তিন
কিছুদূর হাঁটতেই দমকা বাতাস এসে রীতিমত ধাক্কা মারল পীর সাহেবকে। তাঁর লম্বা জোব্বা উড়ে উঠে যেন পাখির মতো দূরে চলে যেতে চায়। কিন্তু শরীরের সাথে জটিল বন্ধন থাকায় সেটা হয়ে ওঠে না। শরীরের বাধা পেয়ে পত পত একটা শব্দ হয় শুধু। গলায় পরা কয়েক ধরনের মালার পুতির মধ্যে সংঘর্ষে টুংটাং ফ্যাটফ্যাট একটা শব্দ হয়। পীর সাহেব চমকে ওঠেন। উড়নোন্মুখ জোব্বাটির শব্দে তিনি ফিরে যান স্বাধীন বাংলার পতাকা ওড়ানোর দিনগুলিতে। উড়ন্ত পতাকার শব্দও তো এমন। পীর সাহেব খানিকটা ঘোরের ভেতরে পড়ে যান।
চা খেয়ে ফেরার পথে প্রথম যে বাঁক ডানদিকে বেঁকে গেছে তার বিপরীতে বিশাল প্রান্তর। এটা মূলত করতোয়া নদীর পাড়। এই প্রান্তর ধরে একটু এগুলেই করতোয়া নদী। এই দমকা বাতাস যদি ওই জায়গাটায় হতো তাহলে পীর সাহেব খুব বেশি অবাক হতেন না। কিন্তু রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে তিনি যখন কিছুটা দূরেই চলে এলেন তখন এই বাতাস নদী বিধৌত মনে না হওয়ায় তিনি একটু অবাক। তিনি এও ভাবলেন যুদ্ধের বাতাস, কখন কোনদিকে যায় বলা যায় না।
তিনি একটা নির্জন বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালেন। পিছে পিছে আসা কুকুরটিও আছে তার সাথে। দুনিয়াটা কতই না বিচিত্র।
গেটের সামনে দুজন খাঁকি পোশাক পরা দারোয়ান। একজনের হাতে বন্দুক। পীর সাহেব দ’জনের দিকে এক পলক তাকিয়েই বুঝে নিলেন একজন বাঙালী আরেকজন বিহারী। বন্দুকটি বিহারীর হাতে।
সাধারণত দারোয়ান থাকে একজন। দু’জন রাখার ব্যাখ্যা হিসেবে বলা যায় যুদ্ধকালীন বিশেষ সতর্কতা। বিহারীর হাতে বন্দুক। বাঙালীর হাত খালি। বুঝা যাচ্ছে বাঙালী অত বিশ্বস্ত না। কখন কী করে বসে!
পীর সাহেব আরো এগিয়ে গেলেন গেটের দিকে। দু’জনই উঠে সালাম দিলেন। পীর সাহেব বিহারী দারোয়ানের চোখের দিকে তাকিয়ে খাঁটি উর্দুতে বললেন, আমি ডিসি সাহেবের সাথে দেখা করতে চাই। আপনি যদি একটু ব্যবস্থা করে দিতেন।
