৩ নং ধানুস নগর বাস ডিপো
এক.
বাস কোম্পানিটার নাম জনতা ট্রান্সপোর্ট কোং। বাসের ফ্রন্ট গ্লাসের বাম পাশে সে কথাটাই অর্ধচন্দ্রাকৃতির মতো করে লেখা। তার নিচে সোজা নীল রঙে লেখা ধানুস নগর টু আশিসপুর। ধানুস নগর এখানে একটা আধা-মফস্বল শহর। আর তার তিন নম্বর মহল্লায় জনতা বাস সার্ভিসের ডিপোটির অবস্থান।এই ছোট মফস্বল বাজার থেকে ২৩ কিলো দূরে আশিসপুর এই রুটের সর্বশেষ স্টপেজ। অর্থাৎ রুটটা গিয়ে দাঁড়ালো ধানুস নগর টু আশিসপুর। কুড়ি টাকা ভাড়া। আপ- ডাউন চলিশ্ল টাকা।
রাজেন আজ ৭ নং বাসের হেল্পারি পেয়েছে। এরকম প্রতিদিনই ডিপো ইন-চার্জ বাসের ডিউটি শিডিউল সুবিধামতো ফিক্সড করে দেন। ইন-চার্জ গত রাতে তাকে ৭ নম্বর ঠিক করে দিয়েছে। এই ইন-চার্জ হল জমেল শেখ। বয়স প্রায় পঞ্চাশ। এতটা ভালো দেখতে নয় সে। কিছুটা বদখত—আবার কিছুটা মায়াবি। তার ব্যবহারও এ রকমই আধাআধি। বাসের ড্রাইভার তো কতদূর আর মহৎ হবে সে! কথাটা প্রায়ই সেভাবে আর বলে—বেকেরই ত শইল্লে কেদা রে ভাই। আমি জোহরে ভালো অইবার চাইলে আছরে পারি না
সে-ও জওয়ানির শুরুর দিকে হাবিবনগর জিন্দাপুর রুটে পুরনো কাঠ-বডির হালিমা ট্রান্সপোর্ট বাসের হেল্পার ছিল। প্রতিদিন একটু একটু করে সে সবেরই গল্প করতে বসে জমেল। গল্প করতে গেলে এই রাজেনই ভরসা। এর আগে ওর বয়সি দুটি ছেলে এই ডিপোতে কাজ করে গেছে। শালারা ছিল চোর আর কাটখোট্টা নেশাখোর। মহাজনের প্যান্ট শার্টসহ দামি কার পার্টস নিয়ে পালিয়েছিল। ফলে জমেলের মুখও সেদিন পুড়ে গিয়েছিল। চুন পোড়া মুখে ডিপো-সর্দার জমেল বেশ কদিন রাজেনকে সহ্য করতে পারেনি। পরে ধীরে ধীরে পরিস্থিতি নিরুপায়ভাবে ঠাণ্ডা হয়েছে।
জমেল শেখকে রাজেনের খবরটা প্রথমে দেয় শাহবাজপুর ফাঁড়ির আব্দুল পুলিশ। বলে—ছেলেটা অসহায়। ওর বাবা বছর বহু আগে থেকেই নাই। মা’র খবর তেমন বলতে চায় না জমেল। শুধু বলে সেই মহিলা ইসলামপুর বাজারের পাশে থাকত। এখন নাকি সেইখানেও কেউই নেই। শুনে খুব মায়া লাগে জমেলের। আগে জমেলের এসব শুনলে মায়া লাগত না। এখন লাগে। যেন বয়স হচ্ছে আর মমতার এন্টেনায় সিগন্যাল শক্তিশালী হচ্ছে।
অন্যান্য দিনের মতো আজ সরস পান মুখে নিয়ে মধ্যমা আর তর্জনির ফাঁকে কে-টু’র প্যাকেট থেকে একটা কে-টু সিগারেট আটকায় সে। প্রজাপতি ম্যাচের একটা পঙ্গু কাঠি দিয়ে সেটার মুখাগ্নি করে। বলে—‘বুচ্ছত রাজেন, আমি তহনই বহুত জোরে চিল্লাইতে পারতাম। ধরো, তহন আমার বয়স ১৫-১৬ অইব। বিনিপুর- জহরগঞ্জ- কালাম পাড়া- পাল হাঁটি- জিন্দাপুর । কত স্টপেজ! চিক্কুর পাইড়া পাইড়া পেসেঞ্জার ডাকতাম। আজমত ডেরাইবারের চোখের মণি আছিলাম। আমারে বহুত বালা পাইত। খাইতে বইলে গোস-মাছের টুকরা পাতে দিত। হের দেশের বাড়ি আছিল দিনাজপুর। এই ধানুস নগরে হেই একলা থাকত। তর মতোই আমি তহন, ঠোঁটের ওপরে হবায় গোঁফ জাগাইসে। কি যে শরম পাইছিলাম হেইদিন যহন বেলেড দিয়া মুছটা কামাই ফালাই। আজমত ওস্তাদ হাসতেছিল আর কইতেছিল—বেডি বেডি লাগতাসে তরে।
