জেরুজালেমের বোনেরা, আমার জন্য কেঁদো না,
কাঁদো তোমাদের জন্য,
আর তোমাদের সন্তানদের জন্য।
লুক ২৩:২৮
মুখবন্ধ ও সম্ভাষণ
১৯৪৫ সালের ডিসেম্বর মাস। মিশরের হামরা ডম এলাকা। দুই ভাই বিশ্রামের জায়গা খুঁজতে খুঁজতে এক গুহার মধ্যে পেয়ে গেল প্যাপিরাসভর্তি একটি ভস্মাধার। স্থানীয় কর্তৃপক্ষকে বলার পরিবর্তে—আইন অনুযায়ী যা হওয়া উচিত—তারা সরকারের দৃষ্টি এড়াতে সেগুলো প্রাচীন জিনিসপত্রের বাজারে বিক্রি করার সিদ্ধান্ত নিল। বালক দুটির মা অশুভ শক্তি ভেবে কয়েকটি প্যাপিরাস পুড়িয়ে দিলেন।
পরের বছর, কোনো কারণে যা ইতিহাসে উল্লেখ নেই, ভাইয়ে ভাইয়ে ঝগড়া হলো। এই ঝগড়াকে অশুভ শক্তির প্রভাব ভেবে মা প্যাপিরাস-পাণ্ডুলিপিগুলোকে একজন ধর্মযাজকের কাছে হস্তান্তর করলেন, যে-যাজক আবার সেগুলোকে কায়রোর কপ্টিক মিউজিয়ামে বিক্রি করে দিলেন। সেখানে প্যাপিরাসগুলোর নাম দেওয়া হলো, যা আজ পর্যন্ত তা-ই আছে: নাগ হামাদির পাণ্ডুলিপি (যে গুহায় এগুলো পাওয়া গিয়েছিল তার পার্শ্ববর্তী শহরের নামানুসারে)। মিউজিয়ামের একজন বিশেষজ্ঞ, ধর্মীয় ইতিহাসবিদ জ্যা ডরেসি এই আবিষ্কারের গুরুত্ব অনুধাবন করতে পেরে প্রথমবারের মতো ১৯৪৮ সালের একটি প্রকাশনায় এর উল্লেখ করলেন।
অন্য প্যাপিরাসগুলো কালোবাজারে পাওয়া যেতে লাগল। পাণ্ডুলিপিগুলো দেশের বাইরে পাচার ঠেকাতে চেষ্টা করল মিশরীয় সরকার। ১৯৫২-এর বিপ্লবের পর, অধিকাংশ পাণ্ডুলিপি কায়রোর কপ্টিক মিউজিয়ামে হস্তান্তর করা হলো এবং জাতীয় ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে ঘোষণা করা হলো। একটিমাত্র লেখা কোনো প্রকারে বাদ পড়ে যায়, এবং এটা বেলজিয়ামের একটি প্রাচীন সংগ্রহ বিক্রির দোকানে চলে আসে। নিউ ইয়র্ক ও প্যারিসে বিক্রির নিষ্ফল প্রচেষ্টার পর, অবশেষে ১৯৫১ সালে কার্ল জাং ইনস্টিটিউট তা কিনে নেয়। বিখ্যাত মনোবিশ্লেষকের মৃত্যুর পর, প্যাপিরাসটি, এখন যা জাং কডেক্স নামে পরিচিত, কায়রোতে ফেরত আসে, যেখানে প্রায় এক হাজার পৃষ্ঠা এবং নাগ হামাদি পাণ্ডুলিপির খণ্ডিতত অংশ এখন পাওয়া যায়।
***
প্যাপিরাসগুলো কিছু আদি পাঠের গ্রিক অনুবাদ যা লেখা হয়েছিল খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতাব্দীর শেষ ও ১৮০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যবর্তী সময়ে। আর এগুলো একটি কাজের অবয়ব গড়ে তোলে যা ‘অ্যাপোক্রিফাল গসপেল’ নামে পরিচিত। কারণ আমরা আজ যা জানি, তা হলো এ পাঠগুলো বাইবেলে অন্তর্ভুক্ত হয়নি। এখন প্রশ্ন হলো কেন এমন হলো?
