সোমবার বিকেল পাঁচটা। বাজারের টলঘর ভরা মানুষ। সব বয়সী মানুষে ঠাসা ফ্লোর। এলাকার মাতুব্বররা চেয়ারে বসা। তাদের সামনে একটি কাঠের টেবিল। টেবিলে রাখা এক প্লেট পান, এক পিরিচ কাটা সুপারি, এক কৌটা চুন, এক কৌটা জর্দা। এসবের ব্যবস্থা করেছে জালাল। বয়স্করা সেখান থেকে পান বানিয়ে খায়।
আগত বাকিরা হোগলা পেতে ফ্লোরে বসা। সেখানে সব বয়সের মানুষই আছে। বিচার-সালিশ তাদের কাছে গল্প-আড্ডার মতো মনে হয়। তাদের উপস্থিতি গুরুত্বপূর্ণ না হলেও বিচার কাজের প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে যথার্থ। সব শ্রেণির লোকের সমাগম দেখলে গ্রাম্য মাতুব্বরা একুট জোশ পায়। তাদের বিচার কাজ জমে ওঠে। পাশাপাশি তাদের ক্ষমতা, কর্তৃত্ব, বাহাদুরী জনসমক্ষে জাহিরের সুযোগ পায়। গ্রামাঞ্চলে যুগ যুগ ধরে এমনটিই হয়ে আসছে।
সালিশের ভাষায় অভিযুক্ত মমতা, মমতার ছেলে শাহেদ আর মমতার মা টলঘরের এক কোণে বসে আছে। মমতার শরীর বেশি একটা ভালো নয়। মাথাও ঠিক আগের মতো কাজ করে না। যখন-তখন আবোল-তাবোল বকে। মাঝে মাঝে কথাই বলে না। তাই সময় ক্ষেপণ সমীচীন নয় ভেবে কথা শুরু করলো মহিন চৌধুরী। বার দুয়েক গলা ঝেরে নিয়ে বললো, ‘আচ্ছা, বিচার-সালিশ শুরু করলাম তাইলে। আগে কও জালাল, তুমি তো অভিযোগকারী। কও মিয়া, তোমার কী অভিযোগ?’
সবাইকে সালাম দিয়ে জালাল বলতে শুরু করে, ‘আইজ থেকা বছর সাত আগে আমি মমতারে বিয়া করছিলাম। ধর্মীয় নিয়ম-কানুন মাইনাই বিয়া অইছিলো। তয় বড়-সড় কইরা অনুষ্ঠান করি নাই। তড়িগড়ি কইরা বিয়া অইছিল। বাজানে জোর কইরা বিয়া করাইছিল। হেই কতা সবাই জানেন। বিয়া কইরা এক বছর পরই বিদাশ গেছিলাম, তা-ও আপনেরা সবাই জানেন। যাই হোক, বিদাশ গিয়া সবাই সুখ পায় না। সবাই সফল অয় না। কেউ কেউ কষ্টও পায়। আমিও কষ্ট পাইছি। আমি স্বীকার করি, কিছু ভুল-ভ্রান্তি আমারও আছিল। তাই আমার লগে লগে আমার পুরা পরিবারও কষ্ট পাইছে। দালালের খপ্পড়ে পইড়া না পাইছি কাজ, না পাইছি বৈধতা। নিজের টাকা দিয়া বিদাশ গিয়াও আকামা না পাইয়া পলায়া পলায়া এতদিন আছিলাম। আর হেই সুযোগে নিজের ঘরে বইয়া আকাম-কুকাম কইরা বেরাইছে আমারই বিয়া করা বউ। তার কোলে এহোন দুই বছরের বাচ্চা। তার আবার নাম রাখছে শাহেদ। হেই বাচ্চা কার, আমি জানি না। এমনকি আমার বাপ-মায়েও জানে না। আপনেরা জানতে চাইলে হ্যারে জিগান। আর আপনেরাই কন, এই বউ কি আমার ঘরে নেওয়া উচিত?’ কথা শেষ হয় জালালের। যেন কিছুটা হাপিয়ে ওঠে সে। কথা শেষ করে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে।
‘কী রে মমতা, তোর কী কওনের আছে, সংক্ষেপে তাড়াতাড়ি কইয়া ফালা।’ মমতার উদ্দেশে বলে মহিন চৌধুরী।
মমতা কোনো কথা বলে না। এদিক-সেদিক তাকায়। মনে হয় কাউকে খোঁজে। ভরসার একজন মানুষ খোঁজে। চোখের তারায় আতিপাতি। মুখে রাজ্যের হতাশা।
‘কিরে কতা কস না কেন মমতা?’ ধমক দিয়ে বলে মহিন চৌধুরী।
মহিন চৌধুরীর ধমক শুনে মমতার মা বলে, ‘মমতা আর কী কইবো? কওনের তো কিছু নাই। মমতা যদি কইতেই পারতো, তাইলে তো পোলার বাপের নামও কইতে পারতো। জালাইললা যে সেরাজরে মারল, হেই কতা তো কেউ কইলো না। আমাগো কিছু কওনের নাই। আপনেরা যা খুশি বিচার কইরা দেন।’
মমতা মায়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ছোট্ট করে শুধু বলে, ‘আমরা কী কমু, আপনেরা যা কন।’ বলেই উদাস নয়নে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। কিন্তু সেখানেও আকাশ নেই। কেবল টলঘরের মরিচা ধরা টিনের চাল দেখতে পায়। মমতার চোখে-মুখে হাতাশার ছায়া। ভীত হরিণীর মতো সে চাহনী কারো অন্তরে মায়ার উদ্রেক করে না। বরং আরও কঠোর বানিয়ে দেয়।