জমেল শেখ থামে। কিন্তু তার হাল্কা হাসিটা আরেকটু পরে থামে। সত্যি বলতে কি সে থামে না, ওকে কিছু একটা থামিয়ে দেয়। ইদানিং পুরনো দিনের কথা ভাবতে গেলে ওর মন বেশি খারাপ হয়। সঙ্গে-সঙ্গে শরীর খারাপের বিষয়টাও চলে আসে। জমেল শেখের আলসার সমস্যা। গত বিশ বছর দিনরাত টিপ মেরে ওর নাওয়া খাওয়ার ভীষণ অনিয়ম হয়েছে। শরীর চিকন কিন্তু পেটটা অহেতুক উত্তল। দুই-তিন বেলা টানা না খেয়ে হঠাৎ এক বেলা ঠেসে খেলে যেমন টা হয় আরকি। আর সঙ্গে তো আছেই সিগারেটের দুই ইঞ্চি ভূত। একটার আগুন দিয়ে আরেকটা। আগে অল্প খেত আর এখন ডিপো-ইন-চার্জ হওয়ায় শলাকা খরচ বেড়েছে। অন্যদিকে দৈনিক চোলাইটা তো আরও মাথা ঘুরিয়ে দেয় ওর। প্রতিদিন এশার পর এক বোতল না হলে চলে না। এশার পর সাধারণত রাজেন ওর মহাজনের কাছাকাছি থাকে না। মহাজন উল্টাপাল্টা হয়ে যায়। শেফালি ঘোষ, আব্দুল আলিম, মমতাজদের এইসব মন-ফুটো করা গান চলে। বিচ্ছেদি-মারফতি—সব এলোমেলো গাইতে থাকে। যেদিন পেটে বেশি পড়ে সেদিন সবার শিডিউলটাও এদিক-ওদিক হওয়ার জোগাড় হয়। ডেপুটি মহাজন হিরনআলি সব গুছিয়ে দেয়। তারপরও যেদিন রাজেনের ছুটি থাকে সেদিন সে মাগরিবের পরপর ওস্তাদের কথা শুনতে বসে। রাজেন কেবলই শুনতে চায়। জমেল শেখের মাঝে মাঝে এই স্মৃতিবয়ান ওর কাছে অদ্ভুত ভালো লাগে। মাঝে মাঝে আৎকা গানের টানও। সবই ভালো লাগে। কেমন যেন মনে হয় গল্পটা। রাজেন ভাবে রাজেনের নিজের গল্প এটা। সেও বুঝি এই পথে হেঁটে হেঁটে গিয়ে একদিন ডিপো-সর্দার হবে। তারও পেট বড় উত্তল হবে। কে-টু টানবে। ফাঁড়ির পুলিশদের ডেকে এনে হাজারী খেলবে।
সে আরও ভাবে—ডিপোর বাসগুলো মানুষের মতোই। ক্ষুধা লাগলে, অসুখ হলে কিংবা ঘুমাতে চাইলে এখানে আসে। মানুষের মতোই শরীরে কাদামাটি লাগলে গোসল করাতে হয় ওদের। গোল গোল পা ভাঙলে পা নতুন করে সারাতে হয় বা নতুন পা কিনতে হয়। চামড়ায় আঁচড় লাগলে পালিশ করতে হয়, ইঞ্জিন-বেচারা বিগড়ে গেলে ওপেন- হার্ট সার্জারির মতো পাল্টানো বা ঢেলে সাজাতে হয়। এটা প্রতিদিনের অংক। এগুলোর মেরামত হিসাব, প্রতিদিনের বাসপিছু জমা-খরচ, ফাঁড়ি জমা, থানা জমা সব কিছুই দেখে জমেল শেখ। আর বলে কী মাথা গুরুর!
সঙ্গে আরেকটি ভাবার বিষয় থাকে রাজেনেরও। ওর মায়ের ভাবনা। ওর মা ইসলামপুরে না কি জিন্দাবাজারে? সেখানে একটা পাটকলে নাকি রাইস মিলে নাকি বাজারের পেঁয়াজের আড়তে কাজ করে যাচ্ছে অনেকদিন। ও প্রতিদিনই ভাবে।ভেবে ভেবে সন্ধ্যার দিকে জমেল শেখের কাছে গল্প শোনার আয়োজন করে।
সাকুল্যে ২৩টা বাস আছে এই ডিপোতে। ফলে ড্রাইভার-হেল্পারও সংখ্যায় অনেক। ঝক্কি-ঝামেলাও সে বরাবর। গাড়ি এক্সিডেন্ট তো মাঝেমাঝে হয়ই। সেদিন মহাজনের মাথা ঠিক কাজ করে না। মালিক বেচারা পাগল হয়ে যায়। সে পাগলামির চূড়ান্ত চাপ জমেল শেখের ঘাড়ে এসে পড়ে। তখন পুরো ডিপো জুড়ে হায়-হায় শুরু হয়। ধমকে ধমকে ডিপোর বেলা গড়ায়। রাজেনও চুপচাপ থাকে। মহাজনকে তেমন একটা ঘাঁটায় না কেউ। রান্নার মুখরা বুয়াটা পর্যন্ত ভয়ে থাকে। অযথা ডিপোর তাগড়া পোলাপানদের দেখলে অভ্যস্ত ইশারাটাও করে না। বুকের কাপড় ঠিকঠাক রাখে। মহাজনের সামনে অনভ্যস্ত হাতে মাথায় কাপড় দেওয়ারও চেষ্টা করে।
দুই.