১৭০ খ্রিস্টাব্দে একদল যাজক একত্রিত হন কোন পাঠগুলো নিয়ে নিউ টেস্টামেন্ট গঠিত হবে, এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য। মাপকাঠিটি ছিল খুব সহজ: যা-কিছুই জনশ্রুতি ও সময়ের মতবাদগত বিভাজনের সঙ্গে লড়াই করতে ব্যবহৃত হতে পারবে, তার সবই অন্তর্ভুক্ত হবে। চারটি গ্রন্থ বাছাই করা হলো। যাজকদের এই সভার উল্লেখ এবং তাদের গ্রন্থতালিকা মিউরেটরিয়ান প্রামাণিক রচনাবলীতেও পাওয়া যায়। অন্যান্য গ্রন্থ যেমন নাগ হামাদিতে পাওয়া গ্রন্থ বাদ দেওয়া হয়, কারণ হয় সেগুলো নারীদের দ্বারা লিখিত হয়েছিল (উদাহরণস্বরূপ, মেরী মেগদালিন-এর বয়ান মতে বাইবেলের পাঠ) কিংবা তারা এমন এক যীশুকে চিত্রিত করেছিল, যিনি তার স্বর্গীয় মিশন সম্পর্কে অবগত ছিলেন এবং যার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে অন্তর্ধান হয়েছে।
***
১৯৪৭ সালে ইংরেজ প্রত্নতত্ত্ববিদ স্যার ওয়াল্টার উইলকিনসন আরেকটি পাণ্ডুলিপি আবিষ্কার করেন, এবার তা তিনটি ভাষায় লিখিত: আরবি, হিব্রু ও ল্যাটিন। এ ধরনের আবিষ্কারকে কোথায় আইনি সুরক্ষা দেওয়া হয়—এ খবর নিয়ে তিনি গ্রন্থটিকে কায়রো বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাচীনতত্ত্ব বিভাগে পাঠিয়ে দেন। এর অব্যবহিত পরই জবাব আসে: এই দলিলটির কমপক্ষে ১৫৫টি কপি বিশ্বব্যাপী প্রচারিত হয়েছে (এর তিনটি মিউজিয়ামে সংরক্ষিত আছে)। এর সবগুলোই একই রকমের ছিল। কার্বন-১৪ পরীক্ষা (জৈব পদার্থের বয়স নির্ধারনে ব্যবহৃত হয়) এটা প্রকাশ করল যে দলিলটি ছিল তুলনামূলকভাবে সাম্প্রতিককালের, সম্ভবত ১৩০৭-এর দিকের। এটা বের করা খুব সহজ ছিল যে, এর উৎপত্তি ছিল আক্রায়, মিশরের সীমানার বাইরে। সুতরাং দেশটি থেকে পাণ্ডুলিপিটি বের করে নিয়ে যেতে কোনো নিষেধাজ্ঞা ছিল না, আর স্যার ওয়াল্টার মিশরীয় সরকার থেকে (রেফা. ১৯০১/৩১৭/আই এফ পি-৭৫, তারিখ ২৩ নভেম্বর ১৯৭৪) এটি তার সঙ্গে ইংল্যান্ড নিয়ে যাওয়ার লিখিত অনুমতি পেয়েছিলেন।
***
আমি স্যার ওয়াল্টারের ছেলের সঙ্গে ১৯৮২ সালের ক্রিসমাসে ওয়েলসের পর্থমাডগ এ সাক্ষাৎ করলাম। আমার মনে আছে, সে বলছিল পাণ্ডুলিপিটি তার বাবা কর্তৃক আবিষ্কৃত হয়েছিল, কিন্তু আমরা কেউই এ বিষয়টিকে পাত্তা দিলাম না। আমরা একটি হৃদয়িক সম্পর্ক বজায় রাখলাম এবং কমপক্ষে আরও দুটি অনুষ্ঠানে আমাদের দেখা হলো, যেখানে আমি আমার বইয়ের প্রচারের জন্য ওয়েলস ভ্রমণ করেছিলাম।