দারোয়ান দু’জন ইতস্তত করতে লাগলো। পরস্পরের মুখের দিকে চেয়ে ভাবতে লাগলো কী করা যায়। বেশ ভুশা দেখে তো কামেল পীর মনে হয়। কিন্তু যুদ্ধের সময় কোনো বেশকেই বিশ্বাস করতে নেই। কারণ এসময় ছদ্মবেশটাই বেশি থাকে।
বিহারী উর্দুতে বলল, ‘আপনি কোত্থেকে এসেছেন।’
পীর সাহেব এ কথা শুনে ঘুরে দাঁড়ালেন। ঘুরে যেদিকে দাঁড়ালেন সেটা পশ্চিম দিক। তিনি তিন পা এগিয়ে গেলেন। তারপর বুক ভরে নিঃশ্বাস নিয়ে আকাশের দিকে তাকালেন। স্থির থাকলেন কিছুক্ষণ। তারপর আস্তে আস্তে মাথাটি নিচের দিকে নিয়ে আসলেন।
বিহারী দারোয়ান চিন্তা করল সর্বনাশ! উনি তো সত্যপীর। এখন কী করা যায়? ঢুকতে না দিলে তো আমি শেষ। একবার তাদের কলোনীতে একজন জ্বিন হাজির করার ব্যবসা শুরু করেছিল। সে একটুও বিশ্বাস করেনি। একদিন রাস্তায় এক আগন্তুক জ্বিন হাজির করার বিষয়টি জিজ্ঞাসা করলে সে বলেছিল, ‘সব ভন্ণ্ডমি।’
বাসায় ফেরার সময় গলিতে ঢুকতে না ঢুকতেই প্রথমে আছাড় খেল। তারপর আর উঠে দাঁড়াতেই পারলো না। যতবারই উঠে দাঁড়ালো ততবারই পড়ে যেতে থাকলো। সে এক ভয়ঙ্কর অবস্থা। সুতরাং কামেল পীরকে কোনোভাবেই চটানো যাবে না। কিন্তু ডিসি সাহেবের জেরার মুখোমুখী হওয়াও বুদ্ধিমানের কাজ হবে না।
বাঙালী দারোয়ানকে সে বলল, সুরুজ ভেতরে যা। ডিসি স্যারের কাছে অনুমতি নিয়ে আয়।
সুরুজ বিহারী দারোয়ানের দিকে কটমটো দৃষ্টিতে তাকালো। তারপর ভেতরে চলে গেলো। ভেতরে ঢোকার পর তার চলে যাওয়া পথের দিকে বন্দুকের গোড়া দিয়ে কয়েকবার মারার ভঙ্গি করলো বিহারী দারোয়ান।
কুকুরটি এসে দেয়াল শুঁকতে লাগলো। দেয়াল শুঁকতে শুঁকতে দারোয়ানের কাছে চলে এলো। দারোয়ানের কাছে এসেও সে শুঁকতে লাগলো। দারোয়ান ভয়ে নিঃশ্বাস বন্ধ করল। মনে মনে বলল, পীর সাহেবের সাথে বেয়াদবী হয়ে গেছে মনে হয় নইলে পীরের সঙ্গী এরকম করবে কেন? এটা কি আসলে কুকুর না-কি জ্বিন! শুনেছি কামেল পীররা জ্বিনকে তাবেঈ করে তাদেরকে বিভিন্নভাবে ব্যবহার করে। এই পীর সাহেব জ্বিনকে তাবেঈ করে কুকুরের রূপ দিয়ে নিয়ে আসে নাই তো।! হায় আল্লাহ আজ যে কতবার আছাড় পড়তে হবে!
