নতুন বছরের শুরুতেই ২০২১ সালের দ্বিতীয় মাসটি বাঙালি জাতির ভাষার মাস। বাহান্নোর ইতিহাস-ঐতিহ্যলালিত স্বপ্ন জাগানিয়া ২১ শে ফেব্রুয়ারি আমাদের বইমেলার মাসেই।
বাঙালির আত্মজাগরণ ও আত্মপরিচয়ের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস সৃষ্টির উত্থানপর্বের প্রথম সর্গ ছিল এই মাতৃভাষার আন্দোলন।পৃথিবীর ১৯৩টি দেশে আজ ২১ শে ফেব্রুয়ারি পালিত হয়। অনন্য এই গৌরব জাতি হিসেবে বাঙালির অভূতপূর্ব অর্জন।
বৈশ্বিক পরিমণ্ডল পরাভূত আজ করোনায়। পৃথিবীব্যাপী আক্রান্তের সংখ্যা যখন ৯ কোটির ওপরে, মৃত্যুর সংখ্যা ২০ লাখ ছাড়িয়ে গেছে। যদিও সুস্থ হয়ে নবজীবনে ফিরেছে ৬ কোটি ৬৮ লাখেরও বেশি। পৃথিবীর এমন সর্বনাশাকালে মননশীল ওয়েবজিন সঙ্গত কারণেই কবি, লেখক সাহিত্যিকদের সামনে মৌলিক একটি প্রশ্ন রেখেছে।
মহামারীর এই ক্রান্তিলগ্নে বই মেলা হওয়া উচিত, কী উচিত নয়? হলে কিভাবে? সভ্যতার শুরুমুখ থেকে মানবজীবনের যত কর্ম কোলাহল, সবই বেঁচে থাকার অন্বেষায় বদ্ধমূলভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে আছে। জানি, নতুন করে এই নিয়ে বলার কিছু নেই।
কিন্তু এই কথা অনস্বীকার্য যে, বেঁচে থাকার তাগিদে, আত্মপ্রতিষ্ঠার সম্ভাবনাকেই বীজমন্ত্র করে এগিয়ে গেছে এই মানবসভ্যতা।
পাশাপাশি, একথাও স্মরণে রাখতে হবে যে, প্রত্যেক শতকে প্রায়ই এই জাতীয় মানববিধ্বংসী ভাইরাসবাহিত রোগ-বালাই এসেছে বারংবার। আমাদের এই পৃথিবীকে আক্রান্ত করছে, অগণিত স্বপ্নময় জীবন ছিনিয়ে নিয়ে গেছে। প্লেগের মতো ভাইরাস বারবার ফিরে এসেছে।
এছাড়া, কলেরা, গুটি বসন্ত ও যহ্মায় মৃত্যুবরণ করেছে শত কোটি মানুষ। প্লেগ ভাইরাস নিয়ে রচিত হয়েছিল আলবেয়ার কামুর বিখ্যাত উপন্যাস ‘দ্য প্লেগ’। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘গৃহদাহ’ উপন্যাসে ডাক্তার সুরেশ অচলার প্রেমে ব্যর্থ হয়ে ভগ্ন হৃদয়ে প্লেগের চিকিৎসা দিতে গিয়ে একার্থে আত্মাহুতি দিয়েছে। সাহিত্যে নানাভাবে এর প্রভাব পড়েছে। করোনা নিয়েও আগামীতে অনেক কবি-সাহিত্যিকের রচনা প্রকাশিত হবে, তা বলাই বাহুল্য।
বিশেষভাবে জাতির জনকের জন্মশত বার্ষিকী উপলক্ষে ১৭ মার্চ শুরু হয়ে ১৭ এপ্রিল মুজিবনগর দিবস অবধি চলতে পারে এই মেলার ব্যাপ্তি।
দীর্ঘকালের জীবনবিন্যাসে অকস্মাৎ আত্মঘাতী ভাইরাসের অযাচিত হস্তক্ষেপে, মৃত্যু ভয়ে, ভীতিতে আমরা প্রায় রক্তশূন্য হয়ে পড়েছি। এই মহামারী আমাদের বিচ্ছিন্ন করেছে মানুষের স্পর্শ থেকে, নিসর্গের মায়ারোদ থেকে এমনকী সর্বক্ষণ জড়িয়ে থাকা প্রকৃতির সবুজ থেকেও। এক কথায় জলের সংসারের মতো ভেঙেচুরে তছনছ করে দিয়েছে আমাদের বহুকাল লালিত স্বপ্নময় জীবনবীক্ষণ।