২০১১-এর নভেম্বর মাসে পাণ্ডুলিপিটির একটি কপি আমি পাই, যা সে প্রথম সাক্ষাতে উল্লেখ করেছিল। আমি এটি এখানে ভাষান্তরিত করলাম।
। এক ।
আমি বরং এভাবেই শুরু করব যে:
‘এখন আমি যেহেতু জীবনের শেষ প্রান্তে,
পৃথিবীর বুকে চলতে গিয়ে আমি যা কিছু শিখেছি
আমি তাদের জন্য সেসব রেখে যাচ্ছি, যারা আমার পরে আসবে।
তারা যেন এর সদ্ব্যবহার করে।’
হায়, সেটি সত্য নয়। আমার বয়স মাত্র একুশ। বাবা-মা আমাকে ভালোবাসা ও শিক্ষা দিয়েছেন, আর আমি বিয়ে করেছি একজন নারীকে, যাকে আমি ভালোবাসি, সেও ভালোবাসে আমাকে। কিন্তু, আগামি কাল, জীবন আমাদের আলাদা করে দেবে, এবং আমরা প্রত্যেকে নতুন পথের সন্ধানে বের হয়ে যাব, কিংবা আমাদের নিজস্ব নিয়তির সন্ধানে বা মৃত্যুকে মোকাবিলা করার আমাদের নিজস্ব পদ্ধতির সন্ধানে আমরা বের হব।
আমাদের পরিবারের জন্য আজ ১০৯৯ সনের ১৪ জুলাই। আমার শৈশবের বন্ধু যার সঙ্গে আমি এই জেরুজালেম নগরীতে খেলাধুলা করতাম, সেই ইয়াকুবের পরিবারের জন্য সনটি হচ্ছে ৪৮৫৯। ইয়াকুব সবসময় খুব গর্ব করে বলে যে ইহুদিবাদ আমাদের ধর্মের চে’ অনেক অনেক প্রাচীন। কিন্তু ইবনে আল-আথির, যিনি তার সমস্ত জীবন ব্যয় করেছেন একটি ইতিহাসকে লিপিবদ্ধ করার জন্য, যা কিনা এখন প্রায় শেষ পর্যায়ে, তার জন্য ৪৯২ সাল প্রায় শেষ হয়ে এলো। আমরা তারিখ নিয়ে একমত হই না, কিংবা ঈশ্বরের উপাসনার সর্বোত্তম উপায় নিয়েও না, কিন্তু অন্য সব ক্ষেত্রে আমরা শান্তিতেই বসবাস করি।
এক সপ্তাহ আগে আমাদের কমান্ডার একটি সভা করলেন। ফরাসি সৈন্যরা আমাদের চেয়ে সীমাহীনভাবে শক্তিশালী এবং অনেক ভালো অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত। আমাদের দুটো থেকে একটি বেছে নিতে বলা হলো: নগরী ছেড়ে চলে যাওয়া, না হয় আমৃত্যু যুদ্ধ করা। কারণ এটা নিশ্চিত ছিল যে, আমরা পরাজিত হব। তবে আমাদের অনেকেই এখানে থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল।
মুসলমানরা এ সময় আল আকসা মসজিদে জড়ো হলো। এদিকে ইহুদিরা তাদের সৈন্যদের মিহরাব দাউদে জড়ো করল, যেটা ডেভিডের টাওয়ার নামে খ্যাত, আর বিভিন্ন জায়গায় বসবাসরত খ্রিস্টানদের শহরের দক্ষিণাঞ্চল রক্ষার দায়িত্ব দেওয়া হলো।
বাইরে আমরা ইতোমধ্যে শত্রুদের ছিন্নভিন্ন জাহাজ থেকে তৈরি অবরুদ্ধ টাওয়ার দেখতে পাচ্ছি, শত্রুদের চলাচল দেখে মনে হচ্ছে তারা আগামীকাল সকালে আক্রমণ করবে, পোপের নামে আমাদের রক্ত ঝরিয়ে, নগরীর স্বাধীনতা ও ঈশ্বরের ইচ্ছাপূরণের জন্য।