তবে এ আলোচনা চায়ের দোকানে, রাস্তা-ঘাটে, হাটে-বাজারে আরও কয়েকদিন চলবে। অন্য কোনো ইস্যু না আসা পর্যন্ত মমতার নামই থাকবে সবার মুখে মুখে।
‘তোর এই পোলার বাপ কেডা? কইতে পারবি?’ মমতার কথার জবাবে জানতে চায় বাজার কমিটির সভাপতি ইদু খা।
‘আমি কেমনে কমু?’ এবারও ছোট করে জবাব দেয় মমতা। মমতার কথা শুনে হেসে ওঠে উপস্থিত লোকজন। যেন সবাই যাত্রাপালা দেখছে। কিংবা সার্কাসের কোনো সং তাদের সামনে বসা। সেই হাসির রেশ থেকে যায় অনেকক্ষণ। তাই হাসি থামাতে ধমক দেয় মহিন চৌধুরী।
‘হাসনের কী অইলো? আমার বুঝে আসে না, সবাই দাঁত বাইর কইরা হাসতাছেন ক্যান? এইডা কি হাসির জলসা? শোনেন আপনেরা, মমতা মনে হয় পাগলের ভান ধরছে। অরে দোষ দিয়াও লাভ নাই। আসলে সব দোষ মমতার মার। বুড়া মানুষ, তাই কিছু কইতেও পারি না। আর শোনেন মমতার মা চাচি, মাইয়ারে যদি সামলাইতেই না পারেন, তয় বিয়া দিছিলেন কেন? এহোন মায়-ঝিয়ে মিইলা পাগলের নাটক হাজাইছেন।’
মহিন চৌধুরীর ধমক আর রাগত স্বরের কথায় স্তব্ধ হয়ে যায় টলঘর। যেন পিনপতন নীরবতা। হঠাৎ কেঁদে ওঠে মমতার ছেলে শাহেদ। মমতার বুকের কাপড় টানতে টানতে বলে, ‘উদু কাইম, উদু কাইম।’ ছেলের কান্নায়ও মমতা নির্বিকার। থতমত খেয়ে যায় সালিশরাও।
ইদু খা এবার জালালের বাবা বলাই মুন্সীকে উদ্দেশ্য করে বলে, ‘বোঝলেন তো ভাই অবস্থা? মমতা তো কোনো কতাই ঠিকমতো কয় না। মাতামুতা মনে অয় খারাপ অইয়া গেছে গা। এই মাইয়ার আশা কইরা লাভ নাই। আর গ্যাঞ্জাম-ফ্যাসাদ না করাই ভালো।’
‘এই মাইয়ার আশা তো ছাইড়া দিছি হেদিনই; যেদিন আমার ঘরে পরপুরুষ লইয়া রাইত কাটাইছে। আমার মাতা মোডা পোলারে খালি বুঝাইতে পারি না ভাই। এই মাইয়া দিয়া আমরা কী করমু? কার না কার পোলা আমরা পালমু? আর কোন মুখ লইয়া আমার বাড়ি ওডবো? নাউজুবিল্লা।’ বলে বলাই মুন্সী।
‘কিরে মেরাজ, তোর বইনেরে তালাক দেওন ছাড়া তো কোনো গতি নাই। কী কস তোরা?’ জানতে চায় ইদু খা।
‘আমার বইনের অপরাধে আমাগো তিন মাস একঘইরা কইরা রাখছিলেন। এহোন আবার সমাজ যেইডা ভালো মনে করে, হেইডাই করবো। আমরা আর কী কমু চাচা?’ মাথা নত করে কথাটি বলে মেরাজ।
‘মুখ শামলায়া কতা কঅ বেডা। আকাম-কুকাম করবো, আবার বড় বড় কথা।’ মেরাজের কথায় ক্ষিপ্ত হয়ে বলে ওঠে ইদু খা।
‘আচ্ছা, ঠিক আছে তাইলে। দু’এক দিনের মইধ্যে লিগাল এইডের লগে আলাপ কইরা কোটে গিয়া ঝামেলাডা শ্যাষ কইরা ফালাইও তোমরা।’ আর কথা না বাড়িয়ে দুই পক্ষের উদ্দেশে বলে মহিন চৌধুরী।
জীবনের কঠিন মুহূর্তে মমতা ছেলেকে দুধ খাওয়ায় আপনমনে। মাথা নিচু করে বসে থাকে। সবার কথা তার কানে গেল কি না, সে-ই কেবল বলতে পারে। আর কেউ হয়তো অনুমান করতে পারলো না।
সালিশি আপাতত শেষ। সবাই যার যার মতো চলে যায়। সবার মুখে এখন মমতার নাম। বয়স্করা ছি-ছি করে। জালাল জেনে-শুনে আবার এই মেয়েকে কিভাবে নিতে চায়? কেনই বা নিতে চায়? কারো মাথায় ধরে না। না কি সবাইকে জানিয়ে তালাক দিতেই আজকের এই আয়োজন? এমনটাও ভাবে কেউ কেউ। তবে এ আলোচনা চায়ের দোকানে, রাস্তা-ঘাটে, হাটে-বাজারে আরও কয়েকদিন চলবে। অন্য কোনো ইস্যু না আসা পর্যন্ত মমতার নামই থাকবে সবার মুখে মুখে।
মমতা
সালাহ উদ্দিন মাহমুদ
প্রকাশনী: অন্যধারা
প্রচ্ছদ: আরিফুল হাসান
বইমেলা ২০২১
মূল্য ২০০ টাকা