হাওর পাড়ের কইন্যা
শিয়ালের ভয়ে মেয়েটি অস্থির!
শিয়ালচোখের অন্তরালে যৌবনের রঙিন ফানুস মাথাচাড়া দিয়ে উঠলে রূপজান ভাবিত হয়; ভাবনার অথৈই সাগরে পতিত সে। অন্ধকার রাজ্যে থরে থরে সাজানো ভাবনাগুলো হাওয়ার বেগে তার নিজের মধ্যে প্রবেশ করে। ফলে অবসরের ক্ষণসমূহ ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যায়। ছায়াচিত্রের খণ্ডাংশ আষ্টেপিষ্টে লেপ্টে অস্তিত্বের সংকট বহুগুণে প্রকট হয়ে ওঠে। কতিপয় চোখ জোড়া কিছুতেই বেভুল হয় না তখন। মেয়েটি ঈর্ষান্বিত চোখে রামদার পানে তাকায়। হায়, দা’টার যেন ভরা যৌবন এখন! শরীরে উথালপাথাল ঢেউ। সূর্যের আলোয় এক একবার ঝিলিক দিয়ে ওঠে। সংকুচিত দৃষ্টিতে দা’র গায়ে হাত বোলায় রূপজান। মনের মধ্যে বিশেষ কোনো ভাবনা লাটিমের মতো ঘুরপাক খায়। ঘুরতে থাকে তার নিজস্ব পৃথিবী। রসুই ঘরের সামনে এসে ধারালো অস্ত্রটি এক ঝটকায় মাটিতে ফেলে দেয়। খুচরা পয়সার মতো ঝনাৎ করে শব্দ ওঠে। শব্দটাই বলে দেয়, আওলা বাতাস উঠবে এবার। এমনিতেই নানামুখী ঝামেলা, উপরন্তু নতুন করে শিয়ালের আনাগোনা! কদিন আগেও একটা তাড়া করেছিল কিন্তু অল্পের জন্য ধরতে পারেনি। রূপজান তথাপি অধৈর্য হয় না; শিয়ালের জন্য অপেক্ষা করে—অন্তত একটা শিয়াল কি সে ধরতে পারবে না!
চোয়াল শক্ত করে ডানে বামে বার কয়েক মাথা নাড়ে সে। ফুলি নিস্পলক দৃষ্টিতে মা’র মুখের পানে তাকিয়ে। কী এমন ভাবনা, যার কোনো আদি নেই অন্ত নেই! নাহ, মাথা-মুণ্ডু কিচ্ছু বুঝতে পারে না। মা’র সম্মুখে নিজেকে বড় অসহায় মনে হয়। চোখে চোখ পড়তেই চোখের পাতা মাটিবর্তী হয়ে ওঠে। অকারণে দাঁত দিয়ে নখ কাটে। ডান পায়ের আঙুল দিয়ে মাটি আলগা করে। রূপজান গলা ছেড়ে চিৎকার দেয়, অ্যাই ফুলি কী হইতিছে রে, হারামজাদাটা অমন কইরি কানতিছে ক্যান; এখনো সময় আছে, ওরে থামবার ক। মিজাজটা কিন্তুক ভালা না। আছাড় দিয়া ফ্যালাইয়া দিমু কইলাম!
মামুনকে থামানোর জন্য ফুলি প্রাণপণ চেষ্টা করে কিন্তু কাজ হয় না; উল্টো পান্তার বাটিতে লাত্থি মারে। সে এখন গরম খাবে; গরম ভাত। বোনের কোলে চড়ে মায়ের কাছে পুনপুন ভাতের আবদার করে, আমালে ভাট দেও মা, আমি ভাট খাব। আ আ আ…
পরিশ্রান্ত শরীরে এতসব জ্বালাতন রূপজানের সহ্য হয় না,ছেলেটাকে শূন্যে তুলে আছাড় মারে। চকির ওপর থেকে ফেলে দেয়। তারপর সর্বশক্তি দিয়ে কিলঘুষি চালায় আর অস্পষ্ট স্বরে গালমন্দ করে, কুত্তার বাচ্চার কত্ত বড় সাহস, পান্তার বাটিতে লাত্থি দেয়! ওই খানকির পোলাই কি জানবার পারে, পান্তার জন্য কত কষ্ট কইরিছি! নিজির পেট খালি কইরি ওর জন্যি রাইখি দিছি !
সংসারের জ্বালার সঙ্গে ছেলের গলা একাকার হলে দু’চোখে অন্ধকার নেমে আসে। আলোর প্রত্যাশায় দিগ্বিদিগ জ্ঞান থাকে না। কণ্ঠে বিলাপ, এত জ্বালাতন আর সহ্য হয় না। মরণ দেও খোদা, আমি মরবার চাই। দুনিয়াত থিকি তুইলি নেও।
চড়-থাপ্পড় খেয়েও ছেলের কান্নায় কোনো হেরফের হয় না। ভাতের দাবিতে অনড় সে। অগত্যা মামুনকে কোলে নিয়ে ফুলি পাশের বাড়ি চলে যায়। রূপজান কপাল চাপড়িয়ে নিরিবিলি কিছুক্ষণ কান্নাকাটি করে। আল্লাহর দরবারে অসংখ্য ক্ষোভ-আক্ষেপ তার। জন্মদাতার প্রতিও অভিমান! ধনীর ঘরে জন্ম নিলে জীবনের হিসাবটি নিশ্চয় অন্যরকম হতে পারতো; কিংবা বিনা চিকিৎসায় মরতে হতো না! অভিমানের আড়ালে চোখের পাতায় জলের ধারা। গাল বেয়ে ফোঁটা ফোঁটা জল চুয়ে পড়ে। রূপজান বাধা দেয় না,নোনাজলে বুকের কিয়দাংশ ভিজে ওঠে। এমন কান্নার অবশ্য কিছু ভালো দিকও আছে। বুকের নানারকম ক্ষোভ, দুঃখ জলের সঙ্গে বেরিয়ে যায়। দিল পরিষ্কার হয়। কাজেকামে উদ্যোম ফিরে আসে।
খালুই আর জাল হাতে রূপজান হাওড়ের পথ ধরে। এভাবে বসে থাকলে তো আর চলবে না! মাছ না ধরলে তিন তিনটি প্রাণী অভুক্ত থাকবে। যা দিনকাল পড়েছে, ক্ষুধার জ্বালায় কোলের শিশু চিৎকার করে কাঁদলেও কেউ একমুঠো ভাত দেয় না। হাওড়ের বুক চিরে সে অনেক দূর পর্যন্ত পৌঁছে যায়। চারদিকে অথৈই জলরাশি। জলের কাছে এলে রুপার মন্দ লাগে না; মনে হয় জল আর সে অভিন্ন! আর যাই হোক জলের কল্যাণে সংসারের অচল চাকা সচল রয়েছে, দু’মুঠো ভাতের বন্দোবস্ত হয়েছে। রূপজান একা না,তার মতো অসংখ্য মানুষের জীবন এই হাওড়ের কাছে বাঁধা। মাঝে মাঝে এও মনে হয়—হাওড়ই তাদের বাপ-মা; বাবা-মার আদর স্নেহে জনপদের মানুষগুলোকে বুকে আগলে রেখেছে। অভুক্ত মানুষের মুখে অন্ন তুলে দেওয়ার ব্যবস্থা করেছে। বছরে একবার মাত্র ফসল হয়। তা দিয়ে আর কদ্দিন! জোতদারদের খপ্পরে জলের কাছে আশ্রয় খুঁজতে বাধ্য হয়। আহা, জল আর জল!
বাতাস পড়ে গেলে হাওড়ের বুকে খুব অস্থির লাগে। সেদিন আর মাছ ধরায় মন বসে না, তিরতির করে শরীর ঘেমে ওঠে। কপালের জল হাওড়ের জলের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। যাদের নৌকা আছে তারা পাটাতনের ওপর গড়াগড়ি দেয়, ক্লান্তির রেশ কাটাতে পাতার বিড়িতে বুন্দার আগুন লাগায়। ইঞ্জিনচালিত বোটের পানে চোখ পড়তেই তার মনটা বিষিয়ে ওঠে। এটাও একপ্রকার শিয়াল যেন-বা! ভটভট আওয়াজ তুলে শিয়ালের মতো খিপ্র গতিতে পানি কেটে দু’ভাগ করে এগিয়ে চলে। ধাতব শরীরে ছলাত ছলাত ঢেউ আছড়ে পড়ে। রূপজানের বুকের মধ্যে আক্রোশের ঢেউ। ঘোর অন্ধকারে বিশেষ ওই নৌযানকে ডুবিয়ে দেওয়ার ভাবনা ভাবে। কেনোনা শান্ত হাওড়ের পাশে যন্ত্রটাকে বড় বেশি বেমানান লাগে। বাম হাত দিয়ে কপালের ঘাম মুছে রূপা আকাশের পানে তাকায়। মেঘ থাকলেও বাতাসের অভাব নেই। ডাঙা থেকে জলে ধোঁয়া বাতাস এসে শরীরময় লুটিয়ে পড়ছে।
আহ, কী প্রশান্তি!