এই সকালে একই স্কয়ারে, যেখানে সহস্রাব্দ আগে রোমান শাসক পন্টিয়াস পিলেট যিশু খ্রিস্টকে ক্রুশে চড়ানোর জন্য উন্মত্ত জনতার হাতে তুলে দিয়েছিল, সব বয়সের একদল নারী ও পুরুষ কপ্ট (প্রাচীন মিশরীয় খ্রিস্টান) নামে পরিচিত এক গ্রিককে দেখতে পেল।
কপ্ট একজন আজব মানুষ। কৈশরেই সে টাকা ও রোমাঞ্চের সন্ধানে নিজ শহর এথেন্স ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু উপবাসে, আমাদের নগরীর দরোজায় করাঘাতের মধ্য দিয়ে তার রোমাঞ্চের সমাপ্তি ঘটে। তাকে যখন এখানকার লোকেরা গ্রহণ করে নেয়, সে পর্যায়ক্রমে তার যাত্রা চালিয়ে যাওয়ার ধারণাটি পরিত্যাগ করে এবং এখানে থেকে যাওয়ার সংকল্প করে।
তারপর সে একটি জুতা তৈরির দোকানে কাজ নেয়। ইবনে আল-আথিরের মতোই সে যা ই দেখত এবং শুনত তা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য লিপিবদ্ধ করতে শুরু করল। কোনো ধর্মে সে যোগ দেয়নি, আর কেউ তাকে এ বিষয়ে প্ররোচিতও করেনি। তার বিষয়ে বলতে গেলে আমরা এখন ১০৯৯ কিংবা ৪৮৫৯ সালে নেই, তারচে’ ঢের কম ৪৯২ সালের শেষ দিকে আছি। কপ্ট শুধু বর্তমানেই বিশ্বাস করে এবং মইরাকে সে ডাকে—অজানা ঈশ্বর, স্বর্গীয় শক্তি বলে, যা সৃষ্টি জগতের একক বিধানের উৎস হিসেবে কাজ করে। এর কোনো বিচ্যুতি বিশ্বের ধ্বংস ডেকে আনতে পারে।
একইসঙ্গে কপ্ট ছিল জেরুজালেমে বসতি করা তিনটি ধর্মের গোত্রপিতা। কোনো সরকারি কর্মকর্তা এ কথোপকথনের সময় উপস্থিত ছিল না; তারা প্রতিরোধের চূড়ান্ত প্রস্তুতির জন্য ভয়ানক ব্যস্ত ছিল, যা আমাদের বিশ্বাস মতে অযৌক্তিক প্রমাণিত হবে।
‘অনেক শতাব্দী আগে, এই চত্বরে একজন মানুষের বিচার ও শাস্তি হয়েছিল’, গ্রিক লোকটি বলল। ‘ডানদিকের রাস্তা ধরে সে যখন তার মৃত্যুর দিকে হেঁটে আসছিল, সে একদল মহিলাকে অতিক্রম করল। তাদের কাঁদতে দেখে সে বলল: ’আমার জন্য কেঁদো না, জেরুজালেমের জন্য কাঁদো।’ সে তখন যা ঘটছিল তার ভবিষ্যদ্বাণী করছিল: ’কাল থেকে, সম্প্রীতি কলহে পরিণত হবে। আনন্দের জায়গা দখল করে নেবে দুঃখ-দুর্দশা। শান্তি পরাজিত হবে যুদ্ধের কাছে যা অকল্পনীয় দূর ভবিষ্যৎ পর্যন্ত প্রলম্বিত হবে।’
কেউ কিছুই বলল না, কারণ আমরা কেউই জানতাম না আমরা ঠিক কী কারণে ওখানটায় ছিলাম। আমাদের কি এই আগ্রাসণকারীদের বিষয়ে আরও নসিহত শুনতে হবে, যারা নিজেদের ‘ক্রুসেডার’ বলে পরিচয় দিত?