রাজেনের মনটা সেদিন বেশ খারাপ। গাড়িতে এক প্যাসেঞ্জার তার মাকে একটা খারাপ গালি দিয়ে ফেলেছে। ভুলে দুই-তিনবার ভাড়া চাওয়াতে ওকে এই গালিটা খেতে হয়েছে। ওটা ওর কাছে তেমন কিছু না, প্রতিদিনই এরকম গালি ওকে অগত্যা নীরবে সামলাতে হয়। সমস্যা এখানে নয়। ওর আক্ষেপ হলো—কেন বার বার শুধু ওর মাকেই গালি খেতে হয়? গালিগুলো কি বিশেষভাবে কেবল মায়েদের অপমান নির্দেশ করছে? ওর বাবাও তো ওর জন্মের জন্য বহুলাংশে দায়ী। ওই বেটার খবর রাজেন কখনোই কারও কাছ থেকে পায়নি। সেই ছোটবেলায় নিজের মাকে কত জিজ্ঞেস করেছে কিন্তু কোনো উত্তর সে পায়নি। কেবল খিস্তি-খেউরের মতো কয়েকটা নির্দিষ্ট ডায়ালগ ওর মুখস্ত হয়ে গেছে।
ওই বেশ্যার বেটা। ওর কিড়া ধরা সুনায় আরও কিড়া পড়ুক। হারামজাদার কথা আমাক জিগাস করিস কেন? আমি কি তোক খাতি দিতেছি না? তো বারবার ইক কথা পাড়িস ক্যান?
আশ্চর্যের বিষয়! ইদানিং রাজেন ওর মায়ের ওই বিশ্রী গালিভরা কথাগুলোও প্রায় ভুলে যাচ্ছে। ভুলে যাবারই তো কথা। ইসলাপুর না জিন্দাবাজার কোথায় যেন ওর মা কাজ করে। তিন-চার বছর ধরে খুঁজে খুঁজে সে হয়রান। কই, কোথাও তার মা নেই। সেই যে এক বাদলা দিনে পেঁয়াজের আড়তে কাজে গিয়ে আর আসেনি। এই তো বছর ঘুরল কেবল ফাঁড়ির এক পুলিশ তাকে এখানে নিয়ে এসেছে।
আজ দুপুরে জমেল শেখ গোশত দিয়ে ভাত খাবে। গতকালের ৮ নং গাড়ির এক্সিডেন্টের ঝামেলা আজকে সকালে মিটেছে। মালিক ঠাণ্ডা হয়েছেন। সেই খুশিতে আজকে জমেল শেখ বাজারে বেশি টাকা দিয়েছে। আর বলে দিয়েছেন যেন গরুর কচি গোশত যেন আলু দিয়ে ঝোল করে। আজকে ডিপোতে তাই সুঘ্রাণ ভেসে বেড়াচ্ছে। গোশতের আনচান ঘ্রাণ গাছপালা, বন বাদার-টিনের চাল সব সব জায়গায় বাড়ি খেয়ে খেয়ে ঘুরছে। শাপলা বুয়ারও বেশ মন ভালো। নিজের ছেলেটাকে এনে রান্নাঘরেই খেতে বসিয়ে দিয়েছে। ছেলেকে খেতে বসিয়ে একপাক মইদুলের ঘরেও ঘুরে এসেছে সে। গোশতের ঘ্রাণের সঙ্গে শরীরের ঘ্রাণ মিশিয়ে সে এক অন্য খাবার মেখে খেয়ে এসেছে। খুব দ্রুত। কেউ কিছু টের পায়নি। কিন্তু সেটা মইদুলের ঘামভর্তি চুলের চিকচিক দেখে ডিপো-ইন-চার্জ বুঝতে পারে। সে খাওয়া অবস্থাতেই লুঙ্গির ওপর দিয়ে কিছু একটা চুলকিয়ে নেয় সন্তর্পণে। ভাতের পরপর দুটি গ্রাসের মাঝে একটু সময় নেয় জমেল শেখ। তারপর আবারও গপগপ খেতে শুরু করে।
দুপুরের এই ঘটনার পর থেকেই আজ জমেল মহাজন কিছুটা বেচইন। সে-ই অনেকদিন হলো সে গ্রামের বাড়ি যায় না। বউকে টাকা পাঠিয়েই খালাস। অন্যকিছু পাঠানোর তার ফুসরত নেই। সেই উত্তরবঙ্গে যাওয়া-আসাতেই ৩ দিন লাগে। থাকবে ক’দিন আর? আর এদিকে একদিন না থাকলে আস্ত বাস নিয়েই উড়াল দেবে ডিপোর ঈমানদার লোকজন। ফলে জমেল শেখ এখানে বউ-বিবির আদর পায় না। অবশ্য ইচ্ছে করলেই সে শাপলা বুয়াকে আটার দলার মতো গুলিয়ে ফেলতে পারে কিন্তু সে তো ইন-চার্জ। এই ডিপোর সর্দার। ভেবে ভেবে নিরুপায় সে ক্লান্তই হয়।
সেদিন সন্ধ্যা আসে অবাক উত্তেজিত ভঙ্গিতে। জমেল শেখের ডেপুটি হিরনালি আজ ২ লিটার চুলাই এনেছে। মহাজনই বাড়িয়ে আনতে বলেছেন। রাজেন এদিকে এসবের কিছুই জানে না। সে শুধু তার মতো করে নানান কথা ভাবে। মহাজনের মুখে কথা শুনতে তার ভালো লাগে।
তিন.
