মাহিনের ইচ্ছেগুলো
মাহিন লেখালেখি করুক এটা কখনোই চায়নি মিথিলা। এ নিয়ে অনেকবার বাকবিতণ্ডাও হয়েছে। তবু মাহিন থেমে যায়নি। মিথিলাকে বোঝানোর চেষ্টা করেছে। বলেছে, ‘দ্যাখো, আমার লেখা কবিতা পড়েই তুমি আমার প্রেমে পড়েছ।’ মিথিলা বলেছে, ‘সেটা ছিল অপ্রকাশিত কবিতা। তা শুধু আমার জন্যই লেখা। এখন যে গল্প-কবিতা লেখো সেগুলো অনেকেই পড়ে। আমি সেটা চাই না।’
মাহিন ঘাবড়ে যায়। কী করবে সে। মিথিলাকে ম্যানেজ করতে ব্যর্থ হয়।
একদিন খুব উৎফুল্ল মেজাজেই মিথিলাকে ফোন করে। কিছুক্ষণ আলাপচারিতার পর মাহিন একটা সুখবর জানায়। মিথিলা আঁৎকে ওঠে। বলে, ‘কী? তুমি সাহিত্য পুরস্কার পেতে যাচ্ছ, তা আবার আমাকে বলছো? তুমি তাহলে আমাকে না জানিয়ে গোপনে গোপনে লিখছ। আজ সেটা স্পষ্ট। তুমি আমাকে ঠকিয়েছ।’ মিথিলা এবারও চটে যাবে তা ভাবতে পারেনি মাহিন। তাই কথা না বাড়িয়ে ফোনটা রেখে দেয়।
মাহিনের উভয়সংকট। কাকে রেখে কাকে ছাড়বে? লেখালেখি তার নেশা। মিথিলাও তার কাছে কম কিছু নয়। দুটি বিষয়ই গুরুত্ব বহন করে। মাহিন হারিয়ে যায় অতীতে—প্রেমের প্রথম পর্বে রোজ একটা করে কবিতা লিখে মিথিলার বইয়ের মধ্যে রেখে আসতো। কবিতা পেয়ে মিথিলাও খুশি হতো। সেই থেকে নেশাটা আরও বেড়ে যায়। মিথিলা প্রশংসা করে কবিতার। তাই প্রথম সাহস করে পত্রিকায় কবিতা পাঠায়। একটি কবিতা ছাপা হয়। এরপর ছোটগল্প, প্রবন্ধ লিখতে আরম্ভ করে। লেখার হাতটা মোটামুটি পাকা হয়। লেখার সাহসও বাড়ে। তখন তেমন বাধা দেয়নি মিথিলা। কিন্তু হঠাৎ এমন ঘোরবিরোধী হয়ে ওঠার কারণও খুঁজে পায় না।
মাহিনের অনেক দিনের ইচ্ছে ছিল একটি বই প্রকাশের। অনেক প্রকাশনীতে ধর্ণাও দিয়েছে। কিন্তু কাজ হয়নি। মাহিন তেমন পরিচিত কবি বা লেখক নয়। নিজের তেমন টাকাও নেই। এদিকে মাহিনের লেখালেখির ঘোরবিরোধী মিথিলা। আশার গুড়েবালি। মাহিন দমে যায়।
একদিন বিকেলে নদীর পাড়ে হাঁটতে হাঁটতে মাহিন জানতে চায়—‘আমি লিখি এটা তুমি চাও না? মিথিলা এককথায় বলে, ‘না।’ মাহিনের পাল্টা প্রশ্ন—‘কেন?’ মিথিলা একটু থামে। এরপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, ‘আমার ভাইরা কবি-লেখক পছন্দ করে না। কবিদের চরিত্র নিয়ে বাজে কথা বলে। আমার শুনতে ভালো লাগে না।’ মাহিন দৃঢ়কণ্ঠে জানতে চায়, ‘তুমি কি আমাকে বিশ্বাস করো না?’ মিথিলার ছোট্ট জবাব- ‘করি।’ মাহিন বলে, ‘তবে?’ মিথিলা শেষবারের মতো বলে, ‘আমার ভাইরা যেটা পছন্দ করে না, আমিও সেটা মেনে নিতে পারি না।’ বলেই দ্রুত পায়ে হেঁটে যায় মিথিলা। মাহিন নিথর হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। তখন পশ্চিমাকাশে হেলে পড়েছে আলো। আঁধারে ঢেকে আসছে পৃথিবী।
