চিন্তাসূত্র ডেস্ক
সম্প্রতি কথাকার সাদাত হোসাইনকে নিয়ে একশ্রেণীর লেখক নেতিবাচক প্রচারণায় লিপ্ত হয়েছেন। তাদের সেই নেতিবাচক প্রচারণার জবাব খোদ সাদাত হোসাইন কখনো কখনো কৌশলে দিয়েছেন, কখনো কখনো তার অনুরাগীরাও দিয়েছেন। কিন্তু তার বিরুদ্ধে নেতিবাচক প্রচারণা কেন চালানো হচ্ছে, সেই বিষয়ে সাদাত হোসাইন কিংবা তার অনুরাগীরা, কেউ প্রশ্ন তোলেননি। অথবা তারা প্রশ্ন তুলে জল আরও ঘোলা করতে চাননি।
এ কথা সুবিদিত যে, সিরিয়াস লেখক হোন, আর বাজারি লেখক, তিনি যখন জনপ্রিয়তার তুঙ্গে অবস্থান করেন, তখনই তার নিন্দুক শ্রেণীর আভির্ভাব ঘটে। এই নিন্দুকরা রবীন্দ্রযুগে ছিল, নজরুলকেও ছাড়েনি। এমনকী আপাতত নির্জনতাপ্রিয়, অজনপ্রিয় জীবনানন্দ দাশও এই নিন্দুকদের হাত থেকে রেহাই পাননি। তবে, তাদের জন্য সুখের কথা এই যে, ওই যুগের নিন্দুকরা ছিলেন শিক্ষিত, প্রাজ্ঞ। তারা আগে আক্রমণের শিকার লেখকের রচনারাজি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়তেন। এরপর নিন্দাচর্চায় অবতীর্ণ হতেন। কিন্তু এই যুগের নিন্দুকরা যে জনপ্রিয় লেখকের নিন্দায় নামেন, সেই লেখকের কোনো একটি বই কিংবা একটি বইয়ের পুরো একটি অধ্যায়ও ভালো করে পড়েন না। কেউ একজন হয়তো এক পাতা পড়লেন, ফেসবুকে এসে সেই একপাতার বিরুদ্ধেই তার বিদ্বেষ ঢেলে দিলেন। অমনি বাকিরাও হুমড়ি খেয়ে পড়লেন নিন্দাচর্চায়। বললেন, ‘এই লেখক বাজারি লেখক, সিরিয়াস কিছুই নেই তার লেখায়।’
অথব ভাবতেও অবাক লাগে, এই নিন্দুকরা যখন হুমায়ূন আহমেদ বাজারি লেখক বলে তার রচনা পড়তে অস্বীকৃতি জানান, তখন কিন্তু আখতারুজ্জামান ইলিয়াস পড়েন না। অর্থাৎ মূলত নিন্দাচর্চাই তাদের মৌলিক ও একমাত্র কাজ। তারা বাজারি বলে একধরনের লেখককে প্রত্যাখ্যান করেন, আবার সিরিয়াস ধারার লেখকদেরও এড়িয়ে চলেন। এরা সাহিত্যের পাঠক নন, সমালোচকও নন। এরা মূলত ওই বাজারি লেখক অর্থাৎ জনপ্রিয় লেখক হতে আসা গোষ্ঠী, কিন্তু নিজের কলমের জোরে না হতে পেরেছেন জনপ্রিয় লেখক, না হতে পেরেছেন বুদ্ধি-প্রজ্ঞায় সিরিয়াস লেখক। পর্যবসিত হয়েছেন অক্ষম-নিন্দুকে। তাই তাদের অক্ষম আক্রোশে কেঁপে কেঁপে ওঠেন নিজ নিজ ফেসবুক টাইম লাইনে।
শুধু সাহিত্য জনপ্রিয় হলেই মনে করি তা বাজারি। যারা জনপ্রিয় হতে পারছেন না; তারাও তো ছুটছেন জনপ্রিয় হওয়ার জন্য। নিজের বইয়ের বিক্রি বাড়ানোর জন্য মরিয়া হয়ে ওঠেন। না পারলে ‘শেয়ালের আঙুর ফল টক’ হওয়ার মতো অবস্থা তৈরি করেন।