মাথার ওপর দিয়ে একটা জলপাখি উড়ে যায়। হাওয়ার ডানায় ভর করে উড়ে যায় দুধ-সাদা মেঘের ভেলা! অন্যান্য দিনের তুলনায় মাছের আমদানি বেশ ভালো। তার জালে টপাটপ কতগুলো মাছ ওঠে। কী চমৎকার সব মাছ! খালুই’র মধ্যে মাছগুলো লাফালাফি করে—তার নিজের মধ্যেও খুশির উচ্ছ্বাস! একটু একটু করে মনের বিক্ষুব্ধ ভাব কেটে যায়। সে এখন নূপুরপরা কিশোরীর মতো উৎফুল্ল! গুনগুন করে গান আওড়ায়। ইউনিয়ন বোর্ডের এবড়ো-খেবড়ো হেরিং রাস্তা ধরে জলডাঙার দিকে হাঁটতে থাকে। স্থানীয় ফড়িগুলো বেজায় বজ্জাত। মাছের ঠিকঠাক দাম দিতে চায় না। নানারকম ফন্দিফিকির। ওজনেও হেরফের। শুধু ঠকানোর তালে ব্যস্ত। গতরে কষ্ট হলেও রূপা তাই জলডাঙায় যায়। যাচাই-বাছাই করে দরদাম করতে পারে। তাতে দুটো পয়সা বেশি আসে।
বাড়ি ফিরতে ফিরতে অনেক রাত। দূর থেকে পিদিমের আলোয় মামুনের মুখটা স্পষ্ট দেখা যায়। ভাই-বোন মিলে সুর করে কবিতা আওড়াচ্ছে। রূপাকে দেখে ছেলে তার গলা জড়িয়ে ধরে; আদুরে গলায় জিজ্ঞেস করে, এটো ডেলি কল্লি ক্যান মা?
সকালের মারের কথা আর মনে নেই। ভালোবাসার ছোঁয়ায় সব ভুলে গেছে। মামুনের গালে মুখে রূপজান চুমা দেয়। কোলের মধ্যে নিয়ে আদর করে। মিহি সুরে মেয়ের নাম ধরে ডাকে, ফুলি, এই ফুলি।
রসুই ঘরের দুয়ার বন্ধ করে ফুলি মায়ের সামনে এসে দাঁড়ায়। চোখে চোখ রেখে জিজ্ঞেস করে, কী বলতিছ মা?
কিছু রানছিস?
হ, রানছি; তয়, এখনো খাইনি।
রূপার মেয়েটা বড়ই লক্ষ্মী। সহজ সরল। কাজে কামে উদ্দাম আছে। মায়ের সঙ্গে এক আধদিন মাছ ধরতেও যায়। ফিরতে দেরি হলে উৎকণ্ঠার প্রহর গোনে। বাড়ির সামনের রাস্তায় চোখ রেখে দহনের বাষ্প ঝরায়। চোখের পাতায় কাতরতা। বকাঝকা যাই করুক, মাকে ছাড়া ঘরবাড়ি ফাঁকা মনে হয়; শূন্য।
তৃপ্তি করে খায় ওরা। তারপর শুয়ে শুয়ে ঘুমপাড়ানি গান করে। হরেক পদের গল্প শোনায়। ছেলে মেয়ে ঘুমালেও অনেক রাত পর্যন্ত রূপার ঘুম হয় না। থেমে থেমে দীর্ঘশ্বাস পড়ে। মাথার মধ্যে অগোছালো চিন্তা। মেয়েটা ডাঙর হয়েছে। ওর স্ফীত বুকের দিকে তাকালে ভয় হয়। কখন যে কার কুদৃষ্টি পড়ে, ঠিক-ঠিকানা নেই! মেয়ের সমবয়সী একদল ছেলে আশেপাশে ঘুরঘুর করে। রূপজানের সঙ্গেও খাতির জমাতে চেষ্টা করে কিন্তু পাত্তা পায় না। কৌশলে এড়িয়ে চলে। সময়ের জন্য অপেক্ষা করে।
রূপা চিন্তিত। অন্ধকারে বাড়ির চারপাশে পায়চারী করে। তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে কি যেন অনুসন্ধান করে। আনমনে হাওড়ের তীরে এসে দাঁড়ায়।
ভরা বর্ষা মৌসুম। মেঘের আড়ালে নক্ষত্রগুলো হারিয়ে গেছে। অথৈই জলের ঢেউ এসে পায়ের কাছে হুমড়ি খেয়ে পড়ে। হয়তো বশ্যতা স্বীকার করা। কিন্তু রূপজান একথা বিশ্বাস করে না। মেয়ে মানুষের মতো হাওড়েরও ষোলকলা; ক্ষণে ক্ষণে ওরা খেলা দেখায়—ষোলকলার খেলা! জন্মের পর থেকে রূপা এই খেলা দেখে আসছে।
ফুলির বাপের কথা মনে হয়; এমন বর্ষা মৌসুমে হাওড়ের বুকে মানুষটা একদিন মাছ ধরতে গিয়েছিল আর ফিরেছিল লাশ হয়ে। মামুন তখন কোলে।
পূবালী বাতাসে শরীরটা হীম হয়ে যায়। লোমগুলো কাঁটা দিয়ে ওঠে। জীবনের ওই দুঃসহস্মৃতি ধবল মেঘের মতো সারাক্ষণ তার পিছু নেয়। রূপজান দৌঁড়ায় আর দৌঁড়ায়। দৌঁড়ে দৌঁড়ে ক্লান্ত, অবসন্ন সে। বুঝতে পারে না, আর কত ছুটবে, কোথায় তার গন্তব্য! গন্তব্য খুঁজে খুঁজে মেয়েটি হয়রান। মাঝে মাঝে মনে হয় পৃথিবীটা অর্থহীন; মরণের গহীন অরণ্যে হারিয়ে যাওয়ায় বোধহয় জীবনের একমাত্র ধর্ম। বাকি সব মিথ্যা।
অভিমানে কান্না পায়, মানুষটা ক্যান মইরিছিলু!
অলিক ভাবনা কেটে গেলে রূপজান বাস্তবের মাটিতে ফিরে আসে। সন্তানদের ভবিষ্যৎ চিন্তা করে বিচলিত হয়। বাবাহীন সন্তান। এতিম। যা করার তাকেই করতে হবে।
যেদিন কাজে-কর্মে মন বসে না, অফুরন্ত অবসর থাকে রূপজান; সেদিন রামদাটায় ধার কাঁটে; ঠিক আছে কি না হাত বুলিয়ে পরখ করে। দা নিয়ে ফুলির মধ্যে অসংখ্য কৌতূহল। সন্তর্পণে মায়ের পাশে এসে দাঁড়ায়। অবাক হওয়ার ভঙ্গিতে গালে হাত রেখে প্রশ্ন করে, ওমা, ইডা দিইয়ে তুমি কী করবা শুনি?
রূপা আঁড়চোখে মেয়ের মুখের পানে তাকায়। একটু ভেবে উত্তর দেয়, ইডা দি শিয়াল কাঁইটব।
আইচ্ছা, আজও কি একখান শিয়াল মাইরিছ!
রূপজানের হাতের মুষ্টি আপনা-আপনি বন্ধ হয়ে যায়। উত্তর দিতে গিয়ে শক্ত চোয়াল আরও শক্ত হয়ে আসে, নাহ! বার বার ফস্কাইয়ি গিইছে, তয় এইবার আর না; শিয়ালের জন্যি সারারাইত কান খাড়া কইরি শুয়ি থাকি, একবার সুযোগ পাইলি হয়, কচুকাটা কইরি ফেলামু!
