বাংলা অ্যাকাডেমি ‘সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ পুরস্কার’ প্রবাসী লেখকদের জন্য প্রবর্তন করেছে। কোন বিবেচনায় এবং কেন এমন পুরস্কার চালু হয়েছে, আমরা কেউই তার কারণ জানি না। তবে, যখন থেকে প্রবাসী লেখকদের জন্য এই পুরস্কার প্রবর্তিত হয়ে আসছে, তখন থেকেই ‘প্রবাসী’ শব্দ ব্যবহারের তীব্র প্রতিবাদ হচ্ছে। যতদূর শুনেছিলাম, প্রথমে এই পুরস্কারটি শুধু ‘প্রবাসী লেখক’ নামে ছিল। পরবর্তী সময়ে লন্ডনপ্রবাসী লেখকদের তীব্র প্রতিবাদে ‘প্রবাসী লেখক’ নামের পরিবর্তে ‘সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ পুরস্কার’ নামে পুরস্কারটি ঘোষণা করা হয় এবং পুরস্কারটি শুধু প্রবাসী লেখকদের জন্যই বরাদ্দ করা হয়। এছাড়া, যখনই পুরস্কারটি ঘোষণা করা হয়, তখনই অমুক ‘প্রবাসী লেখক’ বলে নাম উল্লেখ করেন। বাংলা অ্যাকাডেমির এই বৈষম্যমূলক মানসিকতার তীব্র নিন্দা জানাই। কারণ, প্রবাসে বসবাসকারী লেখকের নামের পাশে ‘প্রবাসী লেখক’ শব্দযুগল ব্যবহার করে বাংলাদেশ থেকে সে-সব লেখককে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হচ্ছে বা দেখা হচ্ছে।
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহকে কি ‘প্রবাসী লেখক’ হিসেবে মূল্যায়ন করছে বাংলাদেশ? এই প্রশ্নটা আমার মাথায় ভীষণভাবে ঘুরপাক খাচ্ছে। কারণ, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ বাংলা সাহিত্যের একজন দিকপাল; অপরিহার্য নামও। তার ‘লালসালু’ উপন্যাসটি বাংলা সাহিত্যের ধ্রুপদী সৃষ্টিকর্ম হিসেবে বিবেচিত হয়। এর পটভূমি ১৯৪০ কিংবা ১৯৫০ পঞ্চাশ দশকের বাংলাদেশের গ্রামীণ সমাজ হলেও এর প্রভাব বা বিস্তার কালোত্তীর্ণ। এই উপন্যাস পড়ে কখনোই মনে হয়নি তিনি একজন প্রবাসী লেখক। বাংলার শেকড়ের কাছে, মাটির টানে যার আত্মার অস্তিত্ব গ্রথিত, তাকে আমরা কিভাবে প্রবাসী লেখক মনে করি? এমনটা ভাবতেই বিস্ময় লাগে। আজকে যদি তিনি বেঁচে থাকতেন, তাহলে হয়তো প্রচণ্ড ক্ষোভে ফেটে পড়তেন।
দেশের বাইরে বসবাস করলেই যে তিনি বাইরের কেউ হয়ে যান, এই মানসিকতাও অবাক করে দেয়। যেখানে বাংলার শিকড়ের টানে বাংলা ভাষা নিয়ে কাজ করছে বাংলাদেশকে মাথায় রেখে, সেখানে কিভাবে একজন লেখক ‘প্রবাসী’ হন? শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চায় কি কোনো ভৌগোলিক সীমারেখা আছে? আর পৃথিবীর যে প্রান্ত থেকে বাংলা ভাষা নিয়ে, বাংলার ঐতিহ্য রক্ষা করে যে কাজই করা হোক না কেন, তা বাংলাদেশর কাজ মনে করেই মূল্যায়িত হবে, এমনটাই তো প্রত্যাশা করতে পারি। এছাড়া, ‘সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ’র নামে প্রবাসী লেখকদের জন্য এই পুরস্কার, এটাও তো একধরনের ধৃষ্টতা!