পীর সাহেব আবার আকাশের দিকে তাকালেন। গাছগাছালি ভরা কী অপরূপ এই মহল্লাটি। এখানে কত পাখি থাকার কথা। আর কী শীতল ছায়া ছায়া! নামটিও ভারি সুন্দর। মালতিনগর। আহা মালতিনগরের নাম মালতিনগর কেন হলো! এখানে মালতি নামে কেউ ছিল? না-কি ফুলের বন ছিল একসময়? মালতির ঘ্রাণে ভরে যেত চারপাশ! কোথায় হারালো সে ঘ্রাণ? এত নিশ্চুপ এত নিরিবিলি যে হঠাৎ করে গ্রাম বলেও ভুল হয়ে যায়।
বাঙালী দারোয়ান ফিরে এলো। বিহারী দারোয়ানকে বলল, ‘স্যার অনুমতি দিছে।’
বিহারী দারোয়ান ভাবল যাক বাঁচা গেছে। খামাখা ঝামেলার ভেতর পড়তে হতো। পীর সাহেব না হয়ে অন্য কেউ হলে এত সহজে সুরুজকে ভেতরে পাঠাত না অনুমতির জন্য। কামেল পীরের বিষয়টি ভিন্ন। সাথের জ্বিন কুকুর এখনও তার চোখের দিকে তাকিয়ে নাক খিটমিট করছে। তাকালেই পিলে চমকে যায়।
বিহারী দারোয়ান বলল, তুই এখানে থাক। আমি হুজুরের সাথে কথা বলি।
বিহারী দারোয়ান পীর সাহেবের সামনে এলো। আরেকবার সালাম দিলো সে। সে জানে আগে সালাম দিলে আশি নেকি পাওয়া যায়। হুজুরকে সে খুব আদবের সাথে বলল, স্যার আপনার জন্য অপেক্ষা করছেন।
তোয়াজ করার কৌশলটি ভালোয় জানে বিহারী দারোয়ান। ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠার কৌশলও তার জানা আছে। যখন যেটা প্রযোজ্য সেটা সে প্রয়োগ করে। দরোজা খুলে দিয়ে সে আরেকবার সালাম দিলো। সুরুজকে বলল, ‘তুই বাবার সাথে যা। বাবাকে পথ চেনায়ে দে।’
বাবাকে পথ চেনাতে গেলে বিহারী দারোয়ানের হঠাৎ মনে পড়লো, আগে সালাম দিলে আশি নেকি পাওয়া যায়। কিন্তু কামেল পীরকে সালাম দিলে বেশি পাওয়া যায় কি? হুজুরকে জিজ্ঞাসা করতে হবে।
ভেতরে ঢুকতেই সবুজের এক বিশাল সাম্রাজ্য পীর সাহেবের চোখে এসে পরম মমতায় স্পর্শ করল যেন। আহ এত সবুজ! সারা দেশ ধ্বংসস্তুপ, জ্বলন্ত ভিটেমাটি, বাস্তহারা মানুষের সারি, কঙ্কালসার শিশুর পান্ডুর মুখ, জীবনবাজি রেখে পলায়নপর মানুষের আর্তি- এগুলোই তো দেখে আসছে কয়েক মাস। এগুলোর বাহিরে যে সবুজের এক সমারোহ আমাদের পুরো দেশ জুড়েই- পীর সাহেবের চোখে সেগুলো কতদিন ধরা দেয়নি! তিনি থামলেন। আকাশের দিকে তাকালেন। তারপর চারপাশটা একটু সময় নিয়ে দেখে নিলেন।
মূল বাড়িটা একটু ভেতরে। দারোয়ান সামনে হাঁটার সাহস পাচ্ছে না। পীর সাহেব বুঝে গেছেন হেঁটে যেতে হবে মূল ভবনে। তিনি যতই ভেতরে প্রবেশ করছেন ততই বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছেন জ্বলন্ত একটি দেশ থেকে। সুবজ তাঁকে আলিঙ্গন করছে। পাখির ডাকও ভেসে এলো। আহা! কতদিন এরকম ডাক তার কানে পড়েনি! আর্তনাদ আর আহাজারি ছাড়া গত কয়েকমাসে তার কানে আর কীই বা পড়েছে!
