একুশের বইমেলার আকর্ষণ মানুষের মধ্যে অনেক কারণে দিন দিন বাড়ছে।বইমেলাকে ঘিরে নিজেদের ভাষা ও জাতিসত্তার বৈশিষ্ট্য নিয়ে এক ধরনের বোধ লালন করছে মানুষ সূক্ষ্মভাবে, যা বিকশিত হচ্ছে আরও। এই মেলা আজ বাঙালির উৎসবের অন্যতম মূলভূমি হয়ে উঠেছে, যেখানে এসে মানুষ তার সংস্কৃতিবোধের সংহতি নিয়ে একে অন্যের সঙ্গে মিলিত হওয়ার প্রেষণা অনুভব করে। উৎসবের এই বইমেলা থেকে দূরবর্তী থাকা এক ধরনের বিচ্ছিন্ন হওয়ার মানসিক চঞ্চলতা সৃষ্টি করে—স্বভাবত। বইমেলার সঙ্গে—বিশেষত লেখা ও প্রকাশনার সঙ্গে যুক্ত থাকা মানুষের অর্থনৈতিক স্বার্থ তো জড়িয়ে আছে। আর এবার বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী ও মুক্তিযুদ্ধের পঞ্চাশ বছর পূর্তির বিষয়টিও রয়েছে। এসব কারণে এ-বছরের একুশের বইমেলার তাৎপর্য আরও বেশি হয়ে ধরা দেওয়ার বিষয়টি কাঙ্ক্ষিত হয়ে দাঁড়িয়েছে।
অন্যদিকে করোনায় মানুষের মৃত্যু থামছে না, বছর পার হয়ে গেছে, কোনো কোনো দেশে করোনার প্রকোপ কমেছে—আবারও বেড়েছে, কোনো কোনো দেশে নিয়ন্ত্রণের পরও আবারও অনিয়ন্ত্রিত অবস্থা! মৃত্যৃ থামছে না, সে লক্ষণও নেই। ছিন্নভিন্ন অবস্থা! আমাদের দেশেও সংক্রমণের ঝুঁকিতে এখনো, সামনে আরও পরিস্থিতি কী হবে, তা বলা যায় না স্পষ্টভাবে। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় এখনো বন্ধ। তবে জানুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে বাংলাদেশে সংক্রমণের হার কমছে, এই প্রবণতা যদি বজায় থাকে কিছুদিন, অশনি-আশঙ্কা কমতে থাকে, তাহলে ২১ শে ফেব্রুয়ারি থেকে ২৬ মার্চ পর্যন্ত এই বইমেলার তারিখ এই বছরের জন্য পুনঃনির্ধারণ করা যেতে পারে। এতে ভাষার মাস, বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন ও স্বাধীনতা দিবস যুক্ত হয়ে বইমেলার ভিন্ন এক সময়পোযোগী তাৎপর্য সৃষ্টি হবে।
একুশের বইমেলা ২০২০ সালে বড় পরিসরে আয়োজন করা হয়েছিল, এতে বিভিন্ন সীমাবদ্ধতা কাটানো সম্ভব হয়েছে। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বইমেলার সম্প্রসারণ করার যুক্তি এখন গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠেছে। বাংলা অ্যাকাডেমি ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের চেতনাগত দর্শন সাংঘর্ষিক নয়, বরং তা কাছাকাছি ও আমাদের জাতীয় চেতনার মূলভূমিরই কণ্ঠলগ্ন হয়ে আছে। তবে, করোনাকালে কড়াভাবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে (মাস্ক ছাড়া নয়) ও অন্যান্য বিধি মেনে শৃঙ্খলার প্রতি বিশেষ নজর দিয়ে—বইয়ের স্টল ও যাতায়াতের বিন্যাস নতুনভাবে করা সমীচীন। খাবারের দোকান, মিডিয়ার জন্য সংরক্ষিত এলাকা ও অন্যান্য আয়োজন ভিন্ন মাত্রায়—করোনা প্রতিরোধ উপযোগী করে গড়ে তুলতে হবে। এ ক্ষেত্রে করোনাকালের উপযোগী ব্যবস্থাপনার কোনো বিকল্প নেই।
বইমেলা আরও সংহত হোক, আরও বিকাশ লাভ করুক—তা শুভবোধ সম্পন্ন মানুষ মাত্রই চাইবেন—আমি তাদের একজন হয়ে চাইবো না কেন?
আমাদের দেশে—সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক ও সামাজিক গ্যারান্টি কম, সে-কারণে অনেক মানুষকে প্রয়োজনে ঘর থেকে বের হতে হচ্ছে, ছুটতে হচ্ছে। তা হয়তো ঠিক, আরও সচেতনতা, আরও নিয়ম মানার জন্য মানুষের বিবেকতাড়িত ভূমিকাও জরুরি। করোনাসংকট মোকাবিলায় সরকারের তৎপরতা চলছে ঠিকই কিন্তু তা আরও প্রণালীবদ্ধ করে স্বচ্ছতার ভেতর নিয়ে আসা প্রয়োজন। তবে, মানুষের মধ্যে স্বাস্থ্যবিধি মানার ক্ষেত্রে শিথিলতা চলে এসেছে, তা কাম্য হতে পারে না। আগে স্থানীয় প্রশাসন ও বিভিন্ন সংস্থা বেশ সতর্ক ছিল, তা থেকেও তারা দূরে চলে যাচ্ছে। রাষ্ট্র, সরকার ও সংশ্লিষ্টজনেরা জনগণের পাশে না থেকে ব্যক্তির ওপর তার পুরোপুরি দায়িত্ব ছেড়ে দেওয়ার মানসিকতা লক্ষ করা যাচ্ছে। এতে করোনার মৃত্যুঝুঁকি বাড়বে, বৈ কমবে না। এমন অবস্থা কারো জন্য মোটেই সুখকর নয়। মানুষের জন্য এ-এক মহা বিপত্তিকাল, কষ্টের কাল, অনিশ্চয়তার কাল! এমন সময়ে আমাদের সকলের মন থেকে আতঙ্ক ও ভয়বিহ্বলতা কাটাতে হবে, তেমনি জীবনাচরণে করোনাকাল উপযোগী ব্যবস্থাও গড়ে তুলতে হবে। সার্বিক পরিস্থিতির উন্নতির জন্য সকলের যূথবদ্ধ ভূমিকা দরকার, এমন ভূমিকার মধ্যে দিয়ে—আমরা বইমেলার মত বড় বড় জাতীয় আয়োজনকে আরও সংহত করতে পারি, না হলে—এসব আয়োজন করা সম্ভব হবে না, বরং সংকট বাড়াবে।
বইমেলাকে কেন্দ্র করে—অনেক নতুন নতুন লেখক লেখায় উৎসাহিত হচ্ছেন, নতুন নতুন প্রকাশকের অস্তিত্ব বিকশিত হচ্ছে, বই প্রকাশনার সংখ্যাও বাড়ছে। বইমেলা আরও সংহত হোক, আরও বিকাশ লাভ করুক—তা শুভবোধ সম্পন্ন মানুষ মাত্রই চাইবেন—আমি তাদের একজন হয়ে চাইবো না কেন?