আমাকে তোমরা অবলা বলো-
কখনো ভালোবেসে, কখনো রেগে, কখনো বা তাচ্ছিল্যে!
কিন্তুু আমি, আমি কি বলি!
কোনটা নেব আমি, ভালোবাসা, রাগ না তাচ্ছিল্য?
যেন আজন্মকাল থেকে বয়ে চলেছে এই স্রোতধারা!
দুদিন আগে এ পথের ধারে
একটা ঘটনা ঘটে গেল,
দুর্ঘটনাও বলা যেতে পারে!
মধ্যদুপুরে টিউশন থেকে ফিরছিল গঙ্গা,
কাঁধে ঝোলানো ব্যাগ, হাতে অ্যাকাউন্টিংয়ের মোটা বই,
অংক শিখতে গিয়েছিল
ও পাড়ার দিদিমণির কাছে।
অঙ্কেতে সে বড়ই কাঁচা!
হঠাৎ গলির মধ্যিখানে নির্জনে চার বখাটে
তাকে পাকড়াও করে।
অঙ্ক শেখাবে বলে হাত থেকে কেড়ে নেয়
অ্যাকাউন্টিংয়ের মোটা বইটি,
ছুঁড়ে ফেলে গলির মুখে আস্তাকুড়ে!
এরপর?
এরপর তারা অঙ্ক শিখিয়ে যায় পর্যায়ক্রমে!
গঙ্গা একেক করে সব অঙ্ক গ্রহণ করে।
অপরাধ ছিল তার,
জ্ঞানের আলোয় আলোকিত হয়ে
শুধু একটি বিশেষ লিঙ্গে নয়,
স্রষ্টার সৃষ্ট মানুষে পরিণত হওয়া।
অপরাধ এই ছিল যে,
উন্মুক্ত মাঠে শিশুদের সম্মুখে
ধূমপান থেকে বিরত থাকতে বলা!
সেই ভরদুপুর, যেন আজও আমায় ডেকে যায়!
মধ্যাহ্নের আহারের পর সবাই দিবানিদ্রায় ছিল,
কেবল আমিই শুনেছিলাম সেই অসহ্য আর্তনাদ!
২.
গলির শেষপ্রান্তে, যে পুরনো বাড়িটা,
তাতে একজন শিল্পী থাকেন, চিত্রকর।
খুব নাম তার চিত্রশিল্পে,
সেই এঁকেছিল
গঙ্গার সেই বীভৎস্য ছবিখানি, ‘ন্যুড স্কেচ’।
একদৃষ্টিতে যখন তাঁকিয়ে দেখছিলাম,
হঠাৎই চোখের ভাষা বুঝতে পেরে
বলে উঠলো, ‘এটা তো নেহাতই শিল্প’।
এক অস্ফুট স্বর অন্তঃপুরেই চাপা পড়লো,
ভাবছিলাম, ধর্ষকরাও বুঝি শিল্প করেছিল!
পার্থক্য এই যে,
তা কদাচিৎ একবার মনে এলে
ভয়, ঘৃণা, গ্লানি ছড়িয়ে যায়।
আর এটি, সুন্দর ফ্রেমে সজ্জিত হয়ে
আমাদের মনে শিল্পের অনুভূতি জাগায়!
আমি নিতান্তই একজন সামান্য গৃহিণী,
গৃহের চাল-ডাল হিসেবেই যার দিন কাটে,
আমার এই ভ্রান্ত ধারণা
তার যে কর্ণগোচর হয়নি,
তার দৃষ্টি যে আমার চোখের সম্পূর্ণ ভাষাটা
অবলোকন করতে পারেনি,
সেই তো অনেক!
একদিন সুযোগ পেলে ক্ষমা চেয়ে নেব!
৩.
সন্ধ্যাতারা, নক্ষত্রের নামে নাম তার,
নামের শেষে তারাটা উঠে গিয়ে
শুধু সন্ধ্যাটা রয়ে গেছে মুখে।
বছর তিনেক আগে,
গোকুল কর্মের সন্ধানে শহরে গিয়ে
আর ফেরেনি স্ত্রী সন্ধ্যার কাছে,
তাদের ছোট্ট নীড়ে।
রাজাকার আবদুল্লার সুপুত্র মতি মিয়া,
সুযোগ বুঝে একদিন সন্ধ্যায়
সন্ধ্যার গৃহে আসে।
সন্ধ্যা বীরদর্পে তাকে জানিয়ে দেয়,
তিনটি বছর যখন সে
একাকী, নির্বিঘ্নে পার করতে পেরেছে,
আগামী দিনগুলোও সে অনায়াসে পারবে!
এখানে মতি মিয়াও কিন্তুু সন্ধ্যার সাথে
শিল্প গড়তে চেয়েছিল!
বাঁধ সাধলো সন্ধ্যার যতো রাগ, তেজ আর মর্যাদা।
৪.
‘মর্যাদা’ তাকে কখনো দেখিনি আমি,
ছুঁতে পারিনি হাত মেলে।
শুনেছি শুধু আবাল্যকাল থেকে
বাবার মুখে, কাকার মুখে, ঠাম্মার মুখে
এমনকি রান্নার যে ঠাকরুন ছিল,
তারও মুখে।
‘অমন ছ্যাঁ, ছ্যাঁ করোনি দিদিভাই,
মেয়েদের সব খাওয়া শিখতে হয়,
নয়তো মর্যাদাহানি হয় শ্বশুর বাড়িতে’।
আজ কিন্তু আমি সব খাই!
মাছ, মাংস, ভর্তা, ভাজি, শুঁটকি, নিরামিষ সব।
কিন্তু মর্যাদা, তার দেখা পাইনি আজও!
হে রান্নার ঠাকরুন, কোথায় তুমি?
আমাকে আমার মর্যাদাটা তো বুঝিয়ে দিয়ে যাও!
আজ তো আমি আর সেই বিণুনিকাটা
পুতুল হাতে নিয়ে ঘুরে বেড়ানো
ছোট্ট বালিকা নই!
আজ আমি কারো অর্ধাঙ্গিনী, জননী, পুত্রবধূ,
গৃহ রক্ষার্থে গৃহের কর্ত্রী।
তবু নিজের সঙ্গে নিজের
যে আদি-আত্নিক সম্পর্ক,
তাই খুঁজে বেড়াচ্ছি বহুকাল ধরে!
এতো পরিচয়ের ভিড়ে।
‘মর্যাদা’ তোমাকে ছোঁয়ার যে অভিলাষ,
তা চিরন্তন সত্য হয়ে থাকবে।
(নোট: বানানরীতি-সম্পাদনা লেখকের নিজস্ব)