থেমে থাকেনি জীবন। থেমে থাকেনি মাহিন। থেমে থাকেনি তার লেখালেখি। মিথিলার সঙ্গে আর বোঝাপড়া হয়ে ওঠেনি। অঘোষিত বিচ্ছেদই বলা চলে। দেখা হলে কথা হয়, কুশলাদি বিনিময় হয়। ভালোবাসি এ কথাটি বলা হয় না আর।
একদিন মিথিলার ফোন কল দেখে অবাক হয় মাহিন। ভরদুপুরে মাথার ওপর দিয়ে উড়ে যায় কতগুলো কাক। চৈত্রের খা-খা বিষণ্ন দুপুর। ও প্রান্তে মিথিলার উচ্ছ্বসিত কণ্ঠস্বর। ‘একটা সুখবর দেই তোমায়। শুক্রবার আমার বিয়ে। ছেলে ব্যবসায়ী। ঢাকায় বাড়ি-গাড়ি সব আছে তার।’
মাহিন কান থেকে সরিয়ে নেয় ফোনটা। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে রাস্তার কিনারে। সা-সা আওয়াজ তুলে দুর্দান্ত গতিতে পালিয়ে যায় দুটি ট্রাক।
সময় থেমে থাকে না। বহতা নদীর মতোই বয়ে চলে। পুরনোকে পেছনে ফেলেই এগিয়ে যেতে হয়। হাঁটিহাঁটি পা-পা করে এগিয়ে যেতে থাকে মাহিন। লেখালেখি আর পেটের তাগিদে করা কর্মই তার সম্বল। তেমন উচ্চাশা নেই। পুরনো একটা ইচ্ছা আজও অপূর্ণই রয়ে গেল। এখনো তার কোনো গ্রন্থ আলোর মুখ দেখেনি। তবে লেখক হিসেবে সুনাম ছড়িয়েছে। তিনবার সাহিত্য পুরস্কার পেয়েছে। নিয়মিত জাতীয়, স্থানীয় দৈনিকসহ সাহিত্যের ছোট কাগজে লিখে যাচ্ছে। তবু অভাবটা বড্ড নাড়া দেয় মাহিনকে।
স্থানীয় একটি কলেজের বাংলা প্রভাষক হিসেবে বেশ সুখীই বলা যায় মাহিনকে। বিয়েটা এখনো করা হয়ে ওঠেনি। করি করি করেও ঠিক পছন্দের মতো কাউকে পাওয়া যাচ্ছিল না। পরিবারের পীড়াপীড়ি তো রয়েছেই। মাঝে মাঝে বুকের মধ্যে মোচড় দিয়ে ওঠে মিথিলার স্মৃতি।
শেষ বিকেলের আলোয় বারান্দায় বসে পত্রিকা পড়ছিল মাহিন। দরোজায় সাইকেলের ক্রিং ক্রিং ঘণ্টায় মাথা তুলে তাকায়। ডাকপিয়ন কাছে এসে একটা খাম দিয়ে চলে যায়। মহিন খামটা খুলে একটা চিঠি বের করে। মিথিলা প্রকাশনীর একটি প্যাডে লেখা দাওয়াতপত্র। ‘সুধী, আপনি জেনে আনন্দিত হবেন যে, অমর একুশে গ্রন্থমেলায় ১৪ ফেব্রুয়ারি বিশ্ব ভালোবাসা দিবসে আপনার কবিতার বই ‘মাহিনের ইচ্ছেগুলো’র প্রকাশনা উৎসব অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। অনুষ্ঠানে আপনার উপস্থিতি একান্ত কাম্য। নিবেদনে-প্রকাশক।’
মাহিন অবাক হয়। হওয়ারই কথা। হিসাব মেলে না। সে তো কাউকে পাণ্ডুলিপি দেয়নি। তবে গ্রন্থ প্রকাশ হবে কিভাবে? অনেক ভেবেও কূল-কিনারা না পেয়ে নিরস্ত হয়। মনে মনে সিদ্ধান্ত নেয়—যাই, দেখি, কিভাবে কী হলো।