ফুলের সুবাস ভেসে আসতে লাগলো। পীর সাহেব তাঁর আনত মস্তক উপরে তুললেন। চারপাশ তাকালেন। দেখলেন ফুলের বাগান। কত রকমের ফুল যে ফুটে আছে! চোখ জুড়িয়ে যায়। একজন মালি ফুলের গাছে পানি দিচ্ছিল। পীর সাহেবকে দেখে পানি দেয়া বন্ধ করল সে। ঠায় দাঁড়িয়ে থেকে পীর সাহেবকে দেখতে লাগল।
পীর সাহেব ভাবলেন, আহা বাহিরে ফুলের মতো জীবনগুলো ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। আর ভেতরের এই ফুলগুলো তা জানতেই পারছে না। এই ফুল ঝরে গেলে আবার ফুটানো যায়। কিন্তু বাঙালরি ঘরে ঘরে যে ফুলগুলো ফুটেছে সেগুলো আজ..। তাদের হাতে আগুনের ফুল।
রাস্তাটা ডান দিকে একটু মোড় নিল। তিনি দেখলেন গ্যারেজে দুটো গাড়ি। একটা জিপ আরেকটা ডাটসান গাড়ি। তিনি মূল বাড়ির দরোজায় এসে দাঁড়ালেন। দরোজা খুলে তাঁকে বৈঠক ঘরে বসতে দেয়া হলো।
কোনার এক টেবিলে কাগজপত্র এলোমেলো। কিছু ফাইল। পীর সাহেব বুঝতে পারলেন ডিসি সাহেব ঠিকমতো অফিসে যেতে পারেন না । বা যান না। অফিসের অনেক কাজ বাসাতেই করেন। যুদ্ধকালীন পরিস্থিতি বলে কথা।
একটা ফুটফুটে মেয়ে দরজা দিয়ে উকি দিলো। বযস ছয় সাত হবে। সঙ্গে সঙ্গে উপর থেকে ডাক ভেসে এলো । ফারজানা ফারজানা। একজন মধ্য বয়সী মহিলা এসে ফারজানাকে নিয়ে গেল। একটু পরই ডিসি সাহেব বৈঠক ঘরে ঢুকলেন। সঙ্গে এক আর্দালী পিয়ন।
ডিসি সাহেব ঘরে ঢুকতেই পীর সাহেব উঠে হাত তুলে সালাম দিলেন। ঘোরগ্রস্থের মতো তাকিয়ে থাকলো দু’জন। ডিসি সাহেব ইশারা করে পীর সাহেবকে বসতে বললেন। তিনিও বসলেন। পিয়নকে বললেন, ‘বেলের শরবত পাঠিয়ে দাও।’
পিয়ন দরজা বন্ধ করে চলে গেল।
ডিসি সাহেব আবার তীক্ষ্ণ চোখে আগন্তুকের দিকে তাকালেন। কী বলবেন ভেবে পাচ্ছেন না। কে এই ভদ্রলোক। ইনি তো পীর টীর কেউ না। তাহলে কে?
ডিসি সাহেবই নীরবতা ভাঙলেন, ‘বলেন কী করতে পারি আপনার জন্য?’
জবাবে পীর সাহেব কী করতে হবে তা বললেন না। শুধু নামটুকু উচ্চারণ করলেন। তাতে ডিসি সাহেব উঠে দাঁড়িয়ে রীতিমতো সামরিক কায়দায় সেলুট করলেন। সব ব্যবধান দূরে ঠেলে, বসার দূরত্ব ঘুচিয়ে তিনি এগিয়ে গেলেন পীর সাহেবের দিকে। বুকে জড়িয়ে ধরলেন।
কী নাম উচ্চারণ করেছিলেন পীর সাহেব? তিনি উচ্চারণ করেছিলেন তিনটি শব্দ। ‘আমি গাজীউল হক’।
আমলাদের, বিশেষ করে যুদ্ধকালীন আমলাদের খুব বেশি আবেগী হতে নেই। বগুড়ায় সদ্য বদলি হয়ে আসা ডেপুটি কমিশনার মনযূর উল করীমও আবেগ নিয়ন্ত্রণ করলেন। তিনি তাঁর নিজের জায়গায় ফিরে এলেন।