বেশ কিছুদিন ধরে বিষয়টি চিন্তাসূত্র গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। সেই পর্যবেক্ষণ থেকে চিন্তাসূত্রের টাইম লাইনে দশটি প্রশ্ন করা হয়। প্রশ্নগুলো হলো:
১। এই সময়ের তুমুল জনপ্রিয় লেখক।
২। প্রভাবশালী-বিত্তশালী-ক্ষমতাবান নন।
৩। টাকার জোরে তার বই নিয়ে কাউকে প্রচারে নামতে বাধ্য করেন না।
৪। পদোন্নতি দেওয়া কিংবা পদোন্নতি আটকে দেওয়ার হুমকি দিয়ে কাউকে দিয়ে রিভিউ লেখান না।
৫। তার বই কিনতে কাউকে বাধ্য করেন না।
৬। নিজেকে জাহির করতে গিয়ে অন্যকে খাটো করেন না।
৭। নিজের সৃষ্টি নিয়ে মেতে থাকেন, অন্যের ছিদ্রান্বেষণে সময় নষ্ট করেন না।
৮। তার বই প্রচুর বিক্রি হয়। নিজের বই নিজের টাকা দিয়ে অন্যের মারফতে কিনে প্রকাশককে বোঝান না, দেখুন, আমার বই বিক্রি খারাপ না!
৯। বই বিক্রি থেকে তিনি প্রচুর টাকা পান।
১০। সমালোচকের নিন্দা-প্রশংসায় আপাতত ভাবিত নন।
এরপর পাঠক-সমালোচক-লেখকদের কাছে জানতে চাওয়া হয়, ‘এরপরও আপনারা এই লেখকের কোন বৈশিষ্ট্যের কারণে তাকে নিয়ে ট্রল করেন?’
এর প্রথম কমেন্ট করেন, তরুণ কথাশিল্পী সালাহ উদ্দিন মাহমুদ। তিনি বলেন, ‘Sadat Hossain নিজের আলোয় আলোকিত। যারা ধার করা আলো নিয়ে পথ চলেন; তারা তো ট্রল করবেনই। তাতে সাদাত হোসাইনের কিছুই যায়-আসে না। বরং তার পাঠক দিন-দিন বেড়েই যাচ্ছে। এ নিয়েও নিন্দুকরা হতাশ। পেছন থেকে টেনে ধরার সব রকমের আয়োজনে ব্যর্থ হয়ে নিন্দুকরা এখন নিজের মাথার চুলই ছিঁড়ছেন মনে হয়।’ তার বক্তব্যে সাদাত হোসাইনের প্রতি পক্ষপাত যেমন রয়েছে, তেমনি এই লেখকের নিন্দুকদের প্রতি রয়েছে তীব্র তাচ্ছিল্যভাবও। এরপর খুব ছোট্ট মন্তব্য করেন কথাশিল্পী সাইফ বরকতুল্লাহ। বলেন, ‘ঠিক।’ কিন্তু কী ঠিক, তিনি পরিষ্কার করেননি।
সাদাত হোসাইনের ট্রলকারীদের সাইকো বলে অভিহিত করলেন কথাকার-কবি আবিদ আজম বললেন, ‘পুরোপুরি একমত। সাইকো ট্রলকারীদের সুমতির উদয় হোক।’এরপরই রাহমান ওয়াহিদের মন্তব্য, ‘প্রাণঢালা ভালোবাসা জানাই তরুণ জনপ্রিয় লেখক সাদাতকে।’