এদিন সন্ধ্যাটা বেশ আগেভাগেই নামে। রাজেন ডিপো সর্দারের প্রতিদিনের প্রায় কালো—কুচকুচে বাদামি চেয়ারটার কাছে এসে বসে। সে জানে মহাজন তার পেছনের ঘরে যাবে আরও ঘণ্টাখানেক পর। তার আগে সে এই এক ঘণ্টা ডিপোর খোঁজখবর নেবে—গাড়ি-সারাই, টাকা পয়সার গ্যাঞ্জাম সব মিটাবে। রাজেন এগুলাও খুটে খুটে খেয়াল করে। ফাঁকে ফাঁকে মহাজনের গলায় গান শোনে, গ্রামের গল্প শোনে। ভাবে এ গল্পতো ও জানে, চেনে। আজকে সে গল্পে আরও বেশি বিভোর। আজকের গল্প অন্যরকম ঘ্রাণের গল্প। মহাজনেরই এক সাবেক প্রিয় নারীর গল্প। রাজেন লজ্জা পায়। উঠে যেতে দাঁড়ায়। কিন্তু মহাজন বলে শরমের কী আছে এতে? শুনতে তো পারিসই। আরামসে বয়।
রাত গভীর হতে থাকে। চাঁদ-জোছনা-বাতাস কিছুই তখন টের পাওয়া যায় না। সর্দার আজ রাজেনের সামনেই চোলাইয়ের বোতল খুলে ফেলেছে। সঙ্গে ডেপুটি হিরনালি জমেল শেখের সেবায় আরও নিবেদিত হয়। পেছনের ঘরে রাজেন আজকে এই প্রথম এলো। কিন্তু রাজেনের তেমন খারাপ লাগে না। মনে হয় এই লোকগুলো ভালোই তো।যা শুধু একটু চোলাই খেয়ে নেশা করে কিছু ভুলে থাকতে চায়। কাজের নানান চাপ সহ্য করতে এ রকম পেছনের ঘরে আসে এরা। এটুকুই যা।
রাজেন ভাবতে ভাবতে একটু অন্য মনস্ক হয়। দেখে দুই লিটারের চোলাইয়ের বোতল তার সামনে নিমেষেই খালি হয়ে পড়ে আছে। গান-বাজনায় হয়তো আরও ঘণ্টা খানেক অতিবাহিত হয়। একসময় রাজেন টের পায় পাশে তাকে জাপটে ধরে আছে দুই জন আদিম জন্মান্ধ মাতাল। তার ও কিছুক্ষণ পর হয়ত অনেক পর যখন রাতসামান্য একটু গভীর বা খুব গভীর—রাজনের চোখের সামনে আচমকা তার মায়ের ছবি ভেসে ওঠে। তার বাবাকে নিয়ে ওর মায়ের খিস্তির কথা মনে পড়ে। মনে পড়ে তার মায়ের ক্রোধান্ধ চেহারায় একটা গালির কথা। চোখে ভেসে ওঠে একটা কীট আক্রান্ত শিশ্নের কথা যা তার সামনের চেনা লোকটির উলঙ্গ দেহে ঝুলছিল। মনে পরে শাপলা বুয়ার সন্দেহযুক্ত প্রশ্ন—ওয় রাজইন্যা, এই জমেল্ল্যার চেরার লগে তর চেরার অত্ত মিল কিয়ের লাইগা রে?’
ডিপো সুনসান তখন। কিন্তু ওপরের অসীম আকাশ যেন ফেটেফুটে যাচ্ছিল অন্ধকারে, দিগ্বিদিক।
যেখানে কাশফুলের রঙ লাল
এক.