গাজীউল হক বললেন, ‘এপ্রিলের পনেরো তারিখ পর্যন্ত আমরা বগুড়ায় ছিলাম। ষোলো তারিখ ভোরে কলকাতার উদ্দেশ্যে বগুড়া ছাড়ি। আমাদের দলে ছিলেন এম আর আখতার মুকুল, খন্দকার আসাদুজ্জামান, মজিবর রহমান এমপি, ডাঃ জাহিদুর রহমান এমপি আর দু’জন ইপিআর। বিকাল বেলা কর্নেল ব্লিৎস এর সাথে সাক্ষাৎ করি। তিনি সাথে নিয়ে যাওয়া এম্যুনিশনের নমুনাগুলো পরীক্ষা করেন। উনিশ তারিখ সন্ধ্যায় লর্ড সিনহা রোডে অস্থায়ী সরকারের প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দীন আহমেদ, অর্থমন্ত্রী মনসুর আলী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জনাব কামরুজ্জামান, পার্লামেন্ট সদস্য জনাব আবদুল মান্নান এবং আবদুস সামাদ আজাদের নিকট বগুড়ার মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে প্রতিবেদন পেশ করি।’
এক নাগাড়ে কথাগুলো বলে ফেললেন গাজীউল হক। একটু দম নিলেন। তারপর আবার শুরু করলেন, ‘আমি কিছুদিন এখানে থাকব। কেন থাকব তা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন। যাবার আগে আরেকবার দেখা করবার আশা রাখি। সময় খুব অল্প। আমাকে তার কিঞ্চিত পরিমাণ দিলেই চলবে। আপনি সরকারি কর্মকর্তা। কেন এসেছি কেন চলে যাব তা বুঝে গেছেন নিশ্চয়।’
ডিসি সাহেব সব বুঝতে পেরেছেন। গাজীউল হক এত ঝুঁকি নিয়ে এখানে এমনি এমনি আসেননি। তিনি বগুড়ার সার্বিক অবস্থা সরেজমিনে পরিদর্শন করতে এসেছেন। পরিকল্পনা জানতে এসেছেন। সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে তাঁর কাছেও এসেছেন পাকিস্তানীদের পরিকল্পনা সম্পর্কে জানতে। ডিসি সাহেব এও বুঝতে পারলেন গাজীউল হক খুব তাড়াতাড়ি ফিরে যাবেন কলকাতায়। বগুড়ার প্রতিবেদন পেশ করবেন। সে-অনুযায়ী সকল কর্মপরিকল্পনা নির্ধারণ হবে। ডিসি সাহেব বললেন, ‘আমি বিশ্বাস করি যে আপনি আমাকে বিশ্বাস করেন। সেই বিশ্বাসের আস্থা থেকে বলছি,
রণকৌশল সম্পর্কে আমার সাথে খুব বেশি আলোচনা করা হয় না। যখন তথ্যের প্রয়োজন হয় তখন আমার স্মরণাপণ্য হয় তারা। তাদের তথ্য চাওয়ার ধরণ দেখে আমি একটা ধারণা করি মাত্র। আপনি ভালো করেই জানেন মিলিটারিরা সিভিলিয়ানদের কোন চোখে দেখে। তার উপর আবার বাঙালী হলে তো কথাই নেই। তবে তাদের পরিকল্পনা খুব বেশি শক্তিশালী নয়। কারণ আমাদের ছেলেদের গেরিলা আক্রমণ। আমাদের ছেলেরা পাকিস্তানীদের এমন চাপে রেখেছে যে প্রতিনিয়ত পরিকল্পনা পরিবর্তন করতে বাধ্য হচ্ছে তারা। মেজর সালমান মাহমুদ খুব ধূরন্ধর ব্যক্তি। তিনি একাধিক বিকল্প হাতে রাখেন। কোনো বিকল্পেই তিনি পেরে উঠছেন না।
ডিসি সাহেবের মুখে ‘আমাদের ছেলেরা’ শব্দ দুটি শোনার পর গাজীউল হকের চোখ দুটো আনন্দে ঝিলিক দিয়ে উঠলো। আহ ‘আমাদের ছেলেরা’।
গাজীউল হক বললেন, ‘আপনার কাছে ঢাকা থেকে সরাসরি নির্দেশ আসে না?’
