকবুল হোসেন দেখে গাছগাছালির মাথা তুমুল দোল খায়। ধুলোয় অন্ধকারে আম বাগানে ঝপাত ঝপ আম পড়ার শব্দ হয় তখন হঠাৎ অন্ধকার সে মুখে আলো ঝলকায়। ফুলি হামরা শহরত পালামো। হামরা সেটি সংসার পাতমো। হামি কারখানাত কাজ করমো আর তুই বাচ্চা দেকবু খেলা করবু? ফুলি আকুলি বিকুলি কয় আজগ্যা এই ঝড়ের মদ্যেই কি পালাবা? মিস্টার মকবুল হোসেন কয় কদিন বাদে আগে একটু গোছগাছ কর্যা লেই, হামি তোক টাইম হলে কমু।
শেষ বিকেলে তখন ঝড়ের আকাশে সূর্য উঁকি দিলে রোদ এসে মানুষের রাজ্যে চড়ে আর সে রোদের আলোয় খোকা ঘরের পেছেনে ঝড় পরবর্তী বাংলাদেশের পরিচর্যা করে। ফুলপরি কেমন নির্ভার অনুভব করলে বৈশাখি মেলায় কেনা প্রিয় আয়নাটা নিয়ে জানালার কাছে বসে। দেখে ঝড়ো ঝাপটায় ভেজা আয়নাটায় তার মুখ খোকার বাংলাদেশের মানচিত্রের মতো বেঁকে বেঁকে গেছে।
(নোট: এই লেখার বানানরীতি-সম্পাদনা লেখকের নিজস্ব)