এ এক অদ্ভুত সুন্দর কাশের বন। সালভাদর ঢালির শুভ্র তুলিটা যেন ঈষৎ বামে বেঁকে আছে—ঠিক সোজা আসমানের দিকে নয়, আসমানের হাঁটুর দিকে ঝুঁকে আছে মালুম হয়। তারই নিচের দিকে ঘন সবুজ রঙের তুলির হাতল। দূর থেকে দেখে মনে হয় ঘাসপ্রজাতির এই মোলায়েম তুলি নীল আকাশের ক্যানভাসে আঁচড় মারতে অসম্ভব উদ্যত—যেন বেয়াদবি করে হলেও অনন্ত সুবিশাল নীলে সাদার ছোপ মেরে আসতে চায়। আর এই কাশের তুলির ঢালুতে পড়ে আছে নিশ্চল জলরাশি, ডুবিয়ে রেখেছে যেন নীল আসমান। হেলে দুলে এই শুভ্র কাশ রাশি কত যে বিচিত্র মুদ্রায় এই জলে প্রায় ঢলে পড়ে তো আবার কিছু পর সোজা হয় আসমানের দিকে তার হিসাব নেই। আর জলের দিকে কি তাকানো যায়? খুব নেশাধরা সিলভার রং আরও কাছাকাছি বললে যেন অগুনতি পুঁটি মাছের আঁশের চিকচিক প্রদর্শনী খালটির সমস্ত জল জুড়ে। ফলে দৃশ্যটা দাঁড়ালো কি সাদা দোল খাওয়া কাশের তুলির নিচে চঞ্চল ঝিকিমিকি জলনৃত্য। আহ!
এতক্ষণ এই ভিডিওটা ফেইসবুক লাইভে দেখছিল ইভান। কে যেন একটা নৌকায় চড়ে যেতে যেতে এই দৃশ্যটা সরাসরি এই জনযোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দিচ্ছিল। হাতের মোবাইল সেট টার পাঁচ ইঞ্চি স্ক্রিনে এত বড় ক্যানভাসের ভিডিওটা কি অদ্ভুত সৌন্দর্যের সঙ্গে ইভানের হাতের তালুর মাঝে আটকে আছে এতক্ষণ! ইভান নতুন করে এই প্রযুক্তির কারসাজিতে মুগ্ধ হচ্ছিল তার নিজের বিছানার ওপর। নরম বালিশে মাথা ডুবিয়ে ডান কিংবা বাম—কি উপুড় হয়ে এই মুঠোফোনের সীমিত জানালা দিয়ে বিশাল ক্যানভাসের জল আর কাশবনের যৌথখেলা দেখে পাগল হচ্ছিল সে। ভিডিওটা পজ করে ইভান। সে খেয়াল করলো যে ব্যক্তিটি লাইভ পোস্ট দিয়েছে সে পোস্টের ক্যাপশনে লিখেছে—এখানে এসো, খোপ থেকে বেরিয়ে এসো যতসব নাদান কইতর!
বাহ কি সুন্দর নিমন্ত্রণ! আসলেই তো। ইভান ভাবে। আমরা সবাই বোবা কইতরের মতো এই পানসে শহরের নাদান, নিরীহ আর খোঁড়া স্বপ্নাহত কতগুলো মানুষ। যেখানে আমাদের দরজার মাপ নির্দিষ্ট—জানালার খোপ সীমিত। ভাবতে ভাবতে ঠিকানাটা মুখস্ত করে নেয় সে। একদম পাকা সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয়—সে যাবেই সেখানে এবং এই সপ্তাহেই। বউকে বলবে এই ব্যাপারে ইভান ভাবে। সিলভিয়াকে সঙ্গে নিতেই হবে কারণ ওর বউ সিলভিয়া বেশ ভালো ফটো তুলতে পারে এবং আরও বড় ব্যাপার হলো সে এইসব ঘুরাঘুরির বেশ পাগল। খুব মজা পাবে বেচারি।
সিলভিয়া এখন ফ্রেশরুমে। শাওয়ার নিচ্ছে। পানি ছিটকে পড়ার আওয়াজ আসছে—ও সবসময় ঝর্ণা ছেড়ে গোসল করে। অভ্যাস। সে সময় মৃদু গলায় এসডি-আর.ডি কিংবা ট্যাগর সং গাইতে থাকে। শরীর ডলার সময় হয়ত গানের সুর একটু বেসুরো হয়ে যায়। সেটাও ইভান বুঝতে পারে। বেশ কয়েক মাস তো হয়েই গেল বিয়ের। এতদিনে অনেক কিছু মুখস্ত হয়ে গেছে ইভানের।
সিলিভিয়া বেরিয়ে আসে। হাল্কা নীল রঙের নরম তোয়ালে তার মাথায় মুকুটের মতো বসানো। কি সুন্দর লাগছে! যেন মিশরের ক্লিওপেট্রা! শরীরে শ্যাম্পুর নির্মল ঘ্রাণ। কোমল হাসিতে ও জানিয়ে দেয় ওর মন ভালো। ইভান মনে মনে ভাবে—সিলভিয়া, বউ আমার! তুমি তো ভিডিওটা দেখইনি এখনো, দাঁড়াও তোমাকে সারপ্রাইস দিতে হবে।
সামনের অফ ডে তে চল, একটা জায়গায় ঘুরতে যাব। সিলভিয়ার গলার দুই পাশে হাত আলতো করে ধরে ইভান বলে। গোসল পরবর্তী হিম আরাম সিলভিয়ার গলায়- ঘাড়ে তখনো লেগে ছিল।
দুই.