খানিকক্ষণের জন্য কপ্ট সবার বিভ্রান্তিকে উপভোগ করছে বলে মনে হলো। তারপর, দীর্ঘ নীরবতার পর, ব্যাখ্যা করল:‘তারা নগরটিকে ধ্বংস করতে পারে, কিন্তু এ নগরী আমাদের যা শিক্ষা দিয়েছে, তা তারা ধ্বংস করতে পারে না, আর এ কারণেই এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ যে এ জ্ঞান আমাদের দেয়াল, ঘরবাড়ি ও রাস্তা ঘাটের মতো একই পরিণতি ভোগ করবে না। কিন্তু প্রশ্ন হলো জ্ঞান কী?’
কেউই যখন কোনো উত্তর দিল না, তখন সে বলতে লাগল:‘এটা জীবন ও মৃত্যু সম্পর্কে কোনো চরম সত্য নয়, কিন্তু এটা এমন একটা জিনিস যা আমাদের বেঁচে থাকতে এবং প্রতিদিনকার চ্যালেঞ্জকে মোকাবিলা করতে সাহায্য করে। আমরা বই থেকে যা শিখি, এটা তা না, যা কেবলই কী ঘটেছিল বা কী ঘটবে তা সম্পর্কে কিছু বৃথা যুক্তিতর্ক উসকে দেয়; এটা জ্ঞান যা শুভ ইচ্ছাসম্পন্ন নারী ও পুরুষের হৃদয়ে বাস করে।’
কপ্ট বলেই চলল:‘‘আমি একজন শিক্ষিত মানুষ, তবু বছরের পর বছর প্রাচীনকালের নিদর্শনগুলোকে পুনরুদ্ধার, বস্তুর শ্রেণীবিন্যাস, তারিখ লিপিবদ্ধ করা এবং রাজনীতিবিষয়ক আলোচনা সত্ত্বেও, আমি এখনো পুরোপুরি জানি না তোমাদের কী বলব। তবে আমি ‘স্বর্গীয় শক্তি’র কাছে আমার অন্তরকে পবিত্র করে দেওয়ার জন্য প্রার্থনা জানাব। তোমরা আমাকে প্রশ্ন করবে আর আমি সেগুলোর উত্তর দেব। প্রাচীন গ্রিসের মহান শিক্ষকরা এ কাজটিই করে গেছেন; শিষ্যরা তাদের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে প্রশ্ন করত, তারা সেসব প্রশ্নের উত্তর দিতেন।’’
‘আমরা তবে তোমার জবাবগুলো দিয়ে কী করব?’ কেউ একজন জিজ্ঞেস করল।
‘আমি যা বলি তা কেউ কেউ লিখে রাখবে। অন্যরা আমার কথাগুলো মনে রাখবে। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো আজ রাতে তোমরা যা শুনেছ, তা অন্যদের বলতে বলতে বিশ্বের চারটি প্রান্তের দিকে বেরিয়ে পড়বে। আর এভাবেই জেরুজারেমের আত্মা সংরক্ষিত হবে। আমরা একদিন জেরুজালেমকে পুনঃর্নিমাণ করতে সক্ষম হব, কেবল নগর হিসেবেই নয়, জ্ঞানের কেন্দ্র হিসেবে এবং এমন একটি স্থান হিসেবে যেখানে শান্তি পুনরায় রাজত্ব করবে।’
‘আমরা সবাই জানি আগামীকাল আমাদের জন্য কী অপেক্ষা করছে’, আরেকজন বলে উঠল। ‘এটা আলোচনা করাই কি ভালো নয় যে, কিভাবে আমরা শান্তির জন্য বা যুদ্ধের প্রস্তুতির জন্য কথাবার্তা চালিয়ে যেতে পারি?’