রূপজান দৃঢ় প্রত্যয়ে রামদাটা বুকের সঙ্গে জড়িয়ে ধরে। বিস্ফোরিত চোখ। ঘন ঘন শ্বাস-প্রশ্বাস। ফুলির বাপ যেবার মারা যায়, সেবার হঠাৎ করেই শেয়ালের আনাগোনা বেড়ে গিয়েছিল। সন্ধ্যা নামলেই বাড়ির আনাচে-কানাচে ওঁৎ পেতে বসে থাকতো। টর্চের আলোর মতো জ্বল-জ্বলে চোখ। লোলুপ দৃষ্টি। কখনো একা, কখনো বা দল ধরে আসতো। তৃষ্ণার্ত বুকে আঁকুপাঁকু করতো। ভয়ে রূপার ঘুম হতো না। পিদিমের আলোয় রক্তে আগুন ধরতো। ভাগ্যিস রামদাটা ছিল, তা না হলে শরীরটা ছিঁড়ে ফুঁড়ে খেত। জীবনের ওইসব দিনগুলোর কথা মনে হলে রূপজান এখনো আঁতকে ওঠে। মাঝে মাঝে মনে হতো সে বাঁচবে না; শিয়ালগুলো তাকে বাঁচতে দেবে না। কতদিন পালিয়ে যাওয়ার কথা ভেবেছে কিন্তু সে ভাবনাও ছিল অস্থায়ী। শিয়ালহীন পৃথিবী তার কল্পনারও অতীত! নিরুপায় হয়ে মাজা শক্ত করে দাঁড়িয়েছে, যুদ্ধের মন্ত্র জপেছে। এই মন্ত্রটা ফুলির জানা দরকার; হয়তো কাজে লাগবে। অলস মূহূর্তে রূপজান মেয়েকে পাশে ডেকে বসায়; দা’টা হাতে দিয়ে বলে, আমি যখন থাকব না তখন এই দা তোর হবে। আমার মতো তোকেও শিয়াল কাটতি হবে; বল, পারবি না!
ভয় ও শঙ্কা যুগপৎ ফুলিকে আঁচড় কাটে। শরীরের লোমগুলো শিউরে ওঠে। মুখ দিয়ে কথা সরে না; ঘোরলাগা চোখে দাঁড়িয়ে থাকে। মা’র কথা ঠিকঠাক বুঝতে পারে না।
দু-দিন ধরে ছেলেটার জ্বর। এই নিয়ে মা-মেয়েতে বাদানুবাদ হয়, কাজ নি, কাম নি, সারাদিন কী করিস তুই; ভাত খাইতি লজ্জা করে না?
ক্যান, কী কইরিছি আমি?
কী কইরিছিস মানে! মামুন্যারে দেইখি রাখতি পারিসনি; হাওড়ের জলে ভিঁইজি ভিঁইজি যে জ্বর বাঁধাইছে!
নিচু গলায় ফুলি তার মা’র কথার প্রতিউত্তর করে, ও জ্বর বাঁধাইছে তয় আমি কী করুম? তুমার ছাওয়াল কি আমার কথা শুনবার চায়? তেঁচোখা মাছের লাইগি ছুঁইটি বেড়ায়।
ক্রোধের উত্তাপে রূপজান ফুঁসে ওঠে। মেয়েকে উদ্দেশ করে গালিগালাজ করে, ও ছুঁইটি বেড়ায় আর তুই ঘোড়ার ঘাস কাঁটিস, তাই না? লজ্জা শরম কিচ্চুনি; মাগী খালি পাড়ায় পাড়ায় ঘুইরি বেড়ায়! তোর ভাত খাইতি লজ্জা করে না!
ফুলি নির্বাক। মায়ের পানে তাকাতেও তার ভয় হয়। মনটা মেঘলা আকাশের মতো ভারী। অন্ধকার। অভিমান করে সারাদিন ভাত খায় না। ঘরের দাওয়ায় বসে অঝোরে চোখের জল ফেলে। মামুন ফুলির কাঁধ ঝাঁকিয়ে জিজ্ঞেস করে, কিলে ডিডি, তুই কান্টিছিস?
গালায় ঝাঁঝ মিশিয়ে ফুলি বলে, হ কানতিছি। তোর জন্যিই তো মা আমাকে বকতিছে।
মামুন ওকে সান্ত্বনা দেয়, কাঁন্ডিসনি ডিডি, মা বকলি কাঁন্টি হয় না।
মামুনকে নিয়ে ফুলি শালুক তুলতে যায়। সকাল থেকে কিছু খাওয়া হয়নি। কাঁচা শালুক চিবিয়ে-চিবিয়ে ক্ষুধা নিবারণ করে। শালুক চিবাতে দেখে মামুন ফোকলা দাঁতে হাসে, তারপর কাছে সরে এসে জিজ্ঞেস করে, খাঁটি কেলাম লাগছে লে ডিডি?
খুউব মজা; তুই খাইবি?
মামুন মাথা ঝাঁকায়, না, আমি মাছ ঢলবো; যাবি আমাল সাটে?
ফুলি রাজি হয় না। মা বকবে। ভাইটাকে টানতে টানতে বাড়ি নিয়ে আসে। মায়ের জন্য অপেক্ষা করে।
উঠানে যেন কেউ একজন দাঁড়িয়ে!
রূপজান সারসের মতো ঘাড় উঁচু করে তাকায়। আবছা অন্ধকারে লোকটাকে ছায়ামূর্তি মনে হয়। গলা উঁচিয়ে হাঁক ছাড়ে, এত রাইতি কিডা ওখানে?
লোকটি খুশ খুশ করে কেঁশে তার উপস্থিতি জানান দেয়, রূপা বু আমি; আমি মজু ব্যাপারি।
রুপা খানিকটা হতাশ হয়! কিংবা এইমাত্র একটা শিয়াল যেন তার হাত-ফসকে বেরিয়ে গেল!
অ মজু; তা এত রাইতি কী মনে কইরি?
এদিক দিয়ে যাইতিছিলাম, তাই ভাবলাম তোমার সঙ্গে একটু গপ্ সপ্ করি।
ব্যাপারি চৌকাঠের ওপর বসে। এক খিলি পান মুখে পুরে গরুর মতো জাবর কাটে, বুজান, খাইবা নাকি এক খিলি? জব্বর মিঠাই, গঞ্জ থ্যিইকা লইয়ি আইছি।
পানের প্রতি রূপার অরুচি, না, আমি খাইতাম না। মাথার মইধ্যে চক্কর দেয়, চক্ষে আন্ধার দেখি।
ক্যান, কী হইতিছে তুমার?
রূপা উত্তর দেয় না। মজুকে লক্ষ করে। লোকটা আড়চোখে কাকে যেন খুঁজছে!
রূপা বু; ফুলি কই, তারে দেখতিছিনি তো?
রূপার তাচ্ছিল্লমাখা কণ্ঠস্বর, ঘুমাইতিছে।
মজু ব্যাপারি উচ্চস্বরে হাসে; অকারণ হাসি। ফুলির প্রশংসায় পঞ্চমুখ সে, খুব লক্ষ্মী ম্যাইয়ি। মাইনষের মুখে মুখে সুনাম। দেখতি নাকি রাজকন্যির মতন! এক্কেবারে তুমার গড়ন পাইছে।
রূপজানের হাতদুটো নিশপিশ করে। চোখেমুখে আগুনের ফুলকি। ব্যাপারি লোকটাকে তার একদম পছন্দ হয় না। ডিঙি নৌকো ফেলে ইদানিং ট্রলারের পেছনে ঘুরঘুর করছে। মহাজনের হয়ে দালালি আরম্ভ করেছে। ব্যাপারিকে ইঙ্গিত করে সে বলে, মজু, তুমি কি কিছু কইবার চাও?
মজুর মধ্যে দ্বিধা। লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,কী আর কইবোরে বোইন! তুমাগোরে ল্যাইগি দুঃখ হয়, বুকির মইধ্যি ফাঁইটি যায়। আহারে, ফুলির বাপ থাকলি কী আর এমুন হইতো? তুমার বাড়িত চাঁন্দের বাজার বসতো।
রূপজান ইচ্ছে করে প্রসঙ্গ বদলায়, ও মজু, তুমার বৌ কি বাড়িত নাই?
মজুর মুখে শুষ্ক হাসি, ক্যান, তুমি জানো না; হেই তো ম্যালাদিন থ্যাইকা বাপের বাড়ি। পয়লা পোয়াতি। তাই বাপ মা এইখানে রাখবার চায় না।
রূপার মনটা অন্ধকারের মধ্যে মিশে যায়। বুকের মধ্যে গুমরে ওঠে। রাতে ভালো ঘুম হয় না। হাওড়ের বুকে এলোমেলো বাতাস। মনে হয় বাতাসটা বড় অপয়া; অলক্ষুণে। মাছ ধরার ফাঁকে ফাঁকে গভীর দৃষ্টিতে মেয়ের পানে তাকায়। মজু ব্যাপারি মিথ্যা বলেনি, তার মেয়েটা সত্যি সত্যি সুন্দরী; রাজকন্যার মতো। হাতের ইশারায় ফুলিকে কাছে ডাকে।
ডাকতিছ মা ?
হ, আমাগোরে বাড়িত কি মজু ব্যাপারি আইসে?
কয়েক মুহূর্ত ভেবে ফুলি উত্তর দেয়, হ আইসে?
কী কইবার চায় লোকটা?