জানারা বিবি গোবর টোকায়। মাথায় বাঁশের ঝুপড়িটা নিয়ে সে এ মাঠ থেকে আরেক মাঠ করে। হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত হলে বসে জিরোয় একটু। ফের আবার গোবর টোকায়। চলন্ত গরুর মাত্রই ছেড়ে দেওয়া গোবরটাও ওর ঝুড়িতে উঠে যায়। বাসায় ফিরে এসে ঘুঁটে দিতে বসে। ঘুঁটেগুলো জানারা বিবির ঘরের যে বেড়া আছে তাতে সারি সারি সাজিয়ে শুকোতে দেয়। জানারা বিবির বয়স বাইশ। ছোটবেলায় ওর দাদি এই নামেই আদর করে ডাকতো ওকে। সেই থেকে এই নাম। নাম শুনলে মনে হয় অনেক বড় বয়সের সে।
এই ঘুঁটে শুকিয়ে গেলে জানারা বিবি ঘরের চাঙে বিছিয়ে রাখে। স্তরে স্তরে সাজায়। বিকাল হলে বেতবাড়িয়ার হাটে আট দশ আঁটি ঘুঁটে বিক্রি করে বাড়িতে চলে আসে। বিশ-ত্রিশ টাকার বিক্রি হয়ে গেলেই হয়। জানারার নিজেরও একটা গরু আছে। গাই। দুধ আসে সের খানেক প্রতিদিন। জানারার বাপ আগে গঞ্জে দোকান করত। এখন ঘরে পড়ে আছে দীর্ঘদিন। সেই আশ্বিনের এক অকাল বজ্রপাতে তার কোমর থেকে নিচ অবধি খেই হারিয়ে ফেলেছিল। তা এখনো একই অবস্থায় আছে। নিজের মা বেঁচে না থাকায় বাপের সেবা দেখাশোনা জানারা নিজেই করে।
জানারার স্বামী ছিল। আলিনগরে তার রিক্সার গ্যারেজ ছিল। জানারা ওই গ্যারেজে একবার গিয়েছিল স্বামীর খোঁজে। কিন্তু তার নামগন্ধও খুঁজে পাওয়া যায়নি সেদিনের পর থেকে। পুরুষের সবটা বিশ্রী চরিত্র সেদিন জানারা বিবি বুঝে ফেলেছিল। আর তাই এই অবলা গরুটিতেই বরং বেড়ে গিয়েছিল তার অগাধ বিশ্বাস। সে দুধ দিতে ভুলে না কিন্তু ভণ্ড পুরুষটি সাধের দুধ উল্টো নষ্টই করে দিয়ে গেছে। তিলে তিলে দুধের মতো জমা হওয়া বিশ্বাস ভেঙে পানি হয়েছে। তারপরও জানারা বাপের চিকিৎসা, নিজের জীবন—প্রিয় গরু আর ঘুঁটে করে করে কাটিয়ে দিচ্ছে যৌবনের মতো বিপদজনক বয়স। কী সাহস!
সবাই বলাবলি করে অনেক কিছুই। স্বামী নেই বেচারির। নাক খাঁড়া-টিকোলো। চোখের ওপরে ভ্রূযুগল পাখির প্রসারিত ডানার মতো। কি দারুণ সুন্দর তার চাহনি! গোবর সংগ্রহ করে বলে সুন্দরী হওয়া সত্ত্বেও তার তেমন কদর নেই বলেই সবাই জানে। কিন্তু হাঁটা চলার সময় কেউ যে তাকায় না তা নয়। দায়িত্বের চাহনিতে নয়—সেই চাহনি ভোগের। তাই মাথায় ঘুমটা দিয়ে চলে সে। স্বামী পরিত্যাক্তা বলে উদ্যাম বেপরোয়া চলাফেরা করতে হবে এই নিয়ম মানে না জানারা বিবি। এই তো সেদিন জহুর চাচা কথা বলে গেল তার বাবার সঙ্গে। বিয়ে বিষয়ক। স্বামী ফেলে গেছে তো কী হয়েছে, তাকে বিয়ে দিতে হবে না? এত অল্প বয়সের মেয়ের তো এভাবে থাকা ঠিক না। এই-সেই অনেক কিছুই শুনল জানারা। কিন্তু তার একটাই কথা তার এই পঙ্গু বাপ কে ছেড়ে সে নতুন কোনো সুখের ঘ্রাণ নিতে পারবে না। এদিকে তো বাপকে দেখার কেউ নেই। এক পর্যায়ে জহুর চাচা শর্ত আরেকটু সহজ করে নেয়। বলে—ছেলে বাড়িতে তোমার বাপকে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করলে কেমন হয়? জানারা বিবি ভেতর ঘর থেকে ধন্ধে পড়ে। কিছুক্ষণ কোনো উত্তর আসে না কিন্তু মুখ খোলে একসময়।