‘সব আসে না। যা আতে তা যুদ্ধ পরিচালনাগত কোনো নির্দেশ নয়। তারাও আমাদেরকে অতটা বিশ্বাস করতে পারছে না আসলে।’
‘আমরা আপনাকে বিশ্বাস করছি। আপনি বিশ্বাসের মর্যাদা করবেন এই বিশ্বাস করি। আমাদের ছেলেগুলোকে রেখে গেলাম। সম্ভব হলে তাদের জন্য কিছু করবেন। আমি এখন উঠব।’
গাজীউল হক উঠে দাঁড়ালেন। ডিসি সাহেব বললেন, ‘একটু বসবেন প্লিজ। চা খেয়ে যাবেন।’
গাজীউল হক বললেন, ‘আপনি না বেলের সরবৎ আনতে বললেন!’
ডিসি সাহেব হেসে উঠলেন, ‘ওটা তো সাংকেতিক ব্যাপার ছিল। চায়ের কথা বলা মানে একরকম নির্দেশ, বেলের শরবতের কথা বলা মানে আরেক।’
গাজীউর হকের ঠোঁট আরেকবার নড়ে উঠলো হাসিতে। আনন্দ আর কৌতুহলে তাঁর চোখ চিকচিক করতে লাগলো।
‘কী রকম।’ বিস্ময় ও কৌতুকমাখা কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন গাজীউল হক ।
‘যদি চায়ের কথা বলি তাহলে সবাই বুঝে নেবে খুব সাধারণ বিষয়ে আলোচনা, আগত ব্যক্তি ততটা গুরুত্বপূর্ণ নয় কিংবা ততটা নিরাপদও নয়। তখন আশে পাশে ওরা থাকবে। যদি বলি তাড়াতাড়ি চা নিয়ে এসো তাহলে এগুলোর পাশাপাশি তারা আরেকটা কাজ করবে। পিয়ন এসে একটু পরই বলবে, স্যার ঢাকা থেকে আপনার ফোন। যদি বেলের সরবতের কথা বলি তাহলে বুঝে নেবে আগত ব্যক্তি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোচনা হবে। কেউ আশে পাশে থাকবে না। আলোচনা হবে রূদ্ধদ্বার।’
গাজীউল হক খুবই পুলক অনুভব করলেন। বললেন, ‘আমি তো পীরের ছদ্মবেশে এসেছি। আমাকে গুরুত্বপূর্ণ মনে হলো কেন? কীভাবে?’
‘আপনি যখন আমাকে হাত তুলে সালাম দিচ্ছিলেন তখনই বিষয়টা লক্ষ করেছি আমি। আপনাকে পীর মনে হয়নি আমার। সালাম দিয়ে হাত নামানোর পর আপনার হাত মুষ্টিবদ্ধ ছিল। কোনো পীরের হাত মুষ্টিবদ্ধ থাকে না। সোজা করে নিচেও নামায় না ওভাবে। তাদের হাত খোলা। তসবি গুনলে হাত অত মুষ্টিবদ্ধ রাখা যায় না। আর আপনার হাত তো এক বিশাল আন্দোলনের সাক্ষী।’
গাজীউল হক ডিসি সাহেবের পর্যবেক্ষণ ক্ষমতায় মুগ্ধ হয়ে গেলেন। বললেন, ‘বেলের সরবতের কথায় আমিও কিছুটা অনুমান করেছিলাম।’
‘কী রকম’
‘মেহমাননে সাধারণত চা দিতে বলা হয়। বেলের শরবত কেন এসময়ে। এখন তো আবার বর্ষাকাল।’