রূপজানের জলে ভেজা শরীরে আগুনের আঁচ অনুভব করে। জাল বিছানো বন্ধ করে মাজা শক্ত করে দাঁড়ায়। শ্বাস-প্রশ্বাসের গতিবেগ হঠাৎই উর্ধ্বমুখী হয়। পুনরায় মেয়েকে জিজ্ঞেস করে, কিরে, কী কইবার চায় সে!
ফুলির সরল অভিব্যক্তি, নাহ, বুঝবার পারিনি।
না বুঝবার কী আছে!
কিচ্ছু না, রং ঢংয়ের কতা। ব্যাপারি নানা কিছিমের ঢংয়ের কতা কইতি পারে।
কয়েক মূহূর্ত ভেবে মা’কে জিজ্ঞেস করে, আইচ্ছা মা, তুমি কি সিনিমা দেইখিছো!
হ, দেখছি। ক্যান?
আমারে একদিন যাইতি দিবা! খুব দেখবার মন চায়। সুরুজ ভাই কইছিল সে নাকি আমারে লইয়ি যাবি। ট্যাকা পয়সাও লাগবি না।
সুরুজ!
হুম।
সুরুজ আর কী কয় তোকে?
নাহ, আর কিচ্ছু না। দেখা হইলি খালি তুমার কতা জানবার চায়। ছাওয়ালডা খুব ভালা, তাই না মা?
ফুলি মাছ ধরায় মনোনিবেশ করে। রূপা তখনো দাঁড়িয়ে। হয়তো গভীরভাবে মেয়ের মনের ভেতরটা পড়ার চেষ্টা করে! দিন দিন কেমন বদলে যাচ্ছে। মতিগতি বোঝা দায়! তার মনের ভিতরটা কি ক্রমশ রঙিন হয়ে উঠছে! নাকি প্রেমে পড়েছে! ইদানিং গুনগুন করে গান আওড়ায়। প্রেম ও বিয়ে বিষয়ক প্রসঙ্গ উঠলে তন্ময়তায় ডুবে যায়। অথচ কিছুদিন আগেও এমন ছিল না!
কইন্যা কি কারও জন্য অপেক্ষা করে?
নাহ, মনের ভেতর থেকে উত্তর আসে না। মেয়েও নিরুত্তর। কাকে সন্দেহ করবে সে? মেয়ে না নিজেকে! যদি কোনো অঘটন ঘটে;কারও প্রেমের ফাঁদে পা বাড়ায়; বংশের মুখে চুনকালি মাখায়!
রূপজান চিন্তিত। ঘরে বাইরে কোথাও স্বস্তি নেই। মাছ ধরতে বা বাজারে গেলে মনের ঘরে অন্ধকার বিরাজ করে। নানামুখী আশঙ্কা মাথার মধ্যে ঘুরপাক খায়। গরিব মানুষের এত রূপ থাকতে নেই, পদে পদে যন্ত্রণা। ফুলিকে আজকাল চোখে চোখে রাখে। সন্ধ্যার আগেই জলডাঙা থেকে ফিরে আসে। জীবনের খুটিনাটি বিষয়ে মা-মেয়েতে আলাপ করে। যা বলার রুপাই বলে ফুলি কেবল শ্রোতা। মার দুর্ভাগ্যের কথা শুনে সে ব্যথিত। এক জীবনে আর কত সংগ্রাম! সুখের আশায় যে মানুষটা পথে নেমেছিল তার জীবনে সুখ কেবল মরীচিকা। মরীচিকা বিষয়ে রূপজান আর ভুল করতে চায় না। ফুলির জীবনে ফুল প্রয়োজন, তীব্র গন্ধময় ফুল—যে ফুলের ঐশী ঘ্রাণে প্রাণ আকুল হবে!
ভাটির পথে হঠাৎই উজানের টান। তার ফেরা অনিশ্চত। পরিবেশ প্রতিবেশ তার প্রতিপক্ষ। আকাশের পানে তাকিয়ে বিচলিত হয়। মেঘগুলো পাথরের মতো ভারী আর অনেক নিচে নেমে এসেছে। একটু পরেই হয়তো বৃষ্টি নামবে। বাজার শূন্য করে যে যার মতো ঘরমুখো। তবু একটু দামের জন্য রূপা অপেক্ষা করে। কিন্তু খদ্দেরের অভাব। মোটা মোটা ফোঁটায় দড়বড়িয়ে বৃষ্টি নামে; প্রথমে আস্তে তারপর জোরে জোরে। নিজেকে রক্ষার জন্য সে এদিক ওদিক দৌঁড়ায়; মানকচুর পাতার আড়ালে লুকায়। জলডাঙা থেকে ভরাম—রাস্তাটা মুখস্থ। জন্মের পর থেকেই যাতায়াত করছে। তরল অন্ধকারে চোখের পলকে কয়েকটা বাঁক পার হয়ে সম্মুখে এগোয়। স্থানে স্থানে পানি জমে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। জলার ওপর ছলাত ছলাত পা ফেলে সম্মুখে এগোয়। হঠাৎ একটা দমকা হাওয়ায় কচুর পাতা উড়ে যায়। বৃষ্টির কাছে রূপা এখন সম্পূর্ণ অসহায়। কতদিন ভাবে একটা ছাতা কিনবে, কিন্তু সাধ্যে কুলায় না। গরিব মানুষের সাধ আহলাদ খুব সীমিত, অথচ পূরণের ব্যবস্থা সুদূর পরাহত। বাড়ির জন্য চিন্তা হয়। দুদিন ধরে ডিব্বায় তেল নেই। ছেলে মেয়েগুলো বোধহয় ঘোর অন্ধকারে! সে নিজেও অন্ধকারের রাজ্যে হারিয়ে যেতে থাকে। তীব্র হতে থাকে বাতাসের গতিবেগ। ওই গতির সাখে সে কিছুতেই পেরে ওঠে না। দুর থেকে মেয়েলি কণ্ঠের চিৎকার ভেসে এলে রূপজান থমকে দাঁড়ায়। শরীরময় তোলপাড় শুরু হয়। ঝুলে পড়া শাড়ির আঁচল মাজার সঙ্গে পেঁচিয়ে বাঁধে।
রূপজানের এবার অবাক হওয়ার পালা; এমন অবাক আগে কোনোদিন হয়েছে কি না মনে করতে পারে না!
উঠানে আসতে না আসতে শূন্য খালুইটা হঠাৎ’ই তার হাত থেকে খসে পড়ে। বাইরে ঝড়ো হাওয়া আর ঘরের মধ্যে গোঙানীর শব্দ। চৌকাঠের পশ্চাতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে কিছু লিপিষ্টিক, চুড়ি, চুল বাঁধার ফিতা। ঘরের ভেতরে চোখ রাখতেই নিমেষে দৃষ্টি সরে আসে রূপজানের। রসুই ঘরের পানে পা বাড়ায়। এক পলকে যা দেখেছে তা তার পক্ষে হজম করা সম্ভব নয়। শিয়ালটা জোঁকের মতো ফুলির শরীরের সঙ্গে লেপ্টে আছে। মেয়েটি গলাকাটা মুরগির মতো হাত-পা ছুড়ে লাফাচ্ছে। কাতর কণ্ঠে অনুনয় বিনয় করছে। কিন্তু কে শোনে কার কথা! ফুলির আহাজারি শূন্যে প্রতিধ্বণিত হয়।
আদিম উল্লাসে দাঁত বিচড়িয়ে হাসেন মশাই। বুকে যেন রক্তপিপাসা! আরেক পলক তাকায় রূপজান।
আর কত! আর কত!
আর কতক্ষণ সে নিজেকে ধরে রাখবে!
নিঃশ্বাস বন্ধ করে ঘাড় বরাবর রামদাটা বসিয়ে দেয়। ব্যাস, এক কোপেই শেষ! শরীর হতে কল্লাটা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে।
ফুলি বাকরুদ্ধ। হাত-পা সব থরথর করে কেঁপে ওঠে। ঘটে যাওয়া ঘটনা পুনরায় মনে করার চেষ্টা করে কিন্তু পারে না। মনে হয়, পৃথিবীর কোন প্রান্তে যেন ভুমিকম্প শুরু হয়েছে; যেন এই মুহূর্তে পৃথিবীটা ধ্বংস হয়ে যাবে! অথচ রূপার মধ্যে কোনো ভাবান্তর নেই, কোনো অনুশোচনা নেই! লাশের ওপর হাত উঁচিয়ে নাচানাচি করে। গলা ফাটিয়ে চিৎকার দেয়, কে কুথায় আছ গো, তুমরা দেইখি যাও; আমি শিয়াল মাইরিছি- জব্বর একখান শিয়াল!