প্রতিরোধে মানুষও তাকে জয় করে তৈরি করে নিয়েছে তার প্রার্থিত গন্তব্যালয়। সে কখনো থেমে থাকেনি। নদীর মতো বাঁকপরিবর্তন করেছে, নতুন মোহানায় সমর্পণ করেছে বহুধা পথের ঠিকানা খুঁজে পেতে। মানুষের এই অগ্রযাত্রার নেশাই তাকে চালিত করে সঠিক পথের দিক নির্ণয়ে।
মানি, বইমেলা আমাদের অস্তিত্বের শেকড়। কবি-লেখক-প্রকাশক-পাঠক, এই ত্রিধারায় রচিত যে জনসমুদ্র বইমেলায় প্রতিবছর যাতায়াত করে—তাদের কী হবে? হুজুগে বাঙালিকে কে, কিভাবে রক্ষা করবে, তার গমনাগমন থেকে, ছোঁয়াছুঁয়ি থেকে। যেখানে করোনা প্রতিরোধের প্রধান মহৌষধ হিসেবে মানব-বিচ্ছিন্নতার কথা বলা হচ্ছে শুরু থেকেই। এতকালের অভ্যেসে যে মানুষটি প্রিয়জনের হাতে হাত রেখে, মুখপানে তাকিয়ে থেকে সহজিয়া অনুরাগে তার আবেগ-অনুভূতির কথা জানিয়েছে—আজ যে তা দুর্মরভাবে অচল। এখন সময়টা এমন যে পরস্পরকে পৃষ্ঠ প্রদর্শন করে চলতে হচ্ছে। টরন্টোতে যে লিফটে গত বছর ১০ জনে ওঠা-নামা করেছে, সেই লিফটে এখন দুজনের অনুমতি আছে। সেখানে পরস্পর পৃষ্ঠ প্রদর্শন করে দাঁড়াতে হয়, কিছুতেই মুখোমুখি নয় এবং ডাবল মাস্ক পরে থাকার নির্দেশ প্রায় অমোঘ। ছয় ফুট দূরে অবস্থান করে শুধু প্রয়োজনীয় কাজটি সম্পন্ন করার কথা বলা হচ্ছে। পৃথিবীব্যপী একই নিয়ম সব দেশের জন্যে। কিন্তু আমরা বাংলাদেশিরা মানছি কোথায়?
২০২০ সালের ৮ মার্চ শনাক্ত হওয়া অবধি করোনা ভাইরাসে এই পর্যন্ত মারা গেছে ৭ হাজার ৮৬২ জন, তবে আক্রান্তের সংখ্যা ৫ লাখের ওপর। ভাগ্য ভালো প্রতিবেশী ভারতের চেয়েও মৃত্যুর এই হার অনেক কম। এ জন্যে বোধ হয় চাল-চলন, চলা-ফেরায় অতিমাত্রায় আমরা দুঃসাহসী হয়ে উঠেছি। এরমধ্যে সভা-সমিতি, পৌরসভার নির্বাচন ও তার কার্যক্রমের প্রস্তুতি চলছে।
বইমেলাও হতে পারে, পর্যাপ্ত প্রশাসনিক সাপোর্টসহ নতুন নিয়ম-কানুন অনুসরণ করে অবশ্যই। শীতকালে যেহেতু করোনা সংক্রমন বৃদ্ধি পায়, সেহেতু এই বছরের জন্যে মার্চ-এপ্রিলে হতে পারে এই বইমেলা। বিশেষভাবে জাতির জনকের জন্মশত বার্ষিকী উপলক্ষে ১৭ মার্চ শুরু হয়ে ১৭ এপ্রিল মুজিবনগর দিবস অবধি চলতে পারে এই মেলার ব্যাপ্তি।
বইমেলা কেবল মেলা নয়, একটি জাতির শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির প্রবহমান স্রোতধারা,যা আমাদের আত্মপরিচয়ের অন্বেষণ। জীবন জীবনের জন্যে, জীবন বাঁচিয়ে, তবেই শিল্প। এই পরম ও চরম সত্যটিকে যেন ভুলে না যাই।