এর পরপরই তীব্র ঝাঁজালো মন্তব্য কথাকার হারুন পাশার। তিনি বলেন, ‘৬ নম্বরটা প্রবল আপত্তিকর। সে নিজেকে জাহির করতে গিয়ে অন্যকে খাটো করার সাথে অস্বীকার কিংবা খারিজও করে। এবং মনে করে বাংলাদেশে কেবল জনপ্রিয় সাহিত্যই একমাত্র সাহিত্য।’ যদিও তার এই বক্তব্যের পক্ষে তিনি কোনো তথ্য-উপাত্ত-সূত্র বলেননি।
হারুন পাশার মন্তব্যের জবাব দিতে কলম ধরেন সালাহ উদ্দিন মাহমুদ। বলেন, ‘‘হারুন পাশা ভাই, আমরা সব সময় জনপ্রিয় জিনিসই তো খুঁজি। জনপ্রিয় ব্র্যান্ড, জনপ্রিয় গান, জনপ্রিয় সিনেমা, জনপ্রিয় নাটক, জনপ্রিয় খাবার ইত্যাদি। শুধু সাহিত্য জনপ্রিয় হলেই মনে করি তা বাজারি। যারা জনপ্রিয় হতে পারছেন না; তারাও তো ছুটছেন জনপ্রিয় হওয়ার জন্য। নিজের বইয়ের বিক্রি বাড়ানোর জন্য মরিয়া হয়ে ওঠেন। না পারলে ‘শেয়ালের আঙুর ফল টক’ হওয়ার মতো অবস্থা তৈরি করেন। সবাই সমান জনপ্রিয় হবেন না, এটাই স্বাভাবিক। তা বলে কেউ জনপ্রিয় হয়ে উঠলে অপ্রাসঙ্গিক বিষয় নিয়ে তাকে আঘাত করতে হবে কেন? এটা ঠিক বুঝে আসে না।’’ এই মন্তব্যের পর হারুন পাশার কণ্ঠ কিছু মৃদু হয়ে আসে। ফিরতি মন্তব্যে বলেন, ‘সালাহ উদ্দিন মাহমুদ ভাই, টক আর স্বাদের ব্যাপার না। ব্যাপার ভিন্ন জায়গায়, ভিন্ন জায়গাটা কোথায়, সেটা আপনি, আমি কিংবা বাকিরা সবাই জানে।’
এই দুই জনের কথোপকথনের মাঝখানে শোনা যায় সৌম্য সালেকের কণ্ঠস্বর, ‘‘ভালো কাজ জনপ্রিয় হতেও পারে, নাও হতে পারে। যা ভালো তাই ভালো, কেবল জনপ্রিয়টা ভালো এমন নয় যদিও সেখানে লৌকিক বিনোদনের রসদ রয়েছে। ‘ঢোড়াই চরিত মানস’, ‘ইছামতি’, ‘তিতাস একটি নদীর নাম’, ‘প্রদোষে প্রাকৃতজন’—এসব আখ্যানের কয়জন পাঠক জুটেছে আজ অবধি কিন্তু এসব বাংলা সাহিত্যের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাজ।’’ এবার সালাহ উদ্দিন মাহমুদের জবাব, ‘সৌম্য সালেক ভাই, যুগে যুগে যা পঠিত হচ্ছে, তাকেও আমি জনপ্রিয় বলি। জনপ্রিয় না হলে হারিয়ে যেতো। জনপ্রিয়তার পাশাপাশি টিকে থাকাও গুরুত্বপূর্ণ। হারিয়ে গেলে জনপ্রিয়তায়ও ভাটা পড়তো।’
ভালো কাজের জন্যও অন্যের রোষানলে পড়ে, ঈর্ষার পাত্র হয়ে ট্রলের স্বীকার হতে হয়
সাদাত হোসাইন থেকে প্রসঙ্গে ভিন্ন দিকে টেনে নিলেন কাজী জহিরুল ইসলাম। তিনি বললেন, ‘সালাহ উদ্দিন মাহমুদ, জনপ্রিয় হতে চায় সকলেই, তবে একটু পার্থক্য আছে। ভালো সাহিত্য জনপ্রিয় হোক এটাই প্রত্যাশা।’ সালাহ উদ্দিন মাহমুদের জবাব, ‘কাজী জহিরুল ইসলাম, দুর্বল রচনা জনপ্রিয় হয়েছে বলে কখনো শুনিনি।’ এরপর আর কাজী জহিরুল ইসলামকে নিজের বক্তব্যের সমর্থনে যুক্তি দিতে কিংবা সালাহ উদ্দিন মাহমুদের বক্তব্য খণ্ডন করতে কোনো মন্তব্য করতে দেখা যায়নি।