রূপজানের ছোট্ট আঙিনাটা লোকে লোকারণ্য হতে সময় লাগে না। শুধু মানুষ আর মানুষ। কারও মুখে কথা নেই। শরীর থেকে ফোঁটায় ফোঁটায় কাঁচা রক্ত চুইয়ে পড়ছে।
পুলিশ আসতে আসতে দুপুর। রূপজানের হাতে হ্যান্ডক্যাফ লাগায় তারা। মহিলাটি একবারও আপত্তি করে না। পুলিশের পানে নিষ্প্রভ দৃষ্টিতে একবার তাকায় মাত্র। তারপর স্থির দৃষ্টিটা ধীরে ধীরে অন্যত্র সরিয়ে নেয়। রাতের বৃষ্টিধারা এখনো ঝরছে। মাথার লম্বা চুল বেয়ে ফোঁটায় ফোঁটায় বৃষ্টির জলে গড়িয়ে পড়ে। চেনাজানা মানুষ তাকে দেখে হতবাক হয়। কেমন অচেনা রূপ রূপজানের! অনেক বেশি শান্ত ও নির্ভার। ফুলির বাপ যেদিন মারা যায়, সেদিনও এমন শান্ত ও নির্ভার মনে হয়েছিল!
দারোগার জামা ধরে অবোধ শিশু মামুন টানাটানি করে, ওগো পুলিশ আমাল মা’কে টুমলা কনে নি যাবা? মা না ঠাক্লি আমাগেলে কিডা ডেকবিনে?
পুলিশের মুখে কোনো উত্তর নেই। হাওড়ের বুক চিরে রূপজানকে বহনকারী ইঞ্জিনচালিত নৌযানটি থানা সদর অভিমুখে এগিয়ে চলে। অন্যদিন হলে নৌযানের গাঁ’এ থুতু ছিটাতো কিংবা লাথি মরতো কিন্তু আজ আর তা করে না। তার চোখের অভিমুখ কেবল শিয়ালচোখ! জনতার কোলাহল ছাঁপিয়ে ইথারে-ইথারে ছড়িয়ে পড়ে ফুলি আর মামুনের অসহায় আর্তনাদ। রূপজান নিজেও উত্যক্ত; বাতাসের ডানায় ভর করে দুর থেকে ভেসে আসে তার কণ্ঠস্বর, ওই ফুলি, কাঁনতিছিস ক্যান, তর চোখের পানির কোন মুল্যি নি; ওই পানি মুইছি ফেল। তোর এখন ম্যালা কাম; আমার মতো শক্ত হ। মামুন্যারে বড় করতি হবি। শিয়াল মারতি হবি! শিয়াল!
মৈত্রী এক্সপ্রেস
হুস হুস আওয়াজ তুলে মৈত্রী এক্সপ্রেস ছুটে চলেছে। সঙ্গে অস্থিরতা; অস্থিরতার কারণ জানতে চেয়ে মিথিলা নিরাশ হয়। মিলা নির্বিকার। চুপচাপ। সারি-সারি তালগাছ আর উঁচু-নিচু টিলা পিছনে ফেলে ট্রেনটি অবশেষে বাংলাদেশ সীমানায় প্রবেশ করে। অস্থিরতার মাত্রা বহুগুণে বৃদ্ধি পায় তখন। মনের মধ্যে যুদ্ধজয়ের অনুভূতি। যুদ্ধই বটে! পরাজিত হলে ফেরার পথ হয়তো আজন্মের মতো রুদ্ধ হয়ে যেত! কিংবা গহীণে হারিয়ে যেত কতিপয় শুভ সম্ভাবনা। সম্ভাবনার স্বপ্ন বুকে নিয়ে মেয়েটি উজানের পথ হাঁটে। যে জন্মের জন্য এতদিন ক্ষোভ-আক্ষেপ ছিল, মুহূর্তে তা জলের সঙ্গে মিশে যায়। শরীর বেয়ে নোনাজল চুইয়ে পড়ে। খুশিতে মিলার তনুমন নেচে ওঠে। বুকভরে শ্বাস নেয়।
আহ বাংলাদেশ, প্রিয় বাংলাদেশ!
চারদিকে মুগ্ধতার আবেশ, প্রাণের স্পন্দন। নয়নের সীমানায় বিস্তীর্ণ ফসলের মাঠ। পুবের হাওয়ায় পাকা ধানের শীষগুলো নুয়ে পড়েছে। আসন্ন শীতে প্রকৃতির সর্বত্রই বিরহের বসন। মাথার উপর দিয়ে ঝাঁক বেধে উড়ে যায় বুনো টিয়া। মিলা তন্ময় হয়ে পাখিগুলোর পানে চেয়ে থাকে। আচ্ছা, পাখিগুলোর গন্তব্য কোথায়; নাকি ওরাও তার মতো শিঁকড়চ্যুত বৃক্ষ!
শিকড়চ্যূত বৃক্ষের সঙ্গে নিজেকে তুলনা করে বিস্বাসে ভরে ওঠে মন। নিয়তির ওপর দায়ভার চাপিয়ে স্বস্তি ফিরে পেতে তৎপর। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে ওই চেষ্টা সফল হয় না। শিকড়চ্যুত বৃক্ষ জন্মের ভূগোল ভুলে যায়; ভুলে যায় শিকড়ের টান। পরগাছা হয়ে আর কতদিন?
মিলা আনমনে মাথা ঝাঁকায়। দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে গেলে মুখটা অন্যদিকে সরিয়ে নেয়। মৈত্রী এক্সপ্রেসের কামরা জুড়ে কেবল বিষণ্ন বাতাস; বুকের গহীণে তীব্র ব্যথা। শ্বাস-প্রশ্বাসের গতিবেগ দ্রুত ওঠানামা করে। মিলা তখন মিথিলাকে কোলের মধ্যে টেনে নেয়।
মামার জন্য কষ্ট হচ্ছে?
আর কষ্ট; মাটির সঙ্গে মিশে যাওয়া মানুষের জন্য আবার কষ্ট! মাটিতে নাক দিয়ে ঘ্রাণ নিতে ইচ্ছে করে। অতীত হয়ে যাওয়া মানুষগুলোকে হয়তো এভাবেই খুঁজে পাওয়া সম্ভব! কিন্তু লোকমুখে যা শুনেছে,এদেশের মাটি তার স্বকীয়তা হারিয়েছে। শুধু মাটি নয় সাগরের জলেও রক্তের ঘ্রাণ। ঘ্রাণ নিতে বদ্ধ পরিকর মিলা। কেউ ছেলেমীপনা ভাবলে ভাবুক, তাতে তার মাথাব্যথা নেই। মনের সঙ্গে আর কোন আপস নয়। তাছাড়া মন খারাপ নতুন কিছু নয়, প্রায়ই হয়। অবশ্য আজকের অনুষঙ্গ অন্যরকম। নির্জন মূহুর্তে অনেকগুলো চোখ তার স্মৃতির পর্দায় উঁকিঝুঁকি মারে। সর্বনাশা যুদ্ধের চিত্র মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। অনুভূত হয় লাশের গন্ধমাখা উৎকট বাতাসও। সারা আকাশ জুড়ে যেন শকুনের আনাগোনা! কালিদাসপুরের ঘরে-বাইরে লাল রক্তের স্রোত; কলতলায় পড়ে আছে বাবা মা’র ক্ষত-বিক্ষত লাশ।
মিলা অসংখ্যবার শিহরিত হয়। ভাবতে কষ্ট হয়, তাদের একটি সংসার ছিল; সুখের সংসার। ভালোবাসার আকুলতা এখনো তার ব্যাকুলতায় আঘাত করে। জীবনের ওইসব দিনগুলোতে বার বার ফিরে যায় ফিরে আসে। স্মৃতির আঙিনায় উজ্জ্বল হয়ে বিশেষ একটা মুখ। প্রাণচঞ্চল ওই মুখটা কিছুতেই বেভুল হয় না। মিলা স্পষ্ট দেখতে পায় সবকিছু। শাহেদকে নিয়েই তো ধল প্রহরের আগে দিঘির জলে শাপলা তুলতে যেত! রাতের পর রাত এক আকাশের নিচে বসে গল্প করতো, জীবনের ছবি আঁকতো। ভাবলে মনে হয় সেদিনের কথা: অথচ মাথার ওপর দিয়ে কত মেঘ উড়ে গেছে!