যথারীতি অনুষ্ঠান শুরু হয়ে যায়। উপস্থাপিকা অনু্ষ্ঠানের প্রধান অতিথি সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক, প্রকাশক মিথিলা রহমান ও কবি মাহিনকে মঞ্চে আসন গ্রহণের আহ্বান জানান। মাহিন নির্বাক। ভাবনার অতলে হারিয়ে ঘোষণাটুকুও কর্ণগোচর হয় না। অনুষ্ঠান সহযোগী এসে মাহিনকে ডেকে নিয়ে যায় মঞ্চে।
অতিথিরা বহুল প্রশংসিত বক্তব্য রাখেন। মাহিনকে নিজের কাছে একজন অযোগ্য-অপদার্থই মনে হয়। কবির বক্তব্যে বেশি কিছু বলা হয় না তার। শুধু প্রকাশনী ও প্রকাশককে ধন্যবাদ জানিয়ে বক্তব্য শেষ করে। প্রকাশক মিথিলা রহমান তার বক্তব্যে চমকে দেন মাহিনকে। মিথিলা বলেন, ‘কবির দীর্ঘদিনের ইচ্ছে ছিল একটি বই প্রকাশ করার। আমি শুধু তার এই একটি স্বপ্ন বাস্তবায়ন করার দুঃসাহস দেখিয়েছি। বিভিন্ন সময় আমার সংগৃহীত মাহিনের কবিতাগুলোর একটি সংকলন করেছি মাত্র। ভুল-ত্রুটি মার্জনার দৃষ্টিতে দেখবেন।’
মাহিনের চোখ তখন ছলছল করছিল জলে। টেবিলে রাখা টিস্যু নিয়ে অনবরত চোখ মুছছিল। মিথিলার বক্তব্যের পর অুনষ্ঠান শেষ হয়ে গেলে অতিথিরা বিদায় নিলেন। মিথিলা এসে দাঁড়ায় মাহিনের পাশে। মিথিলা বলে, ‘এই রাতে কোথায় যাবে? চলো আমার সাথে।’ মাহিন বলে, ‘আর কত ঋণী করবে আমায়?’ মিথিলা হাসে। হাসতে হাসতে বলে, ‘ভয় নেই শোধ করতে হবে না। আর যদি ইচ্ছে হয় শোধ করে দিও।’ প্রসঙ্গ পাল্টে মাহিনের জিজ্ঞাসা- ‘বাসায় কে কে আছে?’ মিথিলা বলে, ‘তেমন কেউ নেই। শুধু আমি, আমার একমাত্র মেয়ে ও একজন গৃহপরিচারিকা।’ মাহিনের জিজ্ঞাসা- ‘কেন? সাহেব নেই?’ মিথিলা বলে, ‘দুবছর হলো আমার কাঁধে সব ঝামেলা চুকে দিয়ে তিনি স্বর্গে চলে গেলেন।’ মাহিন অবাক হয়—‘মানে?’ মিথিলা কথা ঘুরিয়ে বলে, ‘সে থাকগে। ওর জন্য দোয়া করো, যেন সুখে থাকে- ভালো থাকে।’
মাহিন নির্বাক। কিছু বলার ভাষা আর অবশিষ্ট নেই। মিথিলা মাহিনের হাত ধরে টান দিয়ে বলে—‘চলো তো।’ ড্রাইভার গাড়ির দরোজা খুলে দেয়। মিথিলা আর মাহিন প্রবেশ করে গাড়ির গহীনে অন্ধকারে। বহুদিন পর পাশাপাশি দুজন।
যুবতী এবং চাঅলা
বাসা থেকে বের হয়ে গেটের সামনে দাঁড়ায় লোপা। ব্যাগ থেকে ফোনটা বের করে ডায়াল করে। ওপাশ থেকে সাবিত ফোন ধরে:
হ্যালো।
কোথায় আপনি?
তুমি কোথায়?
বের হচ্ছি। কোথায় আসব?
কোনো চাইনিজে?
না, আমি কোনো দামি খাবার খেতে আসছি না।
ফাস্টফুডে?
তা-ও না।
তাহলে তুমিই বলো।
রবীন্দ্র সরোবর।
ওকে।
লোপা একটা রিকশা ডেকে উঠে বসে। রিকশাঅলাকে বলে: মামা যাও।
আপা কই যাইবেন?
