দুটি কথা
আমি কাগজ-কলমে কবিতা লিখি। যখন কবিতা লিখি, তখন কাগজকে মনে করি আমার হৃৎপিণ্ড, কলমকে ছুরি। তাই আমি হৃৎপিণ্ডকে রক্তাত করে কবিতা লিখি। সেই কারণবশত আমার প্রতিটি কবিতা আমার জীবনেরই অংশ। অথচ আমার জীবন থেকে কবিতা অনেক বড়। সে জন্য কবিতা আমার কাছ থেকে অনেক দূরে-দূরে বসবাস করে। যদিও আমি তাকে প্রাণপণে কাছে পেতে চাই।
মাটির অনেক গভীরের জল যেমন সুপেয়, তেমনি করে জীবনের অনেক গভীরতম বোধই আমার কাছে কবিতা। তাই আমি কবিতার মাধ্যমে নিজেকে খনন করি। গর্ভবতী নারীর মতো পুলক অনুভব করি, দুঃখ অনুভব করি।
আমার কৃষক বাবা যেমন লাঙলের মুঠোটা শক্ত করে ধরে শস্যক্ষেত্র তেরি করে ফসল ফলায়। আমিও তেমনি করে কলম হাতে কবিতার শস্যক্ষেত্র চাষ করি। তবু মনে হয়—আমার কলমের কালির কী এমন সাধ্য আছে, যা বাবার ঘামের তুল্য হয়।তাই আমার কবিতা প্রতিতুলনাহীন আজন্ম ক্ষুধার্ত।
আমার গৃহিণী মা যেমন ধানের মলম শেষে ক্লান্ত শরীরে ঘুমিয়ে পড়ে এবং সেই ঘুমন্ত অবস্থায় বাবাকে একান্ত কাছে আসার সুযোগ করে দেয়। আমার কাছে কবিতা অনেকটা তাই, যা ঘুমন্ত অথচ কামহীন নয়।
কোনো কোনো শিশুর জন্মের পূর্বে তার নাম রাখ হয়। আমার কাব্যবোধ তাই নয় কি? হয়তোবা তাই! অথচ আমার কোনো কবিতার মা-বাপ নেই। নেই কোনো মৌলিক জন্মবীজ। কারণ আমি জীবনের নামতা পাঠে জেনেছি—শিল্পসাহিত্যে মৌলিক বলতে কিছু নেই, এমনকি নেই কোনো মৌলিক কবি কিংবা জ্ঞান। বস্তুত সব জ্ঞান কিংবা কবিতা আমরা বস্তুজগৎ ও প্রকৃতি থেকে সংগ্রহ করি মাত্র। সেই অর্থে আমি একজন কবিতা সংগ্রহকারী। প্রকৃত প্রস্তাবে নই কোনো কবি।
মা সিরিজ
(ক)
সবুজ চা পাতা শুকিয়ে গরম পানিতে স্নান করালে
ওই পানির রঙ রক্তলাল হয়ে যায়
চা পাতার এই রক্তলালের রহস্য খুবই কুয়াশাময়।
আমার মায়ের গল্পে শুনেছি-চা পাতার এই রক্তাক্ত রহস্যকথা
মা বলেছিলেন—‘চা পাতার মাঝে লুকিয়ে আছে
চা শ্রমিক নির্যাতনের রক্ত। তাই সে লাল।’
সেই থেকে আমার চা পান করলে মনে হয়
আমি কোনো না কোনো শ্রমিকের রক্ত পান করছি।
(খ)
আমার দাদু জীবন বাউল ছিলেন
আমি তার কাছ একতারা পাঠের তালিম নিতাম।
তখন আমি দেখেছি—একতারা বেসুরে বাজলেই
দাদু মোচড় দিয়ে একতারার তার ঠিক করতেন।
যেমন করে আমি বেপথে গেলেই—
মা আমার কান মোচড় দিয়ে—আসল পথ দেখাতেন।
অনেক পরে মায়ের কাছে জেনেছি—
আমাদের জীবন নাকি লালনের কাছে একতারার তার
তাই মোচড় দিয়ে তিনি গাইতেন মানবতার সুর।
(গ)
ব্যাঙ বড় হলে হারিয়ে ফেলে তার শিশুকালের লেজ
আমিও এমনি করে—শহরে এসে হারিয়ে ফেলেছি গ্রামের স্মৃতি।
মা, তুমি আমারে কেন পাঠালে শহরে?
আমি তো ভালোই ছিলাম তোমার আঁচলে মুখ গুঁজে।
এই শহরের খোয়াড়ে আমি এক ঘাড়ভাঙা অন্ধঘোড়া।
মা, তুমি আমারে কেন পাঠালে শহরে?
আমি তো ভালোই ছিলাম-মধুমতির জোয়ার ভাটার টানে।
এখন এই শহর আমার শরীরে—
প্রতিদিন পুশ করে দুঃখের ইনজেকশন।
মা, আমার ভেতরের ঘাড়ভাঙা অন্ধঘোড়া
এখন ঘুরে দাঁড়িয়েছে।
তাই আমি ফিরে আসতে চাই-মেঠোপথের ধানফুলে
কুয়াশায় নুয়ে পড়া আমের মুকুলে
তোমার আদরমাখা নরম মাটির কোলে।
(ঘ)
মা আমাকে যে বিছানায় প্রসব করেছিলেন
সে বিছানায় আমি প্রস্রাব করেছি বহুবার।
কারণ আমাদের ঘর ও আঁতুড়ঘরের কোনো পার্থক্য নেই
এমনকি আমার পিতা-মাতার বাসরঘর ছিল ওই ঘর।
আমাদের সেই একটি ঘরের একটি রুমের একই বিছানায়
মা আমাদের কাটিয়ে দিলেন জীবনের পুরোটা সময়।
অথচ! আমরা যখন নতুন আরেকটি বাড়ি বানালাম
সেই নতুন বাড়ির উদ্বোধনের দিনে-মা আমাদের জানালো
তিনি আজই সন্ন্যাসে যাবেন, বুকের ভেতরে বহুদূরের পথ মাড়িয়ে।
আমাদের নতুন বাড়ির দিকে তাকিয়ে মা একবার হাসলেন
তারপর পা রাখলেন সন্ন্যাসের পথে।
মা আমাদের চলে যাচ্ছে—
বুকের ভেতরের গহীন জলে ঢেউ তুলে চলে যাচ্ছে।
আমাদের চলে যেতে যেতে ছোট হয়ে যাচ্ছে।
ও দখিনা বাতাস-তুমি আমাদের অগস্ত্যযাত্রার মাকে বলে দিও
আমরা তাকে কাঁদতে দেখেছি।
(ঙ)
কোনো এক অন্ধকবি জেলখানার জানালা খুলে দেখে
নরম আলো নিয়ে জেগেছে ভোরের সূর্য।
সেই আলো তার হৃদয়ে মেখে-সে বুঝতে পায়
পৃথিবী একটি অন্ধকার জেলখানা।
আরো পরে সে দেখে-সেই জেলখানার দ্বারে
তার প্রিয়তম জননী, তারই মুক্তির প্রতীক্ষায়—
হাজার বছর ধরে অনশনে রত।
তারপর সে বুঝতে পায়
পৃথিবীর অন্ধত্ব চিরস্থায়ী নয়।