কপ্ট তার আশেপাশের অন্য ধর্মাবলম্বী মানুষদের দিকে খেয়াল করল এবং পরক্ষণেই জনতার দিকে ঘুরে দাঁড়ালো। ‘আমরা কেউই কিন্তু বলতে পারি না কালকের দিনটি আমাদের জন্য কী রেখেছে, কারণ প্রতিটি দিনেরই ভালো এবং খারাপ মুহূর্ত আছে। সুতরাং, যখনই তোমরা তোমাদের প্রশ্নগুলো করবে, বাইরের সৈন্য সামন্ত ও ভেতরের ভয়ের কথা একদম ভুলে যাবে। আজ এ তারিখে কী ঘটল, তা ভবিষ্যৎ উত্তরাধিকারীদের জন্য লিপিবদ্ধ করে যাওয়া আমাদের কাজ নয়; ইতিহাস তার নিজস্ব পথেই চলবে। আমরা শুধু আমাদের দৈনন্দিন জীবন নিয়ে কথা বলব, কথা বলব সেসব প্রতিকুলতা নিয়ে যা আমাদের মোকাবিলা করতে হয়। এতেই ভবিতব্য নির্ধারিত হবে। কারণ আগামী হাজার বছরেও খুব বেশি কিছু পরিবর্তন হবে বলে আমি বিশ্বাস করি না।’
।দুই।
তখন আমার প্রতিবেশী ইয়াকুব বলল:
‘পরাজয় সম্পর্কে আমাদেরকে কিছু বলো।’
আর সে প্রতিউত্তরে বলল:
একটি পাতা, যখন সে শীতে গাছ থেকে ঝরে পড়ে, তখন কি ঠাণ্ডায় নিজেকে পরাজিত ভাবে?
গাছ তখন পাতাকে বলে: ‘এটাই জীবনের চক্র। তুমি ভাবতে পারো তুমি মরে যাচ্ছ, কিন্তু তুমি বেঁচে থাকো আমার ভেতরে। তোমাকে ধন্যবাদ যে আমি বেঁচে আছি, কারণ তোমার কল্যাণেই আমি নিঃশ্বাস নিতে পারি। তোমাকে আরও ধন্যবাদ যে আমি প্রেম অনুভব করতে পেরেছি, কারণ ক্লান্ত পথিকদের ছায়া দিতে পেরেছিলাম আমি। তোমার প্রাণ আমার প্রাণে; আমরা দুজনে মিলে একজন।’
একটি মানুষ, যে সর্বোচ্চ পর্বত আরোহণের প্রস্তুতি নিতে গিয়ে বছরের পর বছর কাটিয়ে দিয়েছে, কখনো কি নিজেকে পরাজিত ভাবে, যখন পর্বতে পৌঁছে সে দেখে যে প্রকৃতি ঝড়ো মেঘ দিয়ে পর্বতচূড়াকে ঢেকে রেখেছে? ওই মানুষটি তখন পর্বতকে বলে: ‘এবার তুমি আমাকে চাওনি, কিন্তু আবহাওয়াও পরিবর্তিত হবে, এবং একদিন আমি তোমার চূড়ায় উঠবই। ততদিন তুমি আমার জন্য অপেক্ষা করতে থাকো।’
জীবনের প্রথম প্রেমে প্রত্যাখ্যাত হয়ে একজন তরুণ কি এটা ঘোষণা দিয়ে বসে যে প্রেমের কোনো অস্তিত্ব নেই? যুবাটি তখন নিজেকে নিজে বলে: ‘আমি আরও ভালো কাউকে খুঁজে পাব, যে আমার অনুভূতিকে বুঝতে পারবে। আর তখনই আমি আমার বাকি দিনগুলোতে সুখি হব।’
প্রকৃতিচক্রে জয় পরাজয় বলে কোনো জিনিস নেই: আছে শুধু গতিচাঞ্চল্য।