রবীন্দ্র সরোবর।
রবীন্দ্রনাথ তো বাঁইচা নাই। তারে পামু কই? যটটুকু জানি হের বাড়ি কলকাতায়।
উফ। ধানমন্ডি লেক।
ওহ। চলেন।একটু এগিয়ে গিয়ে রিকশাঅলা আবার জানতে চায়:
আপা, ওই লেকটা কি তার বাপ-দাদার?
কার?
একটু আগে যার নাম কইলেন।
অসহ্য। এত কথা বলেন কেন? আপনার কাজ আপনি করেন।
ওহ। স্যরি। বুঝছি। আদার ব্যাপারির কাজ কি জাহাজের খোঁজ নেওয়া!
লোপার ফোনে রিং বেজে ওঠে। স্ক্রিনে তাকিয়ে ভ্রূ কোচকায়। এ সময় আবার সালুর ফোন কেন?
হ্যাঁ, বলো।
তুমি কোথায়?
যাচ্ছি।
কোথায় যাচ্ছ?
জাহান্নামে।
আমিও যাব।
সালু, সবসময় ফাজলামো ভালো লাগে না।
জানি তো। কী করব বলো?
এখন ফোন রাখো, এসে সব বলব।
সালু ফোন রেখে দেয়। লোপা আনমনা হয়ে ওঠে। তার দৃষ্টি উদাস। মনে মনে ভাবে। ফেসবুকের কল্যাণে পরিচয় সালুর সঙ্গে। ক্যাম্পাসের মাঠে বসে প্রথম চ্যাটিং হয়। তখন সালুর একটি স্ট্যাটাস ভালো লাগে লোপার।
সেই থেকে স্ট্যাটাসের কমেন্টসে দু’জনের চরম ঝগড়া চলতে থাকে। তবে ঝগড়া চললেও সালুকে দেখতে ইচ্ছে হয় লোপার। তাই একদিন ইনবক্সে গিয়ে নম্বর চায়। সালুও দিয়ে দেয়। হ্যালো। কে বলছেন?
শুকতারা।
ওহ। কেবল যে ফোন নম্বর নিলেন?
হুম। আপনি কী করেন?
কিছু না। তবে এখন বাইরে। দুপুর হয়েছে। এক কাপ দুধ চায়ের সাথে একটা বাটারবন খাব বলে বের হয়েছি।
ইন্টারেস্টিং। দুপুরে লাঞ্চ করবেন না?
লাঞ্চ বলতে আপনি কী বোঝেন?
মানে?
আমি এখন যা খাবো, তাই আমার লাঞ্চ।
স্যরি।
না না, স্যরি বলার কিছু নেই। আমি শিক্ষিত বেকার। চাকরির জন্য ব্যাকুল হয়ে আছি। মাসেরও শেষের দিক। ফলে পকেটটা গড়ের মাঠ।
আপনার অকপট স্বীকারোক্তি আমাকে মুগ্ধ করেছে।
ধন্যবাদ। এবার তাহলে রাখি?
ভাবতে ভাবতে লোপার পথ ফুরিয়ে যায়। রিকশা এসে পার্কের গেটে থামে। রিকশাঅলা বলে:
আপা নামেন।
ও হ্যাঁ। এই নাও ভাড়া।
ভাড়া দিয়ে সামনে এগিয়ে যায় লোপা।
পার্কের গেট দিয়ে ঢুকে রাস্তা ধরে হাঁটতে হাঁটতে সালুর কথা মনে পড়ে। লোপার বিয়ের প্রস্তাব যখন আসে, ছুটে যায় সালুর কাছে। সালুকে জানায় সে। কারণ সালুকে প্রচণ্ড ভালোবাসে।
সালু: তুমি এখন কী করতে চাও?
লোপা: এ কথা বলছ কেন?
সালু: তোমার জন্য একটা ভালো প্রস্তাব আসছে।
লোপা: ভালো-মন্দ বুঝি না?