চাচা, আপনেরা আমার জন্য ভাবতিসেন এটাই আমার জন্যি ম্যালা ভাগ্যির। আমার বাপকে তো দেখতিসেন, ঘর আটকা মানুষ—কদিন কে কাকে রাখবি? ছাওয়াল থাকলি পরে একটা গতি তার হতোই। আপনি যে ঘরেই আমাক দিতে চান না কেন সেখানেই অধীন থাকতি হবি—তার চে ভালো আমি যেমনি আছি থাকি—দিন তো নিজের পথ চিনি ঠিকই চলে যাচ্ছে। জহুর চাচা আপনে খালি আমাগের জন্য একটু দোয়া করবেন।
বজ্জাত শালার বেটা কই যে গেল? বলে একটা অস্ফুট কিন্তু রাগাশ্রিত স্বর মুখ থেকে বেরিয়ে আসে জানারার বাপের। মেয়েকে শখ করে বিয়ে দিয়েছিলেন। জামাইয়ের তিন তিনটা রিক্সা ছিল। একটা চালাত আর দুইটা ভাড়া দিত। খুব সুদিনের লোভে মেয়েকে বিয়ে দিয়েছিলেন সেই ছেলের হাতে। কিন্তু কে জানত গ্যারেজ পাল্টানোর মতোই সেই কুলাঙ্গার বউও পাল্টাবে। যেন নতুন গ্যারেজে গিয়ে নতুন রিকশা চালানোর মতো। নতুন চাকা—নতুন চকচকে বেল-বাটি আর গিয়ারের রিক্সা!
অগত্যা বাড়ির ঢালু বেয়ে নেমে যায় জহুর মিয়া। বুঝিয়ে লাভ নেই। বউ মরা ভাতিজাটার জন্য জানারা কে বেশ মানাত। এই ভেবেই এসেছিল সে। কিন্তু কি অটল মেয়েরে বাবা! কি ঘন কষ্ট যে পেয়েছে মেয়েটা!
রাতের দিকে গাইটার জন্য খড় কেটে দিতে দিতে—ঘুঁটেগুলো বস্তায় ঢোকাতে ঢোকাতে চোখ ভেজে জানারা বিবির। রাতের আসমান তার কাছে বন্য লাগে। বাড়ির পেছন দিক থেকে নানান জাতের পক্ষীর বহুমিশেল ডাক ভেসে আসে। হু হু করে ঠাণ্ডা বাতাস ঢুকতে থাকে বাড়ির ভিটায়। দূরে ইছামতির আবছা বাঁক। তারও কয়েক মাইল আগে ইছ্মাতিরই পেটে গিয়ে পড়া বেনু খাল। সবাই তারই মতো একা পড়ে আছে কাকে যেন হারিয়ে অথবা কাকে যেন মমতায় জড়িয়ে রাখার জন্য।
তিন.
সিলভিয়ার আনন্দ আর ধরে না। এত সুন্দর একটা জায়গায় তাকে নিয়ে যাবে ইভান! ইভান আসলেই অনেক ভালো। এত মারপ্যাঁচ সে বোঝে না। তার চোখে যা নগদ সুন্দর তাই সে চেখে দেখতে চায়। দুনিয়ার যা দেখতে আর শুনতে ভালো প্রিয় মানুষকে নিয়ে ও তা-ই করে। বেশ ভালো লাগার মানুষ ইভান—সিলভিয়া ভাবে। ভাবতে ভাবতে ব্যাগ গোছায়। ইভান ফ্রেশ রুমে। ও রেডি হয়ে গেলেই ওরা বেরিয়ে পড়বে। আবারো সেই জায়গাটির দৃশ্য কল্পনা করে সিলভিয়া আরাম বোধ করে। ডি এস এল আর-এর ব্যাপারটা তাই প্রসঙ্গ ক্রমে চলে আসে। হ্যাঁ, সেটা ইভানের ব্যাগে ঢোকানো আছে। তিনটা এক্সট্রা লেন্স ও নেওয়া হয়েছে। ইভান বের হয়ে এসেছে। এখন ও পাঞ্জাবিটা পড়বে। যার কথা সে বার বার বলছিল গতকাল। অসম্ভব সুন্দর একটা পাঞ্জাবি।
এ পর্যন্ত অনেক জায়গায় ওরা ট্রিপ দিয়েছে। মনে হচ্ছে ওরা বিয়েই করেছে ঘোরাঘুরি করার জন্য। একা একা হয়তো তেমনভাবে পারতো না এতদিন। সঙ্গী লাগতো। এ এক অদ্ভুত রকমের জুটি।