পরের মন্তব্য আরিফুর রহমান সেলিমের। তার মন্তব্য, ‘তাঁর (সাদাত হোসাইন) বই নাকি বিদেশি গল্পের ছায়া অবলম্বনে লেখা। তবুও তিনি সেটাকে মৌলিক বলে দাবি করেন। সম্ভবত ট্রলের কারণ এটাই।’ এই মন্তব্যে ব্যাখ্যা দাবি করে বসলেন সালাহ উদ্দিন মাহমুদ। বললেন, ‘কোন বইটি কোন গল্পের ছায়া অবলম্বনে লেখা পরিষ্কার করে জানালে উপকৃত হতাম। আমি তার যতগুলো বই পড়েছি, তাতে সময় ও প্রেক্ষাপট সম্পর্কে যথেষ্ট ধারণা পেয়েছি। কোনো ছায়া খুঁজে পাইনি। ঢালাওভাবে বলাটা যুক্তিসঙ্গত নয়। তুলনামূলক সমালোচনাও ইতিবাচক হওয়াটা বাঞ্ছনীয়।’
এদিকে, সাদাত হোসাইনের নিন্দাচর্চাকারীদের মনস্তত্ত্বের একটি ব্যাখ্যা দিলেন কথাকার হোসনে আরা মনি। বললেন, ‘তিনি দেখতে কিউট। শুনেছি তার ভক্তরা বেশিরভাগই তরুণী। তাই হয়তো পুং কবি-লেখকেগণ (কেউ কেউ) তাকে দুই চোখে দেখতে পারেন না। আমি তার কোনো বই পড়িনি। তবে কোথায় যেন একটা লেখার কিছু অংশ পড়েছিলাম। টেনেছিল। মনে হচ্ছিল লেখকের পাঠক ধরে রাখার ক্ষমতা আছে।’ জবাবে সালাহ উদ্দিন মাহমুদের মন্তব্য, ‘Hosneara Moni আপা, ওই পাঠক ধরে রাখার ক্ষমতাই তাকে ঈর্ষণীয় সাফল্য এনে দিয়েছে। লেখকের অন্তত এই গুণটা থাকা জরুরি বলে আমি মনে করি।’
এই পর্যায়ের অন্ধ তিরন্দাজ আইডি থেকে মন্তব্য, ‘তার ভেতরে ছ্যাচরামি আছে।’ আর আহমেদ ফারুক আইডির মন্তব্য, ‘দোষগুণ নিয়েই মানুষ।’ ১৯ নভেম্বর/২০২০ তারিখের ১০ টা ৪১ মিনিট পর্যন্ত আপাতত শেষ মন্তব্য আনুপম হাজারীর। তিনি বলেন, ‘সবসময় খারাপ কাজের জন্য ট্রলে পরিণত হতে হয় এটা আপনাদের কে বলছে? ভালো কাজের জন্যও অন্যের রোষানলে পড়ে, ঈর্ষার পাত্র হয়ে ট্রলের স্বীকার হতে হয়।’ তবে, এই তিনজনের মন্তব্যের কোনো পাল্টা মন্তব্য পাওয়া যায়নি।
(যেহেতু এই বিতর্ক চিন্তাসূত্রের টাইমলাইনে পাবলিকলি হয়েছে, সেহেতু এই প্রতিবেদনে মন্তব্য নেওয়ার ক্ষেত্রে মন্তব্যকারীদের অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন নেই। পরবর্তী সময়ে আলোচনা ও নতুন বিতর্কের সুবিধার্থে প্রত্যেকের মন্তব্যের স্ক্রিন শটও যুক্ত করে দেওয়া হলো।)