আগন্তুকের উপস্থিতিতে তার ভাবনায় সাময়িক ছেদ পড়ে।
মিলার ভাড়া করা কামরায় হঠাৎই একজন আগন্তকের অনুপ্রবেশ। মিলা না করতে পারে না; কেননা লোকটির একটা পা নেই- পঙ্গু। তবু মনের মধ্যে উচাটন। যা দিনকাল পড়েছে মানুষকে বিশ্বাস করা কঠিন। লোকটিকে তার অসহ্য লাগে। অজানা আশঙ্কায় মনের মধ্যে আনচান করে। যদি চোর-ডাকাত হয়! মিলা আড়চোখে লোকটিকে নিরীক্ষণ করে। বেশভূষায় চোরের সাখে খুব বেশি অমিল নেই। তাকানোর ভঙ্গিমাও দৃষ্টিকটু। দাঁড়ি-গোঁফের আড়ালে চোখদুটো বার বার জ্বলে ওঠে! অস্বস্থি বোধ করে সে। নির্লজ্জের মতো মিলার পানে তাকিয়ে রয়েছে। কোনোদিন যেন মেয়ে মানুষ দেখেনি! আগন্তুকই প্রথম কথা বলে,আমাকে দেখে খুব রাগ হচ্ছে তাই না? আসলে আপনি একা না, পঙ্গু মানুষ দেখলে সবারই এমন হয়; আমার নিজেরও।
মিলা মনে মনে হোঁচট খায়। লোকটি কি তার মনের কথা পড়তে পারছে; নাকি নিজেকে জাহির করছে! পঙ্গু লোকটি নিজেই মিলাকে আস্বস্ত করে, ভয় নেই ম্যাডাম, কিছুদুর গিয়েই নেমে পড়বো।
লাইটারের আগুনে সিগারেট ধরায় লোকটি। আনমনে কয়েকটা টান দিয়ে কুণ্ডুলী পাকানো ধোঁয়ার পানে তাকিয়ে থাকে। মিথিলার চোখও ধোঁয়া অভিমুখে। কামরার বাতাসে একটু একটু করে নিকোটিনের বিশেষ ঘ্রাণ মিশে যাচ্ছে। বদলে যাচ্ছে আবহ। মিলা প্রতিবাদী হয়ে ওঠে, দেখুন, এটা আমার ভাড়া করা কামরা; যা খুশি তা করতে পারেন না। দয়া করে অন্য কোথাও বসুন। তাছাড়া সিগারেটের গন্ধ আমার সহ্য হয় না।
কয়েক মুহূর্ত চিন্তা করে জানালার বাইরে সিগারেট ছুঁড়ে মারে। তার নিজের ভিতরেও অনুশোচনা। মিলার কাছে দুঃখ প্রকাশ করে, ছরি ম্যাডাম, বাচ্চাটার সামনে আমার সিগারেট ধরানো ঠিক হয়নি।
মিথিলার মুখে একটু একটু করে কথা ফুটতে শুরু হয়েছে। আম্মুর ইশারা অমান্য করে আগন্তুকের পাশ ঘেঁষে জানালায় উঁকিঝুঁকি মারে। প্রকৃতির নানাবিধ অনুষঙ্গ তার শিশুমনে দোলা দেয়। আম্মু ও আগন্তুকের সঙ্গে কৌতুহল ভাগাভাগি করে নেয়। অসংখ্য প্রশ্ন তার মনের দরজায় ঢুঁ মারে। প্রশ্নগুলো অপ্রাসঙ্গিক। মিলা বিরক্ত হয়। আগন্তক নিজের মতো করে উত্তর দেয়; মেয়েটির কৌতূহল নিবৃত করে। মিষ্টি মধুর কলতানে মৈত্রী এক্সপ্রেসের ছোট্ট কামরাটি পুনরায় যেন প্রাণ ফিরে পায়, চাচ্চু, তোমার আরেকটি পা কোথায়?
আগন্তুক অস্বস্তিতে পড়ে। বুঝতে পারে না, কী জবাব দেবে। মিলার ঠোঁটের কোণে বাঁকা হাসি, কোথায় আবার; চুরি-টুরি করতে গিয়ে বোধহয় কাটা পড়েছে!
ঠিক এমন একটি সুযোগের জন্যই সে অপেক্ষা করছিল। মনে মনে চিন্তা করে উচিত শিক্ষা দিয়েছে। নিশ্চয় তার ভিতরকার জ্বলে ওঠা তেজ নিভে যাবে! কিংবা লজ্জা আড়াল করতে কামরা ছেড়ে চলে যাবে! অথচ এখানেও লোকটি অন্যরকম; মিলার কথা গায়ে না মেখে মিটমিট করে হাসে- উৎভ্রান্তের হাসি।
হাসছেন যে, হাসতে লজ্জা করে না?
লোকটি তথাপি হাসি থামায় না। মিলাকে যেন তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য মনে করে।
মিলাও দমে যাওয়ার পাত্রী নয়; ঠোঁটের ফাঁক গলে ক্ষোভ ঝরে পড়ে, এতটা নির্লজ্জ কেন আপনি! বুঝতে পারছেন না, আপনার উপস্থিতিতে আমরা বিব্রত। প্লিজ, আমাদের নিজের মতো থাকতে দিন। অন্য কোথাও বসুন।
আম্মুর আচরণে মিথিলার শিশুমন আহত হয়। অসহায় মানুষটার অপমানে সে নিজেও খানিকটা বিচলিত। আম্মুর হয়ে ক্ষমা প্রর্থনা করে, প্লিজ চাচ্চু, তুমি কষ্ট পেও না। আম্মুর মনটা বোধ হয় খারাপ; তাই এমন করছে।
মিথিলার সরল অভিব্যক্তি মিলাকে আহত করে। নিজের ভুল বুঝতে পারে। বুঝতে পারে, ঔদ্ধত্যের সীমা মাড়ানো ঠিক হয়নি। তাছাড়া লোকটি তো তার কোনো ক্ষতি করেনি! মিলার তপ্ত হৃদয়ে অনুতপ্তের লু হাওয়া বয়ে যায়। সেই কতদিন আগে দেশ ছেড়েছে; বলতে গেলে আজ সে বিদেশ-বিভুঁইয়ে। নতুন ঠিকানায় এমন আচরণ তার চরিত্র-বিরুদ্ধ। তাছাড়া উদ্দেশ্য বিষয়ে লোকটি তো তাকে সহায়তাও করতে পারে!
আগ্রহভরে মিলা জিজ্ঞেস করে, কোথায় যাবেন আপনি?
মিলার প্রশ্নের কোনো উত্তর নেই; কানে বাজে কেবল একটানা শোঁ শোঁ শব্দ। ট্রেনের জানালা ভেদ করে দৃষ্টির সীমারেখা আকাশের ঠিকানায়; যেখানে দ্বাদশীর চাঁদ ক্রীড়ারত। চাঁদের মতো লোকটির মধ্যেও ভাঙা-গড়ার খেলা। মুহূর্তের জন্য অভিমান এসে জমা হয়। না, কিছুতেই সে তার গন্ত্যব্যের কথা বলবে না! বাস্তবের মুখোমুখি দাঁড়ানোর জন্য সে দিনের পর দিন অপেক্ষা করেছে; ভেবেছে সুদিন আসবে। অথচ বাস্তবকেই আজ তার বড় ভয়। জগৎ-সংসার থেকে যেমন অদৃশ্য এখানেও অদৃশ্য থাকতে চায়। তাছাড়া দৃশ্যমান হওয়ার যন্ত্রণা ইতিমধ্যেই বুঝে ফেলেছে। তারচেয়ে এই ভালো- ভাবনার জগতে পরিব্রাজক হয়ে আজন্ম পথ হাঁটবে; রঙতুলি দিয়ে নিজের মতো করে ছবি আঁকবে। দহনে দহনে ক্ষয়ে যাবে তবু নিজেকে প্রকাশ করবে না।
মিলার অনুশোচনা ক্রমশ রিদ্ধ হয়। পুনরায় জিজ্ঞেস করে, রাগ করেছেন?
না না ম্যাডাম, রাগ করব কেন, আপনি তো মিথ্যে বলেননি! দয়া না থাকলে এতক্ষণ বসতে পারতাম না। অন্য কেউ হলে পুলিশ ডাকতো, না হয় হাতে দুটো পয়সা ধরিয়ে বিদায় করতো।
আত্মতুষ্টির মাঝে অনুশোচনা। দুঃখবোধ। খুব বেশি অভিমান তাকে গ্রাস করে। রুম ছেড়ে বাইরে যেতেও দ্বিধা। মিথিলার করুণ চাহনি, চাচ্চু, আপনার বুঝি কেউ নেই!
আগন্তুক কাঁধ ঝাঁকায়। মিষ্টি মেয়েটিকে কাছে ডেকে নিয়ে বলে, না মা, কেউ নেই আমার।
কেন, বাড়ি নেই?
না, নেই।
তাহলে থাকেন কোথায়?