‘আমি জানি আপনি এটা ধরে ফেলবেন। এটাতো সামান্য ব্যাপার। ভাষা আন্দোলনের মতো বিশাল ব্যাপারটা যার হাতে এরকম রূপ পেল তিনি সামান্য চা আর বেলের সরবতের পার্থক্য করতে পারবেন না? তা কখনো হয় না। জানেন আমার এখনো অবাক লাগে আপনি কীভাবে আগের রাতের সিদ্ধান্ত গ্রহণ থেকে বিরত রাখলেন সবাইকে! এ এক পরম ঝুঁকি। সেই ঝুঁকি আপনি নিলেন। এবং জিতে গেলেন।’
গাজীউল হক উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, ‘এখনো চূড়ান্ত বিজয় আসেনি। তবে জিততে আমাদের হবেই। আমরা জিতবই।’
গাজীউল হক যখন কথাগুলো বলছিলেন তখন তার বুক স্ফীত হয়ে যাচ্ছিল। সেই স্ফীত বুকের ভেতরে স্বাধীনতার আকাঙক্ষাগুলোই যেন নিঃশ্বাস হয়ে বের হয়ে আসছিল। তিনি জোব্বার পকেট থেকে তসবি বের করলেন। ডান হাতে ঝুলিয়ে নিলেন। বললেন, ‘ওরা চা আনলে বলবেন, পীর বাবা চা খান না।’
ডিসি সাহেব কেমন এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলেন কিংবদন্তীতুল্য ওই মানুষটির দিকে। তিনি তো এখনো পাকিস্তানের কর্মকর্তা। কথায় কথায় বলেও তো ফেললেন রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ কাজে ব্যস্ত থাকলে…। রাষ্ট্র! এটা কি আসলে রাষ্ট্র!
পীর সাহেব দরোজার দিকে এগিয়ে গেলেন। ডিসি সাহেব উঠে দাঁড়ালেন। দরোজা খোলার ঠিক আগে আগে পেছনে ফিরে ডিসি সাহেবের দিকে তাকিয়ে গাজীউল হক বললেন, এই চায়ের বিল তো আপনার সরকার বহন করবে, তাই না?’
পীর সাহেব বের হয়ে এলেন। ডিসি মনযূর উল করীম এমনিতেই অপরাধবোধে ভুগছিলেন। এ কথায় মনে মনে খুব আহত হলেন। একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস বের হয়ে এলো তার বুক চিরে। আহত মন নিয়েই সোফায় গা এলিয়ে দিলেন তিনি।
বাংলোর রাস্তায় নেমে পীর সাহেব আবারো আকাশের দিকে তাকালেন। ভাবলেন বাহিরে কী উন্মাতাল ধ্বংসলীলা চলছে এখানে তার ছিঁটেফোটা চিহ্নও নেই। জগৎটা কতই না বিচিত্র। তিনি হাঁটতে লাগলেন। মালি কাজ করছিল। হাতের জারটি রেখে সে পীর সাহেবের কাছে এসে দাঁড়ালো। পীর সাহেব থামলেন। গম্ভীর গলায় বললেন, বাবা, কিছু বলবে?
মালি বলল, ‘বাবা আমার জন্য একটু দোয়া করবেন?’