শীতকাল সবার ওপর রাজত্ব করতে চায়, কিন্তু অবশেষে, বসন্তের বিজয়কে মেনে নিতে বাধ্য হয়, যা সঙ্গে করে নিয়ে আসে সুখ আর পুষ্পপল্লব।
গ্রীস্মকাল চায় তার উষ্ণ দিনগুলো চিরদিন বেঁচে থাকুক, কারণ সে বিশ্বাস করে যে উষ্ণতা পৃথিবীর জন্য ভালো। কিন্তু অবশেষে, তাকে হেমন্তের আগমনকে স্বাগত জানাতে হয়, যা পৃথিবীকে বিশ্রামের সুযোগ করে দেবে।
হরিণ ঘাস খায়। আর শিংহ গিলে খায় হরিণকে। এখানে কে শক্তিশালী সেটা বিষয় নয়। এটা আমাদের মৃত্যু ও পুনরুত্থান চক্র দেখানোর ঈশ্বরের পদ্ধতি বিশেষ।
এই চক্রের মধ্যে না আছে বিজয়ী না আছে পরাজিত, আছে শুধু বিভিন্ন পর্যায়, যার মধ্য দিয়ে আমাদের অবশ্যই যেতে হয়। মানব হৃদয় যখন এ বিষয়টি বুঝতে পারে, মূলত তখনই সে মুক্তি পায় এবং প্রতিকূল সময়কে গ্রহণ করতে সক্ষম হয়। আর গৌরব-মুহূর্ত দ্বারা সে প্রতারিতও হয় না।
আসলে উভয়েই উত্তীর্ণ হবে। একজন আরেকজনকে ছাড়িয়ে যাবে। এভাবে চক্রটি চলতে থাকবে যতক্ষণ না আমরা আমাদের রক্তমাংস থেকে মুক্ত করতে পারি এবং যতক্ষণ না ‘স্বর্গীয় শক্তি’কে আমরা খুঁজে পাই।
সুতরাং যখন কোনো যোদ্ধা ময়দানে থাকে—নিজের পছন্দেই হোক কিংবা অনির্ণেয় নিয়তির কারণেই হোক—তার আত্মা যেন আসন্ন যুদ্ধের কথা ভেবে আনন্দে পরিপূর্ণ থাকে। সে যদি তার সম্মান ও ব্যক্তিত্ব ধরে রাখতে পারে, তাহলে সে হেরে গেলেও কখনো পরাজিত হবে না। কারণ তার আত্মা অক্ষতই থেকে যাবে।
আর তার প্রতি যা-ই ঘটুক না কেন, সে কাউকে দোষারোপ করবে না। জীবনে প্রথম সে যখন প্রেমে পড়েছিল ও প্রত্যাখ্যাত হয়েছিল, তখনই সে জেনেছিল যে এ ব্যর্থতা তার ভালোবাসার ক্ষমতাকে শেষ করতে পারবে না। প্রেমের ক্ষেত্রে যা সত্য, তা যুদ্ধের ক্ষেত্রেও সত্য।
যুদ্ধে হারা কিংবা সর্বস্ব হারানো আমাদের জন্য দুঃখের মুহূর্ত নিয়ে আসবে, কিন্তু এই মুহূর্তগুলোর মধ্য দিয়ে আমরা আমাদের প্রত্যেকের অন্তর্নিহিত শক্তিকে আবিষ্কার করতে পারব। এটা এমন এক শক্তি যা আমাদের চমকে দেবে, আর বৃদ্ধি করবে আমাদের আত্মমর্যাদা।
আমরা চারিদিকে তাকিয়ে তাকিয়ে নিজেদের বলব: ‘আমি টিকে গেছি’। আমাদের কথা দ্বারাই আমরা অভিনন্দিত হব।
যারা এই অন্তর্গত শক্তিকে চিনতে পারবে না, শুধু তারাই বলবে ‘আমি হেরে গেছি’, আর দুঃখ তাদের পিছু ছাড়বে না।