রাস্তায় রাস্তায়। যাদের কেউ নেই তাদের রাস্তা আছে।
আগন্তুকের কথাগুলো ছোট্ট মেয়েটি ঠিকঠাক বুঝতে পারে না। মাথা দুলিয়ে বলে, জানেন চাচ্চু, আমাদের বাসার পাশে অনেক বড় রাস্তা আছে! আপনি যাবেন সেখানে?
খুব যেতে ইচ্ছে করে আগন্তুকের। ওই রাস্তার খোঁজে এক জীবনে অনেক পথ পাড়ি দিয়েছে সে। যুদ্ধের পরে নতুন আরেকটি যুদ্ধ বেছে নিয়েছে। মাত্র নয় মাসের যুদ্ধে যে মানুষ একটা দেশ স্বাধীন করেছে, পথের যুদ্ধ সে পরাজিত। বছরের পর বছর পথ হেঁটে পথের দিশা পায়নি! ক্রমাগত পথ হেঁটে হতাশ হয়েছে। কিন্তু আজকের পর থেকে আগন্তুকের আর আক্ষেপ থাকার কথা নয়। যা খুঁজতে পথে নেমেছিল তা আজ হাতের নাগালে। হাঁ, সে এতদিন মিলাকেই খুঁজছে। সমীকরণও মিলে গেছে। সব ভুলে বেশ আছে সে। আর যাই হোক সুখের অভাব নেই। এমন মিষ্টি মেয়ের চোখের পানে তাকিয়ে হাসিমুখে সব দুঃখ ভুলে থাকা সম্ভব। কিন্তু মিলার কি সত্যি সত্যি দুঃখ নেই!
মিলার দুচোখ জলে ছলছল করে। ট্রেনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তার ভাবনাগুলোও হামাগুড়ি দেয়। রাতের আঁধারে সে কোথায় উঠবে! ঢাকার পথ ঘাট খুব বেশি চেনা নেই। তাছাড়া যুদ্ধের পর রাতারাতি সব বদলে গেছে। ২৫ মার্চের স্মৃতি মনের পর্দায় উঁকি মারে। বান্ধবীর বাসার নাম করে মিলা সেদিন সারা শহর ঘুরেছিল। শাহেদকে সঙ্গে নিয়ে অনাগত স্বপ্নে বিভোর হয়েছিল। বস্তুত ২৫ মার্চে পর থেকে বাঙালির জীবনাচার বদলে গেছে। কেউ মারা গেছে, রাতের অন্ধকারে কেউ ভারতে পালিয়ে গেছে; কেউ কেউ আবার লড়াই করাটাই জীবন বলে মনে করেছে। শাহেদ লড়াই করেছে। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত লড়াই করেছে। ট্রেনিংয়ের জন্য মাঝে কিছুদিন ভারতে অবস্থান করেছিল। তখনো মিলাকে অনুসন্ধান করেছিল। যুদ্ধ শেষে বেশ কিছুদিন কলকাতার রাস্তায় হাঁটাহাঁটি করেছে। অথচ বহুবছর বাদে নতুন পরিচয়ে সে আজ মিলার মুখোমুখি! শাহেদ চোর;নির্লজ্জ! ভাবতেই বুক ফেটে কান্না আসে। কিন্তু নির্জনতার অভাবে কাঁদতে পারে না।
যুদ্ধ বিষয়ে মিথিলা প্রশ্ন করে, আপনি কি মুক্তিযোদ্ধা?
কেন। তুমি কি যুদ্ধ সম্পর্কে জানো?
হ্যাঁ সূচক মাথা নেড়ে মিথিলা বলে, হুম, একটু একটু জানি।
আগন্তুক পুলক অনুভব করে। যুদ্ধ বিষয়ে তার ধারণা চানতে চায়।
আম্মুর মুখে শুনেছি যুদ্ধ নাকি ভয়ঙ্কর! অসংখ্য মানুষ মারা যায়। চারদিকে রক্ত আর রক্ত। যে যেভাবে পারে পালিয়ে বাঁচে। আর যারা যুদ্ধ করে তারা মারা যায়। কেউ কেউ বেঁচে থাকলেও চিরদিনের জন্য পঙ্গু হয়ে যায়।
কয়েক মুহূর্ত ভেবে মিথিলা পুনরায় বলে, আপনি কি যুদ্ধ করতে গিয়ে পঙ্গু হয়েছেন?
মেয়ের সামনে নিজেকে লুকাতে মন চায় না। তার মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় ফাঁস করে দেয়। মিথিলা খুশি হয়। সে একজন মুক্তিযোদ্ধার সামনে দাঁড়িয়ে। মেয়েটি যুদ্ধ দেখেনি কিন্তু একজন যোদ্ধার দেখে পেয়ে আনন্দিত। মিলা লজ্জিত। তার মুখচ্ছবি ক্রমশ বদলে যাচ্ছে। একজন মুক্তিযোদ্ধাকে সে অপমান করেছে। মুখে যা এসেছে তাই বলেছে। হাতজোড় করে ক্ষমা প্রার্থনা করে, প্লিজ আমায় ক্ষমা করুন। চরম অন্যায় করেছি আমি। আসলে আমার মাথা ঠিক নেই। প্রচণ্ড অস্থিরতায় ভুগছি। একজন মুক্তিযোদ্ধার সন্ধানেই আমার বাংলাদেশে আগমন!
একজন মুক্তিযোদ্ধা!
আগন্তুক বুঝতে পারে না, মিলা কাকে খুঁজতে এসসছে! ওদের পরিবারে এমন কেউ ছিল না যে মুক্তিযোদ্ধা। মিথিলার কাছে তার মামা বিষয়ে জানতে পারে।
জানেন চাচ্চু, আমার মামা যোদ্ধা। তিনি বেঁচে আছেন নাকি মারা গেছেন আমরা কেউ জানি না।
নাম কী উনার?
শাহেদ। আপনি কি তাকে চেনেন?
নিয়তি বড় আজব।
এইমাত্র নিয়তি তাকে কষে থাপ্পড় দিল। কাছে থেকেও মিলা আজ দূরের কেউ। কৈশরের একটা মুখচ্ছবি হয়তো তাকে বাস্তব থেকে ছিটকে দিয়েছে! তা না হলে চিনতে পারবে না কেন? না চিনেই বরং ভালো হয়েছে। হয়তো আরও বেশি কষ্ট তাকে ছুঁয়ে যেত।
টানা হুঁইসেল বাজিয়ে রাতের ট্রেন এগিয়ে চলে। দ্রুত সময় পেরিয়ে যাচ্ছে। আগন্তুক আড়চোখে মিলার পানে তাকায়। ছাত্র জীবনের শেষে এই প্রথম সে লুকিয়ে লুকিয়ে মেয়ে দেখছে। নেমে যাওয়ার আগে মিলার মুখচ্ছবি সে সারাজীবনের জন্য মুখস্ত করে নেবে। নীরবতার ক্ষণগুলো পার হলে মিলা জিজ্ঞেস করে, কোথায় যাবেন?
কুষ্টিয়া।
মিলা পিঠ টান টান করে উঠে বসে, কুষ্টিয়া!
জ্বি, ওখানেই আমার বাসা।
মিলার এবার অবাক হওয়ার পালা। গড়াই নদীর চর, কুষ্টিয়া সরকারি কলেজ, রেনউইক বাঁধ, রবীন্দ্রনাথের কুঠিবাড়ি, শাইজীর আঁখড়াবাড়ি—সব যেন ছবির মতো জীবন্ত হয়ে ওঠে। প্রবলভাবে নাড়ির টান অনুভব করে।
আচ্ছা, কালিদাসপুর নামে একটা গ্রাম আছে না!
জ্বি, আছে।
গেছেন কখনো?
ইচ্ছে করেই আগন্তুক মিথ্যার আশ্রয় নেয়, না ঠিক যাইনি তবে গ্রামটি সম্পর্কে কমবেশি ধারণা আছে।
কী রকম ধারণা?
শাহেদ নামে আমার এক বন্ধু ছিল ওখানে। তার কাছে অনেক গল্প শুনেছি।
ওহ মাই গড, আপনি শাহেদকেও চিনতেন!
হুম, চিনতাম। আমরা দুজনেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলাম। যুদ্ধও করেছি একসঙ্গে। ছেলেটির দূর্ভাগ্য, আমার মতো সেও একটা পা হারিয়েছে।
হতাশায় নুয়ে পড়ে মেয়েটি। টেবিলে মুখ লুকিয়ে অনেকক্ষণ বসে থাকে। নিঃশব্দে কাঁদে সম্ভবত। আগন্তুকের মনটা খুশিতে ভরে ওঠে। সে হারেনি। বরং মিলা হেরে গেছে। তার চোখে মুখে পরাজয়ের চিহ্ন। ব্যাকুল হয়ে শাহেদ সম্পর্কে জানতে চায়। শাহেদের সঙ্গে তার সম্পর্কের বিষয়টির গোপন রাখে না। দেখা হওয়ার প্রত্যাশায় দুর মুল্লুকে ছুটে এসেছে। কতিপয় কৈফিয়েত নিয়ে সম্মুখে দাঁড়াতে চায়।
কিসের কৈফিয়েত?