‘আয় কাছে আয়’। মালি কাছে এলো। পায়ে হাত দিয়ে সালাম করল। পীর সাহেব মালির মাথায় হাত রাখলেন। আকাশের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘হক্ব মওলা।’
মালিকে বললেন, ‘তোর মঙ্গল হবে। শুধু ক্ষুধার্তকে একটু খাইতে দিস।’
পীর সাহেব গেটের কাছে এলেন। যথারীতি দুই দারোয়ান। বাঙালী দারোয়ানের দিকে তিনি কটমট করে তাকালেন। তারপর বিহারী দারোয়ানকে নির্দেশ দিলেন, ‘ওরে একটা চড় দে।’
প্রথমে বিহারী দারোয়ান কিছু বুঝতে পারেনি। পীর সাহেব ধমক দিয়ে খানিকটা উঁচু স্বরে বললেন, ‘ওরে একটা চড় দে।’
বিহারী দারোয়ান এবার স্পষ্ট বুঝতে পারল পীর বাবার নির্দেশ। এই বাবা যে আসল বাবা তার আর কোনো সন্দেহই থাকল না। আচ্ছা, বাবা বুঝতে পারল কীভাবে তার মনের কথা? বাঙালীরা তো হাড়ে হাড়ে বজ্জাত। এদের উপর অনেক রাগ তার। খালি সুযোগের অপেক্ষায় আছে। আজ একটা চরম সুযোগ যে পাওয়া গেলো হাতের কাছে।
বিহারী দারোয়ান হাতের বন্দুকটি বাম হাতের বগলে চেপে রেখে সব শক্তি একত্রিত করে সুরুজের বাম গালে কষে এক চড় বসিয়ে দিলো।
পীর সাহেব চড়ের শব্দ শুনে একটু জোরেই বললেন, ‘হক্ব মওলা।’
চড় খাওয়ায় সুরুজ মিয়ার মাথার ভেতরে একটা চক্কর দিলো। চোয়ালে যেন চড় দেয়নি, আগুনের আঙরা ঠেসে ধরেছে শালা বিহারী। চড়ের এতো জ্বালা আগে কখানো বুঝেনি সুরুজ। চোখ কান নাক মুখ দিয়ে গরম ভাপ বের হতে থাকলো সুরুজ মিয়ার।
সুরুজ মিয়া চড় খেয়ে মাথা নিচু করে থাকলো। তার অশ্রু-বিষ্ফোরিত চোখে দুটি ছবি ভেসে উঠল। একটা লাল-সবুজ পতাকার ভেতরে আঁকা বাংলাদেশের মানচিত্র। আরেকটি তার মায়ের মুখ।
বিহারী দারোয়ান আহ্লাদে আহ্লাদে দরোজা খুলে দিলো। পীর সাহেব বাহিরে এসে দেখলেন কুকুরটি ঘুমাচ্ছে। দরোজা খোলার শব্দে জেগে উঠে বসল। শালা শ্রীমানটা এখনও যায়নি! তবে ওটা সঙ্গে থেকে ভালোয় হয়েছে।
কুকুরটি উঠে দাঁড়ালো। সে বুঝে গেছে এখন আবার হাঁটতে হবে। তারই প্রস্ততি হিসেবে গায়ে একটা ঝাড়া দিলো। তার দেহের চারপাশে একটু একটু ধুলো উড়তে লাগলো। সামান্য কুকুরও পথের কিছু গায়ে রাখতে চায় না।
পীর সাহেব বিহারী দারোয়ানের দিকে আবার তাকালেন। বললেন, ‘কুকুরের কাছে অনেক কিছু শেখার আছে। যেমন বিনয়, আনুগত্য, সেবা। তবে প্লেটো একমাত্র কুকুরকেই জ্ঞানী বলেছেন। তবে এগুলো তার ভিত্তি ছিল না। ভিত্তি ছিলো অন্যকিছু।’
পীর সাহেন বিহারী দারোয়ান থেকে চোখ তুলে আকাশের দিকে তাকালেন আরেকবার। তারপর একটু জোরে বললেন, ‘আল্লাহ মালিক। ’
পীর সাহেব শেরপুর রোডের দিকে হাঁটতে লাগলেন। পেছনে পেছনে কুকুরটি যথারীতি হাঁটতে থাকল।
কিছু দূর হেঁটে তিনি ভাবলেন প্লেটো তার রিপাবলিক গ্রন্থে একটি মাত্র প্রাণীকে জ্ঞানী বলেছেন। সেই প্রাণী অজ্ঞাত কারণে তার পিছে পিছে হাঁটছে। প্লেটো সাহেব বেঁচে থাকলে এখন এর কী ব্যাখ্যা দিতেন কে জানে।