অন্যরা তাদের পরাজয় জনিত দুর্দশা ও অসম্মান সত্ত্বেও হয়ত দু’ফোটা চোখের জল ফেলবে, কিন্তু আত্মকরুণার কাছে নিজেদের সঁপে দেবে না। তারা জানে যে এটা যুদ্ধের মাঝখানে একটা বিরতি মাত্র, এবং তাদের এ অসুবিধাও সাময়িক।
তারা তাদের আপন হৃদকম্পন শোনে। দুশ্চিন্তাগ্রস্ত ও ভীত হওয়ার ব্যাপারেও তারা সজাগ। তারা এটা আবিষ্কার করে যে, ভীতি সত্ত্বেও, তাদের বিশ্বাস এখনো তাদের আত্মায় জীবন্ত রয়েছে আর তাদের সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।
কোনটা ভুল করেছে আর কোনটা ঠিক করেছে এ নিয়েও তারা কাজ করে। পরাজয়ের সময়টায় বিশ্রাম করে তারা এর থেকে ফায়দা তুলে নেয়, তাদের ক্ষতগুলো নিরাময় করে, উদ্ভাবন করে নতুন কৌশল আর নিজেদের আরও ভালো অস্ত্রেশস্ত্রে সজ্জিত করে।
অতঃপর কোনো এক প্রদোষে আবার যুদ্ধ এসে কড়া নাড়ে দরোজায়। এখনো তারা ভীত, কিন্তু তাদের উঠে দাঁড়াতে হবে—হয় জয় না হয় চিরতরে মাটিতে শুয়ে থাকা। অতীতের যন্ত্রণার কথা মনে পড়ে তাদের, যা তারা আর সহ্য করতে চায় না। তারা জেগে ওঠে ও শত্রুকে মোকাবিলা করে।
তাদের আগের পরাজয়ের অর্থ হচ্ছে এবার তারা অবশ্যই বিজয়ী হবে। কারণ তারা আর একই ব্যথা পুনর্বার সইতে চায় না।
কিন্তু এবারও যদি তাদের বিজয় না আসে, পরের বার আসবে। পরের বারও যদি না আসে তাহলে তারও পরবর্তী সময়ে বিজয় আসবে। আসল কথা হচ্ছে নিজের প্রতি আস্থা রাখা।
শুধু সেই ব্যক্তিই পরাজিত হয়, যে হাল ছেড়ে দেয়। অন্য সবাই বিজয়ী।
এমনও দিন আসবে যখন সেই কঠিন মুহূর্তগুলো গর্বভরে বলার মতো গল্পে পরিণত হবে। যারা এ গল্প শুনবে তারা শ্রদ্ধার সঙ্গেই শুনবে এবং তিনটি গুরুত্বপূর্ণ জিনিস তারা শিখবে: (১) সঠিক সময়ের জন্য ধৈর্য সহকারে অপেক্ষা করো। (২) পরবর্তী সুযোগ হাতছাড়া হতে দিও না। (৩) নিজের ক্ষতচিহ্ন নিয়ে গর্ব অনুভব করো।
ক্ষতচিহ্ন হলো শরীরের ওপর সেঁটে থাকা মেডেল স্বরূপ। এগুলো দেখে তোমার শত্রুরা ভীত সন্ত্রস্থ হবে কারণ এসব ক্ষতচিহ্ন যুদ্ধক্ষেত্রে তোমার দীর্ঘ অভিজ্ঞতার প্রমাণ। এটা প্রায়ই তাদের বিরোধ এড়িয়ে যেতে ও সংলাপে বসতে প্ররোচিত করবে।
ক্ষতচিহ্ন সেই তরবারির চেয়েও শক্তিশালী, যে-তরবারি তাদের জন্ম দিয়েছিল।