দেশ ছেড়ে এসেছি বলে বৈদেশিক অর্থাৎ প্রবাসী হয়েছি। আমার মতো দেশছাড়া সব বাঙালিই তাই। শুধু জায়গা বদল করেছি। আর তো কিছুই বদলাইনি! তাহলে আমাদের আলাদা করে দেখার অর্থ কী? বাংলাদেশভিত্তিক সব কর্মকাণ্ড প্রবাসে বসে বাঙালিরা যতই করি না কেন, তার মূল্যায়ন হচ্ছে প্রবাসী বলে অর্থাৎ আমরা দেশের কেউ না, কিচ্ছু না। অথচ, এই আমাদের শ্রমের সবটুকুই বাংলাদেশকেন্দ্রিক। কী অর্থনৈতিক, কী মানসিক, কী শারীরিক; এর সব শ্রমই বাংলাদেশের দিকে ছোটে। দেহটা শুধু এখানে। মননে-মনে সবটুকুজুড়ে আছে বাংলাদেশ। আমরা যারা বাংলা ভাষায় সাহিত্যচর্চা করি, কিংবা শিল্প-সংস্কৃতির বিভিন্ন অঙ্গনে যারা বাংলার ঐতিহ্যকে তুলে ধরে কাজ করে যাচ্ছেন, তার পুরোটাই বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করে। আমরা বাংলাদেশকে মাথায় রেখে বাংলা ভাষায় সব কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাই বাংলাদেশের মুখ উজ্জ্বল করার জন্য। কোনো বাঙালি যদি কোনোকিছুতে কৃতিত্ব দেখায়, তখন আমরা প্রথমে বাংলাদেশ নামটা উচ্চারণ করে উল্লাস করি। অথচ, সেই আমাদেরই বাংলাদেশের মানুষ দেখে বাইরের মানুষ হিসেবে, বিদেশি হিসেবে।
এ পর্যন্ত যারা সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন, তাদের অভিনন্দন জানাই। কিন্তু প্রবাসী লেখক হিসেবে অভিনন্দন জানাচ্ছি না।
প্রবাসী লেখকদের জন্য বাংলা অ্যাকাডেমি ‘সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ পুরস্কার’ নামে যে পুরস্কার প্রবর্তন করেছে, তাকে আমি প্রহসনমূলক পুরস্কার বলি। প্রতি বছর বাংলা অ্যাকাডেমি এই পুরস্কার ঘোষণা করে একটা কেওয়াজের পরিবেশ সৃষ্টি করে। প্রবাসে বসবাস করা অধিকাংশ লেখক এর প্রতিবাদ করেন। কিন্তু বাংলা অ্যাকাডেমি তাতে কর্ণপাত করেন না। কেন করেন না, জানি না। তবে আপাতদৃষ্টিতে মনে হয়, বাংলা অ্যাকাডেমি এই পুরস্কার ঘোষণা করে প্রবাসী লেখকদের এমন কেওয়াজ দেখে মজা পায়। হাসিঠাট্টায় মশগুল হয়ে পড়ে অ্যাকাডেমির পরিবেশ। এমন কথাও শুনেছি। নাহলে বছরের পর বছর এই পুরস্কার প্রবর্তিত হচ্ছে কেন? বিষয়টা তো বাংলা অ্যাকাডেমির বিবেচনায় আনা উচিত! প্রবাসী লেখকদের বাংলাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখার বা রাখার কোনো এখতিয়ার তো তাদের নেই।
এখন কথা হচ্ছে, ‘সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ পুরস্কার’ কে গ্রহণ করবেন, আর কে প্রত্যাখ্যান করবেন; সেটা যার যার ব্যক্তিগত অভিরুচি। সেখানে কারও কোনো বক্তব্য থাকতে পারে আমি তা মনে করি না। প্রতিবাদটা মূলত একটা প্রতিষ্ঠানের এই পুরস্কার ব্যবস্থাপনার বিরুদ্ধে। সেখানেই আমরা অনেকে পরিবর্তন চাই। বাংলাদেশের লেখকদের সঙ্গে এক কাতারে দাঁড় করিয়ে প্রবাসী লেখকদেরও মূল্যায়ন করা হোক। সেই মোতাবেক পুরস্কার দেওয়া হোক। প্রত্যাশা শুধু এইটুকুই। শিল্প-সাহিত্য-সংসস্কৃতিচর্চার ক্ষেত্রে এমন বিভাজনের মানসিকতা থাকবে কেন? সৃষ্টিশীল জায়গা থাকে অসীম অর্থাৎ সীমাহীন। সেই সীমাহীন উদারদৃষ্টিতে এই বিষয়টি গুরুত্বসহ বাংলা অ্যাকাডেমি দেখবে, এমনটাই আশা করি।
আর যদি এভাবেই চলতে থাকে, তাহলে এখন থেকে অঞ্চলভিত্তিক লেখক দেখে দেখে মূল্যায়ন করা হোক। জায়গা বদল হলেই যদি শেকড়চ্যুত মনে করা হয়, তাহলে সেটা হবে হীন-মানসিকতার পরিচায়ক। যদিও এটা একধরনের রেইসিজম। তারমধ্যে প্রবাসী শব্দটাও পড়ে। মন-মানসিকতা উদার না হলে শিল্প-সাহিত্য সংস্কৃতি চর্চার কোনো মূল্য নেই। বাংলাদেশের সব রকম পুরস্কারের তালিকায় প্রবাসী লেখক শিল্পীদের বাংলাদেশের কাতারে রেখে সমমূল্যে মূল্যায়ন করা হোক।
বাংলা সাহিত্যের ওপর বাংলাদেশে প্রবর্তিত প্রতিটি পুরস্কার দেশে-বিদেশে অবস্থানরত প্রত্যেক বাংলাদেশি লেখকের জন্য উন্মুক্ত হওয়া উচিত। এ পর্যন্ত যারা সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন, তাদের অভিনন্দন জানাই। কিন্তু প্রবাসী লেখক হিসেবে অভিনন্দন জানাচ্ছি না। কারণ, তারা প্রত্যেকেই বাংলা ভাষার শেকড় থেকে উঠে আসা এবং তারা প্রত্যেকেই বাংলা সাহিত্যচর্চার একনিষ্ঠ কর্মী।