সেদিন বাসে করে ওরা সরাসরি গিয়ে নামে বদরগঞ্জ বাস টার্মিনাল। সেখান থেকে সোজা হোটেলে। দরকারি কাজগুলো সেরে খাওয়া দাওয়ার পাট চুকিয়ে ওরা বেরিয়ে পড়ে। দুজনের চোখেই হলিউডি দুটি রোদচশমা। সিলভিয়ার পরনে ফ্যাকাশে জিন্স- আর গলাবন্ধ ফতুয়া। চুল পেছনে টেনে শক্ত করে খোঁপা করা। ব্যাগ টা টুরিস্ট স্টাইলে বরাবরের মতোই। ইভানেরও তুলনা পাওয়া যাচ্ছিল না। যেন শহরের বিল বোর্ডে সুদর্শন যুবক। ওরা হাঁটছিল ইছামতির ঢালু তীরের দিকে। আনন্দে হু-ই-ই শব্দ করে ওরা তীরের দিকে এগুচ্ছিল। দূর থেকেই চোখে পড়ছিল কাশবনের সুবিশাল সমতল ফলে ওদের পায়ের গতি আনমনেই বেড়ে যাচ্ছিল। দূরে দু-একটি খাল ইছামতির মূল শরীর ছেড়ে বাঁক নিয়ে গ্রাম গুলোতে ঢুকে গেছে। আর সেই খাল গুলোকে অনেকটা পাহারা দিয়েই গ্রামের দিকে নিয়ে গেছে অকৃপণ কাশবন। যেন বিস্তীর্ণ এই কাশের ফুল হেমন্তরই পতাকা। যতদূর চোখে কুলায় ততদূর সাদা সামিয়ানা। নদীর কাছে এসে ওরা অলস কিছু নৌকাপাড়ে বাঁধা অবস্থায় পায়। কিছু নৌকা চলছিল নদীতে। সেগুলো তে নানা রঙের পাল তুলে দেওয়া আছে। সেই মুহূর্তে ফেইসবুকের ওই লাইভ ভিডিও টার কথা মনে পড়ে ইভানের। কি সুন্দর! আসলেই বাস্তবদৃশ্য সেই রকমের সুন্দর না হলে ভিডিও কি এত সুন্দর হয় কখনো?
সেই মুহূর্তটা আসে। ইভান আর সিলভিয়া নৌকায় উঠে বসে। অনেকটা সময় পর তাদের পাল তোলা নৌকা ইছামতির মূল শরীর চষে কাশবনের নিরাপত্তা বেষ্টনী বেয়ে বেয়ে বেণু খালের দিকে ঢুকে যায়।
বেণু খালের কিছুটা ভেতরে,যেখানে কাশবনের সবচেয়ে ঘন অংশটা—ওরা সেখানে ঢোকে তাদের আসল কাজটি করার জন্য। ওদের মধ্যে উত্তেজনা কাজ করে। কাশফুলের কি অশেষ সাদা মাঠ—কি উদার ফুটন্ত মহিমা এই কাশবনের।
এখানে নির্জনতার চূড়ান্ত। শুভ্রতার একশেষ। নির্মলতার নীরব ছবি। ইভানের মাথা ছাড়িয়ে ঊর্ধ্ব একেকটা কাশফুল ঘাস। খালের তীরে সেই পানি। টলটল স্নিগ্ধ। যেমনটা চারদিন আগে মোবাইলের স্ক্রিনে দেখেছিল ইভান। কি অপরূপ দোল দোল বৈভব এই কাশবনের। হেমন্তের দূত হয়ে গজিয়ে উঠেছে মহাসমারোহে। যেন বিনা শুল্কে এইখানে ফুটে আছে তারা।
সিলভিয়া ডিএসএলআর. হাতে ঠিক করে নেয়। একের পর এক ক্লিক পড়তে থাকে সাটারে। তাতে উঠে আসতে থাকে এই নিসর্গের ঝিম ধরা সৌন্দর্য। পাগলের মতো এদিক ওদিক এঙ্গেল ঠিক ঠাক করে ছবি তুলতে থাকে এই বেহুঁশ দম্পতি।
এরকম সময়ে হঠাৎ সিলভিয়ার এক বিকট চিৎকারে বেণু খালের সমগ্র তীর কেঁপে ওঠে। ইভান হাত বিশেক কদম দূরে থাকায় দৌড়ে কাছে গিয়ে হতবাক হয়ে যায়। ভয়ে অন্তরাত্মা শুকিয়ে যায় ওদের।
কাশের একটা ঘন ঝোপের আড়ালে পড়ে আছে একটা নিথর দেহ। মেয়েটার খাড়া- টিকলো নাক। পাখির প্রসারিত ডানার মতো চোখের ভ্রূ যুগল। পাজামার পুরোটা রক্তাক্ত- চুল গুলো ছড়িয়ে আছে। ওপরের দিকের জামা অক্ষত নেই। কিছুটা দূরে পড়ে আছে একটা বাঁশের ঝুড়ি।
সিলভিয়া আর ইভান ইতোমধ্যেই দুজন দুজনকে অভাবনীয় আতঙ্ক ও বিস্ময়ে জড়িয়ে ধরেছে। ওদের কাছে চারপাশের সব সাদা কাশফুল রক্তের মতো লাল মনে হচ্ছিল তখন।