সালু: তো কী করা যাবে এখন? আমি তো ছন্নছাড়া একটা মানুষ।
লোপা: সালু, তুমি না! আসলে বুঝতে চাও না। আমি শুধু তোমাকেই চাই। আর কিছু জানি না।
সালু: তাতো জানি। তবে এমন একটা সিরিয়াস ব্যাপারে হুট করে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারছি না।
লোপা: শোনো তোমারা কিছু আছে কি নেই এ মুহূর্তে তা ভাবতে পারছি না। তবে আমি বাবা-মার কাছ থেকে সময় নিয়েছি।
সালু: কী করতে চাও? তার চেয়ে রাজি হয়ে যাও।
লোপা: বললেই হলো? আমারও তো পছন্দ হতে হবে। শোনো, তার ফোন নম্বর এনেছি। আমি আগে কথা বলে দেখি।
সালু: ঠিক আছে, তাকে তোমার পছন্দের কথা বলো।
লোপা: হুম, দেখি আগে ওনার সাথে কথা বলি।
ভাবতে ভাবতে নীল রঙের শার্ট এবং কালো প্যান্ট পরা একজনকে বেঞ্চে বসা দেখে থমকে দাঁড়ায় লোপা। ফোন করে সাবিতকে।
হ্যালো।
হ্যাঁ, বলো।
এসেছেন আপনি?
হ্যাঁ, তুমি?
হুম। কোথায় আছেন?
কর্নারের একটি বেঞ্চে। রাতে যে পোশাকের কথা বলেছিলাম।
হ্যাঁ, মনে আছে।
সাবিতকে দেখে এগিয়ে যায় লোপা।
আপনি সাবিত?
হু। তুমি লোপা? তোমার ছবি আমি আগেই দেখেছি।
তাই না কি! গুড জব।
হঠাৎ এখানে তলব কেন? রাতে তো কিছুই বললে না।
সেজন্যই এখানে ডেকেছি। আপনি কাউকে ভালোবাসেন?
না, বাসলে তো তাকেই বিয়ে করতাম। তাহলে আর তোমাদের বাসায় বিয়ের প্রস্তাব পাঠাতাম না।
কেন?
যাকে ভালোবাসবো তাকেই তো বিয়ে করা উচিত।
ঠিক বলেছেন। আমি তো একজনকে ভালোবসি। তো আমার কী করা উচিত?
তাকেই বিয়ে করা উচিত।
সেটা বলার জন্যই ডেকেছি।
বাবা-মাকে বলেছ?
কিভাবে বলব? ও তো এখনো বেকার।
ওহ, তোমার তাহলে সকার দেখে একজনকে পছন্দ করা উচিত ছিল।
দেখুন, আপনি বিজনেসম্যান। সারাজীবন টাকার পেছনে ছুটেছেন। ভালোবাসার সময়ও হয়তো পাননি। তাই একটা মেয়েকে দেখে পছন্দ হলো। প্রস্তাব পাঠালেন। মেয়ের বাবা-মা জোর করে আপনার হাতে তুলে দিলো। ফলে কী হলো? মেয়েটাকে সারাজীবন ভালোবাসা হারানোর কষ্ট বুকে নিয়ে অন্যের সংসারে সুখী হওয়ার অভিনয় করতে হলো।
দেখো, এখানে আমার কী করার আছে। ঠিক আছে তুমি যখন নিজে এসে বললে, আমি আর আগাবো না। তবে একটা অনুরোধ।
কী? বলেন।
আমি কি তোমার ভালোবাসার মানুষটাকে কোনোভাবে হেল্প করতে পারি?
সেটা ওর সাথে কথা না বলে জানাতে পারছি না।
সে যাকগে। চলো একটু কফি-টফি খাই।
না, কোনো কফিশপে বসব না। (এদিক-ওদিক তাকিয়ে) ওই যে এক চাঅলা যাচ্ছে। ডাক দিন তাকে।
কী বলো? ওই পার্কের চা খাব আমরা?
কেন নয়? কী সমস্যা? উনি তো জীবিকা নির্বাহের জন্যই বিক্রি করছেন, না কি?
ঠিক আছে। (ঘাড়টা একটু ঘুরিয়ে) এই চাঅলা ভাই। এদিকে আসেন।
চাঅলা ধীর পায়ে এগিয়ে আসে। মুখের অর্ধেকটা গামছা দিয়ে আড়াল করা। এসে ফ্লাস্কটা রেখে কাপ ধুয়ে চা দিতে গেলে মুখের গামছাটা সরে যায়।
সমস্বরে: সালু, তুমি…
সালু: হ্যা, আমি। অবাক হয়েছো তোমরা?