অবহেলা। সে আমাকে আমাকে অবহেলা করেছে। ভারতে যাওয়ার আগ পর্যন্ত তার জন্য আমি অপেক্ষা করেছিলাম।
এ দায় তার না; সময়ের।
আপনি কিভাবে জানলেন!
জীবনের ওই চরম দুঃসময়ে আমি ও আমরা একসঙ্গে ছিলাম।
শাহেদের মনে হয় একটু একটু করে সে যেন ঘোর অন্ধকারে ডুবে যাচ্ছে। তার চারপাশে কালরাত্রির আবহ; ষ্পষ্ট দেখতে পায়- রাতে কী ঘটতে যাচ্ছে দিনের আলোয় তার বিন্দুমাত্র আভাস ছিল না। সন্ধ্যার পর পরই পাক বাহিনীর সাঁজোয়া যানগুলো রাস্তার মোড়ে-মোড়ে অবস্থান নিতে শুরু করে। সবার মধ্যেই বিবমিষা; কী হয়, কী হয়! তখন পর্যন্ত আন্দাজ করতে পারেনি এই রাতটিই বাঙালি জাতির কালরাত্রির মর্যাদা পাবে; বুঝতে পারেনি ভোটের রাজনীতিতে পরাজিত সৈনিক বুলেটের ভাষায় উত্তর দেবে। ক্ষ্যাপা কুকুরের মতো ওরা গুলি ছুঁড়তে শুরু করে। নাহ, কোনো বাছ-বিচার ছিল না; নারী, শিশু, বৃদ্ধ কাউকেই শালারা ক্ষমা করেনি। এক একটি সতেজ প্রাণ মুহূর্তেই লুটিয়ে পড়ছিল। শহরময় শুধু লাশ আর লাশ; ওই রাত্রেই ঢাকা শহরে প্রায় ৫০ হাজার নিরীহ বাঙালি খুন হয়।
মিলা ভয়ার্ত চোখে মিলা জিজ্ঞেস করে, তারপর, তারপর কী করলেন!
গা ঢাকা দিলাম। বেশ কিছুদিন পালিয়ে বেড়ালাম। এরপর এক বৃষ্টিভেজা রাতে আপনার খোঁজে শাহেদ গ্রামে গিয়েছিল।
আগন্তুক পুনরায় বলে, আপনাকে না পেয়ে শাহেদ মুক্তিযুদ্ধে নাম লিখিয়েছে। পদে-পদে মৃত্যুর সম্ভাবনা জেনেও আমরা যুদ্ধ করতাম। একদিকে পাকবাহিনী অন্যদিকে তাদের দোসর রাজাকার; উঃ, সেকি টেনশন! মাঝে-মধ্যে দিশেহারা হয়ে উঠতাম। বৃষ্টিতে ভিজে, খেয়ে না খেয়ে ৯ মাস যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করলাম; শত্রুমুক্ত হলো জনগণ; অর্জন করলাম লাল-সবুজের পতাকা। সে কি আনন্দ, একটা পা দিয়েছি তবু দুঃখ নেই। কিন্তু আজ বড় ক্লান্ত। দুর্বিষহ জীবনের বোঝা বইতে-বইতে হাঁফিয়ে উঠেছি।
মুক্তিযোদ্ধার সামনে মিলার মাথা নুঁয়ে পড়তে চায়, পায়ের ধুলো মাখতে সাধ জাগে। আগন্তুক সম্পর্কে জানতে আগ্রহী হয়।
বাবা-মা কোথায়?
নেই। এক এক করে জীবনের সূঁতো কেটে- আজ আমি সূঁতাকাটা ঘুড়ি। অহর্নিশ ঘুরপাক খাচ্ছি।
কেন, স্ত্রী-পুত্র!
আগন্তুক আরেক দফা হাসে।
হাসছেন যে!
যোদ্ধার কণ্ঠে তাচ্ছিল্লের ব্যঞ্জনা, আমার মতো পঙ্গুর আবার বিয়ে! তাছাড়া সবার ঘর-সংসার থাকতে নেই।
কিন্তু বাইরের টানই বা কতদিন! এভাবে কি জীবন যাবে?
হয়তো যাবে হয়তো যাবে না; তবে অনুশোচনা নেই। মহাজীবনের পথে নিজেকে সঁপে দিয়েছি। ভেবেছিলাম মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে বেঁচে থাকবো, কিন্তু সে আশাও সুদূর পরাহত। মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে নতুন একটা খেলা শুরু হয়েছে।
লোকটার আমিত্বের কাছে মিলার নিজেকে অসহায় মনে হয়। শাহেদের সঙ্গে কোথাও যেন একটু মিল পরিলক্ষিত হয়! অসম্ভব সম্মেহনী ক্ষমতা ছিল তার! ছুঁটিতে বাড়ি এলে কথার পিঠে কথা লাগিয়ে মিলাকে উতলা করে তুলতো। দুরন্ত কৈশর, চণ্ডীদের তুলশিতলা, শৈলেন বাবুর পোড়োবাড়ি, অভিসারের নির্ঘুম রাত, মলাটের ভাঁজে-ভাঁজে নীল খাম—অসংখ্য সব স্মৃতি আড়মোড়া ভেঙে জেগে ওঠে; জেগে ওঠে বুকের অন্তঃপুরে লুকিয়ে থাকা গোপন ব্যথাও।
কৈশরের মিলা কখনোই এমন সুস্থির ছিল না; ভবিষ্যৎবিষয়ক কৌতূহল তাকে অস্থির করে তুলতো। অথচ এই মুহূর্তে তার মুখ দিয়ে কথা সরে না। বোঝাতে পারে না, একজন শাহেদের জন্য সে পাগলা গারদের চৌকাঠ ছুঁয়েছিল; অন্ধকার আকাশই তার সঙ্গী হয়েছিল। জীবনের হিসাব গোলমেলে; এক অঙ্কের সঙ্গে অন্য অঙ্কের কোনো মিল নেই। যে শাহেদকে ছাড়া এক মুহূর্ত ভাবতে পারতো না, তাকে ছাড়াই কেটে গেছে জীবনের অনেকগুলো বছর!
শাহেদের ভাবনায় ছিল কৈফিয়েত, মিলার সঙ্গে দেখা হলে কৈফিয়েত চাইবে। কিন্তু আজ আর কোনো কৈফিয়েত নেই; সব কৈফিয়েত তার নিজের কাছে। তা না হলে তার জীবনটা কেন লণ্ডভণ্ড হয়ে যাবে, কেনই বা একটি মানসপ্রতিমা সারাজীবন বয়ে বেড়াতে হবে! সংসারের কথা যে শাহেদ ভাবেনি তা না, কিন্তু প্রতিমার অঞ্জলি দিতে দিতেই তো সে ক্লান্ত। বুকের গহীণে অভিমান গুমরে মরে। মিলাকে বলতে সাধ জাগে, ভেবো না মিলা; দুঃখের আগুনে পুড়ে-পুড়ে এ জীবন একদিন নিঃশ্বেষ হয়ে যাবে; কোনো মা আমার লাশটা ছুঁয়ে দেখবে না, কোনো মেয়ে বলবে না, বাবা ও বাবা, আমাকে তুমি কার কাছে রেখে যাচ্ছো! মাটির অভাবে এই দেহখানা হয়তো শেয়াল কুকুরে খাবে।
মিলার মধ্যে অস্বস্তি। শাহেদকে খুঁজে পেতে উৎগ্রীব। যেহেতু বেঁচে আছে; দেখা হবেই। আগন্তুক যেখানে যেভাবে বলেছে মিলা সেভাবেই চেষ্টা করবে। অচেনা শহরের অলিতে-গলিতে একজন মানুষ খুঁজে ফিরবে সে।
স্বল্প সময়ে অচেনা যাত্রীর প্রতি আস্থা জন্মেছে; বিশেষ ধরনের টান অনুভব করে। ছেড়ে দিতে ইচ্ছে করে না। হৃদয়ের অতলান্তে গোপন ব্যথার অনুভুতি। দুর্বল মুহূর্তে মনে হয় এই মানুষটাই শাহেদ। অনেক কিছু বলতে সাধ জাগে। কিন্তু সময় খুব কম। একটু-একটু করে ভাবনার পরিধি সংকুচিত হতে শুরু করে। ট্রেনের গতি কমে আসছে। দূরের নিশানসমূহ আরও নিকটবর্তী; হাত বাড়ালেই যেন যেন ছুঁয়ে দেখা যায়!