সাবিত: এসবের মানে কী?
সালু: মানে আবার কী? আমি চাঅলা। দেখতেই পাচ্ছো।
সাবিত: মজা করো না সালু। অন্তত আমার সঙ্গে।
লোপা: কী, হচ্ছে কী এসব? আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। আপনারা একে অন্যকে চেনেন?
সাবিত: আমি বলছি শোনো…
সালু: প্লিজ সাবিত।
লোপা: সালু, তুমি কোনো কথা বলবে না।
সাবিত: সালু বাবা-মার একমাত্র সন্তান। ছোটবেলা থেকেই একরোখা, বাউন্ডুলে। লেখালেখি করতে ভালোবাসে। চারুকলা থেকে পড়াশোনা শেষ করে আঁকাআঁকি নিয়েই আছে। টাকা-পয়সার অভাব না থাকলেও সাদাসিধা জীবনযাপন করে।
লোপা: তা-ই বলে চাঅলা?
সালু: তুমি পথিক বাঙালির ‘যুবতী এবং চাঅলা’ গল্পটি পড়েছ?
লোপা: হুম। পড়েছি। তো কী হয়েছে?
সালু: আমিই পথিক বাঙালি। আমি বিভিন্ন চরিত্রের মধ্যে গল্পের প্লট খুঁজি। তুমি আমাকে যতদিন যেভাবে দেখেছ, সবই আমার গল্পের চরিত্র। তবে তোমাকে ভালোবাসি এটা সত্য। কিন্তু সাবিত তোমাকে বিয়ে করতে চায়?
লোপা: হ্যাঁ, উনিই তো প্রস্তাব পাঠিয়েছেন। আমি তোমাকে ওনার কথাই বলেছি।
সালু: সাবিত আমার ছোটবেলার বন্ধু। বিভিন্ন প্রেক্ষাপটের কারণে আমরা আপাতত বিচ্ছিন্ন। এখন সবাই যার যার কাছে ব্যস্ত।
সাবিত: লোপাকে ধন্যবাদ। আজকের এই মহামিলনের জন্য।
সালু: বন্ধু বিচ্ছেদের সুর তো বাজতে শুরু করলো।
সাবিত: মানে?
সালু: আমি কি আমার বন্ধুর জন্য ভালোবাসা বিসর্জন দিতে পারি না?
সাবিত: আর কোনো নাটক নয়। আর কোনো কাল্পনিক গল্প নয়। এবার বাস্তব জীবনের গল্প লেখো।
লোপা: না, ওকে আমি বিয়ে করতে পারব না। ও আমাকে ঠকিয়েছে। গরিব সেজে
আমার ভালোবাসা পরীক্ষা করেছে। ও একটা প্রতারক।
সালু: স্যরি, আর হবে না। তবে মাঝেমাঝে পাগল সাজতে পারি। ওই চরিত্রটা বিয়ের পরে করব ভাবছি।
লোপা: ইয়েস, গুড বয়। তুমি আগেও যেমন ছিলে, তেমনই থাকবে। কারণ আমি ওই সালুকেই ভালোবেসেছি। কোনো বিখ্যাত লেখক বা চিত্রশিল্পীকে নয়।
সাবিত: জয় ভালোবাসার জয়, আমি তবে চোখের জলে নেই বিদায়। ভালো থাকিস বন্ধু। সুখে থাকিস তোরা।
সালু: আমরা কি হাসপাতাল পর্যন্ত পৌঁছে দেব?
সাবিত: মানে? আমি কি রোগী?
লোপা: না মানে সিনেমার শেষ দৃশ্যে এমনটা হয় না?
সাবিত: এটা বাংলা সিনেমা নয়? সুতরাং এমন দৃশ্যের অবতারণা হওয়ারও সম্ভাবনা আপাতত নেই।
সমস্বরে হেসে উঠলো সবাই। লোপা আর সালু আরও একটু কাছে, শরীরে শরীর ঘেঁষে। নীরবে বয়ে যায় উষ্ণতার বাতাস। সাবিত হেঁটে চলে আপন পথে।